২০০৯ সাল। আমি তখন হেদায়াতুননাহু পড়ি। সে বছর মালিবাগ জামিয়া শারইয়্যাহ’র ৩০ সালা দস্তারবন্দি উপলক্ষে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। জীবনের প্রথম এ রকম বর্ণাঢ্য ও আড়ম্বরপূর্ণ জলসায় শরিক হওয়ার অনুভ‚তিই ছিল আলাদা। দেশ-বিদেশের বুজুর্গ উলামায়ে কেরামের মুখনিসৃত গুরুত্বপূর্ণ নসিহত শুনে যারপরনাই উপকৃত হয়ে ফিরতি পথে বইয়ের স্টল থেকে দু’টো বইসহ চার পৃষ্ঠার একটা আরবি পত্রিকা কিনি। ‘রিসালাতুল আদাবিল আরাবি।’
পুরো পত্রিকার আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে বুঝতে বাকি রইল না যে, আরবদের প্রচলিত আরবি ভাষার দ্বার আমাদের সামনে উন্মুক্ত করে দেওয়ার সুন্দর ও ইতিবাচক একটা প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে এতে। যা যুগান্তকারী ও সময়ের দাবিও বটে। পত্রিকাটির রইসুত তাহরির (স¤পাদক) শায়খ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী, প্রধান প্রশিক্ষক, আল মারকাজুল ইসলামি, মুহাম্মদপুর, ঢাকা। এই প্রথম একজন আরবি ভাষার কিংবদন্তিকে চিনলাম, জানলাম। আল-লুগাতুল আরাবিয়্যাহ আল-মুআসারাহ সমসাময়িক আরবি ভাষা)-এর ওপর স্বতন্ত্র পাঠ ও সিলেবাস প্রণয়নে মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী’র আগে বাংলাদেশে আর কেউ উঠে আসেননি। মিডিয়াকেন্দ্রিক আরবি ভাষার পঠন-পাঠন ও চর্চা করার মূল থিওরিটা তাঁর হাত ধরেই কওমি অঙ্গনে আলো ফেলেছে।
আরবি ভাষার প্রতি আমার এক ধরনের ঝোঁক ও প্রবণতা ছিল আগে থেকেই। অভিপ্রায়ও ছিল, তাকমিল সমাপ্ত করে আরবি ভাষার ওপর স্বতন্ত্র পাঠ গ্রহণ করব। সে সুবাদে আমার আগ্রহটা আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। পাক্কা ইরাদাও করে ফেললামÑমাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী’র কাছেই আরবি ভাষার পাঠ গ্রহণ করব। তখন থেকেই তিনি আমার প্রিয় ও স্বপ্নের শিক্ষক হতে চললেন।
২০১৫ সালে আমার তাকমিল সমাপ্ত হলো। এখন আমার মাথায় একটাই পেরেশানি, আরবি ভাষার তাদরিব (প্রশিক্ষণ)-এর জন্য কী করে আল-মারকাজুল ইসলামিতে সুযোগ পাওয়া যায়। যেহেতু ওখানেই আমার প্রিয় শায়েখ প্রধান মুদাররিস হিসেবে দরস দিয়ে আসছেন প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। সে বছর রমজানের দু’দিন আগে বন্ধু মাসউদুর রহমান ফোন করে জানালেন, তিনি জামিয়া রাহমানিয়ায় যাচ্ছেন। কেন যাচ্ছেন জানতে চাইলে বললেন, ‘মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী সাহেব হুজুরের তত্ত¡াবধানে জামিয়া রাহমানিয়ায় বিশ দিন ব্যাপী আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত কোর্সের আয়োজন করেছেন আল-মারকাজুল ইসলামির আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের মুশরিফ (তত্ত¡াবধায়ক) মাওলানা আনওয়ারুল আযীম। শুনে আমি আর দেরি না করে মাসউদ ভাইয়ের সঙ্গী হয়ে ছুটে গেলাম রাহমানিয়ায়। আমাদের সঙ্গে তৃতীয় জন যুক্ত হলেন দেওবন্দ ফারেগ গোলাম রাজ্জাক আতীক।
বিশ দিনের এই সংক্ষিপ্ত কোর্স বেশ ফলপ্রসূ হলো আমাদের জন্য। আরবি ভাষার অজানা বিভিন্ন দিক আমাদের সামনে উন্মুক্ত হতে লাগল। বিশেষ করে আধুনিক ও সমসাময়িক আরবি ভাষা শেখা ও শেখানোর তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে লাগলাম। মেহনত ও মুজাহাদার মাধ্যমে এ ভাষাটাকে রপ্ত করার দুর্বার ইচ্ছা ও প্রেরণা জাগতে লাগল নিজের ভেতর। যে করেই হোক প্রিয় ভাষাটার আদ্যান্ত না জানলেই নয়।
বারী সাহেব হুজুরের মুখে তাঁর কষ্ট করে আরবি শেখার গল্প শুনে তো আমরা হতবাক! একজন মানুষের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হলো সেই সত্তর-আশির দশকেÑযখন এ দেশে আরবি শেখার তেমন কোনো সুযোগ ছিল নাÑতিনি আরবি ভাষার নাড়িভ‚ড়ি পরীক্ষা করে দেখেছেন! দাওরা ফারেগ একজন সাধারণ আলেমÑযিনি আরবি একটা ছোট্ট বাক্য বলা কিংবা লেখার যোগ্যতা রাখেন নাÑতিনি কিনা আজ আরবি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ যাদুকর! শুনেছি ফ্রেঞ্চ ভাষায়ও শায়েখের দক্ষতা ছিল অসামান্য।
কোর্স শেষ করে আল-মারকাজুল ইসলামিতে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে জানতে পারলাম শায়েখের তত্ত¡াবধানে মুহাম্মদপুরের বছিলায় ‘মারকায যায়েদ বিন সাবেত’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান হতে যাচ্ছে, যার মুদির (পরিচালক) হচ্ছেন মাওলানা আনওয়ারুল আযীম। আর প্রধান আদিব মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী। হাল-হাকিকত জেনে আমরা তিনজন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিÑরমজানের পর এই নতুন প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি হব ইনশাআল্লাহ!
