রাত প্রায় বারটা ছুঁইছুঁই। নিঝুম নিস্তব্ধ রজনী। ব্যস্ত নগরের ব্যপ্ত কোলাহল এখন নির্জীব। ঝিমিয়ে পড়েছে তার যন্ত্রণাদায়ক-পীড়াদায়ক শোরগোল ও হট্টগোল। নেতিয়ে পড়েছে ক্লান্ত-শ্রান্ত শ্রমিকের জীর্ণ-শীর্ণ দেহ। গাড়িতে জানালার পাশের সিটে বসে আছি। গাড়ির বিশ্রী ও বিরামহীন শব্দে কান ঝালাপালা। বিষাক্ত ধোয়া উড়ে এসে গায়ে লাগছে। এসব কিছু উপেক্ষা করে আমি উপভোগ করছি পূর্ণ চাঁদের আলোয় নিশুতি ঝলমল রাতের নৈঃসর্গিক সৌন্দর্য। গায়ে মাখছি রুপোলি চাঁদের ¯িœগ্ধ জোছনারাশি। কদাচ শুনি শিরশির বাতাসের ঝিরঝির শব্দ। মৃদু হাওয়ার পরশ এসে বিষণœ তনু-মনকে আন্দোলিত, শিহরিত ও পুলকিত করে তুলছে।
গাড়ি এখন কর্ণফুলী ব্রিজে। যার তলদেশে বয়ে চলেছে আত্মবিসর্জনের বেদনাবিধুর স্মৃতি নিয়ে নিরন্তর প্রবহমান নদী। এক মোহিনী স্রোতস্বিনী। শ্রæতকীর্তি এক তটিনী। যার এক ক‚লে অপরূপ গ্রাম আর অন্যক‚লে ব্যস্ত নগরী। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জনপদের ধমনি। ভারতের মিজোরাম প্রদেশের লুসাই পাহাড় থেকে যার উদ্ভব। দীর্ঘ ১৭০ মাইল পথপরিক্রমা শেষে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যার মিলন। যার শীতল অমৃত জলে কত তৃষাতুর ওষ্ঠদ্বয় সিক্ত করে। যার হিমেল হাওয়ায় কত বিষাদমনে খুশির হিল্লোল বয়ে যায়। যার বিক্ষুব্ধ ঊর্মিমালার উথাল-পাতাল কত কিছু বয়ে নিয়ে যায়। উজান ঢেউয়ের তালে তালে কত মাঝি শক্ত হাতে পাল তুলে, মধুর সুরে উদাস গলায় গান ধরে সা¤পান চালায়।
রাতের আঁধারে নদীর সৌন্দর্যের বাহার আরও দ্বিগুণ লাগছে। দিগন্তবিস্তৃত জলপু®প যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। স্বচ্ছ নির্মল জলের ছলাৎ ছলাৎ তরঙ্গমালার সুরের সুমধুর ক¤পনে আমি মূর্ছিত। মনে পড়ে যায় কবি নজরুলের সেই অমর কাব্য। কর্ণফুলীর অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি তাঁর কাব্য তুলিতে অঙ্কন করেন কর্ণফুলীর নামকরণের ইতিহাস–
‘ওগো কর্ণফুলী!
কবে কার কান-ফুল খুলি’।
তোমার স্রোতের উজানে ঠেলিয়া
কোন তরুণী কে জানে,
‘সা¤পান’ নায়ে ফিরেছিল
তার দয়িতের সন্ধানে?
আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা
কান-ফুল গেল খুলি
সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে কি কর্ণফুলী।’
কর্ণফুলীর নামকরণের আরও একটি ইতিহাস আছে। এক সময় এই নদীতে লবঙ্গ উৎপাদিত হতো। আরব বণিকরা এ সুগন্ধি মসলা এখান থেকে নিয়ে যেত। তারা এর নামকরণ করেছে ‘করনফোল’। আরবের প্রখ্যাত কবি ইমরুল কায়েসের কাব্যে ‘করনফোল’ শব্দটি এসেছে। ‘নাচিম চে সাবা যায়ত রিবায়াল করনফোল। (লবঙ্গের সুবাস ভাসে পূর্বদেশে উপক‚লে বাতাসে বাতাসে)’
ঐতিহাসিকদের ধারণা সেই ‘করনফোল’ থেকেই কর্ণফুলীর নামকরণ করা হয়েছে।
নগরী অতিক্রম করে গাড়ি এখন গ্রামের পথে। সুনসান পরিবেশ। শহরের উজ্জ্বল বাতির আলো এখানে নি®প্রভ। মখমল জোছনার ¯িœগ্ধ প্রভা গ্রামের জন্য আশার আলো। গ্রামের পথে উপভোগ করলাম আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলা। কিছুক্ষণ পর পর চোখের তারায় ভেসে উঠছে শীতল ছায়ায় মধুময় মায়ায় মাখা ছোপ ছোপ সবুজ-শ্যামল নিবিড় গ্রাম এবং বনানীর অফুরন্ত সবুজ মায়ার অনাবিল সমাহার। সবুজ আমার প্রিয়তম রঙ। সবুজের শামিয়ানার মাঝে খুঁজে পাই আত্মার প্রশান্তি। একটু সবুজের কোমল ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল থাকি। প্রতীক্ষার নিঃশেষ প্রহর গুনি। সবুজের মাঝে যেন আমার প্রাণের সঞ্চার। যেখানেই সবুজ সেখানেই আমার বসবাস। শহরে সবুজের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। একটু সবুজের ছোঁয়া পেতে চলতে হয় দীর্ঘ পথ। শহুরে জীবনে সবুজের ছোঁয়া যেন সোনার হরিণ। সবুজের ব্যস্ত শহর যেখানে ধূসর বা পাÐুর, সেখানে প্রাণ নেই, গতি নেই, ছন্দ নেই, সুর নেই; আছে শুধু বৈরাগ্যের বাণী, অবসানের বাণী। কিন্তু গ্রামের সবুজের মাঝে খুঁজে পাই জীবনের নৃত্যচঞ্চল রূপ, শুনি তার বলিষ্ঠ কল-সঙ্গীত। বিশ্ব প্রকৃতির অন্তরতলে যে গোপন সঞ্জীবনী সুধা আছে, সবুজ যেন তার প্রাণোচ্ছল ¯িœগ্ধ কান্তি। মাটির বুকে ঔশ্বর্যের যেন বহিঃবিকাশ। সবুজ তো সৃষ্টির জীবন রসায়ন।
গ্রামের পথে যেতে যেতে কখনো চক্ষুগোচর হয় ছোট-বড় দীঘি। ছায়া সুনিবিড় দিঘল দীঘির জল আমাকে মায়ার টানে ডাকছে। তিমির নিশিতে শব্দায়মান জোনাকিরা মিটিমিটি আলো ছড়াচ্ছে। সারি সারি সবুজ পল্লব মৃদু হাওয়ার তালে তালে দোলছে।
হঠাৎ গাড়ি থামল। বুঝলাম গন্তব্যে এসে পৌঁছে গেছি। আমার চিন্তার মোহ ভেঙে গেল। এলোমেলো ভাবনার রেশ এখনো হৃদয় সরোবরে ভাসমান। হাতড়ে বেড়াচ্ছি স্মৃতির ক্যানভাসে। রাতের নৈঃশব্দের মাঝে খুঁজে পেলাম হরেক রকম শব্দমালা। সেই শব্দসম্ভারের মধুর ঝঙ্কার আমার কানে বেজেছে। সেই ঝঙ্কারে আমি আন্দোলিত ও শিহরিত হয়েছি। শব্দের সবুজ পাখিরা কিচিরমিচির সুরে আমাকে ডাকছে তাদের সঙ্গে গল্প করতে। তাদের সঙ্গে ভাব জমাতে। কিন্তু আমি তাদের ডাকে সাড়া দিতে অপারগ। বিদায় নিলাম তাদের জমজমাট আসর থেকে। দু’চোখে নেমে এসেছে ঘুমের ঢল। আধো তন্দ্রা আধো নিদ্রায় গাড়ি থেকে নামলাম। চলেছি অপার জ্ঞানের নীড়ে। আমার আপন জ্ঞানভুবনে। যেখানে নিত্য নতুন রঙ-বেরঙের স্বপ্নের জাল বুনি। যেখানে আমার জাজ্বল্যমান আশার পিদিম নতুন আলোকে প্রজ্জ্বলিত হয়। হৃদয়ের উড়– উড়– ভাবনা পেখম মেলে উড়তে থাকে যার বিশাল অঙ্গনে।
সেপ্টেম্বর ২০১৮