সেই দুধ-সকালে বাড়ি ছাড়ি। মায়ার বন্ধন, খেলার মাঠ, বাড়ির পুবের তেপান্তরের জলপ্রান্তর পেছনে ফেলে দীঘল স্বপ্নের আকাশকুসুম লক্ষ নিয়ে রাতের সঙ্গে প্রণয়ের বন্ধন নিশ্চিত করি। মাতৃ-মমতার শাশ্বত-ক্রোড়, বৈরাগি আগামীর কোরাস, শিশুত্বের মজার পাঠ, বিনোদনের সাত-দুয়ার, আর বাল্যসহচর দুষ্টু তায়েফদের সঙ্গ ত্যাগ করি নিঠুরিয়া শিকারি সরীসৃপের মতোন।
সিলেটের পথ। মৌলভীবাজার থেকে সিলেট, যেন এক পৃথিবী পাড়ি দেওয়া, গাড়ি চড়ে চড়ে, লম্বাগাড়িÑ‘টেরেইন’ বলতাম যাকেÑএই আমার স্বপ্ন। এই আমার নিষ্ঠুর বন্ধু, আমার ঘোরাচ্ছন্ন যাদুমণি। চঞ্চল ব্যস্ত শৈশবের সমুদয় ¯েœহপ্রীতির বন্ধন, প্রণয়ের মৃদুলা মাতৃক্রোড় ত্যাগ করি গাড়ি চড়ার অদম্য নেশায়। আমার আম্মা, আমার আব্বা, আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় মেঝো আপু, সবার মায়াঘোর মুহূর্তেই ছিন্ন করি।
রেঙ্গায় আসি, তখন নয় বছরের আমি। পড়ার জন্যে নয়, বৃহস্পতিবারে লম্বাগাড়ি চড়ার ঘোরলাগা স্বপ্ন নিয়ে। আমার পৃথিবী যেন তখন শুধু গাড়ি আর গাড়ি। ট্রেনের উন্মুক্ত বাতায়নে চোখ রেখে ঠায় দেখে যাওয়া, সবুজের নগরী। অদূরে লংলার খাসিয়াপল্লী, কুলাউড়া জংশন পেরিয়েই হাকালুকির প্রাণশীতল উষ্ণীষ হাওয়া, দিগন্তবিস্তৃত জলের উন্মাতাল ঢেউ, বাতাসের সঙ্গে রস-টসটস লুকোছাপা খেলা, ভাটেরায় পাহাড়ের আকাশে মিলিয়ে যাওয়া, আর ফেঞ্চুগঞ্জের সরোবর-জলের ওপর কুশিয়ারার দীর্ঘ ব্রিজ; এই স্বপ্নের পথ!
রেঙ্গায়ই জীবন শুরু। কত ভালোলাগা। নানার দোকানের (আফতাব আলি, চা-বিক্রেতা, নানা নামেই ছাত্রদের কাছে অধিক প্রসিদ্ধ) মনমাতানো চায়ের অতুলনীয় স্বাদ, কী যে স্বাদ হায়! স্বাদের রহস্য সম্ভবত এখানে, একটুজীবনে নগ্ন-বাতাসে স্টলের আধভাঙা বেঞ্চে বসে চা খাওয়া, তাও একলা একা, স্বাধীনমতো।
হিফজের দিন। নাজারায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো। স্বভাবতই আমি নীরব ও মৌনবাদী, অনেকটা অন্তর্দেশীয়। খুব সহজে সবার সঙ্গে মিশতে না-পারা, জানি না, আমার চরিত্রের নেতিবাচক দিকও হতে পারে। বিকেলে রেললাইনে একা একা হাঁটতে যেতাম। ট্রেন দেখার অপেক্ষায় মাগরিবের নামাজে গরহাজিরির কেচ্ছাও নিতান্ত কম না। নীরবচারী স্বভাবের আমাকে উসতাদরা সকলেই আহ্লাদি নজরে দেখতেন।
‘আস্তমা হুজুর’ গরম উসতাদ, সিলেটের হিফজ-ছাত্রদের নতুন করে জ্ঞাত করার দরকার পড়বে না। হাফেজ গড়ার যাদুকর। কিন্তু তাঁর জবানের চেয়ে বেতটা অধিক উষ্ণ। সেই আস্তমা হুজুরের বেতটা আমার বেলায় ছিল বিস্ময়াকর নম্র ও নীরব। আমি মায়াময়তায় দু’টি মাস ঘুরে-ঘোরে অতিক্রান্ত করলাম। কুরবানি-ঈদের পর আমাকে দ্বিতীয় ক্লাসে উন্নতি দেওয়া হলো। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় দ্বিতীয় ক্লাস থেকেই অংশগ্রহণ করলাম। হোয়াইট-বোর্ডে ঝুলানো রেজাল্ট-নামায় আমার নাম সবার শুরুতে, মানে এক নাম্বার। আমি আর কি, সবার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মতো হাসলাম। রেজাল্ট নিয়ে আনন্দের কোনো কারণ যদিও নিখোঁজ পেলাম। আমি কি বুঝতাম তখন রেজাল্ট কী? অসম্ভব নয়, না। তবে এক নাম্বার হলে হুজুর ও সহপাঠিরা মায়াদৃষ্টি দেয়, আমি তাই চেষ্টা না করেও এই কোঠার আশা ছাড়িনি।
পরের বছর। কাজিহাটা হুজুর আসলেন জামেয়া রেঙ্গায় উসতাদ হয়ে। আমাকে কেমন আপনের মতো কোলে তুলে নিলেন। আমার সার্বদেশিক খোঁজখবর নিয়মিত নিতে থাকলেন। ¯েœহভরে ছায়া দিতে থাকলেন। বাড়ির গল্পগুচ্ছ, খেলার মাঠ, আর পুরানবাড়ির সজীবদের সঙ্গে তুমুল দিন ঢাকা পড়ল ¯েœহরূপের রূপসী বিভায় মিষ্টির মৌ মৌ ঘ্রাণের পাদদেশে।
এরপর ছায়ায় ছায়ায় মায়ায় মায়ায় হাঁটতে লাগলাম নদীনগরের বিলাসি দিনের খোঁজে। একদিন শঙ্খনিনাদে ঘুমকাতুরে দিন ভিজিয়ে রোদেল পরশে জাগলাম কৈশোরকে আবার স্বাধীন-নগর, বিহঙ্গপুর ভেবে। মিজানে ভর্তি হলাম। নতুন সকাল, নতুন উসতাদবৃন্দ। নতুন ছায়া, আর নতুন মায়ামমতার দিনচলা। এই দিনগুলোর সোনাঝরা সকালে রূপান্তরের অবদানে ‘হাদারপাড়ি স্যার’ ও ‘মুন্সিবাজারি হুজুর’কে তুলনা করতে গেলে, ¯পর্ধিত হবার আশঙ্কা আছে। সমুদ্র-প্রিয়দের ভীড়ে, এই মুখগুলো বারবার ভাসে শীতল-হাওয়াই সা¤পান হয়ে হয়ে।
নাহবেমিরের দিনগুলো। শায়খ ইকবাল বিন হাশিম সুনামগঞ্জি হুজুরের বদান্য-দৃষ্টি আর সীমান্তভেদি বনেদিপনা উৎসাহিত করে আমাকে। আর গোয়াশপুরি হুজুর, আর কাতিয়ার হুজুরের কথা স্মরণে পড়লেই চোখদ্বয় বরষার টাপুরটুপুর জলের মতো থৈ থৈ হয়ে যায়।
আরও অসংখ্য আলো, অসংখ্য জোনাকিপোকা, আমার পথে পথে আলো দিয়ে গেছে। সাহিত্যের এই প্রদোষে জুনাইদ কিয়ামপুরি হুজুরের দিকদর্শন, আমার অভদ্র অবহেলা সত্তে¡ও ডেকে নিয়ে দেখিয়ে নয়, আঙুল তুলে বলে দেওয়াÑএভাবে নয়, ওভাবে; ঋণের খাতা ভারি করছে দিনভর।
শুকতারা পথিককে দিক চেনায়, সময়ের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে। আমার এই দিকহীন উশৃঙ্খল পথে যাঁরা দিয়েছেন মহিরুহ-ছায়া, ঋদ্ধ করেছেন অভাজনের তুচ্ছ-শীর্ণ কায়া; পথ, যখন ফিরে ফিরে তাকাই, দোয়া আর দোয়া আর দোয়া!
জুন, ২০১৮