ঘটনাটা ১৯৭৩ সালের। উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলায়হি তখন ছিলেন যাত্রাবাড়ি মাদরাসায়। বর্তমানে যে প্রতিষ্ঠানটি মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেবের তত্বাবধানে রয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরের কয়েকটি মাদরাসার অন্যতম একটি। লালবাগ, ফরিদাবাদ, বড় কাটারাসহ অধিকাংশ পুরনো মাদরাসা তখন বন্ধ ছিল। ’৭১-এ কিছু অনাকাক্সিক্ষত ভুলের কারণে পুরনো ঐতিহ্যবাহী মাদরাসাগুলোর কার্যক্রম স্থগিত রাখতে হয়েছিল। ৭১ সালের উত্তাল এপ্রিলের শুরুর দিকে পায়ে হেঁটে কাজী সাহেব হুজুর যশোর ঝুমঝুমপুর পৌঁছান। হুজুরের পরিবার পাকিস্তান-বিরোধী মনোভব লালন করার অপরাধে যশোর এ বøকে অবস্থানরত বিহারিরা একদিন তাঁর বাড়িতে হামলা করে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখছি, এই এ বøকেই মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী সে সময় অবস্থান করছিলেন। আমার বাবা ৭১ পরবর্তী সময়ে মাগুরা থেকে যশোর এলে বিহারিদের পরিত্যাক্ত এফ বøকে ভাড়া থাকতেন। শৈশবে আমিও পাকিস্তানিদের এই স্থানে বেড়ে উঠেছি। এ জন্য এখানকার খোঁজখবর কম-বেশ আমার জানা আছে।
নিজের বাড়ি-ঘরের দুরবস্থা দেখে কাজী সাহেব আবারও পায়ে হেঁটে মাগুরা যান। পথে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি উৎসাহিত করেত থাকেন। রাজাকার বাহিনীর লোকেরা হুজুরকে হত্যার জন্য যশোর-মাগুরা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে। এখানে সেখানে আত্মগোপন করে তাঁর কয়েক মাস অতিবাহিত হয়। এর ভেতর বাংলার সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের লেলিহান আগুন ছড়িয়ে পড়ে। যতদূর মনে পড়ে, হুজুর বলেছিলেন, জুলাই বা আগষ্ট মাসে হুজুর আবার ঢাকা আসেন। মাওলানা মুহিউদ্দিন খান হুজুরকে খবর দিয়েছিলেন। ঢাকা এসে খবর পান যাত্রাবাড়ি মাদরাসার সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব শাখারি বাজারের একটা মন্দিরে লাগিয়েছেন। মন্দির দখলের খবর পেয়ে কাজি সাহেব তৎক্ষণাৎ শাখারি বাজারে ছুটে যান। সেখানে হুজুরের কিছু ছাত্রকে দেখেন তেপায়া বিছিয়ে কুরআন শরিফ পড়ছে। হুজুর মন্দিরে ঢুকেই ছাত্রদের আদেশ করেন, ‘এই মুহূর্তে মন্দির থেকে বের হও। আমার মাদরাসার সাইনবোর্ড দিয়ে এই অপকর্ম!’ যাত্রাবাড়ি মাদরাসার সাইনবোর্ড খুলে সবাইকে নিয়ে যাত্রাবাড়ি ফেরেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হুজুরের সক্রিয়তা এবং পাকিস্তান বিরোধী মনোভাব তৎকালীন জাতীয় নেতাদের সবার জানা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন কাজী সাহেব। সেখানে আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদেরও দাওয়াত করেছিলেন। ৭২-এ বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন। একটা বছর বিভিন্ন শঙ্কা ও ত্রাসের ভেতর দিয়ে শেষ হয়। বড় বড় মাদরাসার গেটে তখনও তালা ঝুলছে। এভাবে চলতে থাকলে দীনি ইলম থেকে বঞ্চিত হবে পুরো জাতি, বঞ্চিত হবে পুরো দেশ। মাওলানা কাজী মুতাসিম বিল্লাহ খুব চিন্তিত হন। লোক মারফত ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে মাওলানা আসআদ মাদানি রহমতুল্লাহি আলায়হিকে সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করেন। দেওবন্দের মাওলানা আসআদ মাদানি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একটি পরিচিত নাম। নয় মাসের সংগ্রাম শেষে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনায় তাঁর রয়েছে অসামান্য অবদান। ভারতের তখনকার দিনে কংগ্রেস সরকার মুসলিম ভোট ব্যাংক হারানোর ভয়ে ভীত ছিল। তাই তারা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল। এই সময় মাওলানা আসআদ মাদানি দিল্লিতে লক্ষাধিক মুসলমানের সমাবেশ ঘটিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। ব্যক্তিগতভাবে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, বাঙালিরা মজলুম। তাদের সাহায্য করা ভারতের নৈতিক দায়িত্ব।
৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একটি বৈঠকে মিলিত হন ফেদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানি। কাজী সাহেবও ছিলেন সেখানে তাঁর আরও দুই সাথি নিয়ে। সিলেটের মাওলানা তাজাম্মুল আলি রহমতুল্লাহি আলায়হি ও কানাডা প্রবাসী জনাব সেলিম সাহেব। ফেদায়ে মিল্লাত বঙ্গবন্ধুকে মাদরাসা সম্পর্কে কথা বললে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘হজরত! এ-দেশের মৌলভিদের কথা আর বলবেন না; এরা যে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে…।’
ফেদায়ে মিল্লাত বঙ্গবন্ধুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাকে মৌলভিদের পক্ষ নেওয়ার জন্য বলছি না, যা বলছি তা আপনার স্বার্থের জন্য বলছি। সমস্ত মুসলিম বিশ্বে আপনার বদনাম হচ্ছে। আপনাকে ইসলাম বিদ্বেষী বলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এভাবে শত্রæরা আপনার বিরোধিতার সুযোগ পাচ্ছে।’
বঙ্গবন্ধু সমঝদার মানুষ ছিলেন। বৈঠকের পর সংশ্লিষ্ট সবাইকে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেন। ঢাকার লালবাগ, বড়কাটারা, ফরিদাবাদসহ বহু বন্ধ মাদরাসা নতুনভাবে খোলার পেছনের এই ইতিহাস আজ হয়তো অনেকেই জানেন না। ইতিহাসবিমুখ বাঙালির কত গুরুত্বপূর্ণ ঘটানাই যে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়, কে তার খবর রাখে?
৭৩ সালের পর দু’বছর ধানমন্ডি ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়িয়েছিলেন কাজী সাহেব রহমতুল্লাহি আলায়হি। কাজী সাহেবের পেছনে বঙ্গবন্ধু ঈদের নামাজ আদায় করেছেন। ৭৫ সালে সপরিবারে নিহত হবার কিছু দিন আগে আরেকবার গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। যাত্রাবাড়ি মাদরাসার জায়গা সংক্রান্ত কোনো একটা বিষয় নিয়ে। সঙ্গে মাওলানা তাজাম্মুল আলি রহমতুল্লাহি আলায়হিও ছিলেন। আলোচনা শেষে ফেরার সময় বঙ্গবন্ধু কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘হুজুর, আমার জন্য দুআ করবেন, যেন ঈমানের সঙ্গে মরতে পারি।’
একটা দুঃখের কথা দিয়েই নিবন্ধ শেষ করছি। পাকিস্তানে দলমত নির্বিশেষে জিন্নাহর মতো জাতীয় গাদ্দারকে কায়েদে আজম নামে স্মরণ করা হয়। ভারতের নেতৃবৃন্দÑসুভাষ, চিত্তরঞ্জন, গান্ধিজিকে যথাক্রমে নেতাজি, দেশবন্ধু এবং মহাত্মা নামে ডাকা হয়। আর আমরা বাঙ্গালিরা বঙ্গবন্ধু বিশেষণটি উচ্চারণ করতে সংকুচিত হয়ে যাই। যেন শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু বললে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে অথবা মুসলমান থাকতে পারব না। এর চেয়ে হীনম্মন্যতা পৃথিবীর আর কোনো জাতির ভেতরে আছে বলে আমার জানা নেই। নিজেকে বাংলাদেশি বলতেও অনেকের লজ্জা। বাংলায় কথা বলা বা বাংলায় লিখতেও কিছু মানুষের আজ পর্যন্ত সংকোচ। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত কবি সৈয়দ আব্দুল হাকিমের কাব্যাংশ দিয়ে লেখাটির ইতি টানছি―
‘যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’
আগস্ট ২০১৮