আপন গল্প
বছর দশেক আগের কথা। আমার বয়স তখন আঠারোর কোটা পেরিয়ে উনিশ ছুঁই ছুঁই। দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। ভোটার হওয়ার জন্যে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। আবেদনের যোগ্য সকলই ফরম সংগ্রহ করে আবেদন করছেন। আমিও সকলের মতো ফরম সংগ্রহ করি। ফরমের সবগুলো কলাম ঠিকঠাক মতো পূরণ করে সংশ্লিষ্ট মাঠকর্মীর কাছে জমা দিই। মাঠকর্মী ভদ্রলোক ফরম খুলে কলামে কলামে চোখ বুলালেন। ফরমের শেষের দিকের ‘জাতীয়তা’ কলামটিতে আঙুল ধরে বললেন, ‘এটা ঠিক করে দিন। আপনার জাতীয়তা মুসলমান না; বাংলাদেশি।’
এই প্রথম জাতীয়তার প্রশ্নের মুখোমুখি হই। এবং জানতে পারি আমার জাতীয়তা মুসলমান না; বাংলাদেশি। কিন্তু এ জানাটা আমার কাছে যথেষ্ট মনে হলো না। ভেতরে আরও কতগুলো অজানাকে জানার কৌতুহল তৈরি হলো। সে কৌতুহল থেকেই একদিন জানতে পারলাম ÑÑ জাতীয়তা শুধু আমার ব্যকুল জিজ্ঞাসা নয়, শত মতের বিভাজন, বিতর্কের উপদান, একটি তাত্তি¡ক মতবাদ ও আত্মপরিচয়ের নিভৃত পাঠ। আরও জানতে পারলাম, জাতীয়তার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুও বহুবার বলেছিলেন ‘আমি মুসলমান’।
কেন বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ?
নির্যাতিত জাতি আত্মপরিচয়ের স্লোগানে জুলুমের বিরুদ্ধে সংহত হয়। যুদ্ধ করে। স্বাধীন হয়, মুক্তি পায়। মুক্তির জন্যে সংহতির প্রয়োজন। সংহতির জন্যে দরকার আত্মপরিচয়। আর আত্মপরিচয়ের জন্যে দরকার জাতীয়তার পাঠ। শুধু মুক্তি নয়, নিজেকে জানবার, জানাবার, বেড়ে উঠবার ও ঠিকে থাকবার জন্যেও দরকার জাতীয়তাবাদের পাঠ। এর বাইরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির মর্ম অনুধাবনেও জাতীয়তাবাদ পাঠের প্রয়োজন।
কোন আত্মপরিচয়ের ¯েøাগানে মানুষ সংহত হবে ÑÑ কালো-ধলো, বাঙালি-ইংরেজ, হিন্দু-মুসলিম, আরব-অনারব, এশিয়ান-ইউরোপয়িান? এ তাত্তি¡ক প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নের চেয়েও তাত্তি¡ক ÑÑ তার্কিক। এ তত্ত¡ ও তর্ককে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। জায়গা মতো আমরা সেই তর্কে জড়াবো; তত্তে¡ গড়াবো। তার আগে আপাতত শুধু এটুকু মনে রাখুন, ‘আমরা মানুষ’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা বাংলাদেশ নামক ভূখÐ পেয়েছি। এ ভূখÐের মানুষের জাতীয় পরিচয় একটি মৌলিক জিজ্ঞাসা। স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নেতৃত্বের কাছ থেকে এমন একটি মৌলিক জিজ্ঞাসার জবাব খোঁজাটা নেহায়েত জরুরি। বঙ্গবন্ধুও আমাদের জন্যে জবাব রেখে গেছেন। সে কারণেই বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের পাঠ।
জাতি ও জাতীয়তা
মানুষের দেহের আকার দেখেই বোঝা যায় সে মানুষ। হাজার সৃষ্টির ভীড়ে পরিচয়ের প্রশ্নে তাকে কখনও বলতে হয় না ‘আমি মানুষ’। যদিও মনুষ্যত্বের প্রশ্নে আমরা বুকে আঙুল ঠেকিয়ে প্রায়শ বলি, ‘আমি মানুষ’। পরিচয়ের মানুষ আর মনুষ্যত্বের মানুষ এক নয়। মনুষ্যত্বে কেউ ভালো, কেউ মন্দ। কেউ পরিপূর্ণ, কেউ অপরিপূর্ণ। পরিচয়ে কেউ কালো, কেউ ধলো। কেউ খাটো, কেউ লম্বা। কেউ বাঙালি, কেউ ইংরেজ। কেউ বাংলাদেশি, কেউ ভারতীয়। কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম।
দেশ, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার বিভাজনে আমাদের পরিচয়ের এ রকম একেকটি বিশেষায়িত রূপ একেকটি স্বতন্ত্র জাতকে নির্দেশ করে। এ রকম একজাতের কতগুলো এককের সমষ্টিতে হয় জাতি। আর জাতীয়তা হলো, সে জাতির পরিচয়ের বিশেষ্য।
