পায়ের রগে খিচ্চা-টান মারছে। স্বস্তি, যাত্রী কেউ ছিল না। হঠাৎ মনে হলো, পা-টা যেন কাঠ হয়ে গেছে। বা লোহা, পায়ের রগটা যেন লোহার তার, কপ করে কেউ টান মেরে ধরেছে।
শাহবাগ ফুট ওভারব্রিজটা, কমলা রঙ যে চুইয়ে চুইয়ে ঢালছে চলে যাওয়া গতিমান বাসের চুলে, তার অদ‚রেই এসে রিকশার ব্রেকটা সামলাল কাজী নজরুল ইসলাম। মাঝবয়েসি তাগড়াই দেহ। রিকশা চালায়, তাও মনে হয় জিমে পোড়া ফিটনেস। তেলতেলা ঘাম লেপ্টে আছে মুখে।
পায়ের রগটা আবার মানুষ হলে, কিছুটা ধাতস্থ হবার পর সে দেখতে পায়, ভালো একটা জায়গায় এনে রিকশা তার থেমেছে। টায়ারগুলো ক্ষুধার্ত। মুখ বুজে ধুলো চিবোচ্ছে। কাজী নজরুল ইসলাম তার ঝাঁকড়ামাকরা বাবরি চুলের ফাঁকে, খেয়াল করল, একেবারে ঘাড়ের পাশেই শরবতি লোকটি।
তার প্রাণ কেমন চাতকের কলিজা হয়ে যায়, আ পিয়াসা…!
কাজী নজরুল ইসলামের কিছু বলতে হয় না। শরবতওয়ালা তার কাঁচের বাক্সের ডালা খুলে। ইশ, বরফভাসা ঠাÐা ঢকঢকে জল। মিষ্টি। তোকমা দানার আঁশে পুষ্ট। হলদে কী এক টনিক পদার্থে সেই জলের রঙ প্রথম থাকে হলুদ। তারপর তাতে লাল রুহ আফজার রক্ত ঢালা হলে পর, মিশ্র একটা রঙ আসে। এই জল সেই কাঁচের স্বচ্ছ পরিস্কার হিরের মতো চকচকে গøাসে ঢালা হওয়ার আগে, তার মধ্যে অপেক্ষা করে অনেকগুলি আপেলকুঁচি।
তার মন ফাল পেড়ে উঠল, ছাঁইয়ে মাখা জীয়ল কই মাছের মতো। কী এক অস্থির ঘোরের মধ্যে এক সুখটানে পুরো গøাস শেষ করে যেন তার হুশ হলো। পরম তৃপ্তিতে, যেন রোজ হাশরে সে পিলো হাউজে কওসরের সুরাÑচোখ বন্ধ করে সে কী এক রোমাঞ্চকর স্বাদ একটু আগে ভেতরে টেনে নিল, তা অনুধাবনের চেষ্টা করতে লাগল।
সেই সময়টাতেই এক পাঠক সমাবেশ থেকে সরে এসে এই দৃশ্যপটে আমার হাজিরি ঘটল।
আজ একটা হত্যা হবে।
কাজী নজরুল ইসলাম স্থির আরামে তার রিকশায় ঠেস দিয়ে বললেন, ‘আরেক গøাস শরবত দে রে ভাই।’
দুই
কোথায় যাব আসলে? কই যাব ভাইয়া, হ্যাঁ?
মায়ের সঙ্গে আমার ঝগড়া। সে বাসা ছেড়ে চলে গেছে। স্বার্থপর মহিলা। মাকে কেমন অচেনা ঠেকে এখন। ছিন্নবিচ্ছিন্ন একটা সময় যেন যাচ্ছে। জানি না কীভাবে লিখে বুঝাব।
আজ সাতদিন, বাসায় একা। একবেলা কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে আছি। যাওয়ার সময় কোনো খাবারও রেখে যায়নি। ফ্রিজ পুরো খালি। বিগত সাতটি দিন, যাওয়ার পর একটা ফোন দিয়েও জানার প্রয়োজন সে বোধ করেনি, ছেলে কেমন আছি। আমি কোনো রান্নাবান্না কিচ্ছুটি জানি না। ঘর লÐভÐ। ময়লা কাপড়ের স্তুপ জমে যাচ্ছে।
আশ্চর্য, কোনো ভদ্র ফ্যামিলিতে এমন হয়!
