তীব্র শীত। রাতের শেষ প্রহর। শহরের সব মানুষ ঘুমিয়ে আছে। উষ্ণতায় তপ্ত হচ্ছে কম্বলের নিচ। এই রাতে ছাত্রাবাসের সর্ব দক্ষিণে কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে থাকা একটা ছেলে উঠে দাঁড়াল। পাতলা কম্বলটা ভাঁজ করল ব্যস্ত হাতে। যেন খুব তাড়া তাঁর। দ্রæতপদে সবার সিট ডিঙিয়ে নেমে এল নিচে। বাইরে কুয়াশা। ছেলেটা মাদরাসার গেইটের দিকে একবার তাকাল। সন্তর্পণে নেমে ধীরে ধীরে বোর্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। ভেতরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কারও তো আসার কথা না! চুলা জ্বালানো।
দুই.
হাফেজ ইরফান আলি। নুরুল কোরআন হাফেজিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল। বর্তমানে তিনিই একমাত্র শিক্ষক এ মাদরাসার। সামনের মাসে আরেকজন হাফেজসাহেব আসার কথা। তাড়াতাড়ি এলে ভালোই হয়। এতগুলো ছাত্রকে হক আদায় করে পড়াতে পারছেন না তিনি। ক্লান্তি চলে আসে শরীরে। হাফেজ ইরফান আলির কষ্ট হয় প্রচুর। মাঝেমাঝে মনে হয় অন্যকিছু করলেও পারতেন। শুধু শুধু এই ছোট মাদরাসায় পড়ে না থাকলেই পারতেন। পরক্ষণেই আবার চিন্তা পাল্টান। ইদানীং খুব দ্বিধায় আছেন। তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখেন। নিজে আগে নামাজ পড়েন। রোনাজারি করেন দু’হাত তুলে। করুণাময়ের কাছে সবকিছুর সমাধান চান। তারপর ছাত্রদের জাগিয়ে তোলেন। কুরআনের পবিত্র ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। মুহূর্তেই চলে যায় সব ক্লান্তিক্লেদ। পালিয়ে যায় সকল ক্লান্তি। আজ অ্যলার্মরে আগেই জেগে উঠলেন। ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। দুইতলা মাদরাসা। নিচ তলায় অফিস রুম, বোর্ডিং, বায়তুল খলা আর অজুর স্থান। উপর তলায় ক্লাস রুম। এখানে সারাদিন কুরআনের রেওয়াজ চলে। ছাত্ররা খাবারের সময় খাবার খায় এখানেই। এখানেই রাতের বেলা সবাই ঘুমায়। ইরফান আলি মূলত জেগে উঠলেন কথার আওয়াজ শুনে। উচ্চস্বরে কথা বলছে কেউ। জেগে ওঠার পর নিশ্চিত হলেন একজন নয় দু’জন কথা বলছে। ঝগড়া করছে রীতিমতো।
ইরফান আলি ভয় পেলেন কিছুটা। উৎস খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলেন। মোবাইল স্ক্রিনে সময় দেখলেন। দুইটা পঁচিশ। পাঁচ মিনিট পর অ্যালার্ম বাজবে। ইরফান আলি দ্বিতীয় বারের মতো ভয় পেলেন। কথার আওয়াজ আসছে নিচতলা থেকে। আর গলার স্বর দু’টো পরিচিত। তার ছাত্র শোয়াইব আর হানিফের। ছেলেদু’টোর গলায় গলায় খাতির। সবসময় একসঙ্গে থাকে। সবকও এক সঙ্গে ওদের। দু’জন একসঙ্গে হিফজ শুরু করেছে। কিন্তু এতরাতে ওরা নিচে কেন? আর ঝগড়াও বা করছে কেন? ইরফান আলির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জন্ম নেয়। আল্লাহ আবার নতুন কোনো বিপদে না ফেলেন। ইরফান আলি দ্রæত নামেন সিঁড়ি দিয়ে। অফিস রুম পার হয়ে বোর্ডিং। বোর্ডিং থেকেই আসছে আওয়াজ। কানে আসে কয়েকটা উচ্চবাক্য–‘তুই আমার আগে আইলি কেন? তোরে বলছি আমার পরে আইবি। আজকে আমি আগে আসমু। কালকে তুই।’
‘তুই ঘুমাইতাছোস, তয় আমি কি করমু? আর আমি আগে আইলে সমস্যা কী? কাজ তো একই।’
‘না, তুই আগে আইতে পারবি না।’
ইরফান আলি দ্রুত সামনে এগিয়ে যান। বোর্ডিংয়ের সামনে এসে থামেন। তখনও ছাত্রদ্বয়ের চোখে পড়েননি তিনি। নিজেকে আড়াল করে শোনার চেষ্টা করেন ওদের কথাÑ‘তুই বেশি দোআ নিতে চাস হুজুরের?’
‘হুজুর কি জানব কে পানি গরম করসে? আমরা তো হুজুরের বাথরুমে রাইখা আসব। হুজুর তো জানবই না। দুআ করব কে¤েœ?’
‘তোর মাথায় কখনই বুদ্ধি-বিবেক হইব না। হুজুর না দেখলে কি হইসে, আল্লাহ তো দেখতেসে। আল্লাহ আমাদের উত্তম প্রতিদান দেবেন। তুই একটা ছাগল। কিছুই বুঝোস না।’
‘এত ঝগড়া করিস না তো। হুজুরের উঠার সময় হয়ে গেছে। পানি গরম হয়া গেছে। তাড়াতাড়ি নামা।’
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না ইরফান আলি। দ্রæত ফিরে আসলেন ওপরে। ওদের কিছুতেই বুঝতে দিতে চান না যে তিনি দেখে ফেলেছেন। ওপরে উঠতে উঠতে জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি। সারাজীবন এই মাদরাসার খেদমতেই কাটিয়ে দেবেন। আর কোথ্থাও যাবেন না।
জুন ২০১৮