মহান মনীষীদের সুমহান বয়ান ছাড়া কোনো কিছুর পরিচয় বুঝে এলেও গ্রহণযোগ্য হয় না। কেমন যেন অপূর্ণ মনে হয়। আর যদি মাথায় গবেষণার ভূতটা একবার চেপে বসে, তাহলে তো আর কথাই নেই; এক বিষয়ে একাধিক উদ্ধৃতি ছাড়া জীবনেও কোনো কিছু আর বুঝে আসবে না। সঙ্গত কারণে আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি, এখন থেকে কিছু উদ্ধৃতি হজম করতে হবে।
বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে জাতির অর্থ করা হয়েছে, সমলক্ষণ বিচারের শ্রেণিবিভাগকে। আর জাতীয়তার অর্থ করা হয়েছে, স্বজাতিচেতনা, স্বজাত্যবোধ ও স্বজাতিপ্রীতি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত এ ‘জাতি’ (ঘধঃরড়হ) পরিভাষাটিকে সংজ্ঞায়নে নানা মুনি নানা কথা বলেছেন। দ্য ওয়ার্ল্ড বুক অব অ্যানসাইক্লোপিডিয়ায় প্রদত্ত সংজ্ঞাটি প্রণিধানযোগ্য :
Nation is a large group of people united by a common language, ancestry, history, or culture. People often feel great loyalty to their nation and pride in their national characteristics অর্থাৎ, জাতি হচ্ছে সেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, যারা ভাষা, উত্তরাধিকার, ইতিহাস-ঐতিহ্য অথবা সাংস্কৃতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ। এবং জনগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের রাষ্ট্রের প্রতি চূড়ান্ত অনুগত ও তারা তাদের জাতীয় রাষ্ট্র নিয়ে গর্ববোধ করে।’ (দ্য ওয়ার্ল্ড বুক অব অ্যানসাইক্লোপিডিয়া, ভলিওম-১৪, পৃষ্ঠা-২৬)
উপরযুক্ত সংজ্ঞাটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ‘জাতি’ ধারণার আলোকে নির্মিত। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ‘জাতি’ ধারণার সঙ্গে রাজনৈতিক চেতনার সংযোগ ছিল না। তখন কেবল নির্দিষ্ট অঞ্চল বা ভূখÐের অধিবাসী একই জন্মধারাগত এমন জনগোষ্ঠীকে বুঝাতো, যারা তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে আপন পরিবেশে একটি আপন সমাজ গড়ে তুলত। ‘জাতি’ ধারণার এ অরাজনৈতিক সংস্করণকে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর রাজনৈতিক চেতনায় প্রগাঢ়ভাবে আচ্ছন্ন করা হয়। ডক্টর হাসান মোহাম্মদের দেওয়া জাতির পরিচয় থেকে যা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হাসান মোহাম্মদ বলেন, ‘ জাতি হচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত সেই কর্পোরেট সোসাইটি বা জনগোষ্ঠী যারা ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত সুনির্দিষ্ট টেরিটোরি বা আবাসভূমির বাসিন্দা। (ডক্টর হাসান মোহাম্মদ, জাতীয়তাবাদ : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা : ১২)
জাতীয়তাবাদের পরিচয়
জাতীয়তাবাদ দৃশ্যমান কোনও বস্তু বিশেষের নাম নয়; নিছক একটা অনুভব, অনুভূতি বা অদৃশ্যমান বোধের স্ফূরণ। অদৃশ্যমান এ অনুভব মানুষের আচরণে মায়ার মতো ছায়া ফেলে স্বজাত্যবোধের ফসল ফলায়। এ স্বজাত্যবোধ গড়ে ওঠে কেবল পারস্পরিক সমলক্ষণ বিচারে। এই যে সমলক্ষণ বিচারের স্বজাত্যবোধÑÑ এর নামই জাতীয়তাবাদ। আরেকটু খোলাসা করে বললে, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে জাতিভিত্তিক স্বজনপ্রীতি। আমরা যেমন আমাদের চারপাশের অসংখ্য বনি আদমের মধ্য থেকে কেবল নিজের আত্মীয়দের আত্মার বন্ধনে পরখ করি, ভালোবাসায় আগলে নিই, ঠিক তেমনিভাবে পৃথিবী নামক গ্রহে বসবাসকারী অসংখ্য জাতির মধ্য থেকে কেবল নিজের জাতির প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখানোর নামই জাতীয়তাবাদ।
আমেরিকান ঐতিহাসিক কার্লটন জোসেফ হান্টলি হেইস-এর দেওয়া জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাটি এমন : ‘জাতীয়তাবাদ হচ্ছে আধুনিক সময়ের একটি আবেগী ব্যাপার। যা দেশপ্রেম ও স্বজাতিচেতনায় উজ্জীবিত’।
