নেপাল যাওয়ার প্ল্যানটা হঠাৎ করেই নেওয়া। জহিরদা ফোন করে বলল, তারা কয়েকজন মিলে ঠিক করেছে দারুল উলুম থেকে নেপাল যাবে আর তাদের সঙ্গে আমিও আজমগড় থেকে শরিক হব। তাই পুঁজি ও প্রস্তুতি ছাড়াই আগাম সফরের উত্তেজনায় বাসায় ফোন করে জানালাম।
ভারতে আসার পর এই প্রথম আমি দূরে কোথাও সফরে যাওয়ার নিয়ত করলাম। যাই হোক ইচ্ছে-অনিচ্ছের দোদুল্যমান অবস্থায় মাদরাসা থেকে ছুটি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। মাদরাসা থেকে প্রথমে আজমগড়, সেখান থেকে রওনা হলাম ১৩০ কিলোমিটার দূরত্বের গৌরখপুরের উদ্দেশ্যে। সফরের বাকি সাথীরা লৌখনৌ থেকে রওনা হয়েছে, তাদের সাথে আমি গৌরখপুরে মিলিত হব। এত লম্বা বাস-সফর ছিল ক্লান্তিকর। কারণ, উত্তরপ্রদেশ বাস সার্ভিস আমাদের দেশের বলাকা বা ৮ নাম্বার থেকে কোনো অংশেই কম নয়। এর আগেও আমি এরচেয়ে বেশি দূরত্বের সফর করেছি পশ্চিম বংঙ্গে, কিন্তু রাতের সেই সফরের আর আজকের এই সফরের মাঝে যোজন যোজন ফারাক।
অবশেষে সাড়ে তিনঘণ্টার সফর শেষে গৌরখপুরে এসে পৌঁছলাম। পাশের এক মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করার পর রেলস্টেশনে গিয়ে জহিরদের সাথে মিলিত হলাম। চারজনের মাঝে শুধু জহিরই ছিল আমার পরিচিত, তাই সংকোচ বোধ করছিলাম, কিন্তু অল্পক্ষণেই সবার অমায়িক আচরণে সমস্ত জড়তা কেটে গেল।
দীর্ঘ সফরে সবাই ছিলাম ক্ষুধার্ত। পাশের এক মুসলিম বিরিয়ানীর দোকানে অপূর্ব স্বাদের বিরিয়ানী ভক্ষণ করলাম। খানা শেষে আবার বাসে করে রওনা হলাম ইন্ডিয়া-নেপাল বর্ডার সোনুলির উদ্দেশ্যে। চার ঘণ্টার সফর শেষে আমরা যখন সোনুলিতে তখন রাত প্রায় দশটা।
নেপাল যেহেতু ভিন্ন দেশ, বর্ডার তো পার হতেই হবে, তাই একটু চিন্তিত হয়ে পড়লামÑনা জানি কি জিজ্ঞেস করে বসে! যদিও ভারতীয় নাগরিকদের পাসপোর্ট ভিসা সংক্রান্ত কোনো জটিলতা নেই, শুধু আইডেন্টিটি কার্ড হলেই চলে তবু দুশ্চিন্তা কম ছিল না। বাস থেকে অন্য সবার পিছুপিছু বর্ডার এর দিকে রওনা হলাম। ১০ মিনিটের দূরত্বেই ইমিগ্রেশন, মাঝে আমি একটা অষুধ কেনার জন্য সবার থেকে পিছিয়ে পড়েছিলাম, অষুধ কিনে যখন তাদেরকে ধরার জন্য গেলাম ততক্ষণে তারা ইন্ডিয়ার ইমিগ্রেশন পার হচ্ছে। কিন্তু এরা নিজেরাও হয়তো জানে না যে, ইন্ডিয়া পার হচ্ছে। যাই হোক, আমি যখন ইমিগ্রেশন অফিসারকে কাগজ দেখাচ্ছি তখন অফিসারকে দেখে মনে হলো খুব বিরক্তÑকেন তাকে কাগজ দেখাচ্ছি? সোজা চলে গেলেই তো হয়! সাথীদেরকে যখন বললাম কাগজ চেক কেন করাওনি তখন তারা তো বেশ অবাক! কারণ তারা নিজেরাও ইমিগ্রেশন কোথায় জানেই না। অবশেষে আমরা নেপালে প্রবেশ করলাম। নেপালি টাইমে রাত তখন প্রায় সোয়া দশটা, মানে ইন্ডিয়া থেকে ১৫ মিনিট এগিয়ে আর এখানে সর্বশেষ বাস ছেড়ে গেছে ৮টায়, ভোর চারটের আগে কোনো বাসই আর পাওয়া যাবে না। আমাদের হাতে সময় খুব কম, যেভাবেই হোক আজ রাতে পোখরা যেতেই হবে। অগত্যা দালালের শরণাপন্ন হতে হলো। দালাল ২৩০০শ’ টাকায় লরি প্লাস গাড়িতে আমাদের উঠিয়ে দিল।
