প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে পত্রিকা দুই ধরনের। কিছু পত্রিকা হয় যুগস্রষ্টা, আর কিছু হয় যুগসৃষ্ট। যুগস্রষ্টা পত্রিকা বলতে আমরা এমন পত্রিকা বোঝাতে পারি, যাকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট একটা পাঠকশ্রেণি তৈরি হয় এবং দীর্ঘ যুগ পর্যন্ত যা পাঠকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যার নিজস্ব কিছু রুচি ও শ্রেণি থাকে। বাড়তি কিছু আবদার ও দাবি থাকে। যা পাঠক দ্বারা চালিত হয় না, বরং তার দ্বারাই পাঠক পরিচালিত হয়। মোটকথা যে পত্রিকাটি হয়ে থাকে নির্দিষ্ট লক্ষ ও উদ্দেশ্য-কেন্দ্রিক একটি আন্দোলন, একটি যুগ বিনির্মাণে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাকেই আমরা যুগস্রষ্টা পত্রিকা বলতে পারি।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ সম্পাদিত মাসিক আলকলম–পুষ্পকে ইসলামি ঘরানার জন্য একটি যুগস্রষ্টা পত্রিকা বলে আখ্যা দিলে অতিশয়োক্তি হবে বলে মনে হয় না।
আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগের কথা। ইসলামি ঘরানার সাহিত্য পত্রিকাই তখন ছিল হাতেগোনা, শিশুসাহিত্যের পত্রিকা তো ছিল না বললেই চলে। তখন বাংলাভাষায় আলেমসমাজের কিতাবাদি ছিল পর্যাপ্ত, কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, তাঁদের লেখা ধর্মচর্চার উপযোগী হলেও সাহিত্যচর্চার তেমন উপযোগী ছিল না। ফলে অনৈসলামি সাহিত্যের সংস্পর্শ ছাড়া বাংলা সাহিত্য চর্চার কোনো উপায় আমাদের হাতে ছিল না। আর তাদের কলমের সংস্পর্শে সাহিত্যের ছিটেফোঁটা হয়তো আসবে কিন্তু ঈমান ও বিশ্বাস এবং আখলাক ও চরিত্রের হবে সর্বনাশ। এই সর্বনাশা অবস্থার অবসানের লক্ষেই সাহিত্যসাধক মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ-এর সম্পাদনায় পুষ্পের আত্মপ্রকাশ ঘটে। যাতে মাদরাসা-শিক্ষার্থীরা ‘আলিম সাহিত্য’-কে অবলম্বন করেই অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ের সাহিত্যচর্চা করতে পারে।
আলেম ও তালিবুল ইলমের সমাজে মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ’র পরিচয় নতুন করে তুলে ধরার কিছু নেই। অল্পকথায় তাঁর পরিচয় হতে পারে একজন নীরব সাধক ও সংস্কারক হিসেবে। বাংলা সাহিত্যে যিনি সফলভাবে একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন। যেটাকে আমরা ‘মিছবাহি সাহিত্য’ বলতে পারি। তাঁরই সপল সম্পাদনায় ১লা জুমাদাল আখিরা ১৪২০ হিজরি (মুতাবেক আনুমানিক ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ)-এ পুষ্পের পথচলা শুরু হয়। প্রথম তিন সংখ্যা ছিল প্রস্তুতিমূলক। তারপর ১লা মহররম ১৪২১ হিজরি (আনুমানিক ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে নিয়মিত সংখ্যা প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকাটি প্রথমে মাসিক পুষ্প নামে প্রকাশিত হলেও বিশেষ কারণবশত দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে এর পোষাকি নাম দেওয়া হয় আলকলম, আর পুষ্প রাখা হয় ডাকনাম। তাই এখনও পত্রিকাটি পুষ্প নামে পরিচিত।
