মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। বরেণ্য কথাশিল্পী। হেফাজত-আন্দোলনের সময় বিবিসির সংলাপে তাঁর বাগ্মিতা এবং প্রাজ্ঞতা বিস্মিত করেছিল সবাইকে। একসময়কার জনপ্রিয় দৈনিক আমার দেশ-এর বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন। দীর্ঘ একটা সময় কাজ করেছেন মাসিক আল-কাউসারের নির্বাহী সম্পাদক পদে। ২০১৭/১৮ সালের ওয়াজের মওসুম থেকে দেশের নানা জায়গার বড় বড় মাহফিলগুলোয় চমৎকার ভাষাশৈলিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছেন। ওয়াজ মাহফিলে তাঁর নতুন এ-অভিজ্ঞতা এবং মাহফিলের নানা দিক নিয়ে এক সন্ধ্যায় নবধ্বনির সহকারী সম্পাদক হামমাদ রাগিব জমিয়েছিলেন দীর্ঘ আলাপচারিতা। সে আলাপচারিতাই হামমাদ লিপিবদ্ধ করেছেন নবধ্বনির পাঠকদের জন্য। প্রচ্ছদ প্রতিবাদ্য হিসেবে নবধ্বনি, এপ্রিল ২০১৮ সংখ্যায় সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল।
হামমাদ রাগিব : আমরা আপনাকে একজন লেখক হিসেবে জানি, জানি লেখালেখিতেই আপনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, অবশ্যি বাগ্মিতার ক্ষেত্রেও আপনার স্বতন্ত্র একটা অবস্থান রয়েছে, যেটা আমরা বিভিন্ন টিভি-টকশো এবং সেমিনারে প্রত্যক্ষ করেছি, কিন্তু এই সব ছেড়ে-ছুঁড়ে এবার শীতের সিজনে আমরা আপনাকে আবিস্কার করলাম দেশের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠিত ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চে। মানে আপনি এখন রীতিমতো একজন ওয়ায়েজ! তো লেখালেখির মানুষ হয়ে কেন মাহফিল ধরলেন? এসবের জন্য তো লোকের অভাব নেই!
শরীফ মুহাম্মদ : আপনার প্রশ্ন সুন্দর। কিন্তু আমার কাছে এর খুব গোছানো উত্তর নেই। আসলে আমি লেখালেখি একদম ছেড়ে—ছুঁড়ে যে ওদিকে মনোযোগী হয়েছি, ব্যাপারটা এমন না…
হামমাদ রাগিব : ছেড়ে-ছুঁড়ে যাননি, স্থগিত তো করেছেন, কলম তো আপনার এই সিজনে বন্ধ…
শরীফ মুহাম্মদ : না না, স্থগিতও না। আমি আসলে লেখার ক্ষেত্রে একটু ধীর লয়ে চলার মানুষ। মাহফিলের ব্যস্ততায় লাগার পর (আসলে মাহফিল যে আমি খুব বেশি করেছি বা করছি, এমন না। অল্প প্রোগ্রাম রাখি। যাই হোক, তারপরও আমাকে এ বছর দেখা গেছে মাহফিলে এবং বেশ ঘন ঘনই দেখা গেছে আর এটাই বাস্তবতা।) মাহফিলের কারণেই যে আমি লিখছি না, ব্যাপারটা এমন না। আমি লিখি একটু সময় নিয়ে। একটু ভেবে ভেবে। অবিরাম লেখা আমার কখনোই হয় না। এখন তো মাহফিলের ব্যস্ততার জন্য আপনি আমাকে ধরছেন, কিন্তু মাহফিলের ব্যস্ততা ছাড়া অন্যান্য সময়েও এমন হয়, দেখা যায়, মাস পেরিয়ে গেছে আমি বিশেষ কিছুই লিখিনি। লিখতে পারিনি। লেখার আগে আমি প্রচুর পড়ি, ভাবি, সময় নিই। আর মাহফিলের ময়দানে পুরোপুরি যে নেমে গেছি, এমনও না। এখানে-ওখানে আলোচনা শুনে মানুষ আমাকে ডাকছে, দেশের নানা জায়গা থেকে অনুরোধ আসছে, আমি কেবল সেই ডাকে সাড়া দিচ্ছি। সবার ডাকে আবার সাড়াও দিতে পারি না। খুব অল্প অল্প প্রোগ্রাম রাখি। যেখানে যাওয়া দরকার মনে করি, বুঝি যে, ওখানকার মানুষজন আমার কথাগুলো নিতে পারবে ভালোভাবে বা আমার কিছু কথা বলার সুযোগ হবে, সেখানেই কেবল যাই।
তা ছাড়া, দাওয়াতের এই ক্ষেত্রটা আমার কাছে উপভোগেরও একটা বিষয়। এখানে সরাসরি সাধারণ মানুষের সাথে ভাব-বিনিময়ের সুযোগ হয়। মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায়। সাধারণ মানুষের হালচাল-চিন্তা-ভাবনা কিভাবে আবর্তিত হচ্ছে, একজন লেখককে তা জেনে রাখা জরুরি। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, এই ময়দানের কিছু অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। এখান থেকেও আমি কিছু প্রশিক্ষণ নিতে পারব।
লেখার মধ্য দিয়ে তো সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাওয়াই উদ্দেশ্যÑআমার একটা পাঠক-গোষ্ঠীÑযাদের সাথে কথা বলার ব্যাপার থাকেÑমাহফিলে যাওয়ার দ্বারা আমার এই কাজটাও হয়। আমার মাহফিলগুলোতে (‘আমার মাহফিল’ বলার সময় আসলে এখনও হয়নি আমার, এই অঙ্গনে আমি এখনও নতুন। তারপরও বোঝার জন্য বললাম।) আমার প্রচুর পাঠকের সাথে দেখা হয়। এটাও একটা কারণ। পাঠকের অনেক আবেগ-উচ্ছ¦াস, মতামত-ভিন্নমত সরাসরি শোনার সুযোগ হয়। ভালো লাগে।
মাহফিলগুলোতে যাওয়ার ব্যাপারে আমার আরেকটা জিনিসও কাজ করে, সেটা হলো, জায়গাগুলো দেখাÑদীনি বড় বড় মাদরাসা, বড় বড় মনীষীর কবর জিয়ারতÑএগুলো তো আসলে এমনি এমনি হয় না, সেই সুযোগ কিংবা সামর্থ তো আর সব সময় হয়ে ওঠে না, মাহফিলের ওসিলায় এই জিনিসটা হয়।
সর্বশেষ যে উত্তরটা দিতে পারি, আমাদের প্রচলিত এই ওয়াজ মাহফিলের ময়দানে এখনও কিন্তু প্রচুর যোগ্য লোকের অভাব। গুছিয়ে কথা বলার মতো লোকের অনেক প্রয়োজন এই ময়দানে। সেই দিক থেকে আসলে একটা তাকাজা এবং তাগাদা আমার ওপরও আসে। তাই, তরুণ যারা দু’কলম লিখতে চান, মানুষকে সুন্দরভাবে বলতে চান এবং সেই প্রস্তুতি নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলছেন, তাঁদের বলব, এই ময়দানেও আমাদের একটু হলেও সময় দেয়া দরকার। পুরোপুরি না পারেন, কিছুটা হলেও অন্তত সম্পৃক্ত রাখা প্রয়োজন।
হামমাদ রাগিব : কিন্তু এর পরও তো কথা থেকে যায়। আপনি যে ধারায় আছেন এবং ছিলেন, যে ধারায় কাজ করার কারণে আপনার আজকের এই পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা, এখানেও তো আপনার প্রচুর কাজ বাকি আছে অর্থাৎ এখানে আপনার প্রয়োজন প্রচণ্ড—তারপরও এখানকার অসম্পূর্ণ কাজ ফেলে নতুন আরেক ধারায় সংযুক্ত হয়ে যাওয়াটা…
শরীফ মুহাম্মদ : এটা আপনার মহব্বত থেকে উত্থাপিত একটা মত কিংবা অভিযোগ। লেখালেখির দৃষ্টিকোণ থেকে আমাকে যারা ভালোবাসেন, আমি জানি প্রত্যেকেই এই অভিযোগটা করবেন। আসলে দেখুন, এই অঙ্গনে, লেখালেখি বলুন আর মিডিয়া বলুন, এখানে আমার কাজ কতুটুকু বাকি, আর কতুটুকু কাজ আমি করতে পারব, সেটা আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। এসব মূলত আল্লাহর ফায়সালা। একটা মানুষ নিজেকে একটা কাজের জন্য প্রস্তুত করল, পরবর্তীতে দেখা গেল, নিজের অজান্তেই সে আরেকটা কাজের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। আমাদের অনেক মনীষীর বেলায়ও এমনটা হয়েছে। সবই আল্লাহ পাকের ইশারা।
যাই হোক, আমার যারা পাঠক এবং লেখকবন্ধু, আমি সাম্প্রতিক সময়ে লেখার ময়দান থেকে একটু দূরে, (আসলে দূরে নয়, সম্পৃক্তই আছি, বাহ্যত দূরে মনে হচ্ছে আর কি) এই দূরত্বের কারণে তাঁরা যে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন, এটাকে আমি সালাম জানাই। সাথে সাথে এটাও বলে রাখছি, মিডিয়ায় আমার আপাতত তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই, ব্যস্ততা চলে এলে ওই ধারার কাজ কমিয়ে অথবা প্রয়োজন হলে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণরূপে আবার মনোনিবেশ করব এই ধারায়। লেখালেখিই আমার মূল কাজ, এটাকে অবশ্যই আমি প্রাধান্য দিই এবং সামনেও দিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।
হামমাদ রাগিব : আচ্ছা, আপনি তো এখন পুরো দস্তুর ওয়ায়েজ, এতক্ষণের প্রশ্ন কেন আপনি ওয়ায়েজ হলেন, এই `খেদ’ থেকেই করলাম। আমাদের পাঠকদেরও যতটা জানি একই `খেদ’ কাজ করছে ভেতরে ভেতরে। এবার ওয়াজ মাহফিল নিয়ে কিছু আলাপ করতে চাই। রাতভর ওয়াজ মাহফিলের যে প্রথা আমাদের বর্তমান বাংলাদেশে প্রচলিত, এর সূচনা কবে থেকে এবং কিভাবে?
