গাছের ঝোপের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে বাতাস আলকাতরার মত কালো পানির মধ্যে এলিয়ে যাচ্ছে। সবুজ ভাটিয়ালিতে এখন কালোর আসর। সাত্তার গতরাতের নির্ঘুম চোখে পানিতে তার ছায়ার দিকে তাকাল। এই পানির জীবন রক্ষার ধর্ম শেষ, সে এখন কারো ইহকাল সমাপ্তের ধর্ম নিয়েছে। নৌকার ধাক্কায় পানির এদিক-সেদিক সরে যাওয়াতে একটা মৃদু শব্দ হচ্ছে। কারো কিছু ধর্মের হয়ত কখনো পরিবর্তন হয় না। সেই মৃদু শব্দে তেমনি পানি তার এই শেষ প্রকৃত ধর্মের অস্তিত্ব জানাচ্ছে। সাত্তার মাথা থেকে ঝুড়িটা নামিয়ে লুঙ্গিতে একটা শক্ত গিঁট দিল। দুই সপ্তাহের টানা বৃষ্টির পর বাতাস এখন স্তিমিত। কোনো অশনি সংকেত নেই। সাত্তার ঘর্মাক্ত শরীরে শান্ত বাতাসের আমেজ নিতে নিতে তার ঝুড়ির মধ্যে থাকা সামগ্রীকে আরেকবার দেখে নিল। ঝুড়িটার মালিকানা তার না; তার বড়দাদা হামিদুর বখশীর। পারিবারিক সূত্রে সাত্তাররা ভাটি অঞ্চলের মানুষ। সাত্তারের বড়দাদা ছিলেন উড়ু উড়ু মনের, ভবঘুরে গোছের। জেলায় জেলায় ঘুরতে ঘুরতে তিনি একদিন এসে পড়লেন এই প্রত্যন্ত ভাটি অঞ্চলে। চারপাশে পানিবেষ্টিত এই অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষের জীবনের সাথে কোথায় নিজের উত্তাল জীবনের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন কেউ জানে না। শতবার নদী-ভাঙন, বর্ষার প্লাবনের তাণ্ডবলীলার মাঝে ধৈর্যশীল ভাটি অঞ্চল আর অন্যদিকে অস্থিরচিত্তের হামিদুর বখশী। বিপরীত মেরুর আকর্ষণেই কিনা কে জানে তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন এখানেই তিনি তাঁর বাকি-জীবন কাটিয়ে দেবেন। তাই ভাটি অঞ্চলেই বিয়েশাদি করে ভিটামাটি গড়ে তুললেন। হামিদুর বখশী আজ আর এই পৃথিবীতে সাক্ষ্য দিতে পারবেন না, শুধু তাঁর বাড়ি আর পরবর্তী প্রজন্মই ভাটি অঞ্চলের আকাশের সাথে তাঁর অস্তিত্বের এক অদৃশ্য যোগাযোগ রাখে।
‘বুড়া ব্যাটার কিড়া হইসিল!’ কিড়মিড় করে মুখ নাড়াল সাত্তার, ‘না হ্যাতের এইসব পিতলা খাইশ হইত না আমগো এইহানো পইড়া থাহোন লাগত’ বলেই একদলা থুথু ফেলল। সাত্তারের গন্তব্য দূরের একটা গ্রাম। দুই সপ্তাহের টানা বৃষ্টির দরুণ ভাটি অঞ্চল এখন পানিতে শান্তির ঘুমে নিমগ্ন। অশান্তির ঘুম শুধু এই অঞ্চলের মানুষদের। তারা নিরুপায়। কোমর-উচুঁ কালো পানিতে শুধু তাদের কালো ভবিষ্যতের ছায়া দেখা যায়। নাহ, তাদের কোনো বৃষ্টিবিলাস নেই। আর দশটা পল্লিগ্রামের বৃষ্টিস্নাত দৃশ্য কিংবা শহরের বিলাসী কফির মগে বৃষ্টির ঝিমঝিম মুহূর্ত কোনোটাই এই অঞ্চলের দৃশ্যপটের সাথে মেলানো যায় না। একটু ভারি বর্ষণ মানেই ভাটি অঞ্চলের চেহারা রাতারাতি কালরূপ ধারণ করে। আর সেই কালরূপ অবসানের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অস্ফুট প্রার্থনারত ভাটিয়ালি মানুষদের জীবন টলমল করতে থাকে ঠিক সেই কোমর-উচুঁ পানির মতো। আর দশটা বাড়ির মতো সাত্তারের বাসাতেও গোটা সাপ্তাহিক বৃষ্টির আনাগোনাতে স্বাভাবিক জীবন ভাসমান। হাতে কোনো টাকা নেই, টিনের চালের ফুটা দিয়ে পড়া প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটার সাথে সাত্তারের দুশ্চিন্তার ঢেউ বাড়তে থাকে। শেষমেষ ছোট মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে আর থাকতে পারেনি, ঝুড়িটা হাতে নিয়ে বাসায় থাকা কিছু অবশিষ্ট সবজি নিয়ে রওনা দিল পাশের গ্রামে। ছোট্ট মুনিয়া শুধু সাত্তারের যাওয়ার সময় তার মাথায় রাখা ঝুড়ির ছিড়ে যাওয়া ছোট জায়গাগুলো ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল। জীবনের বড় বড় পোড় খাওয়া ছেড়া অনুভূতির কাছে ঝুড়ির এই ছোট ছেড়াগুলা আসলেই বিস্ময়কর।
‘চাচা এট্টু জোরে বাই দেওয়া লাগতন।’ সাত্তার জমির মাঝিকে তাড়া দেয়। তাড়া দেয়ার কারণটাও যথার্থ। প্রথমত পাশের গ্রামের বাজারের স্থানীয় বিক্রেতারা আগে ভাগেই জায়গা নিয়ে নেয় যার জন্য পরে ভালো জায়গা পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত যেহেতু ক্রেতারা সকালের দিকে টাটকা জিনিস কিনতে পছন্দ করে তাই দেরি করে গেলে পরে আর কিছু বিক্রি হতে চায় না। তবে সবচেয়ে বড় বিপত্তি ইজারাদাররা। তারা এই সুযোগে বাইরের বিক্রেতা থেকে অতিরিক্ত ইজারা নিচ্ছে। ইজারাদারের চেহারা মনে করতেই সাত্তার আরেক দফা থুথু ফেলল। তার জলের কেড়ে নেওয়া ভাগ্যে আজ স্থলরাও ভাগ বসাচ্ছে।
‘জোরেই বাইতাছি মিয়া!’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল জমির। মাঝখানে দম নেয় জমির। আর প্রবীণ কণ্ঠে ভাটিয়ালি গানে টান দেয়। তার গানে সাড়া দেয় কালো পানি কলকল করে; নিচের মাটিকে আড়াল করে।
‘আবার কবে মাটির চেহারা দেহন যাইবো চাচা? এভাবে চইল্লে তো আমাগো না খাইয়া মরণ লাগব।’
জমির কিছু বলে না। মিটমিট করে হেসে আবার গানে সুর দিল। সাত্তারের মতো অনেক কৌতূহলীই তাকে শতবার এই প্রশ্ন করেছে। তার এই সত্তুর বছরের জীবনে শোনা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক প্রশ্ন এটা। প্রতিবারই এরকমই হাসি দিয়ে উত্তর দিয়েছে সে। হয়ত একদিন আর উত্তর দিতে হবে না তাকে; এই কলকল ধ্বনি তার পক্ষ হয়ে উত্তর দেবে। অর্ধশত বছর হল মাঝি সে। এই ভাটির প্লাবন শেষ হলেই বিশ্রামে যাবে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। হয়ত সাত্তারই তার শেষ যাত্রী, কে জানে। মাঝে মাঝে কিছু উৎসুক চেহারা জানালা দিয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখছে।
‘বেচা কেনা কিসু হয় এম্নে?’
‘ত্যামন সুবিধার না চাচা। বিকানোর সুযোগটাই পাই কই। হেতেরা আগে গিয়া বইসা থাকে আর আমাগো ভাত মারে।’
‘তয় চইলা যাও না ক্যান এহানতো? তোমার বয়স কম। ছোট পোলাপান নিয়া এইহানো মানুষ করা কঠিন। তাছাড়া এইহানো ব্যবসাপাতি করাও ম্যালা সমিস্যার।’
কীসের টান কেউ জানে না। স্বপ্ন ভাঙে বারবার কিন্তু মায়া ভাঙতে জানে না, কাটতে জানে না; শুধু ধাঁধায় রাখে। তাই এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না সাত্তার। চুপ করে থাকে। ক্রমশ গ্রামের কাছে চলে আসছে তারা। নৌকাটা হেলেদুলে উঠে মাঝে মাঝে। অবসন্ন সময় শুধু অপেক্ষায় ডোরা কাটে। জমিরের সাথে এবার সাত্তারও গলা মেলায়। তার ভাটিয়ালি রক্ত আবার জাগতে শুরু করেছে। মাথায় ঝুড়িটা উঠিয়ে পেছনে পড়ে-থাকা ভাটি অঞ্চলের দিকে তাকাল সে। এই পনেরোটা দিন পড়ে ভাটি অঞ্চল ডুবে আছে, শুধু জেগে আছে উপরে-থাকা চোখগুলো। আজকে রোদ উঠেছে ঠিক, কিন্তু প্রকৃতি আবার ফিরে আসবে ভাসাতে। এই নিয়মের যেমন হেরফের হবে না তেমনি হেরফের হবে না বেঁচে থাকার আরেকটি বারের আকাঙ্ক্ষার।
শিক্ষার্থী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ঢাকা