আমাদের মাদরাসায় সাপ্তাহিক সভার আয়োজন হতো প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলবেলা। হ্যান্ড রাইটিংয়ের মাধ্যমে একটি পোস্টার তৈরি করে নোটিশ বোর্ডে সেটি ঝুলানো হতো। পোস্টারে চলতি সপ্তাহের আলোচ্য বিষয় এবং বক্তাদের নাম উল্লেখ থাকতো। সভার আয়োজক ছিল ছাত্রসংসদ। একজন শিক্ষক সভাপতি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন আর দু’টি বিভাগে (ক ও খ) দু’টি বিষয়ের ওপর ছাত্রদের মধ্য থেকে নির্বাচিতরা আলোচনা করতেন।
কখনো কখনো এসব সভায় পুরনো কোনো শিক্ষক বা ফারেগিন ছাত্ররা এসে উপস্থিত হতেন। তারা ছাত্রদের উদ্দেশ্যে উপদেশমূলক কথাবার্তা বলতেন। একদিন একজন পুরনো শিক্ষক এসে হাজির হলেন। সভার শেষ দিকে তাঁকে নসিহতমূলক বক্তব্যের জন্য ডায়াস থেকে অনুরোধ করা হলো। বক্তব্যে তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন তা এখনো মাঝেমধ্যে আমার মনে পড়ে। তিনি ‘বক্তব্য কী দেবেন, কেন দেবেন’Ñএইসব নিয়ে নসিহত করছিলেন। আলোচনার ফাঁকে উদাহরণ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণটি নিয়ে এলেন। সেদিন থেকে আমি ভাবতে থাকি একটি ভাষণের কতটুকু শক্তি! ¯্রফে একটি ভাষণ যে কোনো সময় একটি বিপ্লবের সূচনা করতে পারে।
আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তখন ছিলো রেসকোর্স ময়দান। ৭১ সালের সাতই মার্চ বিকেলবেলা, নিপীড়িত জনপদের মানুষ সমবেত হলে রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় জনসমুদ্রে। মুক্তিকামী মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসে মঞ্চে দাঁড়ালেন। সফেদ-সাদা পাঞ্জাবির ওপর কালো কোর্ট জড়িয়ে নেতা হাত উঁচু করে তাঁর উপস্থিতি জানান দিলেন। ¯েøাগানে ¯েøাগানে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। নেতা তাঁর জনগণের চোখের ভাষা এবং তাদের বুকের ভেতরে পোষা যন্ত্রণা অনুভব করতে পারলেন। সেদিন, সেই ঐতিহাসিক বিকেলবেলা মুক্তির জন¯্রােতে নেতা ঘোষণা করলেন বাংলার স্বাধীনতার ইশতেহার।
শুরু হয় সংগ্রাম। জালিমের আঘাতের জবাবে শুরু হয় মজলুমের পাল্টা আঘাত। টানা নয় মাসের দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে নিপীড়িত জনপদে ফিরে এল শান্তি ও স্বাধীনতা। বিশ্বের মানুষ দেখল একটি ভাষণের কতখানি শক্তি। কতটুকু অনুপ্রেরণা দিতে পারে একজন নেতার সাহসী কণ্ঠস্বর।
সাতই মার্চের পটভূমি যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে দেখব ওই সময়ে এমন ভাষণ দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মতো ব্যাপার এতে ছিলো। কিন্তু সেই সময়ে যদি বঙ্গবন্ধু এমন ভাষণ না দিতেন তাহলে হয়তো কখনোই বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্যদোয় হতো না।
সে সময়, সেই সংকটময় মুহূর্তের জন্য সাতই মার্চের ভাষণটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিপৎসংকুল পথ পেরিয়ে মুক্তির মোহনায় ফেরার জন্য তা ছিল সুস্পষ্ট পথরেখা। ভাষণের মধ্যে যেমন নির্যাতিতদের জন্য ছিল সাহস যোগানো কথামালা তেমনি পাকিস্তানের শাসকদের জন্য ছিল এই জনপদের মানুষের দাবির কথা। বঙ্গবন্ধু সেদিন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের জন্যে ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক নিউজউইক তাঁকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।
১৯ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ এখন ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’। গত বছরের অক্টোবরে ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণকে ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ স্বীকৃতি প্রদান করে। যে ভাষণটি এতদিন কেবল বাঙালিদের নিজস্ব ইতিহাসে সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন বিশ্বের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।
টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকা হয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাকে মুক্ত করে নিয়ে আসাটা খুব সহজ কাজ ছিল না। বঙ্গবন্ধু সে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন নিজের নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা ও আপোসহীনতা দিয়ে।
আজ প্রায় অর্ধশত বছর পরে এসেও আমাদেরকে সেই ভাষণটি নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। একজন মানুষের আর কী সার্থকতা হতে পারে! একজন মানুষের আর কী সফলতা হতে পারে!
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই কিউবার সেই বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কথাটি মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি।’ কাস্ট্রো ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ মূল্যায়ন করেছেন।
ব্রিটেনের রাজা যখন মারা যান, তখন ব্রিটিশরা বলে ‘করহম রং ফবধফ, ষড়হম ষরাব ঃযব করহম.’ যার অর্থ হচ্ছে, রাজার মৃত্যু হয়েছে, রাজা দীর্ঘজীবী হোন। তার মানে মৃত্যুই শেষ কথা নয়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয় বাঙালিদের মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু তাঁকে মুছে নিয়ে যায়নি ইতিহাস থেকে। ঘাতকেরা হয়তো জানতো না কথাটা। বঙ্গবন্ধু এখনো বেঁচে আছেন। এখনো তাকে মানুষ ভালোবাসে, স্মরণ করে। আর যারা থাকে মুছে দিতে চেয়েছিলো মানুষ তাদের ধিক্কার করে। অভিশাপ দেয়।
বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবী হোন।
লেখক : প্রচ্ছদশিল্পী
আগস্ট ২০১৮