(J.H. Hayes, essay an Nationalism, p.6)
একইভাবে প্রফেসর ¯েœাডার বলেন, ‘জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটা সুগঠিত ভূখÐের অধিবাসী জনগোষ্ঠীর মনের অবস্থা, আবেগ বা অনুভূতি। যারা কথা বলে একই ভাষায় এবং একই সংস্কৃতি লালন করে’। (সূত্র দেখতে ক্লিক করুন)
জাতীয়তাবাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা
সম্ভবত, যে দিন থেকে মানুষ ও মানুষের আবেগের জন্ম, ঠিক সে দিন থেকেই জাতীয়তাবোধের জন্ম। মানুষের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রঙ, ভূগোল, বর্ণ, গোত্র ও ভাষার বিভাজন বাড়তে শুরু করে। ফলে জাতীয়তাবোধ ক্রমশ তীব্রতর হয়। কিন্তু তখনও জাতীয়তাবোধ আজকের জাতীয়তাবাদের মতো স্বতন্ত্র মতবাদ হিসেবে রূপ নেয়নি। মানুষের জাতীয়তাবোধ পরিভাষাগত জাতীয়তাবাদে রূপ নেয় ১৭ শতকে ফরাসি বিপ্লবের পর। এর পর থেকে ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহাসিকদের মতে, জাতীয়তাবাদের সূচনা হয় ইউরোপে খ্রিষ্টীয় ১৭ শতকে এবং এর পরিপূর্ণ বিকাশ হয় ১৯ শতকের শেষের দিকে। বিকাশকাল ও তার পরবর্তী সময়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
জাতীয়তাবাদের উপাদান
জাতীয়তাবাদ উপাদাননির্ভর একটি ধারণা। সে উপাদানের ওপর ভর করে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে গিয়েও মাঝেমধ্যে বিপত্তি ঘটে। উপাদান নিয়ে আমাদের মারমুখো বিতর্কের মুখে জাতীয়তাবাদ কখনও মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু আমরা বাঙালিরা বা বাংলাদেশিরা তর্কে হারলেও মুখ থুবড়ে পড়ি না; গায়ের জোরে দাঁড়িয়ে যাই। যদিও জাতীয়তাবাদ তর্কে হারাবার বা গায়ের জোরে দাঁড়াবার বিষয় নয়; আপন বৈশিষ্ট্যবিচারে আত্মোপলব্ধির নীরব অবলম্বন মাত্র। তারপরেও আমাদের বিতর্কের আসরে বার বার ঘুরেফিরে আসে জাতীয়তাবাদের উপাদান–ভাষা, ভূখণ্ড, ধর্ম ও বর্ণ। কারও কাছে জাতীয়তাবাদের উপাদান ভাষা, কারও কাছে ভূখণ্ড, কারও কাছে ধর্ম, কারও কাছে বর্ণ। কেউ আবার এ চারটির দু’টিকে, কেউবা নির্বিশেষে সবক’টিকে জাতীয়তাবাদের উপাদান হিসেবে গণ্য করেন। আমরা নির্বিশেষে সবক’টিকেই জাতীয়তাবাদের উপাদান হিসেবে ধরে নেওয়ার পক্ষে। এ পক্ষপাতের পক্ষে যুক্তি আছে। আপনি পৃথিবীর যে অঞ্চলেরই বাসিন্দা হন না কেন, এ চারটি গুণাগুণ থেকে মুক্ত নন। আধুনিক বিশ্বের একজন নাগরিক হিসেবে আপনার যেমন একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড রয়েছে, তেমনি রয়েছে ভাষা, ধর্ম ও বর্ণ বা গায়ের রঙ। আপনি যদি অবিশ্বাসী নাগরিক হন, তবে ধর্মের গুণাগুণ অবশ্য আপনার জন্যে প্রযোজ্য নয়। এর বাইরে বাকি সবক’টি গুণাগুণ অবশ্যি অনিবার্য। তবে মনে রাখা দরকার, নিধর্মীরও ধর্ম আছে। সেটা প্রচলিত ধর্ম থেকে আলাদা–অবিশ্বাসের ধর্ম। গণনায় এ নিধর্মীদের সংখ্যা খুবই সামান্য। সঙ্গত কারণে আলাপের সুবিধার্থে আমাদের এই সামান্য পরিসরের আলোচনায় সামান্য সংখ্যক নিধর্মীদের আপাতত বাদ দিতে পারি। তার মানে, আমাদের কাছে জাতীয়তাবাদের উপাদানÑভাষা, ভূখণ্ড, ধর্ম ও বর্ণ–এ চারটি।
জাতীয়তাবাদের প্রকরণ
যদি বিতর্ক এড়িয়ে যাই, তাহলে জাতীয়তাবাদের প্রকরণের হিসেবটা একেবারে সহজ। একটু আগে আমরা জাতীয়তাবাদের উপাদান নির্ধারণ করে এসেছি। আমাদের নির্ধারিত উপাদানের আলোকে জাতীয়তাবাদকে চার প্রকারে ভাগ করতে পারিÑ ভাষিক জাতীয়তাবাদ, দৈশিক জাতীয়তাবাদ, বর্ণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ।
