আমাদের যুগের আকাবির খুঁজতে গেলে যার নামটি প্রথমেই চলে আসে, তিনি মোহতারাম তকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহু। আর সমকালীন ইনকিলাবের সূর্যপুরুষ খুঁজতে গেলে যার নুরানি চেহারাটা জ্বলজ্বল করে চোখের তারায়, তিনি জুনায়েদ জামশেদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। দু’জনই পাকিস্তানের নাগরিক। তকি উসমানি কলি থেকে পাপড়ি মেলে সুবাস ছড়াচ্ছেন সারা দুনিয়ায়। আর জুনায়েদ জামশেদ জীবনের মৌবনে গোলাপ হয়ে জায়গা করে নিয়েছেন অসংখ্য মানুষের হৃদয় কুটিরে। দু’জন দুই ধারায় প্রবাহিত হয়ে ছুটে চলছিলেন একই মোহনায়। সিরাতে মুসতাকিমের মহাসড়ক ধরে। উম্মতকে দেখাচ্ছিলেন হেদায়েতের পথ। ডাকছিলেন শান্তির নীড়ে। আহŸান করছিলেন মানবতার ধর্মে। দিক-নির্দেশনা এবং রাহবারি করছিলেন পুরো উম্মতের।
মানুষের দিলে-দেমাগে ইসলামকে ছড়িয়ে দিতে তকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহ লিখছেন অসংখ্য কিতাব। যার ফিরিস্তি সংক্ষেপে দিলেও বলতে হয়, এই মনীষী উর্দুতে রচনা করেছেন ১০৪টি, আরবিতে ৬টি, ইংরেজিতে ১৫টি, সম্পাদনায় ২টি এবং অনুবাদে ৪০টি অনবদ্য গ্রন্থ। সারা বিশ্বের ইসলাহি-ইলমি-ফেকহি নানা সংগঠনের দায়িত্ব পালন, অধ্যাপনা, দুনিয়ার মাশরিক থেকে মাগরিব শিমাল থেকে জুনুব সফর এবং পাশাপাশি এতো এতো কিতাব রচনা করে হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভি রাহিমাহুল্লাহদের সঠিক উত্তরসূরির দায়িত্ব পালন করছেন।
আর জুনায়েদ জামশেদ দীনের পথে ফিরে এসে তকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহদের সুহবতে থেকে দীনের একজন মুখলিস দায়িতে পরিণত হয়েছিলেন। দীনের দাওয়াত নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন সারা দুনিয়া। তার হাত ধরে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন কতো মানুষ। মিষ্টি সুরকে কাজে লাগিয়ে গেয়েছেন অসংখ্য হামদ-নাত। এমনকি তকি উসমানিও তাকে নাশিদ লিখে দিয়েছেন। ‘ইলাহি তেরি চৌকাঠ পর ভিখারি বনকে আয়া হো…’ তকি উসমানিরই লেখা একটা অনবদ্য নাশিদ।
বাদ্যবাজনার জীবন থেকে ফিরে আসার পর গান গাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছিলেন জুনায়েদ। তারপর তকি উসমানি একদিন তাকে খবর করলেন। তার হাতে তুলে দিলেন একটি চিরকুট। বললেনÑ আপনার কণ্ঠটি আল্লাহ তাআলার নেয়ামত। এর সদ্ব্যবহার হওয়া দরকার। এই গানটিতে সুর দিন, আর উম্মাতকে নবিপ্রেমে জাগিয়ে তুলুন। এরপরেই গেয়েছিলেনÑ ‘মিঠা মিঠা পেয়ারা পেয়ারা মেরে মুহাম্মাদ কা নাম…’ শিরোনামের কালজয়ী সেই নাত।
ইন্তেকালের আগের দিনও জুনায়েদের কথা হয়েছে তকি উসমানির সাথে। চিত্রাল থেকে ফোন করে জানিয়েছেনÑ ‘এখানকার মানুষদেরকে নিয়ে আমি একটি দোআ করতে চাই। যারা আমার সাথে আমিন আমিন বলবে।’
