বাংলায় ইসলামি অনুবাদ সাহিত্য : এখনো অনেক পথ বাকি
তিউনিশিয়ার অধ্যাপক শায়খ ড. সামির ‘লানা আবনা ওয়ালানা আযওয়াজ, ফানাহনু খারিজুনা ফি সাবিলিল্লাহ’—এই বাক্যটির অনুবাদ আমি কমপক্ষে তিরিশ সেকেন্ড ধরে করছিলাম শ্রোতাদের সামনে৷ স্ত্রী-সন্তানের সাথে মা-বাবা, বন্ধু-স্বজন, ধন-সম্পদ, বাড়ি-ঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি নানান যৌগিক শব্দ যুক্ত করে৷ দাওয়াতের কাজ শেষ করে যখন ফিরছি, শায়খ সামি আমার হাত শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি ছোট ছোট বাক্য বললাম আর তুমি অনুবাদে লম্বা বয়ান করলে কেন?’ বললাম, ‘নাহনু নাকুল হাত্তা নাশবা, ওয়া নাতাকাল্লাম হাত্তা নাতআব’—আমরা পেটপুরে খাই আর ক্লান্তি আসা পর্যন্ত কথা বলি৷ শায়খ সামি হাসলেন আর বললেন, ‘ও বুঝেছি, অল্প কথায় এরা কিছুই বুঝবে না আর আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার নিয়তও করবে না৷ আনতা জায়্যিদ ফিততারজামাহ৷’
দুই ফিলিস্তিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাইতুল মুকাররম মার্কেটে৷ ওরা কেনাকাটা করবে নিজ পরিবারের জন্য৷ পথে নিতান্ত প্রতিবন্ধী ভিক্ষুকের হস্তপ্রসারণ৷ মুখে কী সব কেওয়ালি গাইছে৷ একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ও কী বলছে?’ বললাম, ‘আল্লাহুম্মা লা মানিয়া লিমা আতাইতা ওয়ালা মুতিয়া লিমা মানাতা ওয়ালা ইয়ানফাউ যালজাদ্দি মিনকাল জাদ্দ৷’ সাথে সাথে একশ টাকা বের করে দিয়ে দিলো৷
অনুবাদশিল্প পুরোই রন্ধনশিল্পের মতো৷ লবণ-মশলার সামান্য এদিক সেদিক যেমন স্বাদু খাবারকে বিস্বাদময় করে তুলতে পারে, ঠিক তেমনি অনুবাদ যদি মূলের চাওয়া ও দাবি অনুযায়ী না হয় তাহলে একেও স্বাদহীন অনুবাদ বলা হবে৷ পাঠক এটা তেমন গিলবে না৷ হয়তো ভাববে বইটি কেনার টাকাই জলে গেছে৷ আমাদের দেশের সাহিত্যমহলে একটা আনকোরা দল আছে, যারা অনুবাদ সাহিত্যকে সাহিত্য চর্চার অন্যতম শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই নারাজ৷ অনুবাদ সাহিত্যকে তারা বিবিসি নিউজ, কোর্ট-কাচারির দলিল-দস্তাবেজ আর ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্ক জাকারবার্গ ও নরেন্দ্র মোদির টুইট বার্তার মতো মনে করে৷ আসলে এতে তাদের কানাকড়ি দোষ নেই৷ দোষ যা সব এই দেশের অনুবাদক ও অনুবাদ সাহিত্যের অনগ্রসরতার৷ দক্ষ অনুবাদ কারিগর তৈরি হয় না বলে অনুবাদ সাহিত্যের পাছায় লাথিও পড়ছে বেশ৷ কটা অনুবাদ আছে সাহিত্যের মূল চারটি শাখায়? কবিতা, কথাসাহিত্য, নাটক ও প্রবন্ধসাহিত্যে এ যাবত যা অনূদিত হয়েছে তার বেশিভাগই উৎসভাষার সেরা বই হলেও লক্ষ্যভাষায় পিছিয়ে পড়া বইয়ের কাতারে পড়ে আছে৷ কারণ, অনুবাদ মূলের চাওয়া ও দাবির ধারে-কাছেও নেই৷ সেই থেকেই এ দেশের সাহিত্য চর্চার বড় মাধ্যম বা নিয়ামক হতে পারেনি অনুবাদ সাহিত্য৷ তবে বড় কথা হলো অনুবাদই-বা হয় কয়টা? একুশে বইমেলার এক অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘অনুবাদের সঙ্গে একটি জাতির মননের পরিচয় মেলে। অনুবাদের বিবর্তনে রাজনীতির বিবর্তনেরও প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। দেশে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলা প্রচলন ও বাংলায় অনুবাদের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সামরিক শাসনামলে এসে বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখাই বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ছাড়া আর কোনো বিষয়ে ক্লাস কিংবা পরীক্ষা বাংলায় হয় না (হয় ইংরেজিতে)। বাংলা একাডেমি সবচেয়ে কম সফল প্রতিষ্ঠান অনুবাদের ক্ষেত্রে। যত অনুবাদের বই বেরিয়েছে তার মধ্যে অনুবাদতত্ত্বের কোনো বই বাংলায় অনুবাদ হয়নি।’