ভালোভাবে অনুধাবনের জন্যে প্রতিটি জাতীয়তাবাদকে পৃথকভাবে আলোচনা করা দরকার। প্রথমেই আসি ভাষিক জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে। এটা খুব সাধারণ কথা যে, পৃথিবীতে বসবাসকারী সব মানুষের মুখের ভাষা এক নয়। দেশ ও অঞ্চল ভেদে ভাষার তারতম্য হয়ে থাকে। এ তারতম্যের আলোকে প্রতিটি স্বতন্ত্র ভাষার অধিকারী ভাষাগোষ্ঠী নিজেদের ভাষার পরিচয়ে পরিচয় প্রদানের অধিকার রাখে। এভাবে ভাষার পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় প্রদানের বোধসম্পন্ন ভাষাগোষ্ঠীর পরিচয়বোধকেই বলে ভাষিক জাতীয়তাবাদ। যেমন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ফরাসি জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি।
একইভাবে ভূখÐ বা দেশের পরিচয়ে আত্মপরিচয়ের বোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর পরিচয়বোধকে বলে দৈশিক জাতীয়তাবাদ। উদাহরণত, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ। গায়ের রঙের পরিচয়বোধকে বলে বর্ণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ–শ্বেত জাতীয়তাবাদ, কৃষ্ণ জাতীয়তাবাদ। আর ধর্মের পরিচয়ে আত্মপরিচয়বোধকে বলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। যেমন মুসলিম জাতীয়তাবাদ বা ইহুদি জাতীয়তাবাদ।
জাতীয়তাবাদ নিয়ে যারা মাঠে-ময়দানে সরব, তারা সব জাতীয়তাবাদকে সরবে-নীরবে মানলেও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ব্যাপারে কঠোর। ধর্মকে তারা জাতীয়তাবাদের উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানে মারাত্মকভাবে অসম্মত। তাদের কাছে এ অসম্মতির অবশ্য একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। আমরা সে রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণে না গিয়ে শুধু এটুকু স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, কোনো কালেই জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত ছিল না। আধুনিক জাতীয়তাবাদের জন্মঘর খুদ ইউরোপেই জাতীয়তাবাদের উত্থান হয়েছিল ধর্মের প্রভাবের ভিত্তিতে। এবং জাতীয়তবাদের জন্মকালে সেটা খুব জোরেসুরেই হয়েছিল। গত শতকের খ্যাতিমান ঐতিহাসিক সালো উইটময়েয়ার ব্যারন জাতীয়তাবাদে ধর্মের প্রভাবকে একেবারে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। ব্যারন বলেন, ‘পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশে জাতীয়তাবাদীদের চিন্তা-চেতনায় শান দিয়েছিল ধর্মীয় মতবাদÑপ্রটেস্ট্যন্টইজম, ক্যাথলিসিজম, অর্থডক্স সিজারও-পাপলাইজম ও জুদাইজম। সেখানকার জাতীয়তদাবাদী মতবাদগুলো আচরণে যতই ধর্মনিরপেক্ষ হোক না কেন, তাদের গোড়া থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি ধর্মকে বাদ দিয়ে তাদের স্বরূপ উদঘাটনও মুশকিল।
বঙ্গবন্ধু একজনই
সেদিন ছিল ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। পৃথিবীর আরও দশটি শিশুর মতো গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় একটা ফুটফুটে শিশুর জন্ম হয়। সম্ভবত, শিশুটির বাবা শেখ লুৎফুর রহমান নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখেই সন্তানের নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। আরও দশটি শিশুর মতো জন্ম নেওয়া শেখ মুজিবুর রহমান একদিন আর শুধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকলেন না। শৈশব ও কৈশোরের মাঠ পেরোতে পেরোতে ভরা তারুণ্যদীপ্ত যৌবনে এসে অবতীর্ণ হন রাজনীতির মাঠে। আন্দোলন শুরু করেন জুলুম আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে; মানুষের অধিকারের পক্ষে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অজর্ন করে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের। শেখ মুজিবুর রহমান ভাবলেন, এবার হয়তো মানুষ তার অধিকার ফিরে পাবে। কিন্তু না, পাকিস্তান নামক স্বাধীন রাষ্ট্রে পূর্ব পাকিস্তান নামক অঞ্চলটি যেন ক্রমেই পরাধীন হতে লাগল। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে সদ্য স্বাধীন হওয়া পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান যেন পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন উপনিবেশ হতে শুরু করল। শেখ মুজিবুর রহমান তখন আবারও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ন্যায্য অধিকারের জন্যে আন্দোলন শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কঠিন ত্যাগ স্বীকার করেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ও বাংলার মানুষের প্রতি কঠোর ত্যাগ ও চূড়ান্ত ভালোবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ মুজিবুর রামান বঙ্গবন্ধু উপাধীতে ভূষিত হন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলার আপামর জনতার পক্ষ থেকে তাঁকে এ উপাধী প্রদান করেন বরেণ্য রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ। সেই থেকে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলার মানুষের জন্যে আন্দোলন করেছেন অনেকেই। ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠাও প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এমন উপাধী আর কেউ অর্জন করতে পারেননি। কী এক আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তায় তাঁকে এমন মহান করেছে! নতুন প্রজন্ম, পুরনো প্রজন্ম, সবার কাছে একই পরিচয়Ñবঙ্গবন্ধু; বঙ্গবন্ধু মানেই শেখ মুজিবুর রহমান। যেন অনন্তকালছোঁয়া ইতিহাসের অনাগত প্রজন্মের মুখেও শুনছি বঙ্গবন্ধু মানেই শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ
বাংলা ভাষা শুধু বাংলাদেশের মানুষের ভাষা নয়; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, শিলচর, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মানুষের ভাষাও। এই বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলগুলোর জনগোষ্ঠীর ভাষাগত পরিচয় বা জাতীয়তাবোধের নাম বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সামান্য আগে আমরা যে ভাষিক জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলাপ করেছি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সেই ভাষিক জাতীয়তাবাদের একটি বিশুদ্ধ উদাহরণ।
ঐতিহাসিকগণ বাংলা ভাষার ইতিহাসের শেকড় বিশ্লেষণে বাঙালি জাতিকে চার হাজার বছরের পুরনো জাতি হিসেবে উল্লেখ করেন। যদিও ইতিহাসের অন্যান্য বিতর্কের মতো বাংলাভাষার জন্ম ও বয়স নিয়ে সরব বিতর্ক রয়েছে। বাংলাভাষার জন্মের ইতিহাস যা-ই হোক, বাঙালির ভাষাগত জাতীয়তাবোধ ও আজকের বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস খুব বেশি আগের নয়। ইতিহাস বলে, ১৯০৫ সনে বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভাষাগত চেতনা ও জাতীয়তাবোধের প্রথম সম্মিলন ঘটে। তারপর দ্বিতীয়বার ৫২-এর ভাষাআন্দোলনে এবং তৃতীয়বার ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি চেতনার জাগরণ হয়। এভাবে বাংলা ভাষাগত জাতীয়তাবোধ ধীরে ধীরে আজকের বাঙালি জাতীয়তাবাদে রূপ নেয়।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ
জাতীয়তাবাদের প্রকরণ বর্ণনায় দৈশিক জাতীয়তাবাদের কথা উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ তার বাস্তব রূপায়ণ। বাংলাদেশে বসবাসকারী সবার মুখের ভাষা এক নয়। চাকমা, বিহারী, সাঁওতাল, মনিপুরী, হাজং ও ওঁরাউ সাদরির মতো বাংলাদেশের অধিবাসী ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে। ভাষার ভিন্নতা সত্বেও একই ভূখÐের অধিবাসী সবাই দেশপরিচয়ে বাংলাদেশি। এটা নির্র্দ্বিধায় বলতে পারি যে, দৈশিক জাতীয়তাবাদ একটা রাজনৈতিক সংস্করণ। দেশের আকার ও বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশরা পুরো ভারতবর্ষের সব জাতিকে ইন্ডিয়ান বলে আখ্যায়িত করত। ৪৭-এ স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়ানদের জাতীয়তা হলো ভারতীয় আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিকরা হলেন পাকিস্তানি। ৭১-এ বাংলাদেশ স্বধীন হয় এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতীয়তা প্রশ্নে বিতর্ক দেখা দেয়। অনেক ঘটনার পর সবশেষে ১৯৭৮ সনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান-বলে বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় বংলাদেশি নির্ধারণ করেন। এবং সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বিদায় করেন। এ সকল কারণে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তকও বলা হয়।
জাতীয়তাবাদ বিতর্ক : বাঙালি বনাম বাংলাদেশি
৭২-এর সংবিধানে জাতীয়তা বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা ছিলÑবাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলে পরিচিত হবেন। তার মানে, স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনাকালে নাগরিকদের জাতীয়তার প্রশ্নে কোনো বিতর্ক ছিল না। বিনা বিতর্কে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ছিল। ঐতিহাসিকদের বিবরণেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতীয়তা বাঙালি না বাংলাদেশিÑএ বিতর্কের প্রথম সূত্রপাত হয় ভারতের কতিপয় লেখকগোষ্ঠী ও পত্রপত্রিকার দ্বারা। ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক বসন্ত চট্্েরাপাধ্যায় ১৯৭৪ সনে ‘ওহংরফব ইধহমষধফবংয ঃড়ফধু: ধহ বুব-রিঃহবংং ধপপড়ঁহঃ’ গ্রন্থে বাংলাদেশের নাগরিকদের বাংলাদেশি জাতীয়তায় পরিচয় প্রদানের প্রস্তাব করেন। এরপর থেকে শুরু হয় জাতীয়তাবাদ বিতর্ক। পশ্চিমবঙ্গে রীতিমতো এ নিয়ে জোরেসুরে প্রচারণাও হয়েছে। বিশেষত, আনন্দবাজার পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সন্তোষ কুমার ঘোষ ও পশ্চিমবঙ্গের একটা লেখকগোষ্ঠী এ প্রচারণায় সরব ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের বাংলাদেশি জাতীয়তায় পরিচিত করবার পেছনে সন্তোষ কুমার ও বসন্ত চট্টোপাধ্যায়গণের রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল। তাঁরা ভাবছিলেন, বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি বাঙালি পরিচয় দেয়, তাহলে একদিন হয়তো পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মনে বাঙালি জাতীয়তাবোধ তীব্র হয়ে উঠবে। এবং এ জাতীয়তাবোধ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপিত হবে। তাঁরা এ প্রশ্নও ছুঁড়েছিলেন যে, বাংলাদেশের নাগরিকরা যদি নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দেয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পরিচয় কী হবে? (আমরা বাংলাদেশী ও বাঙালি। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনী। ফেব্রæয়ারি, ১৯৯৩)