রাত এগারোটা। আমরা রওনা হলাম ১৮০ কিলোমিটার দূরের পোখরার উদ্দেশ্যে। পোখরা নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং হিমালয়ের উঁচু তিনটি পর্বতশৃঙ্গ পোখরা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে অন্নপূর্ণা বেসক্যা¤েপ অবস্থিত। পোখরাকে হ্রদের শহরও বলা হয়।
পাঁচজনের চারজন পেছনের সিটে আর আমি ড্রাইভারের পাশের ব্যাকসিটে। ড্রাইভারের মংগোলিয়ান চেহারা দেখে ধারণা করলাম, নিশ্চয় তার নাম ফুংচু টাইপ কিছু হবে। ফুংচু নামের লোকেরা হিন্দি জানার কথা না, কিন্তু আমার ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত করে সে হিন্দিতে জানাল তার নাম ফুংচু না, য়ুগেন্দ্র (যোগেন্দ্র)। এবং এও বলল, যদি রাস্তায় আমাদের দারু পান করার প্রয়োজন হয় তবে যেন তাকে জানাই। তার কথা শুনে তো আক্কেলগুড়ুম! পোশাকের খাতিরে হলেও আজ অবধি এমন প্রস্তাব কেউ দেয়নি আমাদের। ড্রাইভার এ কী বলছে!
আমরা হাসিমুখে বললাম, আমরা ওসব পান করি না। লোকটা আমাদের অনিচ্ছার কথা শুনে যেন বিস্মিত হলো। আসলে নেপাল পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার সুবাদে এখানে হিন্দুস্তানের চেয়েও অধিক সুলভ মূল্যে দারু বিক্রি হয়, তাই দারু পানের ব্যাপারে নেপালিরা উদার মনের পরিচায়ক।
ড্রাইভারের পাশের সিটে বসার কারণে আমার বাচাল-প্রিয়তায় তাকে বিরক্ত করে তুললাম। কিন্তু নেপালের ব্যাপারে প্রাথমিক জ্ঞান হাসিল করতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম। আসলে আমাদের দেশের রাজনীতির মহল যেমন গরম ঠিক তেমনি সাধারণ জনগণও রাজনীতিক বিশ্লেষণে বেশ পারদর্শী। নেপালিরা এর উল্টো। শান্তিপ্রিয় নেপালিদের কাছে এসব কঠিন ফিলোসফি খুবই কঠিন সাবজেক্ট। মাত্র সাত-আট বছর আগে নেপালের বহুদিনের রাজতন্ত্র রহিত হয়ে প্রজাতন্ত্র কায়েম হয়েছেÑড্রাইভারের দেখলাম ও সম্পর্কে কোনো জানাশোনাই নাই।
সোনুলি থেকে যখন আমরা প্রায় বিশ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়েছি, তখনই শুরু হলো নেপালের দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তা ভয় ধরিয়ে দিল। ভাগ্যিস, রাত বলে অপর পাশ থেকে ওভারটেক করা গাড়ির সংখ্যা ছিল কম। সারাদিনের ক্লান্তিতে পেছনে জহিররা সবাই অঘোরে ঘুমুচ্ছিল, আর আমি উঁচু পাহাড়ের পেছনে লুকিয়ে থাকা বন্য চাঁদের সৌন্দর্য দেখে পাগল হচ্ছিলাম। জীবনের অল্প কিছু মুহূর্তের সাথেই এমন মুহূর্তের তুলনা হতে পারে। আধো ঘুম আধো জাগরণে এই সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে পাহাড়ি রাস্তায় চলতে লাগলাম।
ড্রাইভারের ডাকে আধো ঘুম থেকে জাগ্রত হলাম। চোখ খুলতেই দেখলাম যধাবহ ড়ভ ঃযব হবঢ়ধষ। আমরা পাহাড় থেকে যতই নিচের দিকে নামছিলাম আমাদের চোখে নেপালের এই স্বর্গের ছবি ততটাই পরিষ্কার হচ্ছিল। ভোরের আবছা কুয়াশায় ঢাকা ছবির মতো সুন্দর এক নগরীর ছবি আমাদের সামনে ছিল, দূরে হিমালয়ের চ‚ড়া চারিদিকে সুউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা নেপালের স্বর্গ পোখরাÑসবমিলিয়ে অস্থির এই সৌন্দর্যে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে রইলাম। প্রথম দেখায় পোখরাকে চাইনিজ কোনো শহর বলে ধারণা হলো। চারিদিকে মংগোলিয়ান চেহারা, চাইনিজ স্টাইলে ছোট ছোট সাজানো গোছানো বাড়ি, উপমহাদেশ থেকে একদম ভিন্ন ধাচের এক শহর।
পোখরায় পরিচিত সাথী হচ্ছে মারকাজের আব্দুল বাসিত ভাই, যার নাম্বারে কল দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু নেপালি ভাষায় বলছে নাম্বার ভুল, তাই ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দেওয়ার পর একটি ট্যাক্সির সহায়তায় চিপলিডুংগা মারকাজ মসজিদ গিয়ে পৌঁছলাম।
তিনতলা বিশিষ্ট সুবিশাল মারকাজ মসজিদ। সেখানে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে শহর পরিদর্শনে বের হলাম। সকালের শান্ত পোখরা শহরে তখন মহিলা-পুরুষ সবাই সমানভাবে আপন আপন কাজের জায়গায় ছুটছে। রাস্তায় যান বলতে স্কুটি, যার ড্রাইভার সুন্দরী মংগোলিয়ান চেহারার রূপবতী নেপালি তরুণীরা, পেছনের সিটে কোনোটায়-বা বসে আছে তাদের পরিচিত কোনো তরুণ, কোনোটায় সাধারণ যাত্রী। স্কুটির পাশাপাশি আছে অল্পকিছু মেট্রোপলিটন বাস। তবে স্কুটির সংখ্যা দেখে বুঝতে পারলাম নেপালের তরুণীরা স্কুটি চালাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আছে অল্প কিছু প্রাইভেট কারও, তবে সংখ্যায় নগণ্য। নেপালে পুরুষ-মহিলা সবাই সমানভাবে কাজ করে তাই কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে বেশি নজরে পড়েছে পিঙ্গল কেশী নেপালি রূপসীদের।
পোখরায় মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম। পুরো শহরে দুই থেকে তিনটে মসজিদ মাত্র। তবে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ এখানে বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই হয়। এর একটা ধারণা মারকাজ মসজিদের আয়তন দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম।
শহর দর্শন শেষ করে মসজিদে এসে চিন্তা করছিলামÑকীভাবে পোখরায় ঘোরা যায়Ñমসজিদের খাদেম সাহেব এসে চা পানের দাওয়াত দিয়ে মসজিদের পাশেই এক সাথী ভাইয়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। সেখানে এলাকার কিছু মুসল্লির সঙ্গে পরিচিত হলাম। তারা গাড়ি ঠিক করে দিলেন। মসজিদে এসে সাথীদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে নেপালের স্বর্গ ভ্রমণে বের হলাম।