শরীফ মুহাম্মদ : রাতব্যাপী মাহফিলের কবে থেকে সূচনা আমি ঠিক বলতে পারছি না। তবে মাহফিলের জন্য রাতটাকে বেছে নেয়ার একটা কারণ আমি বলতে পারি। দিনের বেলা মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত থাকে, দিনশেষে সবাই যখন ব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়, তখন একটু অবসর সময় পায়। এই সময়টাতে মাহফিল করলে মাহফিল শোনার বা সেখানে সময় দেয়ার একটা সুযোগ পায় তারা। এ জন্য মূলত রাতের বেলা মাহফিল করা হয়। আর অধিকাংশ মাহফিলই এখন রাত ১০টা থেকে ১২টার ভেতর সমাপ্ত করে দেয়া হয়। কেবল প্রাচীন ঐতিহ্যের সাথে জড়িত কিছু মাহফিল ফজর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। এসব মাহফিলে পুরো রাতই প্যান্ডেল ভর্তি থাকে। মানুষ খুব আগ্রহভরে বয়ান শুনে। আমার এই বছরের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। সিলেটের গহরপুর জামিয়ার বার্ষিক মাহফিলে দাওয়াত ছিল। গেলাম। গহরপুর তো ঐতিহ্যবাহী একটা মাদরাসা। সেখানকার মাহফিলও খুব জমজমাট এবং প্রাচীন। রাত দুটোর পর আমাকে বয়ানে দেওয়া হলো। আমি ভেবেছিলাম এত রাতে শ্রোতা বোধহয় কমে যাবে। সুবহানাল্লাহ, মঞ্চে উঠে দেখি পুরো প্যান্ডেল তখনও লোকে লোকারণ্য। এবং সবাই সচেতন ও সজাগ অবস্থায় মাহফিল শুনছে মনোযোগের সাথে।
তো এটা একটা দিক আর কি, যেখানে মানুষ সজাগ থাকে এবং আগ্রহভরে ওয়াজ শুনে, সেখানে রাতব্যাপী মাহফিল চলতে পারে। তা না হলে রাত ১১টা ১২টার পর মাহফিলকে আর লম্বা করা আমার কাছে মনে হয় সমীচীন না। সমীচীন না এজন্য বললাম, গত ১৫-২০ বছরে আমি বিভিন্ন আকাবের মুরব্বির কাছে এই কথাটা বার বার শুনে এসেছি যে, গভীর রাত পর্যন্ত মাহফিল দীর্ঘায়িত না করা চাই।
হামমাদ রাগিব : বর্তমান সময়ের ওয়াজ মাহফিলগুলো কি আসলেই দীনের দাওয়াত, নাকি ওয়ায়েজদের টাকা উপার্জনের একটা পথ?
শরীফ মুহাম্মদ : হ্যাঁ, এটা খুব প্রাসঙ্গিক একটা প্রশ্ন। অনেকের মনে এই প্রশ্নের উদ্রেক হয়। আমি এই প্রশ্নের শুরুতেই আপনাকে জিজ্ঞেস করব, আপনি তো একটা দিক বললেন, যে, যারা যাচ্ছেন আলোচনা করতে, তাঁদের জন্য এটা উপার্জনের পথ কি না। কিন্তু যারা আয়োজন করছেন, তাদের সাথে এই কথাটা আপনি সংযুক্ত করবেন কিভাবে?
হামমাদ রাগিব : না না, আমি শুধু আলোচকদের কথাই জানতে চাইছি, তাঁদের জন্য ওয়াজ মাহফিল উপার্জনের পথ কি না?
শরীফ মুহাম্মদ : আলোচকদের ক্ষেত্রে আমি বলব, হয়তো মিশ্রিত অবস্থা আছে। বাকি, সব কথার পরও আমি সম্মান জানিয়ে বলব, নিছক টাকার জন্য সম্ভবত কেউই যান না। এটা বললাম আমার সুধারণা থেকে। আমার পরিচিত আলোচকদের ভেতর মাহফিলে উপস্থিত হবার ব্যাপারে যে তাড়না দেখতে পাই, সেখান থেকে আমার যেটা মনে হয়Ñনিছক টাকা উপার্জনের নিয়ত কারও থাকে না। আমার দেখা প্রায় সকল আলোচকই মাহফিলে একটা আবেগ নিয়ে যান, যান একটা তাড়না নিয়ে, কিছু কথা বলবেন, মানুষকে উজ্জীবিত করবেন। নিছক টাকা উপার্জনের নিয়ত থাকলে এই আবেগ কিংবা তাড়নাটা তাঁদের ভেতর কাজ করত না।
হ্যাঁ, একটা সম্মানী তাঁদের দেওয়া হয়। কোনো কোনো সময় এই সম্মানীটা শ্রমের তুলনায় কম হয়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে আমরা দেখি, তাঁকে অনেক মোটা অংকের সম্মানী দেওয়া হয়। এটা হতে পারে। কেউ কেউ এমনও থাকতে পারেন যে, তাঁর পদ্ধতিটা আরেকটু জটিল। চুক্তির মতো থাকে। একটা অংক ঠিক করে নিতে হয়। সেটাও বেশ বড় একটা অংক। এটাও হতে পারে। অস্বাভাবিক কিছু না। যখন একটা জিনিস দাঁড়াতে থাকে, একটা সংস্কৃতি, একটা নিয়মÑতখন এর মধ্যে পছন্দনীয়, হাল্কা অপছন্দনীয়, পুরো অপছন্দনীয়Ñবিভিন্ন ধারা থাকতে পারে। আমার মনে হয় ইতিবাচক ধারার মানুষ যদি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকেন এখানে, তাহলে এই অপছন্দনীয় কাজগুলো কমে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
হামমাদ রাগিব : অনেক বক্তাকে দেখা যায়, এক বছর একটা মাহফিলে গেছেন, আয়োজকরা তাঁর চাহিদা অনুযায়ী সম্মানী দেয়নি, পরের বছর সে মাহফিলের দাওয়াত আর তিনি রাখেন না। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
শরীফ মুহাম্মদ : এখানে অনেক কিছু বলার আছে। এমনটা যারা করছেন, তাঁদের সংখ্যা খুবই অল্প। এটাকে তেমন বড় করে দেখার কিছু নেই। তা ছাড়া এসবের তিক্ত অভিজ্ঞতাও আমার জানা আছে। আমার চেয়ে উঁচু স্তরের অনেক আলোচকের কাছে অনেক গল্প শুনেছি । বক্তা বা আলোচক যখন একটা মাহফিলে যান, আয়োজকদের দায়িত্ব হলো তাঁর গ্রহণযোগ্য একটা সম্মান এবং সম্মানী দেওয়া। আসলে, একজন আলোচক যখন পরবর্তী বছর একটা মাহফিলে যান না, শুধু সম্মানীর কারণে এটা করেন না, কারণ আরোও থাকে বলে মনে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বক্তার সম্মান এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রে আয়োজকদের প্রচুর ঘাটতি থাকে। আমি উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি। মনে করুন, একজন ব্যস্ত মানুষ, তাঁকে দাওয়াত দেওয়া হলো একটা মাহফিলে। সকালে তাঁর ক্লাস আছে। তিনি বললেন, আমার ক্লাস আছে, সম্ভব না। আয়োজকরা বলল, গাড়ি নিয়ে আসবেন, বাদ এশা ১ ঘণ্টা আলোচনা করে আপনি চলে যাবেন হুজুর, কোনো সমস্যা নেই। মাহফিলের দিন তাঁর নির্ধারিত সময়ের আগে তিনি গেলেন। দেখা গেল, কিসের বাদ এশা, রাত ১টার পর ওঠানো হলো তাঁকে মঞ্চে। পরবর্তী আচরণগুলো অনেক সময় এতোটাই রূঢ় হয় যে, এইসব কারণে অনেক বক্তা পরবর্তী বছর সেখানে আর মাহফিল রাখতে রাজি হন না। আর সম্মানীরও অনেক যৌক্তিক দিক আছে। আমার কাছে এর বাস্তব উদাহরণ আছে। এমনও হয়েছে যে, একজন আলোচক গাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়েছেন। তাঁর খুব যৌক্তিক খরচ হয়েছে ৫ হাজার টাকা। খুব এখলাসের সঙ্গে তাঁকে সম্মানী দেওয়া হলো ৩ হাজার টাকা। অথচ তিনি অসুস্থ মানুষ, ইতোপূর্বে তাঁকে বলা হয়েছে আপনি গাড়ি নিয়ে চলে আসুন হুজুর, তারপরও মাহফিলে আসুন। গল্পটা আমার উপরের স্তরের এক আলোচকের। শুনে খুব খারাপ লাগল। এই জায়গা থেকে যদি পরবর্তী বছর সেই আলোচককে দাওয়াত দেওয়া হয়, তা হলে তাঁর জন্য সেই প্রোগ্রাম রাখাটা একটু মুশকিল হবারই কথা।
হামমাদ রাগিব : তা হলে এটা কি এখলাসের পরিপন্থী হলো না? তিনি তো যাবেন মানুষকে হেদায়েতের বাণী শোনাবার নিয়তে…
শরীফ মুহাম্মদ : না, আমি এভাবে বলব না। আপনি দুই দিক থেকে দেখুন ব্যাপারটা। যারা আলোচককে ঠিক মতো কদর করতে জানে না, মূল্যায়ন করতে জানে না, তারা আবার তাঁকে ডাকবেন, তিনিও সে ডাকে বার বার সাড়া দেবেনÑএই প্রত্যাশাটা আমরা একজন আলোচকের কাছে করতে পারি না। এটা শুধু তাঁর জীবন-জীবিকার জন্যও না, তাঁর জরুরতের জন্যও না। সবাই ব্যাপক বিত্তবান না যে, তিনি বলবেন, ঠিকাছে, ঘাটতি পুষিয়ে আমি সেখানে যাব, আমার পকেট থেকে টাকা দিয়ে দেব। আলোচকদের মধ্যে এমন অনেক আছেন যে, ভাবেন, যারা মাহফিল আয়োজন করেছে, আমি কিভাবে যাই, আমার সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা কতুটুকুÑসব জেনেই আমাকে দাওয়াত দিয়েছে। ব্যাস, কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু যাওয়ার পর যখন দেখতে পান সবকিছু তাঁর ভাবনার বিপরীত, তখন কিছুটা খারাপ লাগতেই পারে। অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধায়ও পড়তে হয়। এ জন্য আয়োজকরা যদি আগ থেকে বলে রাখেন, হুজুর, আমাদের অবস্থা এই, আমরা আপনাকে চাহিদা মাফিক কদর করতে পারব না, কিন্তু আপনাকে আমাদের খুব প্রয়োজন, তখন আলোচকরা নিজেদের তাওফিক এবং সামর্থে কুলালে সেখানে গেলেন আর তাওফিকে না কুলালে বলে দিলেন, যেতে পারব না। ব্যাস। তখন আর কাউকেই হয়রানির ভেতর পড়তে হলো না।
এই ব্যাপারটা হলে খুব সুন্দর হত। তখন আর কোনো রকম সমালোচনার সৃষ্টি হত না। আমার কাছের অনেক মুরব্বি এবং বন্ধুবর আলোচকদের ব্যাপারে এমনটা ঘটেÑআয়োজকরা যদি আগ থেকে তাঁদের সীমাবদ্ধতার কথা বলে রাখেন, তবে সেখানে আলোচনার জন্য তাঁরা ওই রকম প্রস্তুতি নিয়েই যান।
আয়োজকদের কেউ কেউ সাধারণত এটা করেন না। দাওয়াত দেওয়ার সময় খুব আগ্রহ নিয়ে দাওয়াত দেন। খুব কদর করেন। কিন্তু মাহফিলে যাওয়ার পর দেখা যায় পার্শ্ব আলোচককে নিয়ম মাফিক কদর করা হচ্ছে, উপযুক্ত সম্মানী দেওয়া হচ্ছে, আর তাঁর প্রতি কোনো ভ্রæক্ষেপই নেই। তিনি এতে কষ্ট পেতেই পারেন। এই কষ্ট থেকে পরবর্তী বছর এখানে প্রোগ্রাম না রাখাটা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অযৌক্তিক কিছু না। এটাকে আমি দোষের কিছু মনে করি না।
হামমাদ রাগিব : আয়োজকদের এই অসচেতনতা বা অবজ্ঞা, যেটাই বলুন, তা দূর করা যায় কিভাবে?
শরীফ মুহাম্মদ : হ্যাঁ, এই ক্ষেত্রে আয়োজক ভাইদের আমি বলব, নিজের সামর্থ অনুযায়ী মাহফিলের আয়োজন করুন। যে আলোচকের পেছনে বিশ হাজার তিরিশ হাজার টাকা খরচ হয়, সামর্থ না থাকলে কেন আপনি তাঁকে দাওয়াত করতে যাবেন? এখন তো বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় যোগ্য আলোচক রয়েছেন, আপনি নিজ জেলার ভালো আলোচককে দাওয়াত দিন। সামর্থ নেই, অযথা কেন রাজধানী কিংবা দূরের আলোচককে দাওয়াত দেবেন? সুতরাং নিজ জেলার ভালো আলোচককে আনুন, যাকে আপনি কদর করতে পারবেন সামর্থ অনুযায়ী। এতে আলোচকেরও কষ্ট হলো না, আপনিও স্বাচ্ছন্দ্যমতো মাহফিল করতে পারলেন।
হামমাদ রাগিব : নির্ধারিত জায়গার বাইরে মাইক লাগানোর ফলে যে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয় এবং যারা মাহফিলে আসেনি তাদের কষ্ট হয়Ñ সেটাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
শরীফ মুহাম্মদ : গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কথাটাকে আমি একটু ভাগ করে বলি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলগুলোতে যে মাহফিল হয় সেখানকার চিত্রটা হলো এমন—শহরের মতো সেখানে ঘনবসতি থাকে না, দূরে দূরে মাইক সেট করলেও কোনো সমস্যা হয় না। তা ছাড়া মানুষেরও একটা আগ্রহ থাকে, মাহফিল ঘিরে আলাদা একটা আবেগ কাজ করে। বাড়িতে বসে বসে অনেকে মাহফিল শুনতে থাকে। তাই, সবাই চায়, বেশি করে মাইক লাগানো হোক। এসব কারণে গ্রামাঞ্চলের মাহফিলগুলোতে শব্দদূষণ কিংবা মাইকের আওয়াজ মানুষের কষ্টের কারণ হওয়ার ব্যাপারগুলো থাকে না। সমস্যা হয় শহরের মাহফিলগুলোতে। এখানে ঘনবসতি হবার কারণে শব্দদূষণের সৃষ্টি হয় এবং তা অনেক মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কারো বাসার ছাদে, কারো বাসার জানালার পাশে মাইক বাঁধা হয়। এতে বাসাওয়ালাদের প্রচÐ কষ্ট হয়। এমনকি অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষও এতে বিরক্তিবোধ করেন। এবং এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আমি প্রস্তাব করব, শহরের মাহফিলগুলো খুব গভীর রাত পর্যন্ত দীর্ঘায়িত না করা। এবং প্যান্ডালের বাইরে বেশি দূরে মাইক না লাগানো। আল্লামা তকি উসমানি দা. বা. তাঁর ‘জিকর ও ফিকির’ নামক কিতাবে মাইকের অপব্যবহার সম্পর্কে একটি অধ্যায় লিখেছেন। সেখানে তিনি ওয়াজ মাহফিলের মতো ইতিবাচক বিষয়গুলোতে লাউডস্পিকার বা মাইকের অপব্যবহার বা অধিক ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করেছেন। এবং এটা যে একটা জুলুমের পর্যায়ে পড়ে সে ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছেন।
বক্তারা কিন্তু বহিরাগত। তাঁরা সেখানকার সব বিষয়ে জানেনও না, সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতিও বুঝেন না। এই সমস্যার জন্য আয়োজকদের খেয়াল রাখা উচিত। বরং খেয়াল রাখাটা খুব জরুরি।
হামমাদ রাগিব : প্যান্ডালের বাইরে যে মাইক টানানো হয় সেটার ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করে প্যান্ডালের ভেতর কয়েকটা স্পিকার বক্স রাখলেই তো যথেষ্ট। বাইরে মাইক টানানোর তো কোনো জরুরতই নেই। শুধু শুধু শব্দদূষণ আর মানুষকে বিরক্ত করা। বিরক্তই বললাম শব্দটা, কারণ আজকাল এতো বেশি মাহফিল হয়, হাটবাজারে কিংবা দোকানে বসে মানুষ কতটা মাহফিল শুনবে? মাইকের বদলে স্পিকার-বক্স রাখলে কেবল মাহফিলের সীমানার ভেতর আওয়াজটা সীমাবদ্ধ থাকল। এতে জরুরতও পূরণ হলো শব্দদূষণ থেকেও বাঁচা গেল। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
শরীফ মুহাম্মদ : না, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আমি পেশ করতে পারছি না। এটা যারা যোগ্য, যারা মাইক বা এ ধরনের ইলেক্ট্রনিক ব্যাপারে অভিজ্ঞ, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে করা যেতে পারে। আমি শুধু একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। এবার ইজতেমায় যাওয়ার পর সেখানে দেখেছি মেহমানদের কামরায় কামরায় ছোট ছোট বক্সের মতো আছে, ওটা অন করলে একটা রেডিও একটু জোর সাউন্ডে বাজালে যতটুকু আওয়াজ হয় ততটুকু আওয়াজ আসে। এই প্রক্রিয়াটা চমৎকার। আমাদের মাহফিলগুলোতে এ রকম করা যেতে পারে।
হামমাদ রাগিব : যাই হোক, শব্দদূষণের এ ব্যাপারটা আসলেই খুব স্পর্শকাতর, আপনার একটু আগের কথা থেকেও আমরা যা বুঝতে পেরেছি, এর থেকে যে কোনো উপায়ে বেরিয়ে আসা দরকার, তো এই ব্যাপারে আপনারা যারা আলোচক, তাঁদেরও কি সচেতন হওয়া জরুরি নয়?
শরীফ মুহাম্মদ : অবশ্যই জরুরি। তবে আয়োজকরা যদি একটু সচেষ্ট হন, তা হলে আমরা যারা আলোচক, আমাদের এ ব্যাপার নিয়ে আর ভাবতে হবে না। আপনাদের পত্রিকা যেহেতু আলোচক-আয়োজকÑউভয়পক্ষের কাছেই পৌঁছবে, আমি আয়োজকদের প্রতি বিনীত আরজ করব, ব্যাপারটাতে যেন তাঁরা সতর্ক নজর দেন। আলোচকরা এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান না খুব একটা। খুঁটি-নাটি ব্যাপার তো, আমাদের পক্ষে অনেক সময় তা ধরা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। যেমন আয়োজকরা যখন দাওয়াত নিয়ে আসে কিংবা ফোনে কথা বলে, তখন অনেক কিছু তাদের কাছ থেকে জেনে নিতে হয়। আলোচনার সময় কখন, বিষয়বস্তু কী, জায়গার অবস্থান কোথায় ইত্যাদি ইত্যাদি। খুঁটিনাটি জরুরি এসব জিনিস জিজ্ঞেস করতে করতেই কথা অনেক দীর্ঘ হয়ে যায়। এখন যদি তাঁদের সাউন্ড সিস্টেম নিয়েও জানতে চাওয়া হয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে তা কর্তৃপক্ষের মনোকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কথাগুলো বলছি আমাদের মতো মাঝারি পর্যায়ের আলোচক যারা, তাদের দিকে খেয়াল করে। তবে হ্যাঁ, প্রভাবশালী ওয়ায়েজ যারা, তারা আয়োজকদের শর্ত দিতে পারেন, অধিক মাইক ব্যবহার করবেন না, যতটুকু জরুরত কেবল ততটুকুই করবেন। তাই দুইটা শ্রেণির লোক এই ব্যাপারে সচেতন এবং সচেষ্ট হলে আশা করি সমস্যাটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। এক. প্রভাবশালী ওয়ায়েজ যারা আছেন, তাঁরা। দুই. আয়োজকবৃন্দ।
হামমাদ রাগিব : শব্দদূষণের এই সমস্যাটাকে আপনি কিন্তু ‘খুঁটিনাটি’ বিষয় বলেছেন। বিষয়টা কি আসলেই খুঁটিনাটি? শব্দদূষণের কারণে কিন্তু মাহফিলগুলোর প্রতি প্রচুর মানুষের বিরক্তি চলে এসেছে। এবং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আরোও বাড়বে। এদের মধ্যে যেমন ধর্মবিমুখ মানুষ আছে, তেমন আছেন ধর্মভীরুও।
শরীফ মুহাম্মদ : না, ওই অর্থে আমি বিষয়টাকে খুঁটিনাটি বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি, আলোচক-আয়োজকদের মধ্যে প্রাথমিক যে কথাবার্তা হয়, সেই কথাবার্তায় বিষয়টা একটু পরের স্তরের। যেমন একজন আলোচক যখন কোনো মাহফিলে যেতে রাজি হন, তখন আয়োজকদের সাথে তাঁর প্রথমত কথা হয় মাহফিলের অবস্থান, আলোচনার সময়, কতজন আলোচক থাকবেনÑএই সব বিষয় নিয়ে। এই হিসেবে কথাটা পরে আসে। আমি এই অর্থে এটাকে খুঁটিনাটি বলেছি। নইলে নাগরিক কষ্টের এই বিষয়টা নিয়ে আপনি যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এবং এর খুব শিগগির সমাধান হওয়া জরুরি।
হামমাদ রাগিব : যাতায়াত ভাড়ার চেয়ে বেশি সম্মানী নেওয়াটা কি কুরআনের আয়াত ‘কুল লা আসআলুকুম আলায়হি আজরা’-এর সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায় না?
শরীফ মুহাম্মদ : আমাদের বুজুর্গদের মধ্যে এমন অনেক ছিলেন, যারা যাতায়াত ভাড়াটা পর্যন্ত নিতেন না। আবার কেউ কেউ এমনও ছিলেন একদম কাঁটায় কাঁটায় গুণে যাতায়াত ভাড়াটা কেবল নিতেন। এর চেয়ে একটা পয়সাও বেশি নিতেন না। তাঁদের এই অবস্থান ছিল তাকওয়ার একদম উঁচু স্তরের। কিন্তু যাতায়াত ভাড়ার চেয়ে বেশি হাদিয়া নিলে তা আজর হিসেবে গণ্য হবে কিংবা নিষিদ্ধ আজর হয়ে যাবে এবং এই আয়াতের মিসদাক হবেÑআমাদের উলামায়ে কেরাম এমনটা মনে করেন না। কারণ, তা’লিম, হেদায়েত কিংবা নসিহতের কাজে গিয়ে কিছু হাদিয়া গ্রহণ করা নিষেধ না। তবে হ্যাঁ, হাদিয়া পাওয়ার তীব্র প্রত্যাশা করাটা এখলাসের পরিপন্থী। এটাকে আয়ের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা বা হাদিয়া প্রত্যাশার চেয়ে কম হলে বাকবিতÐায় যাওয়াকে উলামায়ে কেরাম কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেন। কারণ, এটা তাকওয়া ও এখলাসের পরিপন্থী। আমি বলব, দরোজা খোলা আছে। যদি এটাকে পীড়াদায়ক বা দৃষ্টিকটূ জায়গায় না নেওয়া হয় এবং জটিল করে তোলা না হয়, বরং স্বাভাবিক ও সৌজন্যমূলক একটা পর্যায়ে থাকে তবে তা ফিকহি দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধের কোনো পর্যায়ে পড়বে না। আমাদের বর্তমান আকাবের উলামায়ে কেরামের অনেককে দেখেছি, কোনো জায়গায় তাঁরা হাদিয়া গ্রহণ করেন আবার কোনো জায়গায় উল্টো আরো কিছু টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়ে আসেন। মাহফিল কর্তৃপক্ষের সামর্থ দেখে তাঁরা এই তারতম্যটা করেন। এর থেকে বোঝা যায় দরোজাটা খোলা আছে। এটা আসলে মামনু’ বা নিষিদ্ধ না।
হামমাদ রাগিব : কিন্তু কেউ এ নিয়ে দর-কষাকষি করলে…
শরীফ মুহাম্মদ : হ্যাঁ, এটা অসৌজন্যমূলক। এর একাধিক রকমের ক্ষতি আছে। দীনি নসিহতের ক্ষেত্রে এ-রকম দর কষাকষি শরিয়তের যে একটা মেজাজ আছে, মেজাজের খেলাফ বলে মনে হয়। অবশ্যি যারা এই কাজ করেন, তাঁদেরও হয়তো যুক্তি আছে। তাঁরা হয়তো মনে করেন, আমি যখন হাদিয়া নেবই, তা হলে একটা অংক নির্ধারণ করেই নিই। কিন্তু সবকিছুর পর মূল কথা সেই আগেরটাইÑএমনটা করা দাওয়াতের মেজাজের সাথে যায় না। এটা যেমন তাকওয়ার পরিপন্থী, তেমনি নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও খুব একটা ভালো দেখায় না। সুন্দর হয় না সামাজিক প্রতিক্রিয়াও।
হামমাদ রাগিব : হেলিকপ্টার-বক্তাদের নিয়ে এবার আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইব। যারা মা’জুর, বয়েসের কারণে দূরপাল্লার জার্নি করতে কষ্ট হয় তাঁদের কথা তো ভিন্ন। কিন্তু যারা টগবগে জোয়ান, সুস্থসবল মানুষ, তাঁদের জন্য ব্যয়বহুল হেলিকপ্টারে চড়ে মাহফিলে যাওয়াÑআপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
শরীফ মুহাম্মদ : মাহফিল বিষয়ে মানুষের মুখে মুখে যে সব প্রশ্ন আছে, তার মধ্যে এটা একটা নতুন এবং সচল প্রশ্ন। হ্যাঁ, আমাদের কায়েদ বা মুরব্বি যারা, তাঁদের জন্য এ আয়োজন হলে, আপনিও তো বলেছেন, কোনো প্রশ্নই নেই। তবে তরুণ আলোচকদের মধ্যে যারা খুব জনপ্রিয়, যাদের নিয়ে মানুষের আগ্রহ প্রচÐ এবং মানুষ যাদের টানাটানি করেÑতাঁদের ব্যাপারে আমি দুইটা কথা বলবÑএকটা হচ্ছে, ব্যাপারটা এমনিতে দেখতে খারাপ লাগে, দৃষ্টিকটূ। কিন্তু এর একটা যৌক্তিক দিক আছে। দিকটা হচ্ছে, অনেক সময় দেখা যায় মাহফিলের যিনি আলোচক তাঁর ডিমান্ডের কারণে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে হয়। যেমন ধরুন, একজন আলোচকের মাগরিবের পর এক জায়গায় একটা প্রোগ্রাম আছে। দুই-আড়াইশো কিলোমিটার বা বেশ একটা দূরের আরেক জায়গা থেকে একই তারিখে আরেকটা প্রোগ্রামের দাওয়াত এলো। তিনি বললেন, সেদিন মাগরিবের পর তো অমুক জায়গায় আমার প্রোগ্রাম, সেখান থেকে বয়ান শেষ করে আপনাদের মাহফিল আমি ধরতে পারব না বিধায় দাওয়াত কবুল করা সম্ভব না। তখন আয়োজকরা বললÑঠিকাছে আমরা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করছি, রাত ১০টায় আমাদের মাহফিলে আপনি বয়ান করবেন। আমরা আপনাকে যেভাবে হোক পেতে চাই। হেলিকপ্টার ব্যবহার আসলে এসব কারণেই হয়ে থাকে। এবং আয়োজকদের বড় একটা ভূমিকা এবং আগ্রহ থাকে এ ব্যাপারে। আমি সুধারণা থেকে বলতে চাই, যারাই হেলিকপ্টার ব্যবহার করছেন, তাঁরা আসলে সময়ের সমন্বয়ের জন্য হয়তো এটা করে থাকেন।
হামমাদ রাগিব : সময়ের সমন্বয়ের জন্য যদি করে থাকেন, আপনি উদাহরণের মাধ্যমে যেটা বুঝাতে চাইলেন, তবে তো তা ওজর। ওজর তো আর ধর্তব্য না। কিন্তু নিছক বিলাসিতার জন্য যদি যান, তা হলে?
শরীফ মুহাম্মদ : নিছক বিলাসিতার কারণে যদি হয়ে থাকে, তবে তো তা অশোভন একটি কাজ, নিঃসন্দেহে। সবকিছুর পর মাহফিলগুলোতে বড় ধরনের একটা অংক খরচ হয় আজকালÑহেলিকপ্টার তো কেবল একটা শব্দ, কয় টাকাই আর খরচ হয় এতেÑএর বাইরেও প্রচুর টাকা খরচ করা হচ্ছে, যেটার আসলে কোনো প্রয়োজন নেইÑএর কারণেও নেতিবাচক একটা প্রভাব পড়ছে জনমনে। আয়োজকদের অবশ্যই একটা যুক্তি আছে এর পেছনেÑকত জায়গায়ই তো আমরা অযথা টাকা খরচ করি, সেখানে এসব খরচ না করে দীনি একটা কাজে একটু বেশি করে খরচ করলাম, সমস্যা কী? আমি এর উত্তরে খুব নরম জায়গা থেকে বলতে চাই, দীনি কাজে সর্বদা আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যাতে তা সমালোচিত না হয়। বাংলাদেশের মানুষ একটু অনুসন্ধিৎসু, একটা বিশ্লেষণী মন লালন করে তারা সবসময়। মাহফিলের আয়োজন দীনি কাজ ঠিক, এখানে অনেক টাকা খরচ করলে সে তো দীনের জন্যই খরচ করা হলো, কিন্তু মানুষ এটাকে বিশ্লেষণ করে এর উল্টোদিক প্রকট করে তুলবে। তাই সর্বোপরি আয়োজক-আলোচকÑআমাদের সবাইকে অহেতুক খরচ এবং বিলাসিতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
হামমাদ রাগিব : অনেক জায়গায় দেখা যায়—পোস্টারে কোনো বক্তার নামের নিচে লেখা থাকে ‘হুজুর হেলিকপ্টার চড়ে মাহফিলে আগমন করিবেন’ বা এই রকম একটা কিছু…
শরীফ মুহাম্মদ : হ্যাঁ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এর ছবি আমি দেখেছি, এটা খুব বাজে একটা সংস্কৃতির উদাহরণ। খুবই দুঃখজনক এবং দৃষ্টিকটূ। এটা অনুচিত, পরিহারযোগ্য। অচিরেই এর থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এমন মাহফিলে আমাদের আলোচকদের যাওয়ার ব্যাপারে আমি অনুরোধ করব, একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।
হামমাদ রাগিব : আজকালকার ওয়াজ মাহফিল বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা বাজার-সমিতির প্রতিযোগিতামূলক প্রভাব এবং অর্থের বাহাদুরি দেখানোর মোক্ষম উপায় হয়ে উঠছেÑআপনি কী মনে করেন?
শরীফ মুহাম্মদ : মাহফিল যদি দুই পাড়া, বাজার বা সমিতির মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থেকে হয় আর সেই প্রতিযোগিতা যদি ঝগড়া-বিবাদ কিংবা হিংসা-বিদ্বেষ থেকে না হয় তবে তো সেটা প্রশংসনীয়। ওরা বড় করে মাহফিল করছে, আমাদের পাড়া থেকে আমরা তাদের চেয়েও বড় করে মাহফিল করবÑএটা তো প্রকৃতপক্ষে দীনি বিষয়ে একটা প্রতিযোগিতা। মানুষ ধর্মীয় একটা ব্যাপারকে নিজের গর্বের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, এটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখাই ভালো। এই মানুষগুলোর ভেতর একটা টুর্নামেন্ট কিংবা একটা গানের অনুষ্ঠান নিয়ে এই প্রতিযোগিতা কাজ করতে পারত, তার বদলে কাজ করছে ইসলামি দাওয়াহর একটা সংস্কৃতি নিয়ে, আমি ব্যাপারটাকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই নিতে চাই। তবে হ্যাঁ, এই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য যদি হয় ঝগড়া-হিংসা ইত্যাদি উস্কে দেওয়া কিংবা এই রকম কোনো মনোভাব তা হলে অবশ্যই তা খুব নিন্দনীয় এবং পরিহারযোগ্য।
হামমাদ রাগিব : মাহফিলকে আপনি ইসলামি সংস্কৃতি বলছেন, এটা তো দীনি একটা দাওয়াত, মানে দাওয়াহমূলক কাজÑসংস্কৃতি হলো কিভাবে? এটাকে সংস্কৃতির সাথে তুলনা করাটা…
শরীফ মুহাম্মদ : সংস্কৃতি আসলে সবটাই। যদিও শব্দটা শুনলে আমরা গান-বাদ্য বুঝি কিন্তু এর অর্থ হলো রেওয়াজ। মুসলিম সমাজে আজানও কিন্তু একটা সংস্কৃতি। ফজরের আজান শুনে মুসল্লিরা ঘুম ছেড়ে মসজিদে যাচ্ছেÑএটাও একটা সংস্কৃতি। রমজানের ইফতার একটা সংস্কৃতি। মানুষের জীবনাচারটাই সংস্কৃতি। এই অর্থে বাংলাদেশে শীতের মওসুমে শহর এবং গ্রামে প্রচলিত বর্তমান ওয়াজ মাহফিলগুলোকে একটা পূণ্যের সংস্কৃতি বলে আমি মনে করি।
হামমাদ রাগিব : গত ১০ বছরে ওয়াজ মাহফিল বাংলাদেশের সামাজিক এবং ধর্মীয় উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখছে?
শরীফ মুহাম্মদ : হ্যাঁ, এই প্রশ্নটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। গত ১০ বছর বলি আর ২০ বছর বলি, মাহফিলগুলো সামাজিক এবং দীনি কী উপকার করছে, এটা বলতে গেলে আমি উত্তরটা দুইভাবে দিতে পারি। একটা হচ্ছে, উপকার বলতে যদি আমরা শুধু উপরের দিকে ওঠা বলি তা হলে একরকম কথা আসবে আর যদি বুঝি অবক্ষয়ের কমতি তা হলে আরেক রকম উত্তর আসবে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ চারিত্রিক, নৈতিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়ের আয়োজন মিডিয়া এবং সমাজের পরতে পরতে প্রচলিত আছে, মাহফিলগুলোর দ্বারা আমি মনে করি এই অবক্ষয়ের মাত্রাটা কিছুটা স্তিমিত আছে। দাওয়াহমূলক অন্যান্য কাজও এতে বড় ভূমিকা রাখছে, বরং ওসব কাজের ভূমিকাটাই মুখ্য, তারপরও আমি বলব, মাহফিলগুলোও এতে বড় একটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। এর দ্বারা মানুষ নৈতিক চরিত্র, ইসলামের সাথে নিজের সংযুক্তি, ইসলামের ইতিহাস জানা, নবি-রাসুলের ঘটনা জানা, গোনাহ কমানো, নেক আমল বেশি করে করাÑএই সব বিষয়ে একটা প্রেরণা পায়।
তো, নৈতিক ঘাটতি যে পরিমাণ হবার কথা, তারচেয়ে কম হওয়াটাও কিন্তু সফলতা। আর এই সফলতা অর্জনে বাংলাদেশের ওয়াজ মাহফিলগুলো উল্লেখযোগ্য একটা ভূমিকা রাখছে। মাহফিল দ্বারা হয়তো সবসময় আমরা উপরের দিকে উঠতে পারছি না, তবে সমাজ যতোটা নিচে নামার কথা ছিল, যতোটা অবক্ষয়ের শিকার হবার কথা ছিলÑমাহফিলের কারণে ততোটা হচ্ছে না, হয়নি।
হামমাদ রাগিব : বক্তারা নিম্ন কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের দোষত্রæটি নিয়েই কেবল আলোচনা করেন, সমাজের উচ্চ শ্রেণির অপরাধ বা যৌতুকসহ সামাজিক অন্যান্য ব্যাধি নিয়ে তাঁদের খুব একটা আলোচনা করতে দেখা যায় না—এর কারণ কী?
শরীফ মুহাম্মদ : গত কয়েকদিন আগে এক মাহফিল থেকে ফিরছিলাম, একজন প্রথিতযশা আলোচকও সঙ্গে ছিলেন, তিনি এ বিষয়টা সম্পর্কে আলাপ তুলেছিলেন। সুন্দর একটা বিষয়। আসলে গত ৮/১০ বছর যাবত ধর্মের মৌলিক জায়গাগুলোতে আঘাত বেশি আসছেÑনাস্তিক্যবাদ, ইসলাম-বিরোধী প্রচারণা প্রোপাগান্ডা ইত্যাদিÑতাই কথা বলতে গিয়ে আলোচকগণ মূল প্রস্তুতিটা রাখেন এই সব বিষয় নিয়েই, যেন সাধারণ মানুষের ঈমানটা অন্তত ঠিক থাকে। তাঁরা ধর্মীয় মৌলিক বিষয়গুলো, ইবাদাতের মূল মূল কথাগুলো নিয়েই আলোচনা বেশি করেন। কিন্তু একটা সমাজকে ইসলামের ওপর ওঠানোর জন্যÑআপনি যে জায়গাটায় দৃষ্টিআকর্ষণ করেছেনÑআমি উচ্চবিত্ত নি¤œবিত্ত হিসেবে ভাগ করব নাÑধর্মের নৈতিক যে দিকগুলো আছেÑসত্যকথা বলা, দুর্নীতি না করা, খেয়ানত থেকে বেঁচে থাকা, সদাচার করা, হালাল জীবিকা গ্রহণ করা, যৌতুক, মাদকÑএই সব নিয়ে কথা বলা দরকার। এবং হচ্ছেও। কম হচ্ছে আর কী। আরও বেশি হওয়া উচিত। আজ আপনি আমার সাক্ষাতকার নিতে এসেছেন, আমি গতকালের মাহফিলেওÑআল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা আদায় করে বলছিÑসম্পূর্ণ আলোচনা এইসব সামাজিক ব্যাধি নিয়েই করেছি। আমি আশাবাদী, এই সব বিষয় নিয়ে আগামীতে আলোচকগণের কথা আরও বাড়বে।
এই কথার সূত্র ধরে আমি একটা প্রস্তাবনা পেশ করছি, আমাদের মাহফিলগুলোতে কেন্দ্রীয়ভাবে হোক আর যেভাবেই হোক, যদি কিছু বিষয় নিয়ে চর্চা হয়, তা হলে অনেক ভালো হয়। যেমন ঈমানিয়্যাতের কথাগুলো লাগবেই। এটার ওপর একটা আঘাত চলছে দেশে, ইসলাম-বিরোধী নানা ধরনের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধেও কুরআন-হাদিস থেকে কথা বলতে হবে, সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাসের অংশ আসতে হবে, এটাও জরুরি, এর সঙ্গে সঙ্গে ইসলামে আখলাকের যে দিকগুলো আছে, মুয়ামালাতের যে দিকগুলো আছে, মুয়াশারাতের যে দিকগুলো আছেÑইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হবার মতো একটা সূচি বা তালিকা আলেমদের অভিভাবক পর্যায়ের কোনো সংগঠন (যেমন বেফাক) থেকে যদি করে দিয়ে আলোচকদের বলে দেওয়া হতোÑআপনারা এবার মাহফিলগুলোতে এই বিষয়গুলোর ওপর বেশি বেশি আলোচনা করবেন। অন্যান্য বিষয়গুলোও থাকতে পারে, তবে এই বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব একটু বেশি দিয়ে আলোচনা হবে।
প্রতি বছর নতুন নতুন সূচি করে দেওয়া হলো। যে বছর যে পরিস্থিতির দাবি থাকে দেশ ও সমাজের, সে পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করেÑ১৫টা কিংবা ২০টাÑআলোচনার কয়েকটা টপিক নির্ধারণ করা হলো। ধরুন, প্রতি বছর সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে এই বিষয়গুলো নির্ধারণ করে একটা তালিকা করা হলো। প্রতিটি বিষয়ের জন্য আয়াত-হাদিসসহ সংক্ষিপ্ত একটা শিট তৈরি করা হলো। তারপর বাংলাদেশের সকল তরুণ বক্তার কাছে তা পাঠিয়ে জানিয়ে দেওয়া হলো, এই বছর এই বিষয়ের ওপর আপনারা জোর দিয়ে আলোচনা করবেন।
এমনটা করলে আমার মনে হয়, মাহফিলে আলাদা একটা গতি আসবে। একটা নিয়মানুবর্তিতা তৈরি হবে। এখন তো যার যা মন চায় আলোচনা করেন, পর্যবেক্ষকের মতো এই রকম একটা কাফেলা থাকলে বক্তারা অপরিকল্পিত আলোচনা করার ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকবেন। মানুষজনও এ থেকে ব্যাপক ফায়দা নিতে পারবে।
হামমাদ রাগিব : অধিকাংশ বক্তার ওয়াজ উস্কানিমূলক এবং তা ইসলাম থেকে দূরে থাকা মানুষকে পথভ্রষ্ট আখ্যা দিতে উৎসাহিত করে, দাওয়াতের বিনয়ী আবহ সেখানে নেই, কেন?
শরীফ মুহাম্মদ : হ্যাঁ, আমাদের অনেক আলোচকই মানুষকে উদ্দীপ্ত করার জন্য জোরালো ভাষাটা একটু বেশি ব্যবহার করেন। তবে এটা আসলে ইসলাম থেকে কাউকে খারেজ করার উদ্দেশ্যে করেন না, বরং ইসলামের যারা দুশমনি করে তাদের ব্যাপারে প্রতিরোধ মূলক মানসিকতা জাগ্রত করার জন্যেই করেন বলে মনে করি। তবে হ্যাঁ, জোরালো ভাষার পরিবর্তে নরম সুরে কথা বলার ফায়দা বেশি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আলোচককে মাহফিলের আয়োজক এবং শ্রোতাদের চাহিদা রক্ষা করতে গিয়েও জোরালো ভাষায় কথা বলতে হয়। কারণ, তাঁদের চাহিদা থাকে, বক্তার আলোচনা শুনে একটু উদ্দীপ্ত হবেন, ইসলামের দুশমনদের ব্যাপারে উচ্চকিত কণ্ঠে কিছু শুনবেন।
উচ্চকিত কণ্ঠে কিছু শোনা এবং উদ্দীপ্ত হবার এই প্রবণতাটা শ্রোতাদের মধ্যে, আমার যতোটা মনে হয়, বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক স্থবিরতার কারণে হয়ে থাকে। মানুষ মুক্তভাবে কিছু বলতে পারছে না, নিজের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশের জায়গা পাচ্ছে নাÑএই সব না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে তাঁদের ভেতরে একটা চাহিদা জাগরুক থাকেÑমাহফিলের আলোচক তাঁদের ভেতরে জমে থাকা ভাষাহীন ক্ষোভকে একটু ভাষা দেবেন। বিদ্যমান রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক অন্যায়গুলোর প্রতিবাদ একটু উচ্চ আওয়াজে করবেনÑতাঁরা নিজেরা যেটা করতে পারছে না।
সম্মানিত আলোচকদের কেউ কেউ শ্রোতাদের এইসব চাহিদা রক্ষা করতে গিয়ে মুকতাজায়ে হালের কথা ভুলে যান। কোথায় জোরালো ভাষায় বলতে হবে, কোথায় নরম করে বলতে হবেÑএটা ঠিক থাকে না। আর এই যোগ্যতাও তো আসলে থাকে না সবার। ফলে দেখা যায় একটা মাহফিলে ৮০ ভাগ সময়ই কেবল ডাক-চিৎকার শোনা যাচ্ছে। এটা মানুষের মনে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ দিকে নতুন আলোচকদের খেয়াল রাখা জরুরি বলে মনে করি। জোরালো বক্তব্যের বিষয়টা বিজ্ঞ এবং প্রাজ্ঞ আলোচকদের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভালো। তাঁরা মুকতাজায়ে হাল বুঝবেন। অনেক কথা আছে, অনেক উত্তাপের বিষয় আছে, যেগুলো প্রাজ্ঞ বক্তা ছাড়া বললে দৃষ্টিকটূ লাগে। মাহফিলের বেশির ভাগ সময়জুড়ে প্রায় সব বক্তার ঝাঁঝালো বক্তব্য খুব সুখকর হয় না। সবার জন্য সেটা মানানসইও না।
হামমাদ রাগিব : বক্তার জ্ঞানের চেয়ে সুর প্রধান হয়ে উঠছে, এর প্রতিকার কী?
শরীফ মুহাম্মদ : সুর আসলে নিষিদ্ধ কিছু না। উলামায়ে কেরাম এটাকে নিষিদ্ধ মনে করেন না। মানুষজনের যদি চাহিদা থাকে দীনের কথাগুলো তাঁরা একটু সুরেলা করে শুনবে, একটু আবেগপূর্ণ ভাষায় শুনবেÑ তাঁদের এই আগ্রহের ভিত্তিতেই মূলত সুরটা দেওয়া হয় দীনি আলোচনায়। আর জ্ঞানের ব্যাপারে কথা হলো, ইলমি লাইনে যারা অগ্রগামী, তাঁরা খুব একটা যান না ময়দানের মাহফিলগুলোতে। দরস-তাদরিসেই তাঁদের মূল্যবান সময়ের সবটুকু বিলিয়ে দেন। তাই আল্লাহ তায়ালা যাদের একটু গুছিয়ে সুন্দর করে কথা বলার যোগ্যতা দান করেছেনÑতাঁরা মুহাক্কিক আলেমদের কিতাবাদি মুতালায়া করে একটা প্রস্তুতি নিয়ে মাহফিলে যান, বয়ান করেন। সুরেলা কণ্ঠে আলোচনা করেন। মানুষের ভালো লাগে, তাই অনেক মুহাক্কিক আলেমের চেয়ে ওই ময়দানে তাঁদের কদর বেশি। হোক। সমস্যার কিছু নেই। যতক্ষণ না ওই বক্তা ভুল বা অশুদ্ধ কিছু বলেন।
হামমাদ রাগিব : বেশির ভাগ বক্তা একই কথা বিভিন্ন মাহফিলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেন। দেখা যায়, শ্রোতারা তাঁর এ আলোচনার অডিও কিংবা ভিডিও রেকর্ড ইউটিউবে বা অন্য কোথাও শুনে ফেলেছেন। তারপরও তিনি তাঁর সেই চর্বিত চর্বন আলোচনা করেই যান। এটা কি তাঁদের জ্ঞানের দীনতা নাকি অন্য কথা বললে শ্রোতাদের সাড়া মেলে না?
শরীফ মুহাম্মদ : একটা দামি কথা বলেছেন আপনি। এটা দুটো কারণে হয়। একটা হলো, একজন আলোচক কোনো মাহফিলের জন্য আলোচনার যে খসড়া তৈরি করেন, সেটা দিয়ে কয়েকদিন চালিয়ে দেন। কারণ, এর ভেতরে নতুন কোনো আলোচনা আবার তৈরি করার সময় এবং সুযোগ তিনি পান না। আর পূর্বপ্রস্তুতি ও ভাবনা ছাড়া খুব কম আলোচক আছেন যারা স্বতন্ত্র আলোচনা করতে পারেন। এটা তাঁদের জ্ঞানের দীনতাÑআমি এভাবে বলতে চাই না, বরং বলব, সবাইকে আল্লাহ তায়ালা সব রকম যোগ্যতা সাধারণত দেন না। তাঁদেরকে আল্লাহ তায়ালা দীনের কথা সুন্দর করে মানুষের কাছে উপস্থাপনের যোগ্যতা দিয়েছেনÑএটাই তো অনেক কিছু। এই যোগ্যতা তাঁরা কাজে লাগাচ্ছেন। সময় ও সুযোগের অভাবে হয়তো তাঁরা নতুন নতুন বয়ান খুব দ্রæত তৈরি করতে পারেন না। এটা দোষের কিছু না। আর ইউটিউব বা অন্য কোথাও একই আলোচনা মানুষ শুনে ফেললেও তিনি তো আর একই আলোচনা এক জায়গায় করেননি। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় করেছেন। প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আগেভাগে শুনে ফেলেছে। এটা খুব আইবের কিছু বলে মনে হয় না। তা ছাড়া মাহফিলের বক্তব্য সাধারণত সেমিনারের মতো নিছক পয়েন্ট ভিত্তিক আলোচনা হলে চলে না। একটা বিন্যাস, কিচু যুক্তি, কিছু সহজ-সুললিত কথার সমন্বয় দরকার হয়। এটা যখন-তখন হুটহাট পরিবেশে করা কঠিন।
হামমাদ রাগিব : চমৎকার সব উত্তর শুনলাম আপনার কাছ থেকে। জাযাকাল্লাহ। এবার দীর্ঘ এ আলাপচারিতার ইতি টানব। সর্বশেষ যে প্রশ্নটা, এই সময়ে ওয়াজ মাহফিলে কোন বিষয়গুলো বক্তাদের মাথায় রাখা উচিত?
শরীফ মুহাম্মদ : এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার হকদার আমি না। আমি এই ময়দানে খুব দীর্ঘ সময় ব্যায় করিনি। এটা মুরব্বি পর্যায়ের বিজ্ঞ আলেমরা ভালো বলতে পারবেন। আমি একজন শ্রোতা হিসেবে অথবা ময়দানে বিচরণকারী দর্শক হিসেবে যে কথাটা বলতে পারি, ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়গুলো সম্পর্কে একটি-দুটি কিতাব থেকে হলেও সূচিপত্র পর্যায়ের জ্ঞানটা থাকলে ভালো; যে, ইসলামে এই জিনিসগুলো আছে। প্রয়োজনীয় মুতালায়াÑযেমন সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে, সিরাতের ওপর, কুরআনের তাফসিরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অংশ—মুতালায়া থাকলে আলোচনা করতে সুবিধা। অনুরূপ মা’লুমাতুল কুরআন বা উলুমুল কুরআন সম্পর্কেও একটু ধারণা থাকা চাই। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে যখন যতটুকু জানা থাকা দরকার, আলোচনার আগে একবার জেহেনে তা বসিয়ে নিলে ভালো। একটু ভূগোল সম্পর্কে ধারণা থাকলেও উপকার হবে। চলমান বিশ্বের হালহাকিকত—এসব প্রত্যেক বক্তারই থাকে কমবেশি—তারপরও বললামÑএ সম্পর্কে ভালো জানাশোনা সব সময় থাকা চাই। তা ছাড়া বড় বড় মনীষী বা আলোচকদের মাওয়ায়েজগুলোও অধ্যয়নে রাখা ফায়দাজনক। যা বললাম, এগুলো মেনে চললে একজন আলোচক তাঁর আলোচনার সময় খুব ক্রিয়াশীল এবং প্রভাব-উদ্দীপক কথা বলতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
আপনার শেষ প্রশ্নের সূত্র ধরে আজ একটা কথা আমি পাঠকদের উদ্দেশ্যে পেশ করতে চাই—একটা শুভ লক্ষণ বা সুন্দর ধারা কিন্তু শুরু হয়েছে। মাহফিলে আমাকে ডাকার কোনো কারণ নেই, আমি ওয়ায়েজ না। ওয়াজ মাহফিলের উপযোগী আলোচক নই। কিন্তু আমি দেখেছি, শহর কিংবা শহরতলীর বিভিন্ন মাহফিলে এমন কোনো আলোচকের কথা শোনার জন্য কিছু মানুষ তৈরি থাকে, অপেক্ষা করে, যিনি কেবল আলোচনাই করবেন। ১ ঘণ্টা/দেড় ঘণ্টা তিনি কেবল কথাই বলবেন। সুন্দর এবং গোছানো ভাষায়। ধীরে, সুস্থে। দেশের কোনো একটা বিষয় নিয়ে। ইতিহাসের কোনো একটা অংশ নিয়ে। অথবা দীনি যে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলবেন যা সমকালীনত্বকে স্পর্শ করবে। তাঁর আলোচনায় সুর থাকবে না, জোরালো ভাষা কিংবা উত্তেজনা থাকবে না। একদম স্বাভাবিক শান্ত আলোচনা। এই যে একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, এটা একটা শুভ লক্ষণ। এ থেকে আমি আশাবাদী, বাংলাদেশের মাহফিলগুলোতে অচিরেই একটি সুন্দর ও অভিজাত ধারার সূচনা ঘটবে। ইনশাআল্লাহ।