পশ্চিমবঙ্গে এ প্রচারণা ও বাংলাদেশে নীরব বিতর্ক থাকা সত্বেও বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বহাল থাকে। আগে উল্লেখ করেছি, ১৯৭৮ সনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর জাতীয়তাবাদের বির্তক বাংলাদেশে ধীরে ধীরে নীরব থেকে সরব হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশি নাগরিকদের জাতীয়তা বাঙালি না বাংলাদেশিÑএ প্রশ্নের সমাধানে আসমানি কোনো ফরমান নেই। যা আছে কেবল যুক্তি-তর্ক। বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের যুক্তি হলোÑদেশ স্বাধীন হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের স্লোগান ছিল ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই প্রেরণায় এ দেশের মানুষ সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তাছাড়া, বাঙালির নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আমাদের জাতীয়তার পরিচয় হলে জাতিসত্তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। এবং ম্লান হয়ে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের যুক্তি হলোÑবাঙালি শুধু বাংলাদেশে নয়; ভারতেও আছে। অন্য দিকে বাংলাদেশের অধিবাসী সকল নাগরিকের ভাষা বাংলা নয়। বাংলাদেশের অধিবাসী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রত্যেকের স্ব-স্ব ভাষা রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ ভাষা থাকা সত্তে¡ও বাংলা ভাষার ভিত্তিতে তারা বাঙালি হবে কোন যুক্তিতে?
এ রকম অসংখ্য যুক্তি উভয় জাতীয়তাবাদীদের ঝুড়িতে বিদ্যমান। আমরা তাদের তর্কের সেই মারপ্যাঁচে না ঢুকে শুধু এটুকু বলবÑবাঙালি ও বাংলাদেশি উভয় জাতীয়তাবাদকে স্ব স্ব স্থানে রেখে বিচার করলে বিষয়টির সুন্দর সুরাহা হয়ে যায়। যেমনটা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য থেকে পাই। ধর্ম ও বর্ণের পরিচয় বাদ দিয়ে শুধু নৃ-তাত্তি¡ক দিক থেকে সত্তাগতভাবে আমরা বাঙালি জাতিসত্তার অধিকারী আর দেশপরিচয়ে বাংলাদেশি। আর সকল জাতিগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার জন্যে উদার জাতীয়তাবাদ দৈশিক জাতীয়তাবাদের বিকল্প নেই।
বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদ
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস লেখক ছিলেন না। দর্শন নিয়ে কোনও গ্রন্থও রচনা করেননি। তবুও তিনি দর্শনের জনক। মনুষ ও মানুষের জীবনঘনিষ্ট সব বিষয়ে কথা বলেছেন। দার্শনিক মতামত দিয়েছেন। আলাপ করেছেন একান্ত নিজের মতো করে। তাঁর কথা বলা, মতামত ও আলাপচারিতাকে শিষ্যরা গ্রন্থবদ্ধ করেছেন। এভাবেই তাঁর দর্শন বিশ^ব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে।
সক্রেটিসের প্রিয় শিষ্য প্লেটো বলেছিলেন, রাষ্ট্রনায়কদের জন্যে দার্শনিক হওয়া দরকার। দর্শন না বুঝলে রাষ্ট্রনায়কদের জন্যে রাষ্ট্র পরিচালনায় বিপদ আছে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিক ছিলেন। প্রথাগত দার্শনিক ছিলেন না। প্রথা নিয়ে প্রথার বাইরে কথা বলেননি, কথা এমন না। বঙ্গবন্ধু কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু রাজনীতির জন্যে যেমন খ্যাত, কথার জন্যেও তেমন। বঙ্গবন্ধুর আমলের লোকগুলো এখনও তাঁর কথার প্রশংসা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলে আম্মার কাছ থেকে প্রায়ই শুনিÑÑ ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, আয়ুব খানের শাসন’ কথাটি। বঙ্গবন্ধু শাসনের জন্যে খ্যাত ছিলেন, ভাষণের জন্যে বিখ্যাত।
বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তা ছিল। কর্মময় বিশাল রাজনৈতিক জীবনের ব্যস্ততায় তাঁর লেখার ফুরসত ছিল না। তবুও তিনি লিখেছেন। যা লিখেননি তা বলে গেছেন তাঁর অমর বক্তৃতামালায়। জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে তাঁর ভরাট কণ্ঠের গোছালো বক্তৃতায়। কীর্তিমান ইতিহাসবিদ ড. আকবর আলি খান বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য উদ্ধৃত করে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :
‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) দুই ধরনের বাঙালিতে বিশ্বাস করতেন : ‘আমাদের বাঙালি’ এবং ‘আমাদের নয় বাঙালি’। আমাদের বাঙালি অর্থাৎ পূর্ব বাংলার বাঙালিদের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, আমরা মুসলমান এবং আমরা বাঙালি, মানে বাংলা ভাষাভাষী। এ থেকে স্পষ্ট দেখা যায়, জাতির পিতা স্বয়ং মনে করতেন আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের দু’টি উপাদান রয়েছে। একটি হলো ধর্ম, আরেকটি হলো ভাষা’। (ড. আকবর আলি খান, প্রথম আলো, ২৬ শে মার্চ, ২০১৮)
একইভাবে জাতীয়তাবাদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আরও তিনটি বক্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য :
এক।
‘আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙালি জাতি, এ নিয়ে হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ থাকবে’। (১৯৭২ সালের ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণ)
দুই।
‘জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অসম মরণ-সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সাথে একটা জিনিস রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। অনেক দেশ আছে একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু, কিন্তু সেখানে বিভিন্নœ জাতি গড়ে উঠেছে, তারা একটি জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তাবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, এই সংগ্রাম হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ’। (গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রদত্ত ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরের ভাষণ)
তিন।
‘আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাব। আমার বাঙালি জাতকে অপমান করে যাব না। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’ (১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ)
জাতীয়তাবাদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাই। তিনি জাতীয়তাবাদকে একক উপাদানের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখেননি বা সঙ্কীর্ণ বৃত্তে আবদ্ধ করেননি। জাতীয়তাবাদকে তিনি দেখেছেন আত্মপরিচয় ও সংহতির মাধ্যম হিসেবে। নিজেকে বাঙালি আখ্যায়িত করে থেমে যাননি; একইসঙ্গে নিজের ধর্মপরিচয় মুসলমান এ কথাও দরাজ কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন। বাঙালিকে ভাগ করেছেন দুই ভাগেÑমুসলিম বাঙালি ও অমুসলিম বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের আশেপাশে থাকা যে সকল বুদ্ধিজীবি ধর্মকে জাতীয়তাবাদের উপাদান হিসেবে মেনে নিতে পারেননি বা মুসলিম জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার করেন, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ‘আমি মুসলমান’ কথার কী ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন, সেটা জানি না। তবে বঙ্গবন্ধু যে নৃ-তাত্তি¡ক বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে নিজের ধর্মীয় জাতিসত্তাগত পরিচয়কে বড় করে দেখতেন, তাঁর বক্তব্য সেটাই প্রমাণ করে।
শেষকথা
জাতীয়তাবাদ নিয়ে বাড়াবাড়ি ভালো নয়। বাড়াবাড়ির নাম উগ্রতা। হিটলারের পতন হয়েছিল উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে। হিটলার তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। এর বিপরীতে উদার জাতীয়তাবাদের কারণে বঙ্গবন্ধু আজও নন্দিত।
লেখক : প্রভাষক, সিলেট আইডিয়াল কলেজ
আগস্ট ২০১৮