তাকদিরের কী লীলাখেলা! পরদিনই তকি উসমানি খবর পেলেন জুনায়েদ জামশেদ আর নেই! বিরহের দীর্ঘশ্বাসটা তখন কতোটা ভারী এবং ব্যথাতুর ছিলো তকি উসমানি মুহতারামের, কে জানে! তবে জুনায়েদের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা পুরো বিশ্ব দেখেছে সেদিন। নিজের সব ব্যস্ততাকে মুলতবি দিয়ে মিডিয়ায় বসেছিলেন তিনি। টানা আধঘণ্টা ধরে স্মৃতিচারণ করেছিলেন জুনায়েদ জামশেদকে নিয়ে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেনÑ ‘আমাদের দোস্ত এবং দীনি সাথী জুনায়েদ জামশেদের শাহাদতের খবর পেয়ে আমি ভারাক্রান্ত। আমার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মুহাব্বতের ভাইটির নামের শেষে আজ ‘রাহিমাহুল্লাহ’ বলতে হচ্ছে। তিনি তার কাক্সিক্ষত শাহাদাতের সুধা পান করেছেন। এই দুনিয়া থেকে একদিন সবাইকেই যেতে হবে। কিন্তু এমন মৃত্যু ক’জনের ভাগ্যে জুটে! কিছু মানুষের চলে যাওয়া হৃদয়কে নাড়া দেয়। জুনায়েদ ভাই তাদের একজন। পুরো উম্মাহ আজ তার জন্য কাঁদছে। তাকে আল্লাহ অনেক যোগ্যতা দিয়ে তৈরি করেছিলেন। তিনি নায়েবে নবির অনুপম দৃষ্টান্ত ছিলেন।
সবাই জানেন, তিনি সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। নাম-যশ-খ্যাতি-অর্থের অভাব ছিলো না। যখন সারা দুনিয়া তার গুণকীর্তন করছিলো, জাগতিক অঢেল ধন-দৌলত তার পায়ে এসে আছড়ে পড়ছিলো, তখন তিনি সব ছেড়ে তাবলিগের সুহবতে দীনের পথে চলে আসেন। খালেস লিওয়াজহিল্লাহ দীনের মেহনত শুরু করেন। আমেরিকা-আফ্রিকাতে তার হাতে অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ ‘যে ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে ইসলামের ছায়াতলে আনবে আল্লাহ তাকে লাল উটের চেয়েও দামি পুরস্কার দেবেন।’
জুনায়েদ ভাই উলামাদের সাথে খুব মহব্বত রাখতেন। আলেম ও হাফেজ হয়েছিলেন। তিনি নিজের জীবনকে উম্মাহর জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। দাওয়াতের মেহনতের মাধ্যমে আল্লাহ-রাসুলের পয়গাম মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেয়াই ছিলো তার জীবনের একমাত্র মাকসাদ।
জুনায়েদ ভাই ছিলেন সাহাবা-জীবনের বাস্তব নমুনা। তিনি ইসলামি সঙ্গীত গেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। আমার একটা হামদ ‘ইলাহি তেরি চৌকাঠ পর ভিখারি বনকে আয়া হো…’, যেটা আমি হেরেম শরিফে বসে গাইতাম, জুনায়েদ ভাই সেটি গেয়েছিলেন তার হৃদয় শীতল করা সুর দিয়ে। আজকাল বাচ্চাদের মুখেও শোনা যায় হামদটি। দোআ করি আল্লাহ জুনায়েদ ভাইকে জান্নাত দান করুন।’
শুধু তকি উসমানিই নয়, বিশ্বের ডান-বাম বহু স্কলার তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। সেদিন অনলাইন জগত ছিলো শোকে নীরব। সবার অনুভূতি ছিলো ব্যথাতুর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো অনেকেই। থেমে গিয়েছিলো শিল্পীর সুর। খেই হারিয়ে ফেলছিলো উপস্থাপকের উপস্থাপনা। মুষড়ে পড়েছিলো মুসলিম বিশ্ব।
আল্লাহ জান্নাতের মঞ্চায়নে জুনায়েদ জামশেদের হামদ-নাত শুনিয়ে আমাদের পুলকিত করুন। তার কবরকে রাওজাতুম মির রিয়াজিল জান্নাহ বানিয়ে দিন!
নবধ্বনি জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত