প্রকৃতির নিজস্ব কোনো মেজাজ নেই। আছে আমাদের ভালো-মন্দের ফলাফল। আমরা যদি প্রকৃতিগত নিষ্ঠুরতা পরিত্যাগ করি, বেড়ে উঠতে পারে আরও কিছু প্রাকৃতিক স¤পদ। অবাধে গাছ কেটে সাবাড় করছি বন-বাদাড়। পুকুর ভরাট করে নির্মাণ করছি সুরম্য ইমারত, বিলাসবহুল প্রাসাদ। নিজেদের বন্দী করে রাখছি ইট-পাথরের জিন্দানখানায়। প্রকৃতিঘটিত দুর্যোগ আমাদের কারণেই আসে। প্রকৃতির সঙ্গে না মিশলে, পাহাড়, ঝর্ণা, মুক্ত আকাশ না দেখলে মন ভালো থাকে কী করে!
ধুলোবালি আর কংক্রিটের চাদরমোড়া আমাদের যান্ত্রিক জীবন। জীবন আরও গতিময় হচ্ছে। চাওয়াগুলো পাওয়া হচ্ছে খুব দ্রæতভাবে। শতপ্রাপ্তির পরও আমরা একটু স্বস্তি পেতে ফিরে যাই প্রকৃতির কাছে। মহান রবের অপরূপ সৃষ্টি প্রকৃতির কোমল ছোঁয়া পেতে। চার দেয়ালে আটকা থেকে থেকে মনটায় কেমন মরচে ধরে যায়। আর ভালো লাগে না। ছুট যেতে চায় কেবলই গ্রামের সুসমাহিত প্রাকৃতিজ পরিবেশে। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ইটের গন্ধ শুঁকে শুঁকে মেজাজ কেমন তিরিক্কি। একটু ভালোলাগার জন্য অসহ্য হয়ে বেরিয়ে পড়ি রুম থেকে। খানিকক্ষণের জন্যে হলেও উঠে পড়ি বাসা-বাড়ির ছাদে। উদোম আকাশে মুক্ত বাতাসে প্রাণভরে শ্বাস নিই। ইটপাথরের তোয়াক্কা না করে বেড়ে ওঠা উঁচু গাছগুলো দেখি। কিছুটা প্রশান্তি পাওয়ার জন্য হাঁটাহাঁটি করি। বিফল মনোরথে আবার অল্প তুষ্টে ফিরেও আসি।
এই আমার কথাই বলি, জন্ম গ্রামেই। পড়া-লেখার সুবাদে ঢাকায় থিতু হয়ছি। বিকেল ছাড়া বাইরের পৃথিবী দেখার জা নই। একরকম বাধ্য হয়েই বাঁধভাঙা ঢলের মতো বেরিয়ে যাই গেটর বাইরে। রোজকার মতো বুড়িগঙ্গা নদীর পার, ওই ডিঙি নৌকা, লঞ্চ-স্টিমার। এছাড়া দেখার কিছু পাই না তেমন। ছুটিছাটা ছাড়া গ্রামে তেমন আসা হয় না। কিন্তু যখন আসি গ্রামের সবুজাভ দৃশ্য, মনোজ্ঞ পরিবেশের আমি প্রেমে পড়ে যাই। হারিয়ে যাই সবুজে। মিশে যাই তৃণলতায়। তখন ফিরতে একদম ইচ্ছে করে না। তবে গ্রামে এলে পুকুর-খাল-বিল-নালা থাকা সত্তে¡ও সেই চাপকলেই গোসল করত হয়। মজার ব্যাপার হলো, গ্রীষ্মকালে সূর্যের তাপে যখন তীব্র গরমবোধ হয়; যখন একটা ইয়ার কন্ডিশনারের খুব বেশি প্রয়াজন দেখা দেয়, ঠিক তখন চাপকলের পানির জুড়ি নেই। পুরো শরীর নিমিষ ঠাÐা। মনে হয়, কেউ বরফ মেখে দিয়েছে সারা গায়ে। বিপরীত ঋতু শীতেও চাপকলের অবদান রয়েছে। খানিকক্ষণ চিউবওয়েল চাপার পর বরিয়ে আসে কুসুম গরম পানি। সকাল সকাল গোসল সারায় গোসল শেষে শরীর বেশ ফুরফুরে হয়। প্রফুল্লতা বিরাজ করে মনের প্রতিটা অলিন্দে।
প্রকৃতিঘেরা এই সবুজাভ নৈসর্গিকতা ছেড়ে আমরা পড়ে থাকি ইটপাথরের চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে। আসি না প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে। যেখানে ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচির কাকলিতে। সোনালি রোদ ঝলমল করে গাছের মাথায়, পুকুরের পানিতে আর ঠনঠন উঠোনে। একবার গ্রামে এলে এসব ছেড়ে কীভাবে ফিরে যাই? গেলে তো আর আসা হয় না জলদি। জীবনের ব্যস্ততা আসতে দেয় না। তাই ফিরতে একদম ইচ্ছে করে না গ্রাম ছেড়ে। ইচ্ছে করে না চারদেয়ালে বন্দী হতে। সবুজ ঘাস, বনের ফুল আর নদীর স্বচ্ছ জলে মিশে যেতে ইচ্ছে করে।
পূর্বাঞ্চলে প্রকৃতির কারিশমা দেখে শেষ করার মতো নয়। বান্দরবন, সুন্দরবন, শ্রীমঙ্গলসহ দেখার মতো বহু জায়গা আছে আমাদের নৈসর্গিক বাংলাদেশে। দলবেঁধে আনদভ্রমণ, চড়ইভাতিসহ শিক্ষাসফরে বের হই আমরা। বেড়ানা উচিত। প্রকৃতি দেখে দেখে মহান সুকশলী, নিখুঁত সৃষ্টিকর্তার স্তুতি গাওয়া উচিত। এতে মন ভালো হয়, বিশ্বাসে আসে সজীবতা। বেগবান ও উর্বর হয় দেমাগ। পাহাড়ি অঞ্চলে দৃষ্টিনন্দন ঝর্ণা, সটান দাঁড়িয়ে থাকা ইয়া বড় বড় পাহাড়। রয়েছে না-দেখা সাগর, সামুদ্রিক মাছ আর নীল জলে ডোবা শামুক।
প্রকৃতির টানে দেশ থেকে দেশান্তর ঘুরে বেড়িয়েছেন কত লেখক, কবি, মহাকবি। লিখেছেন সফরনামা, কাব্যগাঁথা। জীবনানন্দ দাশ বলেছেনÑ
‘ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীরÑ
সবুজ ঘাসের থেকে; তাই রোদ ভালো লাগে
তাই নীলাকাশ মৃদু ভিজে সকরুণ মনে হয়
পথে পথে তাই এই ঘাস
জলের মতন স্নিগ্ধ মনে হয়–মৌমাছিদের যেন নীড়
এই ঘাস–যতদূর যাই আমি আরো যতদূর পৃথিবীর।’
তাই সময় হলে, ফুরসত মিললে আমাদের মাড়ানো উচিত সবুজ ঘাস, ঘাটা উচিত জলভরা পুকুর আর দেখা উচিত মুক্ত নীলাকাশ। কারণ নৈসর্গিক প্রেম বুকে লালন করা, প্রকৃতির প্রেমে পড়া সে তো স্রষ্টার সঙ্গেই প্রেমের মিতালি গড়া।
আগস্ট ২০১৮