আমার ফেসবুক-আইডির বয়স দশ, আর বিয়ের বয়স মোটে দেড়। যখন আমার বিয়ে হয় ততদিনে আমি ফেসবুক-সেলেব। তবে বহুচর্চায় বিয়ে প্রসঙ্গ তখন আমার কাছে ডাল-ভাত। বাস্তব অভিজ্ঞতাটাই শুধু বাকি। বিয়ের মাসখানেকের মাথায় চোখে এবং চেখে দেখে সে অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল।
এরপর মনে হতে লাগল, বউয়ের চেয়ে ফেসবুকটাই বেশি যুবতী ও রূপবতী। প্রথমদেখার যেই বউ সেই থাকে, দিনে-দিনে তার কোনো রূপ গজায় না। কিন্তু ফেসবুকটা নতুন নতুন একেকটা পোস্ট-কমেন্টে নিত্য নতুন রূপে ধরা দেয়। তার যৌবনও ফুরোয় না।
আমার হয়েছে আরেক বিপত্তি। সে গ্রামের মেয়ে, ফেসবুক চেনে না। ফেসবুক-সেলেবের দাম সে কী বুঝবে! আমার দু লাইনের একেক পোস্টে হাজার হাজার লাইক-কমেন্ট পড়ে; ফ্রেন্ডলিস্ট পূর্ণ হওয়াতে রিকু ধরে ঝুলে ঝুলে কত শত জনের হাত ব্যথা হয়, অথচ নিজের ঘরের লোক ফেসবুকই চেনে না। উল্টো বলে কিনা, তার দিকে আমি নাকি আর আগের মতো তাকাই না! কী নতুন রূপটা গজিয়েছে তার যে, ঘটা করে দর্শন করতে হবে! নাকি বিয়ে করে নিজের স্বত্বটা তার কাছে বন্ধক রেখেছি! শুনলেই গা-টা জ্বলে যায়!
প্রথম প্রথম এই নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর হত। নয়টা-ছয়টা অফিস করে এসে একটু ফেসবুকিং করি, এ নিয়ে মাথা খারাপ করার কী আছে! শেষটায় ধৈর্য ধরতে না পেরে বসিয়ে দিলাম এক চড়। সেটা নিয়ে কান্নাকাটি আর বাপ-ভাই ডাকাডাকি করে কী এক বিশ্রী অবস্থা! আমিও তাদের বুঝিয়ে বললাম, এই দেখেন, লাখ টাকার ফ্ল্যাটে আপনাদের মেয়ে রানির হালে আছে। কী নেই তার! আর এমনও তো না যে, আমি অন্যকোনো মেয়ের সাথে কিছু করছি। তারপরও যদি গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় ঘ্যানর ঘ্যানর করে তাহলে কার না মেজাজ চড়ে, বলেন!
গ্রামের সহজ-সরল মানুষ। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজের তারা কী বুঝল কে জানে? তবে যাবার সময় মেয়েকে উপদেশ দিয়ে গেল—‘ঠিকই তো, এমন সোনার নাহান জামাই তোর চইদ্দ পুরুষের ভাইগ্য। এত সুক তোর বাহেও তো চউখ্যে দেহে নাই। কামের কালে জামাইরে ত্যইক্ত করবি না।’
তারপর থেকে সে একেবারেই নীরব, পারতপক্ষে আমার ছায়াটাও মাড়ায় না। শুধু খাওয়ার সময় খাবারটা দিয়ে যায়। নিজে হয়তো রান্নাঘরেই খেয়ে নেয়। আর ঘুমের সময় হলে চুপটি করে এসে ওপাশ ফিরে শুয়ে যায়। এতে বরং ভালোই হলো। নয়টা-ছয়টা করে এসে শান্তিমত একটু ফেসবুকিং করা যায়।
দেখতে দেখতে কবে যে বছরটা পার হয়ে গেল টেরটিও পেলাম না। ততদিনে সে প্রায় চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সঠিক মেয়াদটা জানতে চেয়ে লজ্জা দেবেন না। তখন অতসব মনে রাখার সময় কোথায়? ওদিকে নতুন ‘অতিথি’র জন্য সে দিনরাত একাকার করে কাঁথা সেঁলাই করছে, আরও কী কী যেন করছে।
তারপর একদিনের ঘটনা, দিনক্ষণটা এখনও আমার ঠিক ঠিক মনে আছে। দোসরা ডিসেম্বর, ২০১৯। অন্যান্য দিনের মতো অফিস করে এসে শাওয়ার নিয়ে আয়েশ করে বসেছি, ফেসবুকিং করব। নেট চালু করে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! আইডি হ্যাকড! এত দিনের এত সাধের আইডি, এত পোস্ট-লাইক-কমেন্ট, এত এত ফ্রেন্ড-ফ্যান-ফলোয়ার, সব হারিয়ে গেল! চোখে অন্ধকার দেখছি, ওদিকে সন্ধ্যেটাও নেমে এসেছে। অন্ধকারে মশার কামড়ে কতক্ষণ বসে ছিলাম মনে নেই।
হঠাৎ ডাইনিং রুম থেকে ধপাস করে একটা পতনধ্বনি। পরক্ষণেই ওর কাতর কণ্ঠ, ‘ওগো শুনছ, দয়া করে একটু আসবে?’ বলে কি পাগলী মেয়েটা, বিপদে পড়েছে সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য। তাই বলে দয়া ভিক্ষে করতে হবে। বুঝতে পারলাম, দিনে দিনে ব্যবধানের এক দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর দাঁড়িয়ে গিয়েছে আমাদের মাঝে।
গিয়ে দেখি সারা ঘর রক্তে সয়লাব। অশ্রু ধোয়া তার মুখখানা মনে হচ্ছিল যেন কোনো শিশির-ধোয়া পুষ্প। মনে করতে পারলাম না, খ্যাতির মোহে পড়ে, লাইক-কমেন্ট গুণে গুণে কতদিন হয় এই মুখশ্রী দেখার ফুরসত মেলেনি। আইডি হ্যাকের দুঃখবোধ আমার সব উধাও হয়ে গেল নিমিষেই। এই প্রথম মনে হলো, ফেসবুকবিহীন জীবনও সম্ভব।
(ফেসবুকটা তার সতীন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘সতীন’ হ্যাকের সুখ তার অনাগত সন্তান হারানোর শোককে ছাপিয়ে গিয়েছিল। আস্ত একটা পাগলী!)
নভেম্বর, ২০২০