আজকাল বড্ড ব্যস্ত সবাই। শব্দের খেলা হয় না আর আগেকার সে ভীষণ প্রেম নিয়ে। শহুরে বাতাস কেড়ে নিয়ে গেছে আমাদের পুরনো সে প্রেম। কেমন শ্যাওলা জমে গেছে মনের দেয়ালে। একপাল জোছনা ধরতে এখন আর কেউ নৌকা নেয় না। সন্ধ্যে-তারার পর যখন চাঁদ ওঠে, চাঁদটা দেখার সে নির্বাক আনন্দ আমাদের চোখ ছেড়ে গেছে কতকাল আগে কে জানে? গলা ছেড়ে গান, কবিতা ভাঁজ করা নিষিদ্ব চিরকুট এখন শুধু স্মৃতিপথে আসে। ভরা বিল এখন কেমন স্থির। জল ছলছল সে গভীর শব্দটুকু কেমন নিঃসাড় লাগে এখন।
দলছুট আমাদের নিগূঢ় বন্ধুত্বের জোয়ার থেমে গেছে বাস্তবতায়। কিন্তু মনটাও অমন করে নেতিয়ে গেছে কেন? কেমন স্যাতস্যাতে আর ভারী হয়ে থাকে চারপাশ। এটা কি ক’টা প্রাণখোলা মনের বিচ্ছেদ নয়? মহাকালের বিচ্ছেদ বুঝি এমনই হয়।
এই যে হেমন্ত। সেও তো প্রকৃতির নির্মমতায় ঢের বদলেছে। বাঙালি পাড়ায় নবান্নের সে প্রাণছোঁয়া উৎসব এখন আর হেমন্তে হয় না। কিষাণী বধূ দুপুর ভেঙে গামছা বাঁধা খাবার কাঁখে আল কাটে না আর। সরষে ফুলের যে মাদকতামাখা স্থির ছবি তেপান্তর ছেড়ে কোথায় চলে যেত, হেমন্তের প্রতিটা ভোর সেকালে কেমন নিপুণ করে হিম শিশির এঁকে যেত ফুলের নগ্ন দেহে, সে কি রূপ! কি অপার্থিব মোহময়তা! কুমারী মেয়ে ঝনঝন করে আঙুলের ডগায় শোষে নিত সে শিশিরজল। খিলখিল করে হেসে উঠে প্রকৃতির ভোর পূর্ণ করতো কেমন উচ্ছল হয়ে। প্রজাপতির ডানায় যে সৌন্দর্য নামতো তখন। সোনামাখা ঝরঝরে রোদ ছাপিয়ে স্নিগ্ধ বিকেল। পাড়ায় পাড়ায় নেচে উঠতো গাঁয়ের শিশুরা। গোল্লাছুট, ফুল টোকা, জামাই-বৌ খেলে সন্ধ্যে নামাতো আকাশের পাড়ায়। একটু রাত পড়তেই কিষাণ পাড়ায় জমে উঠতো পুঁথি গানের আসর। কাঁচা ধানের গন্ধে চাপা পড়তো ক্লান্তি। সুখস্বর ভেসে যেত রাতের সূতো কেটে দিগন্তরেখায়। নির্মল শান্তিরা পাহারা দিত আমাদের চারপাশ।
আমরা জোয়ান ছেলেরা পাড়া ঘুরে বাঁশি বাজাতাম রাতভর। সে কালে হেমন্ত ছিল আমাদের আসি আসি শীতের প্রথম প্রেম।
অথচ এখন! এই আজকাল হেমন্ত যেন বিস্মৃত প্রায়। একটা ঋতুর মৃত্যুই হয়ে গেল বুঝি। দিনভর লাগাতার বৃষ্টির ফোঁটা পড়েই যায়। থামার কোনো নাম নেই। মন ভিজে কেমন একাকার হয়ে থাকে সারাটা সময়। জবুথবু মন বিষণœতা মেখে বাইরের বৃষ্টি টুকুই শুধু পাহারা দেয় নিত্যদিন। লিরিক-ভাঙা দু’চারটে শব্দে গান বাঁধি একাকী। স্থির হয়ে ভেতরে কথার জল নেমে যায় খুব দূরে কোথাও। রেখে যায় একটা কথাশব্দ! প্রকৃতিই যদি অমন নিষ্ঠুর হয়ে বদলাতে পারে। তাহলে মন সে তো বদলাবেই।
সে যাইহোক, হৃদ্যতা বলে তো একটা কথা আছে। প্রগাঢ় সুনিশ্চিত আহŸান যেখানে চিরকাল এক হয়েছিল। কয়েকটা উচ্ছল প্রাণের রাতজাগা নির্মম ভোর হতো কথায় কথায়। গলা ছেড়ে সে গান! বকুলের গন্ধের মতো এক করে নিত আমাদের ভেতরকে। সুখটুকু ভাগ করে খেয়ে নিতাম সেখানেই। নির্ঘন্ধ পলাশের মতো বাকি থাকতো শুধু কিছু অভিমান-অনুযোগ। আড্ডায় ওপাশ ফিরে বসে থাকতো দীর্ঘক্ষণ। হঠাৎ গানের সুরেই আবার মিলে যেত অভিমানমাখা সে দু’টো স্বর। ভেজা শিউলির মতো মিশে যেত সবক’টা মুখ। অভিমানটুকু মিশে যেত রাতের সোঁদা গন্ধে। চাঁদের রূপ পাহারা দিতে আমরা সোনাচর বিলে নৌকা নামাতাম। শান্ত জলের ওপর লিখে রাখতাম আমাদের প্রাণের নিরাকার অভিব্যক্তি। ঢেউয়ের পাতায় ছেড়ে দিতাম আমাদের বন্ধুত্বের কথাÑ ‘সব্বাই ভালো থাকিস!’
বহুকাল বাদে আজ মনে প্রেমের উচাটন জেগেছে।
এ প্রেম স্নিগ্ধ পবিত্রের। এ প্রেম বন্ধুত্বের। আমাদের প্রেম এখনো বেঁচে আছে আমাদের বুকে মহাকাল হয়ে। আমরা পাল্টে গেছি ঠিক! আমাদের স্মৃতিপাঠ আমরা এখনো করি প্রতিনিয়ত।
আমাদের মহাকালের এ বিচ্ছেদে ভেতরে জেগে ওঠে সে একটাই গান :
‘পুরানো সে দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়/ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়।
মোরা ভোরের বেলা তুলেছি ফুল দোলেছি দোলায়/ বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।’
শিক্ষার্থী, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ, ঢাকা
নবধ্বনি, জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত