একবার মদিনার গলিতে দুই ইহুদি আলাপ করছিল। ঘটনাচক্রে অই পথ ধরে হজরত আবুবকর রাযিয়াল্লাহু আনহু কোথাও যাচ্ছিলেন। সাদাসিধে বিচক্ষণ আবুবকর হাঁটার সুন্নত রক্ষা করে নিচের দিকে দৃষ্টি ফেলে যাচ্ছিলেন। ওদিকে ইহুদিদ্বয় আবুবকর রাযি.-কে দেখে ফন্দি আঁটল। আবুবকর রাযি.-কে নিয়ে তিরস্কারে ফেটে পড়ল। আবুবকর রাযি. তখনো নিশ্চুপ হেঁটে যাচ্ছিলেন। ওদের তিরস্কারে যেন তার কিছু আসে যায় না। নেহায়েত নম্র-ভদ্র আবুবকর রাযি. পরক্ষণেই হঠাৎ ফুঁসে উঠলেন। দৌড়ে এসে শরীরের সর্বশক্তি ব্যয় করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন বিদ্রæপকারী ইহুদির গালে। কারণ, যেখানে কোনো মুসলমানই চুপ-স্থির থাকতে পারে না, সেখানে তিনি তো আবুবকর রাযি.! তিনি কী করে নিশ্চুপ থাকবেন। ইহুদিদ্বয় আবুবকর রাযি.-কে রাগাতে না-পেরে বিদ্রæপ শুরু করে দিয়েছিলো আল্লাাহকে নিয়ে! তখন আবুবকর রাযি. স্থির থাকেন কী করে। ওদিকে ইহুদিদ্বয় দৌড়ে এলো রসুল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের দরবারে। মামলা করলো আবুবকর রাযি.-এর বিরুদ্ধে নবিজির আদালতে।
নবিজি বিচারপতি। ইহুদি বাদী। আবুবকর রাযি. বিবাদী। ইহুদির অভিযোগÑ মুহাম্মদ, আমাকে আবুবকর চড় মেরেছে, আপনি এটার বিচার করে দিন। রসূল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কিছুটা আশ্চর্য হলেন। ইহুদিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেনÑ আবুবকর মেরেছে? তুমি কি আবুবকরকে চেনো? নাকি উমর মেরেছে? কারণ, রসূল ভাবছিলেন, কাউকে কঠোর শাসন করা তো উমরের কাজ। উমরের স্বভাবে আল্লাহ তেজ দিয়েছেন। আবুবকর এমনটা নয়। বরং একদম পানির মতো নরম। আবুবকর কেন মারতে গেল ওকে? এই ভাবনা থেকেই নবিজি বার কয়েক জিজ্ঞেস করলেন ইহুদিকে যে, আবুবকরকে সে চেনে কি-না। আবুবকর যে তাকে মেরেছে এ ব্যাপাওে সে নিশ্চিত কি-না।
প্রিয়সঙ্গী আবুবকর রাযি.-এর বিরুদ্ধে ইহুদির মামলা রসূল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম গ্রহণ করলেন। পুরো মদিনায় প্রচার হয়ে গেলো ‘মুহাম্মদের আদালতে আবুবকরের বিচার হবে।’ বিধর্মীরা বলতে লাগলোÑ এবার দেখব মুহাম্মদ আবুবকরের বিরুদ্ধে কী ফায়সালা দেন। রসূল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামআবুবকর রাযি.-কে ডেকে পাঠালেন। আবুবকর নবিজির কাঠগড়ায় হাজির। বিচারকার্য শুরু হবে। ওদিকে মানুষের ঢল নেমেছে। জনতা উন্মুখ হয়ে বসে আছে চারিদিকে। থমথমে পরিবেশ। মুসলমানেরা বিষণœ চিন্তিত। কাফেরদের ঠোঁটে মুচকি হাসি। এক রহস্যঘন পরিস্থিতি।
খানিক পরেই বিচারকর্ম শুরু হলো। রসুল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন ইহুদিকেÑ আবুবকর তোমাকে কেন মেরেছে? ইহুদি উত্তর দেয়Ñ আমরা দুই বন্ধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম, এমন সময় আবুবকর আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে চড় মেরেছেন। ইহুদি মিথ্যা বললো আবুবকর রাযি.-কে অপমান করার জন্য। মিথ্যা প্রতিশোধের ছলে তাকে লজ্জিত করার জন্য। এতে কি সে সফল হবে কখনো? এবার আবুবকর রাযি.-এর কাছে জানতে চান নবিজিÑ তুমি কি ওকে চড় মেরেছ? হ্যাঁ-সূচক উত্তর প্রদান করেন আবুবকর রাযি.। পরক্ষণেই রসুল স.-এর প্রশ্নÑ তুমি তো কাউকে মারোনি কখনো। ওকে মারলে কেন? এবার আবুবকর রাযি. বলতে আরম্ভ করলেনÑ ইয়া রাসুলাল্লাহ! লোকেরা আমাকে আঘাত করেছে, আমি কখনো তার পাল্টা আঘাত করিনি। আমার পরিবারের ওপর আক্রমণ করেছে। আমার সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। তার প্রতিশোধও আমি কোনোদিন নিইনি। নেয়ার কল্পনাও করিনি। নীরবে সব সয়েছি। তবে যখন আমার আল্লাহকে নিয়ে কেউ কটূক্তি করবে, তখন আমি, আবু বকরের পক্ষে তা সয়ে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। আবুবকরের রক্ত কি এতটাই শীতল হয়ে গেলো! তাই আমি ওকে মেরেছি। এবার রসূল স.-এর জিজ্ঞাসাÑ কী কটূক্তি করেছে, বলো। আবুবকর বললেনÑ লোকটা কে আছো, যে আল্লাহকে ঋণ দেবে, উত্তম ঋণ? (আলবাকারা, আয়াত : ২৪৫) আয়াতখানা উচ্চারণ করে করে বলছিলো আল্লাহ নাকি ফকির হয়ে গিয়েছেন! (নাউজুবিল্লাহ) তাই আমি ওকে চড় মেরেছি। তখন রসূল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেনÑ আর কে শুনেছে? শুধু তোমার কথায় তো তোমার পক্ষে রায় দিতে পারি না। তোমার পক্ষে সাক্ষী লাগবে।
কিন্তু আবুবকর সাক্ষী কোথায় পাবেন। ঐ দুই ইহুদি ছাড়া অন্য কোনো মানুষ ছিলো না তখন সেখানে। তাই আবুবকর রাযি. সাক্ষী পেশ করতে সমর্থ হননি। ইহুদি আনন্দে হাসছে, উপস্থিত জনতার সামনে আবুবকর রাযি.-এর গালে চড় মেরে তাকে অপমান করতে পারবে এই ভেবে। রসুল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আবুবকর রাযি.-কে বিশ্বাস করেননিÑ এমনটা মোটেও নয়। কারণ, আবুবকর রাযি. ঐ ব্যক্তি যিনি সিদ্দিক (সত্যবাদী) উপাধিতে ভূষিত। তাকে কী করে মিথ্যার সাথে ভাবা যায়। তারপরও রসুল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আবুবকর রাযি.-এর পক্ষে সাক্ষী তালাশ করেছেন। কারণ রসুলের আদালতে আবুবকর রাযি. ও ইহুদি উভয়ে সমান। ইনসাফ প্রতিষ্ঠা রসূল স.-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইনসাফের মুআমালায় রসুল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম কাউকে বিন্দুসম ছাড় দেন না। চাই সে আবুবকর রাযি.-ই হোক বা কোনো ইহুদিই হোকÑ যেই হোক না কেন রসুলের কাঠগড়ায় সবাই সমান।
রসূল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সেদিন সম্পর্কের খাতিরে আবুবকর রাযি.-এর পক্ষে রায় দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। রসূল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইনসাফ কায়েম রেখেছিলেন। তিনি-ই বিশ্বনবি মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম।
আবুবকর রাযি. তার পক্ষে সাক্ষী পেশ করতে না-পারায় রসূল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইহুদির পক্ষে রায় ঘোষণা করবেন, এমন সময় জিবরিল আলায়হিস সালাম এসে উপস্থিত। যে মহান সত্তার জন্য আবুবকর আজ আদালতের কাঠগড়ায়, সেই সর্বজ্ঞ রবই জিবলিকে পাঠিয়েছেনÑ আমার মুহাম্মদের আদালতে নিরপরাধ আমার আবুবকর সাক্ষীর অভাবে ইহুদির হাতে অপমানিত হবে! না, এ হতে পারে না। আবুবকর তো আমার জন্যই ইহুদির গালে চড় মেরেছিল। দুনিয়ার কেউ দেখেনি, তো কী হয়েছে, আমি আরশের মালিক তো দেখেছি। আমার জন্য আমার আবুবকর ইহুদির হাতে চড় খাবে, আমি কী করে তা সইব। জিবরিল, যাও, তাড়াতাড়ি যাও, আমি নিজেই আজ আবুবকরের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করলামÑ নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন যারা বলেছে আল্লাহ ফকির আর আমরা ধনী! (আলেইমরান, আয়াত : ১৮১)
রসুল সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম সেদিন ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি আবুবকর রাযি.-কেও ছাড় দেননি। মহানবির মতো ন্যায় প্রতিষ্ঠা পৃথিবীতে দুসরা কেউ করে দেখাতে পারেনি। পারবেও না। কারণ, তিনি তো সৃষ্টিসেরা রহমাতুল লিল আলামিন। তার তুলনা হয় কী করে!
সূত্র : তাফসিরে জালালাইন, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৭৫২। তাফসিরে মাজহারি খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ৪৩৬-৩৭, মাওলানা আব্দুল মাজিদ নদিম রহ.-এর বয়ান, জমিয়তুল ফালাহ ময়দান, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ
নবধ্বনি জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত