খুব বেশি আগের না। এই তো সেদিনের কথা বলি। আমরা এখন যারা তরুণ, টগবগে উদ্যম সময় পার করছি; আমাদের উচ্ছল ছেলেবেলা বা কৈশোরে আমরা পার করেছি নিষ্কলুষ নির্ঝঞ্জাট একটা সময়। কখনো মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো, কখনো বই পড়া, একসাথে মিলে আড্ডায় মেতে ওঠা এভাবে কেটেছে আমাদের সোনালী শৈশব। ফেসবুক কিংবা অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষবা®প আমরা তখনো টের পাই নি।
এরপর বড় হতে হতে অল্প ক বছরে অনেক বেশি বদলে গেল পৃথিবী। ফেসবুক নামের এক আশ্চর্য দৈত্য এলো পৃথিবীতে। তখনো ইন্টারনেট কি বুঝে না এমন মানুষও চিনে ফেলল ফেসবুক নামের এই দৈত্যকে। মহা বিস্ময় নিয়ে ধর্ণা দিতে লাগল এই দৈত্যের কাছে। আর আমাদের অজান্তেএই দৈত্য কেড়ে নিল আমাদের সুখ-শান্তি।
ফেসবুক ছাড়া সত্যি এখন কারও চলছে না। সত্যি বলতে দিন চালানো যাচ্ছে না। অবসরপ্রাপ্ত ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ তিনিও দেখছি একদিন ফেসবুকে একাউন্ট খুলে ফেলছেন। ফেসবুকে এখন সময় পার করছেন চুলে পাক ধরা পাশের বাড়ির দাদী। যিনি কিছুদিন আগে তার মেয়ের ঘরের নাতিনের বিয়ে দিয়েছেন নিজ হাতে। নিজ হাতে ভালো করে খেতে না জানা ছেলেটিও ফেসবুকে ছবি আপলোড দিতে ভুলে না।
এইটুক বক্তব্যের মাধ্যমে আমি প্রিয় পাঠকের বিরাগভাজন হব জানি। ফেসবুকের নানা ফযিলত এরমধ্যে তিনি আমাকে শোনানোর প্রস্তুতি নিবেন। সেসব আমি অবশ্যই স্বীকার করি। ফেসবুক আমাদের জীবনটা সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে সে কথা আমি মানি। সত্যি বলতে আমি নিজেও সে সুখের একজন ভাগীদার। তবে ফেসবুক কি নিয়ে গেল সে নিয়ে আজ কথা বলতে চাই। আজ পাঠকদের নিয়ে বিলাপ করতে চাই ফেসবুকের কারণে যা হারিয়েছি তার জন্য।
প্রাপ্তির কথা যদি স্বীকার করি তাহলে ফেসবুক আমাদের অনেক দিয়েছে। ফেসবুক আবিষ্কারের আগে এমন অভিনব চিন্তা মাথায় আসে নি কারও। সে হিসেব করলে জাকারবার্গকে প্রযুুক্তির পৃথিবীতে কিংবদন্তিই বলতে হবে। ফেসবুক নামের এই যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি একত্র করেছেন শত কোটি মানুষকে। সাধারণ মানুষের চিন্তা-ভাবনা মতামতকে সবার কাছে ছড়িয়ে দেয়ার সাথে সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ফেসবুক।
তবে ঘুণে খাওয়ার মত পৃথিবীব্যপী এক বড় বিপর্যয় সৃষ্টির জন্যও ফেসবুক দায়ী। শুধু ফেসবুক নয়, এর পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও দায়ী। তবে সবগুলোর চেয়ে ব্যবহারকারীর বেশি স্বাধীনতা ফেসবুকে। এজন্য ফেসবুকের ভাগটা এখানে বেশি।
আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে ফেসবুক জড়িয়ে গেছে। পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা, এমনকি শখের কাজগুলোর জন্যও আমরা ফেসবুক নির্ভর হয়ে পড়েছি। তাই ফেসবুককে দোষ দেয়ার কিছু নেই। অভিযোগের আংগুল নিজেদের দিকেই রাখতে হবে।
ফেসবুক কী বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তার একটা সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি এখানে তুলে ধরছি।
শুধু তরুণদের কথা বলি। কারণ সোশাল মিডিয়া ব্যবহারে তারাই বেশি এগিয়ে। বিশ থেকে বাইশ বছর বয়সী ফেসবুক ব্যবহার করে তরুণদের ওপর জরিপ চালিয়েছে বিএমসি নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাদের জরিপে দেখা গেছে, সারা বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ ফেসবুক ব্যবহারকারী পড়াশোনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের শিক্ষাগত দক্ষতা অনেক কমে গেছে ফেসবুকের প্রভাবে। শুধু মানসিকভাবেই নয়, শারিরীকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা ফেসবুক ব্যবহারের কারণে। চোখের সমস্যা দেখা গেছে ব্যবহারকারীদের পাঁচভাগের মধ্যে এক ভাগের। ১৯ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছে চোখের সমস্যায়। ১৬ শতাংশ মাথা ব্যথার সমস্যায় ভুগেছেন।
শারীরিক ক্ষতির চেয়ে মানসিক ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। মানসিক চাপ, ভালো বোধ করা, উদ্বেগ, হতাশা, বিষণœতা, নিদ্রাহীনতা, একাকিত্ব এবং হিংসা এসব ভয়ানক মানসিক বেড়েছে ব্যাপকহারে। মানষিক সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে উপলব্ধি করতে পারে না যে সে অসুস্থ। তাই এক্ষেত্রে জরিপ বা গবেষণা সঠিক ফলাফল দেয় না। অনেকের কাছে বিশেষ মানসিক সমস্যাগুলো গুরুত্বহীন মনে হয়। অথচ এসবে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। শিক্ষিত এবং ধনীদের মধ্যে এসবে আক্রান্তের পরিমাণ অনেক বেশি।
গবেষণাকারী এমন আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বলছে, ফেসবুক কেউ যত বেশি ব্যবহার করে তত বেশি তার মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। একটি প্রতিষ্ঠান বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে গিয়ে মানুষ আরও বেশি অসামাজিক হয়ে পড়ে। মানুষের সাথে মেশা, অন্যের সাথে ভাল ব্যবহার, মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং আবেগের ভারসাম্যতা কমে যায়।
এখানে আমি কিছু উদাহরণ দিতে চাই। মনে করুন কারও আÍীয় বা নিকটতম বন্ধুর কোনো স্বজন মারা গেল। স্বাভাবিকভাবে এখানে অন্যদের সরাসরি অংশগ্রহণ জরুরী। ইসলামও তাই বলে। কোনো মুসলিম মারা গেলে তার দাফন-কাফনে অংশ নেয়া অন্যতম কর্তব্য। শোকতপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সান্ত্বনা দেয়া একট বড় দায়িত্ব হয়ে পড়ে।
কিন্তু সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকে এই দায়িত্ব এড়িয়ে যান। কেউ ফেসবুকে দুই লাইন লিখে দায়িত্ব শেষ করেন। অথচ এই লেখায় শোকতপ্ত পরিবারের খুব বেশি লাভ হয় না।
কেউ হয়ত কাউকে অভিনন্দন জানিয়ে নানা প্রশংসার ফুলঝুরি লিখেন। অথচ বাস্তবে সেই মানুষটার কথা ভাবলে রাগে তাকে কিটমিট করতে দেখা যায়।
ফেসবুক ব্যবহার করে অনেক ভালো মানুষ এখন ভন্ড হয়ে যান। এটা হয়ত ফেসবুকের সবচে বড় নেতিবাচক দিক। অনেকেই ফেসবুকের মধ্যে সবার কাছে একটা ভিন্ন ইমেজ তৈরি করেন। প্রোফাইল দেখে মনে হবে মানুষটা খুব পড়ুয়া অথবা ধার্মিক। অথবা সমাজসেবী জনদরদী কেউ। অথচ বাস্তব জীবনে মূর্খ, দায়িত্বহীন এবং অলস একটা মানুষ।
ফেসবুকে লেখা কারও নীতিবাক্য এবং শেয়ার করা পোস্ট দেখে কাউকে মনে হবে মহাজ্ঞানী এবং চিন্তাশীল। এমন মানুষের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারাটাও সৌভাগ্যের। অথচ বাস্তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে তাকে নিয়ে তার পরিবার হতাশ। আরও খোঁজ নিলে দেখা যাবে সমাজ, জাতি ও দেশ নিয়ে চিন্তা করতে করতে তিনি নিজেকে নিয়ে চিন্তার সুযোগ পান না। তার ঘর এবং বিছানা এলোমেলো। গোসল না করার কারণে শরীরে পলেস্তরা জমে গেছে। হাস্যকর হলেও এমন মানুষ দেখেছি বলেই বলছি।
অনেকে ফেসবুকে দেখানোর জন্যই না কাজ করে থাকেন। জুম্মা মোবারক লিখে পোস্ট দিতে হবে বলেই জুমার নামাযে যেতে হয় কারো। ঘুরতে যাওয়া বা কোথাও খেতে যাওয়া এসব যেন ছবি তুলে সবাইকে দেখানোর জন্যই। কোনো কোনো দ¤পতি ফেসবুকে তাদের প্রেমের সাক্ষী নানা মূহুর্তের ছবি ও পোস্ট দিয়ে ভরে রাখেন। অথচ গড়ে দিনে একাধিকবার তাদের বাড়ি থেকে ঝগড়া এবং থালাবাটি ভাঙ্গার শব্দ পাওয়া যায়।
ফেসবুকের বিরুদ্ধে নানা কথা বললাম। তাই বলে ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে একথা কখনো বলা যায় না। মনে রাখতে হবে, জীবনের প্রয়োজনে ফেসবুক। ফেসবুকের প্রয়োজনে জীবন না। তাই সময়মত লাগাম টেনে ধরা দরকার। ফেসবুকের প্রোফাইল উন্নত না করে বাস্তব জীবনকে উন্নত করতে মনোযোগী হতে হবে সময় শেষ হওয়ার আগেই। আপনি নিজে উন্নত একজন মানুষ হলে সমাজে এমনিতেই উন্নত হবেন আপনি।
সোশাল মিডিয়া নিয়ে সচেতনতা ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। প্রযুক্তির বিস্ময় নিয়ে এখন আর পরীক্ষায় রচনা-প্রবন্ধ লিখতে হয় না। এখন লিখতে হয় প্রযুক্তির ক্ষতিকারক দিক বা ফেসবুক আসক্তি নিয়ে। মাত্র ক বছরেই পৃথিবী আবার উলটো ঘুরতে শুরু করেছে। যে স্মার্টফোনগুলো আমাদের সোশাল মিডিয়ার নেশায় বুঁদ হতে শিখিয়েছে সেগুলোই এখন ডিজিটাল ব্যলান্সিং ফিচার তৈরি করছে। এর মাধ্যমে কতক্ষণ সময় নষ্ট হলো তার হিসাব রাখা যায়। চাইলে স্মার্টফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণও করা যায়।
বুদ্ধিমানরা বিপদে পড়ার আগে সচেতন হয়। তরুণরা এখনই সচেতন না হলে, এখনকার শিশুদের প্রযুক্তি আসক্তি দূর করতে না পারলে খুব শীঘ্রই একটা ফাঁপা, অন্তসারশূন্য এবং ঘুণে ধরা প্রজন্ম গড়ে ওঠবে। মানবীয় বৈশিষ্টগুলো হারাবে সেই প্রজন্মের মানুষেরা। তাই সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে নবধ্বনির এ মাসের আয়োজন।