জুমাদাল আখিরা ১৪২০ হিজরি (আনুমানিক ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে শাবান ১৪২৩ হিজরি (আনুমানিক ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত তিন বছরে মোট ২২টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সময় ও সংখ্যার বিচারে যা খুবই অল্প। কিন্তু এ অল্প সময় ও সংখ্যাই শিশু-কিশোর ও নবীন মহলে যথেষ্ট সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিল।
পাঁচ বছর পর শাবান ১৪২৮ হিজরি মুতাবেক সেপ্টেম্বর ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় মাসিক আলকলম–পুষ্পের দ্বিতীয় প্রকাশনা। নতুন এই প্রকাশনার জন্য বিশেষ কোনো প্রচারণার ব্যবস্তা নেওয়া হয়নি তবুও পত্রিকার কাটতি ছিল আগের তুলনায় অনেক বেশি। পুষ্পের পাঠকপ্রিয়তা সম্বন্ধে এখান থেকেই খানিকটা আন্দাজ নেওয়া যায়।
এ পর্বে শাবান ১৪৩২ হিজরি মুতাবেক ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ২য় প্রকাশনার আরও ২০টি সংখ্যা প্রকাশ পায়। তারপর আবারও বিরতি। দীর্ঘ সাত বছরের! ইতিমধ্যে ১ম ও ২য় প্রকাশনার সংখ্যাগুলো ভিন্ন ভিন্ন মলাটে সমগ্র আকারে প্রকাশ পায়। এগুলোরও কাটতি আশাতীত। কারণ, পুষ্প তো অন্য দশটা বইয়ের মতো একবার পড়ে রেখে দেওয়ার বস্তু নয়। এটা তো চর্চা ও সাধনার জিনিস। পুষ্পসমগ্র ১ম প্রকাশনার ভূমিকায় সম্পাদক যেমনটা বলেছেন।
সাত বছরের দীর্ঘ বিরতির পর রবিউল আউয়াল ১৪৩৯ হিজরি মুতাবেক ডিসেম্বর ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নতুন আঙিকে ও বর্ধিত কলেবরে ৩য় প্রকাশনা শুরু হয়। ইতিমধ্যে ৩য় প্রকাশনার পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
পুষ্পের ১ম প্রকাশনার সংখ্যাগুলোর কলেবর যেমন ক্ষুদ্র ছিল অর্থমূল্যও তেমন অল্প ছিল। অর্থাৎ তিন থেকে সাত টাকা। ২য় প্রকাশনার কলেবরের পাশাপাশি অর্থমূল্যও বেড়ে হয় ১০ থেকে ১৫ টাকা। ৩য় প্রকাশনা আরও বর্ধিত কলেবরে এবং চাররঙা কাগজে প্রকাশ পেয়েছে ফলে এখন পর্যন্ত অর্থমূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০ টাকা। অন্যান্য পত্রিকা থেকে পুষ্পের অন্যতম ব্যতিক্রমী দিক হলো, শুরু থেকেই পত্রিকাটি বিজ্ঞাপনমুক্ত। ফলে এর পুরো খরচটাই বিতরণলব্ধ অর্থ থেকে বহন করা হয়। তবে ৩য় প্রকাশনার সংখ্যাগুলোতে অর্থমূল্য প্রসঙ্গে সম্পা;ক যে মন্তব্য করেছেন (যদি অর্থমূল্য ছাড়া বিতরণ করা সম্ভব হতো, খশি হতাম, হয়তো ভবিষ্যতে আল্লাহ সম্ভব করে দেবেন।) তাতে তাঁর উদারমনের প্রকাশ ঘটে। এমন বক্তব্যের পর ৫০ কেন, ১০০ টাকা দিতেও সঙ্কোচ হয় না।
২য় প্রকাশনার মাঝামাঝি সময়ে ওয়েবনাইট নির্মাণের মাধ্যমে পুষ্প এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল। এবার ৩য় প্রকাশনায় এসে বৈধতা শালীনতার সীমানায় থেকে প্রচ্ছদ এবং চিত্রে বৈচিত্র আনা হয়েছে। ফলে পত্রিকাটি আরও সুখপাঠ্য শিল্পমণ্ডিত হয়েছে।