বাইকুল মাইলা ঠিকই বলেছেন, ‘শান্তিভ‚মি তারাই পাহাড় হিমালয়া, অগ্রগামী রাষ্ট্র হামারো জায়া জায়া নেপালা’। পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী নেপালের শান্তরূপ উপভোগ করার পর সবাই বলবে, ‘জ্ঞান ভ‚মি শান্তি ভ‚মি জয়া জয়া নেপালা’।
মসজিদ থেকে বের হয়ে একটা গাড়ি নিলাম। চারজনের সিটের ছোট গাড়িতে গাদাগাদি করে পাঁচজন বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিশাল বপুর অধিকারী আরিফ জাববার ভাই তার দেহের সুবিধা ভোগ করে ঠিকই ড্রাইভারের পাশের সিট দখল করে নিল, বাকি আমরা চারজন চাপাচাপি করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।
ছবির মতো সুন্দর শহর পোখরা। গাড়ি-ঘোড়ার চাপ নেই। ফাঁকা রাস্তা। দু’পাশে সাজানো গোছানো ছোট ছোট নেপালি বাড়ি, উঁচু নিচু পাহাড়ি মসৃণ পথ। রাস্তায় ভিড় বলতে বিদেশি কিছু পর্যটক আর সুন্দরি নেপালি রূপসীদের স্কুটি চলা।
প্রকৃতির পাগলকরা এই অপরূপ সৌন্দর্য আল্লাহ তায়ালার অপার কুদরতের জানান দিচ্ছে বারবার। ড্রাইভার না হিন্দি বুঝে না ইংরেজি, তাই তাকে কিছু বলার পরও বোঝানো কঠিন হয়ে দাঁড়াল। তার এই দুর্বলতাকে সবাই বিনোদনের খোরাক বানিয়ে নিল। সে আমাদের উল্টাপাল্টা না বাচক বিষয়কে হ্যাঁ বাচক মনে করে উত্তর দিতে লাগল।
আমরা কোথায় যাব তা আগেই বলা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে গুহা দেখতে গেলাম। আমরা ইন্ডিয়ান নাগরিক হওয়ায় নেপালি ৫০ রূপিতেই টিকিট পেয়ে গেলাম। অন্যথায় বিদেশিদের জন্য টিকিট ডবল দামে কিনতে হয়। নেপালের সর্বত্রই এই চিত্র, নেপালিরা এককথায় দাদাদের মর্জির গোলাম।
গুহা দেখা শেষ করে গেলাম নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফাওয়া লেক। পাহাড়ে ঘেরা অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর এই লেক। লেকের মধ্যখানে মন্দির, চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়, কিনারে বোট বাঁধা। সবাই বোটে করে লেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরাও চিন্তা করলাম বোট ভাড়া করি, কিন্তু বাজেট সংকটের কথা চিন্তা করে অবশেষে এই আশাটা অপূর্ণ রয়ে গেল। ফাওয়া লেকের দু’পাশে উঁচু দুটো পাহাড়ের অবস্থান। একটা সারাংকোট অপরটা স্টুপা। এই দু’ পাহাড়ের পাগলকরা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঠিক করলাম আর কোথাও যাওয়া না হোক আপাতত এই দু’ পাহাড়েই যাব। ড্রাইভারকে বললাম আমাদের পাহাড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। পাহাড় অভিমুখে শুরু হলো যাত্রা।
ফাওয়া লেকের পাশের এলাকা একটু ওয়েস্টার্ন টাইপের। কিছুটা আমাদের গুলশান বনানীর মতো প্রশস্ত এলাকা। বিদেশিদের আবাস ফাওয়া লেকের পাশেই। তাই এখানকার রেস্টুরেন্ট ও বাড়িগুলো নেপালি ধাচের চেয়ে ভিন্ন। টুরিস্টদের আনাগোনাও এখানে বেশি।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সারাংকোট পাহাড়Ñযা প্যারাগ্রাইডিং-এর জন্য বিখ্যাত। কয়েক হাজার ফিট উঁচু থেকে প্যারাসুট নিয়ে নিচের ফাওয়া লেকের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। সারাংকোট পাহাড়ে উচ্চতা অনুযায়ী মোট তিনটে পয়েন্ট আছে প্যারাগ্রাইডিং-এর। মাথা পিছু ৭০০০ নেপালি রুপি লাগে। ড্রাইভিং করার জন্য সাথে একজন ড্রাইভারও থাকে। বিদেশিদের অধিকাংশই নিজেই ড্রাইভ করছে নিজেদের প্যারাসুট নিয়ে। আমরা পাহাড়ে ওঠার পর ইউক্রেনের একটি গ্রæপ পেলাম, যারা নিজেই ড্রাইভ করছে। এমনকি ৭/৮ বছরের এক বাচ্চাকে পেলাম যে ড্রাইভারের সাথে ড্রাইভ করছে। ড্রাইভিংয়ের জন্য সারাংকোট খুবই বিখ্যাত। প্যারাগ্রাইডিংয়ের রোমাঞ্চকর এই রাইড দেখে মনে মনে নিয়ত করলাম জীবনে শুধু একবার হলেও আমিও ড্রাইভ দেব। সারাংকোট থেকে নিচের ফাওয়া লেকের দৃশ্য এক অপার্থিব অনুভ‚তি এনে দেয় মনে। যেন সুন্দর এক পেয়ালায় কেউ পরিষ্কার শান্ত জল রেখে দিয়েছে।
অবশেষে সারাংকোটের উঁচু চ‚ড়া থেকে ফিরতি পথ ধরলাম স্টুপার উদ্দেশ্যে। সারাংকোট থেকে এবার আমরা স্টুপার পথে। বিশাল এক পাহাড়ের চ‚ড়া থেকে আবার নি¤œ ভ‚মির দিকে যাত্রা।
স্টুপা বা বৌদ্ধ প্যাগোডা। জাপান সরকার হিরোশিমা নাগাসাকিতে আমেরিকার হামলার সেই কালো অধ্যায়কে মুছে দিয়ে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে গৌতম বুদ্ধের জন্মভ‚মি নেপালের উঁচু পাহাড়ে এই স্টুপার ভিত্তি রেখেছে।
উঁচু পাহাড়ের চ‚ড়ায় অবস্থিত উঁচু এই স্টুপা যেন সত্যিই কোনো শাস্তির দূত। এই পাহাড়ের চ‚ড়া থেকে ফাওয়া লেকের ধারে অবস্থিত ছবির মতো সুন্দর পোখরা শহরের সৌন্দর্য পাগল করে দেয়। ঝিরঝির বাতাসে দুপুরের প্রখর রোদের ক্লান্তি নিমিষেই যেন জুড়িয়ে যায় অপার্থিব এই সৌন্দর্যে। অবশেষে সমস্ত ভালোলাগাকে পেছনে ফেলে ফেরার পথে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। উঁচু এই পাহাড়ের চ‚ড়ায় চড়তে যতটা কষ্ট ভোগ করেছিলাম নামার সময় সেই কষ্ট বেমালুম ভুলে গেলাম।
এবার পোখরাকে বিদায় দেওয়ার পালা। ড্রাইভার কাঠমুন্ডুর গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বিদায় নিল। আর আমরা আমাদের দেশের সেই ‘নোয়া’ নামক গাড়িতে সওয়ার হলাম। পেছনে ফেলে এলাম ভালোলাগা ও ভালোবাসার পোখরাকে। এ বিদায় প্রিয় প্রেয়সী থেকে বিদায় নেওয়ার কষ্ট থেকে কোনো অংশেই কম না। কারণ, পোখরার ভালোবাসা আমাদের সবাইকেই বিষণœ করে তুলেছিল।
অবশেষে সমস্ত বেদনা পেছনে ঠেলে উঁচুনিচু চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে কাঠমুন্ডুর পথে রওনা হলাম। গন্তব্য এবার রাজধানী কাঠমুন্ডু। যধাবহ ড়ভ ঃযব হবঢ়ধষ-কে পেছনে ফেলে এবার আমাদের গাড়ি উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে ছুটে চলছে কাঠমুন্ডুর পথে। আমি বসেছি দরজার পাশে, আমার পিছনের সিটগুলোতে বাকি সবাই। আমাদের সঙ্গেই এক নেপালি ভদ্রলোক বসেছেন। তিনিও কাঠমুন্ডু যাচ্ছেন, তাঁর কর্মস্থলে। সরকারি চাকুরি করেন। কথায় কথায় তাঁর সঙ্গে আমাদের গল্প জমে উঠল। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলাম আধুনিক নেপালের গল্প। নেপালে জাতিভেদে কয়েক শ্রেণীর জাতি বাস করে। মংগোলিয়ান নেপালিÑযারা
অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, আর এদেরকেই আমরা পোখরায় দেখেছি, এদের ভাষা সংস্কৃতি বাকি নেপালিদের থেকে ভিন্ন। আর আছে সাধারণ নেপালিÑযারা সবাই হিন্দু আর এরাই আমাদের মতো ডাল-ভাতে নেপালি। এদের মধ্যে অধিকাংশই হিন্দি বলতে পারে। নেপাল ভ‚তাত্তি¡কভাবেও বিচিত্র।
প্রাচীনকাল থেকেই নেপাল ছিল বৌদ্ধ ধর্মের তীর্থস্থান। কিন্তু ভারতের চালুক্য রাজ্যের অধীন হওয়ার পর থেকে নেপালের ধর্মে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। যার ফলশ্রæতিতে নেপাল আজ একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র। নেপালে রাজশাসন রহিত হওয়ার পর থেকে সাধারণ জনগণ ভারতের দীর্ঘকালীন একতন্ত্রী শাসনের বিপক্ষে আওয়াজ ওঠাচ্ছে। বর্তমান সরকার তাই চিন ও ভারতের রোষানল থেকে গা বাঁচাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই সরকারের আমলেই নেপাল ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে…।
কথা বলতে বলতে পাহাড়ি রাজ্যে সন্ধ্যা নেমে এল। রক্তলাল সূর্যটা উঁচু পাহাড়ের পেছনে হারিয়ে গেল। সারাদিনের ক্লান্তিতে আমরা সবাই ততক্ষণে ঝিমুচ্ছিলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর যাত্রা বিরতি হলো। দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি, তাই খাওয়ার জন্য আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। নেপালে আসার পর নিরীহ দর্শন নেপালিদের মাছ-ভাত থেকে বিরত ছিলাম। ভাগ্যে শুধু চওমিন ছিলÑপাতার বাটিতে চওমিন। চওমিন দিয়েই উদরপূর্তি। খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার যাত্রা শুরু হলো। থেমে থেমে কিছুক্ষণ পর পর যাত্রীদের ওঠানামাÑএভাবেই চলতে থাকল গাড়ি।
রাত প্রায় দশটা। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বলতেই পারি না। জেগে দেখি গাড়ি থেমে আছে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আলোঝলমল কাঠমুন্ডু, পাহাড়ের বুক থেকে দেখা যাচ্ছে একখÐ ছবির মতো সাজানো গোছানো শহর। ড্রাইভার তার ‘প্রাকৃতিক কর্ম’ সমাধা করে গাড়িতে এসে বসলেন। কিছুক্ষণ পরেই আমরা শহরে প্রবেশ করলাম। চাকরিজীবি ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গেই নামলেন। আমাদের জন্য একটা গাড়ি ঠিক করে দিলেন। তারপর বিদায় নিলেন হাসিমুখে। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। আমাদের মেহমানকে ফোনের পর ফোন দিয়ে জাগিয়ে তুললাম। তাঁর নির্দেশিত ঠিকানায় ড্রাইভার নামিয়ে দিল। মেহমান আগে থেকেই মসজিদের গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের স্বাগত জানিয়ে মসজিদে নিয়ে গেলেন। যেহেতু আমরা আগে থেকে জানিয়ে আসিনি, তাই মেহমান আমাদের খাবারের বিষয় নিয়ে পেরেশান হয়ে গেলেন। আমরা তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘আপনি শুধু রান্নাঘরটা দেখিয়ে দিন বাকিটা আমরা করে নেব।’ তিনি নিমরাজি হয়ে শুতে চলে গেলেন। আমরা পঞ্চপাÐব লেগে গেলাম খিচুড়ি রাঁধতে। রান্না শেষে খেয়েদেয়ে মসজিদে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ধকলে সবাই ছিলাম ক্লান্ত, তাই চোখ মুদতেই হারিয়ে গেলাম ঘুমের রাজ্যে।
দিনটি ছিল শুক্রবার। ফজর নামাজের পর কলকাতার সাইয়ুফ ভাইয়ের সহায়তায় আমরা কাঠমুন্ডু ঘোরার প্ল্যান সাজালাম। সাইয়ুফ ভাইয়ের কাছ থেকেই বিভিন্ন স্পটের নাম জেনে রওনা হলাম। নেপালে যদিও টাকার মান কম তবু ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করলে নিরীহ টুরিস্টদের পকেট পুরো ফাঁকা হয়ে যায়, তাই আমরা লোকাল বাসে করেই রওনা হলাম। গন্তব্য শম্ভুনাথ মন্দির। বাস এবং যানজটÑ দু’টোতেই কাঠমুন্ডু আমাদের ঢাকা থেকে পিছিয়ে নেই। কচ্ছপ গতিতে আমরা এসে নামলাম শম্ভুনাথ মন্দির। শম্ভুনাথ কাঠমুন্ডুর সবচেয়ে পুরনো মন্দিরের মধ্য থেকে একটি। এই মন্দির ঘিরে কিছু মিথ প্রচলিত আছে। রাজা মানাদেভা ৪৬৪-৫০৫ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এটাকে অনেকে হনুমান মন্দিরও বলে। কারণ, মন্দিরের পেছনের পাহাড়ে বানরদের আবাস। উঁচু উঁচু তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে বিশালাকার এই বৌদ্ধ মন্দির। হাজারও মোমবাতি জ্বালিয়ে চলছে পূজা-অর্চনা। হিন্দু-বৌদ্ধ
উভয় ধর্মের লোকেরাই আসছে দর্শনে। আছে আমাদের মতো কিছু পরিব্রাজকও। মন্দির থেকে বের হয়ে আমরা ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা হলাম উঁচু পাহাড়ে। পাহাড়ের ওপর থেকে
কাঠমুন্ডুকে দেখে মনে হলো এ যেন রূপকথার গিনিপিগের শহর; একপাশে কংক্রিটের আধুনিক শহর অন্যপাশে উঁচু পাহাড়ে ঘেরা প্রকৃতি। পাহাড় থেকে নেমে বাসে করে আবার রওনা হলাম। গন্তব্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা, কাঠমুন্ডু জামে মসজিদ। বাণিজ্য মেলায় পাকিস্তানি আর আমাদের দেশের স্টল একসাথে। কিছু ঘোরাঘুরি করে ফেরার পথ ধরলাম।
সময় স্বল্পতার কারণে আমাদের সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে রাতের বাসে কাঠমুন্ডুকে বিদায়
জানালাম। রাতের আকাশে তখন বুনো চাঁদ। উঁচু পাহাড়ে চলছে আলো-আঁধারির খেলা। উঁচু-নিচু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ফজরের আগেই আমরা এসে পৌঁছলাম সোনুলি চেক পয়েন্টে। ভালোলাগা ও ভালোবাসার রেশ তখনও আমাদের ঘিরে রেখেছিল। মনের ভেতর ইংরেজি একটা বাক্য তখন অনুরণন তুলছিল বারবারÑ‘নেপাল দ্য বিউটিফুল ল্যান্ড অফ দ্য ওয়ার্লড’।
জুন ২০১৮