রমজানের পর আমরা যথারীতি ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সফল হলাম। দাখেলা পেলাম ‘মারকায যায়েদ বিন সাবেত’-এ। এক বছর ‘আল-লুগাতুল আরাবিয়্যাহ আল মুআসারাহ’-এর ওপর মেহনত চালিয়ে যাওয়ার মোক্ষম একটা প্লাটফর্ম পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত আমাদের তনুমন। এ আনন্দ ‘মারকায যায়েদ বিন সাবেত’-এ ভর্তি হওয়ার কারণে নয়, বরং তা আরবি ভাষার একনিষ্ঠ সাধক, শ্রেষ্ঠ কারিগর, জীবন্ত মহিরুহ শায়েখ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারীকে পেয়ে। সপ্তাহে চার দিন শায়েখের দরস হতো। খুবই প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী ছিল শায়েখের তরিকুত তাদরিস (পাঠদান পদ্ধতি)। যারা তাঁর দরসে বসেছেন, তাঁরা উপভোগ করেছেন তিনি কতটা সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝাতে চেষ্টা করেন। প্রত্যেকটা পয়েন্ট বিস্তারিত খুলে খুলে আমাদের বুঝিয়েছেন। যেন সবাই আত্মস্থ করতে পারে খুব সহজেই, যেন কোনো প্রশ্ন না থাকে কারও।
দরসের ব্যাপারে তিনি খুব যতœশীল ছিলেন। সপ্তাহে চারদিনই তিনি আসতেন এবং সময়মতো আসতেন। বিষয়টা
আমাদের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হতো। কেননা শায়খ একজন সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। সৌদি দূতাবাসের আরবি-ইংরেজি বিষয়ক প্রধান অনুবাদকের দায়িত্ব পালন করতেন দৈনিক আট ঘন্টা। এই আট ঘন্টা সরকারি ডিউটি পালন করেও মানুষটা ক্লান্তিহীনভাবে শান্ত মেজাজে, হাসিখুশি ফুরফুরে মন নিয়ে মারকাজে এসে আমাদের দরস দিতেন। আসরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত চলত এ দরস। কোনো কোনো দিন বাদ মাগরিবও দরসে বসতে হতো। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ ধারাবাহিকতাই রক্ষা করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও তিনি সপ্তাহে দু-একদিন করে যেতেন।
শায়খের একটা বড় গুণ ছিলÑতিনি ছোট-বড় সবাইকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। ‘তুইতুকারি’ বা ‘তুমি-তোমরা’ সম্বোধনে কখনোই কথা বলতেন না। দরসের মধ্যে কোনোদিন শায়েখকে রাগ করে বা মাথা গরম করে কথা বলতে দেখিনি। একদিন এক সহপাঠীর ‘আল ওয়াজিবুল মানজিলি’ (হোম ওয়ার্ক) পুরা হয়নি, শায়খ একটু রাগতস্বরে তাকে জেরা করলেন, যাতে সে সংশোধন হয়ে যায় এবং অন্যরাও আরো যতœবান হয়।
কোনো সফলতার কাজের ক্ষেত্রে তিনি বহুবচনমূলক শব্দ ব্যবহার করে সবাইকে শামিল করতেন। যেমন বলতেনÑএটা আমাদের কাজ বা ওটা আমরা করেছি ইত্যাদি। অথচ কাজটি তিনি একাই করেছেন কারো সাহায্য নেওয়া ছাড়াই। এমনই মহানুভব হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় উস্তাদ ও শায়খ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী রহমতুল্লাহি আলায়হি।
এই যে চারদিকে তাঁর এত সুনাম-সুখ্যাতি, এত নাম-ডাক তবুও নিজেকে তিনি ছোটই ভাবতেন। বলতেন, ‘উস্তাদগণের নেক দোআর বরকতেই সামান্য কিছু শিখতে পেরেছি।’ প্রায় সময় তাঁর প্রিয় উস্তাদ শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহমতুল্লাহি আলায়হি’র নাম স্মরণ করে কাঁদতেন। মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ যখন কারাগারে ছিলেন তখন তিনি তাঁর বাসায় বাজার পৌঁছে দিতেন। দানের ক্ষেত্রেও তাঁর হাত ছিল উদার। উপার্জিত অর্থ থেকে একটা অংশ প্রতি মাসে তিনি তাঁর গরিব উস্তাদগণের বাড়িতে পাঠাতেন। চিঠি লিখে উস্তাদগণের সার্বিক খবরাখবর জানতেন আর দোআ নিতেন। আসাতিজায়ে কেরামের প্রতি তাঁর ভক্তি-শ্রদ্ধার দীপ্ত নমুনা ছিল এটা।
বছরের শেষ দিকে শায়খ শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী যেদিন দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন, খুব শান্তভাবে চুপিচুপি চলে গেলেন। কারণ, সব প্রতিষ্ঠানেই তাঁর দরস শেষ হয়ে গিয়েছিল আমরা বিদায় নিতে যাচ্ছিলাম ‘মারকায যায়েদ বিন সাবেত’ থেকে, তার আগেই তিনি চলে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে।
আল্লাহ তাআলা শায়খকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চাসন দ্বারা সম্মানিত করুন। আমিন।
জুন ২০১৮