উনাকে সেই নিয়ে তিনবার খুন করতে গিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিকই ছিল।
একবার মহানবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কোনো কথাপ্রসঙ্গে বাবা-মাকে গালি দিলে সেটা কত ভীষণ শক্ত পাপ, সে বিষয়ে সতর্ক করছিলেন তাঁর শিষ্যদের। তখন শিষ্যরা চমকে উঠে প্রকাশ করলেন বিস্ময়, মানুষ হয়ে কেউ কি তার পিতামাতাকে গালি দিতে পারে, হে আল্লাহর পয়গম্বর! কোনো মানুষ!
সত্যিই, আমি কি আসলে মানুষ?
বাবা হচ্ছেন পাক্কা পরহেজগার ধার্মিক লোক। আপাতত বাবা-ছেলের সংসার, আমার মানুষ বাবাকে কেমন ভালোবাসতে শুরু করেছি।
তবে তাঁর চিন্তাভাবনা মতে, মাদরাসার পড়া ব্যতিরেক দুনিয়ার আর সব পড়া হারাম।
মাদরাসায় আরবি-ফারসি-উর্দু সাহিত্যের প্রেমকবিতা, হালাল।
আরবি ভাষায় কোনো যৌনতার শব্দ, হালাল।
স্কুলের পদার্থবিদ্যা হারাম। বায়োলজি হারাম। মাদরাসার বইয়ে কোনো ইহুদি-খ্রিষ্টানের নাম আছে! স্কুল কলেজের বইয়ে তো নচ্ছার ইহুদি-খ্রিষ্টানের নাম আছে। উনি ওই হারাম শিক্ষার খবর ভালো করেই জানেন, উনি একজন উকিল।
মাদরাসায় যেতে আমার আর ভালো লাগে না। হোস্টেলে থাকতে হয়। নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পরাধীন জীবন। স্বাধীনতার সুখ লাগা ডানার পাখি আবার খাঁচায় ফিরতে চায় নাকি!
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন স্কুল প্রোগ্রামে ভরতি হয়েছিলাম। বাবা টাকা দেননি। বলে দিয়েছেন, আমাদের সমাজবিরুদ্ধ ওসব পড়া পড়লে নিজের খরচায় পড়তে হবে।
এখন যা পড়ছি, কওমি মাদরাসার সম্মান স্তর, অনার্স ১ম বর্ষ বলা যায়, তার তো কোনো সার্টিফিকেট ভ্যালু নেই। আমি তো এইট পাশও না, কে কী চাকরি দেবে এই সমাজে? মাদরাসায় নাম কেটে দিয়েছে। দেড়মাস দরসে না যাওয়া, বেসুন্নতি বেশভ‚ষা, হুজুরদের সঙ্গে বেয়াদবি করাÑবিস্তর অভিযোগ।
বাসাতেও শুয়েবসে সময় কাটানো কোনো বেকারের জায়গা নেই। লাঞ্ছনা গঞ্জনা ঝগড়া মারামারি লেগেই আছে। আমার কোনো আর্নিং সোর্স নেই। এইটুক বয়সে আমি এখন কোথায় যাব, কার কাছে, কী করব? হয়তো কিছু একটা করা যাবে, আমার ওই বন্ধুটির মতো, কিন্তু আমি যেই জ্ঞানমাহাত্ম জীবনের স্বপ্ন পুষি বুকে, তা বুকছাড়া হতে হতে দ‚র আকাশের তারাসম হয়ে যাবে।
মাঝেমাঝে চিন্তা করি, কষ্টে মন চুরচুর করে, এইবছর যারা এসএসসি দেবে, সারা বাংলাদেশের কত হাজারও কিশোর তরুণ, আমার মতোই, পড়াশোনা করার জন্য তাদের কী পরিমাণ চাপ ও হৃদয়ের উত্তাপ ঢেলে দিচ্ছেন তাঁদের পরিবারের লোকেরা, শিক্ষকেরা, পরিশ্রম করছে তারা, সুযোগ পাচ্ছে, ভালোবাসা পাচ্ছে, কত হুল্লোড়, কত আয়োজন, কত উৎসাহ, কত ব্যস্ততা তাদের, ভবিষ্যতের কত স্বপ্নে চোখ ঝিলমিল!
আমার প্রজন্মের সমস্ত এই কর্মচাঞ্চল্য থেকে, জীবনোচ্ছ¡াস থেকে আমি এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একা। ছয়মাস পর পরীক্ষা অথচ জেনারেল পড়াশুনোর কিচ্ছুটি জানি না।
আমার কোনো স্কুল? নাহ, নেই। কোনো কোচিং সেন্টারে যাওয়ার নিজস্ব পয়সাও আমার নাই। পারিবারিক সাহায্য দ‚রে থাক, ওরা চায় আমি কর্মমুখী জ্ঞান অর্জনই না করি।
বোনের মতো বড়লোক বাড়িতে বিয়ে হয়ে লাইফ সেটেল, মুসলমান বাংলাদেশের একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের জীবন তো এত নিশ্চিতও না!
বইগুলো খুললে চোখ বেয়ে হতাশা আর দুঃখ বেয়ে বেয়ে পড়ে।
এভাবে আসলে কী হয়? এই রকম শুয়েবসে আর কয়দিন? ওরা যা চায়, পড়াশোনা মাদরাসায় আমি আর করছি না।
আশ্রয়-প্রশ্রয়ের প্রবল অভাব ও চাহিদার এই সময়ে সবাই ছায়া সরিয়ে নিচ্ছে। ভবিষ্যত অন্ধকার, চোখ বুজলেই দেখি। ঘুটঘুটে হতাশা। না পারার বা অক্ষমতার বেদনা আমার এই কৈশোর আর কতটুকু নিতে পারবে?
শুধু মৃত্যুর চিন্তাভাবনা এলেই এখন কেমন নির্ভার লাগতে থাকে নিজেকে।
তিন
আমি তাঁর নিউজফিডে স্ট্যাটাস লিখলামÑ
কাজী নজরুল ইসলাম, আপনি মরেন না ক্যান?
মানুষের খাওয়াদাওয়া করেও অনেক সময় আজকাল।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের টাইমলাইনে আবেগীদের দীর্ঘ সারি। পুনরায় মানুষের মনোযোগ কাড়ার জন্য আজকাল কত লোক কত কিছু করে!
যে চলে যায়, তাকে যেতে দিতে হয়। শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে, এক মাঝারি রূপবতী আন্টি, যেতে যেতে কাকে যেন তপ্ত নিশ্বাসে, তিরবেঁধা কণ্ঠে বলছিলেন, মনে আছে ।
মরিবার হলো মোর সাধ। চললাম শাহবাগে।
একজন কবি যখন ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার আয়োজন করেন, এমনিতেই বোঝা যায়, পৃথিবীর আর প্রয়োজন নেই তার এমন বা বিগত কবিত্বের।
তবুও!
গল্পকবিতা লিখে আজকাল কী হয়? হবে? কিচ্ছু না! শুধু আমলাকবির সংখ্যাও নাকি কাকের চেয়ে কম না।
কবির জীবন খেয়ে বেড়ে ওঠে কবিতার শরীর।
সারাজীবন কবিত্ব চর্চার সর্বোচ্চ সম্মাননার অর্থম‚ল্যও বহুজাতিক ব্যবসায়ী কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ অফিসারের মাত্র একমাসের বেতন।
চার
এই নিয়ে পৌনে চৌষট্টিবার চেষ্টা করলাম। কোনো বাসের চাকাই আমাকে পিষ্ট করতে রাজি হচ্ছে না। জাবালে নুর পরিবহন কেন শাহবাগ রুটে চলে না? আমি তো নিরাপদ সড়ক চাই না, নিরাপদ মুত্যু চাই।
এই কয়েক মুহ‚র্ত আগে, শেষবার যখন তরঙ্গ প্লাসের বিশাল বপু বাসটার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, ড্রাইভার কড়া হার্ডব্রেক কষলেন। শুধু মামুলি একটা ধাক্কা দিয়ে মরণটা হাত ফসকে গেল। ইশ!
পিপাসা ধরেছে প্রচুর। তৃষ্ণা নিয়ে মরতে চাই না। উঠে দাঁড়ালাম এবার নির্বিকার। পুরো ভীড়টি আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
অনেক খুঁজেছি আমি। ঠান্ডা একটা কোমলপানীয় পাওয়ার মতো কোনো দোকান শাহবাগের ওই ফুলবাজারের বজ্জাত মোড়ে নেই।
খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে হাঁটতে আরও সামনে, জাদুঘরটি ক্রস করে দেখলাম একটি পাঠক সমাবেশ। ভাবলাম, মরার আগে কিছুক্ষণ বই পড়ে নেওয়া যাক। একটা উপন্যাসের বেশ অনেকটা অংশ বাকি। নয়টায় বের হলাম।
কলিজায় পিপাসাটা, তখনও ঝুলে আছে এক প্লেট মরুভ‚মির মতো।
রাস্তার ওইপাশে দেখলাম সেই শরবতওয়ালা। পকেটে ছিল ষাট টাকা। চল্লিশ টাকা আগেই শেষ। বিশ টাকা বাকি। শরবতের দাম জিজ্ঞেস করলাম, দশ টাকা। ভেবেছিলাম বিশ টাকা হবে। নিশ্চিন্তে এক গøাস চাওয়া যায়। কাজী নজরুল ইসলামের তখন এক গøাস খাওয়া শেষ। রিকশাচালক রিকশায় ঠেস দাঁড়িয়ে। ‘আরেক গøাস দে রে ভাই’র ওই সময়টা আরকি।
আমার মনে হলো, বেহেশতের শরাবান তহুরা পান করলাম। হাউজে কওসরেও কি এমন স্বাদ হবে? আল্লাহ!
আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা শীতল আরাম নেমে গেল, ধীরেধীরে।
কাজী নজরুল ইসলামের মতো আরেক গøাস বলব? কিছুটা অতৃপ্তি এখনও রয়ে গেছে। পুরোপুরি তৃপ্তির এক সমস্যা হলো, তৃপ্তি এসে গেলে তার পরপরই থাকে বিরক্তি। পরের গøাসের দুই-তৃতীয়াংশ পান করে ফেলার পর যদি তৃপ্তি এসে যায়, বাকি এক অংশটা খেতে তো বিরক্তি লাগবে। এভাবে আগের পুরো তৃপ্তিটা নষ্ট হয়ে যায়।
আজ থাক না কিছু অতৃপ্তি!
এই সস্তা লাল শরবত খাওয়ার জন্য হলেও আমাকে জীবনে বারবার শাহবাগ মোড়ে আসতে হবে। অতৃপ্তি বাকি না থাকলে জীবনও যে বাকি থাকে না আর!
পাঁচ
কাজী নজরুল ইসলাম দ্বিতীয় গেলাস শেষ করলেন। সালমান সাদ বাকি থাকা দশ টাকা নিয়ে বাসায় ফেরবার বাসটি ধরলেন।
লেখক : ঈ-এ, ১৫৬, ডাক্তারগলি, পশ্চিম মালিবাগ, ঢাকা-১২১৭
নভেম্বর ২০১৮