কর্মময় দিনটির শেষে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে অলস গোধূলি। দিগন্তের কিনারে ছড়িয়েছে রুধিরাক্ত আভা। ওই যে দিগন্তের শেষ সীমায় গিয়ে ঠৈকেছে আমার সন্ধানী দৃষ্টি। দৃষ্টির সীমানায় আকাশ ঠেকেছে পৃথিবীর পিঠে। মাঝখানে শুধু একখণ্ড মেঘ-বালিকার অন্তরায়। আর না হয় ওই যে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশে উঁকি দেয়া মহীরুহগুলো আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলেছিল যেন। বছরের বসন্ত পর্বটি নতুন করে উপভোগের উল্লাসে সবগুলো পাতা ছেড়ে জলাশয়টির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি কড়ই গাছ। হরিণ-সিংহের মতো আঁকাবাঁকা ডালপালা পেরিয়ে সূর্যের প্রতিবিম্ব মেতে উঠেছে জলের মাছের সাথে নৃত্যের অভিলাষে। বাতাসের তরঙ্গে কিংবা কই-টাকির ছোটাছুটিতে কেঁপে ওঠে জল-পিঠ। কেঁপে ওঠে দিগন্তের সূর্যটিও। দিবসের এই পর্বটি আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। কেন, জানি না। হয়তো-বা প্রকৃতির তন্ময়তার সাথে মনের ভাব হয় খুব বেশি, তাই; অথবা পড়ন্ত বেলার বাতাসে মিলনের মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে থাকে বলে, কিংবা অন্য কোনো কারণে। আমি ঠিক জানি না। এক অজানা মায়ার টানে আমি ভালোবাসি পাতাঝরার গোধূলিকে, রক্তমাখা দিগন্তকে।
ক্লাস শেষে প্রতিদিন বাসায় ফিরতে জোহরের অক্ত শেষ হয়ে যায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আজ একটু বেশি সময় কেটে গেল। বাসার পথ ধরেছি আসরের পর। পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করি সবসময়। পথের শেষে শরীফদের বাড়ির পাশে এই যে বিস্তৃত খোলা মাঠের কিনারে দিগন্ত সেজে আছে অপরূপ সজ্জায়, আর বিস্তৃত নীলিমার বুক জুড়ে ছোপ ছোপ সোনালি ছোঁয়া, প্রকৃতির এই মায়াময় চেহারাটি আমাকে বাসায় যাওয়ার কথা একেবারেই ভুলিয়ে দিয়েছে। সাধারণ ক্ষুদ্র এই শিল্প যদি এত মায়াময় হয় তাহলে আরও কত ক্ষমতাসীন এবং মহান হবেন সেই মহান শিল্পী!
শৈশবের একটি স্মৃতি মনে পড়ছে আজকের পড়ন্ত বেলায়। সাধারণত সেসময়কার কোনো স্মৃতি আমার তেমন মনে নেই। কখনো কখনো আব্বু আম্মুর কাছ থেকে যেগুলো শুনেছি সেগুলোই। এই পড়ন্ত বেলার স্মৃতিটিও শুনেছি আম্মুর কাছ থেকে। আম্মু বলেছিলেন : একদিন আমাদের বাড়িতে মেহমান এসেছিল। আমি ছোট হিসেবে সবার আদরের পাত্র ছিলাম। চাচুরা আমাকে কোলে নিয়ে বাইরে চলে এসেছিল। বেলা তখন অস্তপ্রায়। পড়ন্ত বেলায় দূর-দিগন্তের সবগুলো গাছকে কালো দেখায় খুব। আকাশটাও যেন সেখানে নিচে নেমে এসেছিল। তখন আমি বলেছিলাম, ‘চাচু! এই কালো মানুষগুলো এত বিশাল আকাশটাকে মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে!’ আমার প্রশ্নের সেদিন কোনো উত্তর পেয়েছিলাম কিনা জানি না। চাচুরা হয়তো বুদ্ধিমান ভাতিজা বলে আমার কপালে একটি চুমু এঁকে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের মধ্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি অনুভব করি, প্রকৃতির প্রতি আমার এ ভালোবাসা অবুঝ সময় থেকেই, গোধূলির সৌন্দর্যে আমার বিমোহিত হওয়া সেই শৈশব থেকেই। প্রকৃতিকে আমি ভালোবেসে ভুল করিনি। কারণ প্রকৃতির সবুজ সৌন্দর্যের সমাহারে আমি সন্ধান পাই মহান প্রভুর অফুরন্ত সৌন্দর্যের। প্রকৃতির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এক মহান সত্তার অস্তিত্ব ও একত্বের প্রমাণ। তাই আমি ভালোবাসি ভোরের হাস্যোজ্জ্বল প্রভাকর, বিকেলের ক্লান্তি মুখর সূর্যকে, ভালবাসি রাতের মৃদু চাঁদ ও দুধালো জোছনাকে, এবং আমি ভালোবাসি বিস্তৃত প্রান্তরের ঢেউ-খেলানো সবুজ ও ধেয়ে আসা ঝরনার খলখল হাসিকে, ভালোবাসি এ পৃথিবীকে এক মায়াময় প্রকৃতি আমাকে উপহার দেয়ার কৃতজ্ঞতা হৃদয়ে ধারণ করে।
শিক্ষার্থী, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া, ঢাকা
অক্টোবর ২০২০