সর্বশেষ প্রকাশনায় পাঠকের আদালতসহ নতুন কয়েকটি বিভাগ যুক্ত হয়েছে এবং সূচিপত্র সংযুক্ত হয়েছে বলে পত্রিকাটির উপকারিতা আরও বেড়ে গিয়েছে। ১ম প্রকাশনার বেশ কয়েকটি সংখ্যায় সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কিছু নাম দেওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে ঘরগুলো শূন্য রাখা হয়। ২য় প্রকাশনাার মাঝামাঝি এসে সম্পাদকের ঘরে লেখা হয় আবু তাহের মিছবাহ (ও পুষ্পের লেখকবন্ধুরা)। আর সহযোগী সম্পাদকের ঘরে প্রথম বেশকিছু সংখ্যায় লেখা হয় ‘(এখানে…)’। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে এসব ঘরে বিশেষ অবদানের ভিত্তিতে কিছু নবীন লেখকবন্ধুর নাম দেওয়াা হয়। ৩য় প্রকাশনায় এসে সহসম্পাদক হিসেবে সম্পাদকপুত্র মুহাম্মদ বিন মিছবাহ’র নাম দেওয়া হচ্ছে আর অতিথি সম্পাদক ঘরে আসছে কিছু নবীন লেখকবন্ধুর নাম। নিঃসন্দেহে এটি একটি সাহসী ও ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ। এতে করে নবীনরা উৎসাহ পায়।
এখানে একটি বিসয় খোলাসা করতে চাই, প্রায় প্রত্যেক সংখ্যায় সম্পাদক সাহেবের পুত্র-কন্যার লেখা স্থান পায় এবং সহসম্পাদক ও অতিথি সম্পাদকের ঘরেও তাদের নাম থাকে। এটাকে স্বজনপ্রীতি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। সত্যের অনুরোধে স্বীকার করতেই হবে যে, এটা বরং তাদের যোগ্যতা ও অবদানের প্রতিাদান।
পত্রিকাটি মাসিক হলেও এটা প্রকাশিত হয় দ্বিমাসিক/ত্রৈমাসিক পত্রিকার মতো। এজন্য অনেকের মনে নানা প্রশ্ন বা অনুযোগ তৈরি হয়। তবে যাঁরা পুষ্পের প্রকাশনা কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন বা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁদের মনে কোনো প্রশ্ন বা অনুযোগ থাকার কথা না। আর দশটা পত্রিকার মতো বিরাট কোনো কর্মযজ্ঞ নেই। ছোট্ট একটি কামরায় পিতা-পুত্র ¯্রফে দু’জনের প্রচেষ্টায় প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা কলেবরের পত্রিকাটি প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি কম্পোজ, প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জার কাজও তাঁরাই করছেন। সেই সঙ্গে মাদরাসার জিম্মাদারি তো আছেই। একমাস সময় তো তাঁদের জন্য নিতান্ত অল্প বৈ কিছু নয়। এদিকে বিশেষ রুচি ও মর্জির কারণে অন্য কাউকে দিয়ে প্রæফ দেখানোও সম্ভব হয় না। ফলে প্রতি সংখ্যায় কিছু মুদ্রণপ্রমাদ থেকে যায়। যা কারও জন্য হাসি আর কারও জন্য বিরক্তির উৎপাদক। তারপরও আল্লাহর শোকর যে, এত সংকট, সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকুলতার মধ্যেও আমাদের প্রিয় পুষ্প প্রকাশিত হচ্ছে এবং চারদিক সুবাসিত করছে আর সাধ্যমতো তার উন্নতিও ঘটছে।
আজকের আলেমসমাজের সাহিত্যানুরাগের পেছনে পুষ্প এবং পুষ্প-সম্পাদকের অবদান অনস্বীকার্য। সাহিত্যসাধনার পথে পুষ্প আমাদের রাহবার ও আলোর মিনার। তাই রাব্বে কারিমের দরবারে পুষ্প এবং তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্য উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধির দুআ করি।
লিখেছেন : মিরপুর, ঢাকা থেকে
সেপ্টেম্বর ২০১৮