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ বিবিসি বাংলা একটি ছোটখাট রিপোর্ট প্রকাশ করেছে৷ সেখানে বইমেলার তৃতীয় সপ্তাহের কোনো একদিন তথ্যকেন্দ্র থেকে দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী যেসব বিষয়ে বই জমা পড়েছে সেখানে অনুবাদ সাহিত্যের বই একেবারে তলানিতে৷ অথচ কবিতার বই জমা পড়েছে সাতশ বিশটি। উপন্যাসের বই জমা পড়েছে তিনশত নিরানব্বইটি। গল্পের বই তিনশত আটত্রিশটি৷ প্রবন্ধ-নিবন্ধের বই একশত পঁয়ত্রিশটি৷ গবেষণাধর্মী ও ছড়ার বই সাতচল্লিশটি৷ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই পঁচাত্তরটি৷ ধর্মীয় বই নয়টি৷ অনুবাদের বই জমা পড়েছে সাকুল্যে সাতাশটি । বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশে নতুন পুস্তক প্রকাশের সবচাইতে বড় উপলক্ষ তথা গ্রন্থমেলাকে ঘিরে কত কমসংখ্যক অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে।
সুপরিচিত অনুবাদক, বিশেষ করে বাংলা বই ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য যিনি সুপরিচিত, অধ্যাপক ফকরুল আলম বলেছেন, অনুবাদের ক্ষেত্রে ভালো মানের জাতীয় প্রতিষ্ঠান না থাকায় অনুবাদে পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় যেসব নতুন বই আসছে সেগুলো বাংলায় করার মতো প্রতিষ্ঠান নেই। আবার প্রকাশকদের সামর্থ্যও সীমিত৷ বিশেষ করে একাডেমিক বই বাংলায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ।
ড. খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, তাঁর সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে বলেছেন, অনুবাদ আসলে মর্যাদাসম্পন্ন সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি পেতে শুরু করে গত শতাব্দীর ৮০-র দশক থেকে। যথার্থভাবে অনুবাদ কোনো শিল্পকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ৯০-এর দশকের পর। যতদূর মনে পড়ে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই, অর্থাৎ ১৯৫৫ থেকেই অনুবাদের একটি বিশিষ্ট স্থান নির্ধারিত ছিল৷ যার জন্য তার নিঃশর্ত প্রশংসা অবশ্যপ্রাপ্য৷ যদিও এই প্রতিষ্ঠান থেকে সুপ্রচুর অনুবাদকর্ম প্রকাশিত হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না।
এখন কথা হলো, অনুবাদ সাহিত্য জরুরি কি জরুরি না? বোদ্ধামহল এক বাক্যেই স্বীকার করবেন যে, সাহিত্য যদি টিকিয়ে রাখতে হয় এবং স্বদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-বিজ্ঞান, রাজনীতি-অর্থনীতি সর্বোপরি সে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ও ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি বিদেশে ছড়িয়ে দেবার হয়, তাহলে অতি অবশ্যই অনুবাদ সাহিত্যের দ্বারস্থ হতে হবে৷ অনুবাদ সাহিত্য ছাড়া না এ দেশকে বহির্বিশ্ব চিনবে জানবে, না বহির্বিশ্বকে এ দেশের মানুষ জানবে চিনবে৷ বিশিষ্ট আরব লেখক ইউসুফ হামদান এমনটিই লিখেছেন তাঁর এক প্রবন্ধে৷ তিনি লেখেন, আল আদাবুল মুতারজাম বা অনুবাদ সাহিত্য হলো একটি সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সেতুর মতো৷ যা দিয়ে ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়৷ সে দেশের মানুষের অন্তর্লোকে এসব সংস্কৃতির কী বৈশিষ্ট্য কী মূল্যবোধ এবং কী গুরুত্ব ধারণ করে আছে সে সম্পর্কে বিবিধ অবগতি লাভ করা যায়৷ বিশেষত তাদের সাহিত্য, দর্শন, আবেগ, বাগউপাদান ও অভ্যাস সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। (আরাবি 21, ২৩ অক্টোবর ২০১৯)
ইসলামি অনুবাদ সাহিত্য এখনো নানাভাবে ত্রুটি ও সমালোচনাপূর্ণ৷ এর প্রধানতম কারণ হলো লক্ষ্যভাষা তথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পূর্ণ দক্ষতা অর্জনের অভাব৷ যতক্ষণ না উৎসভাষা ও লক্ষ্যভাষায় সমান যোগ্যতা ও দক্ষতা না আসবে ততক্ষণ যে কেউ অনুবাদ সাহিত্যে আসবে এটা তার বোকামি ও প্রচারবিলাসী নিচু মানসিকতার পরিচয় বহন করবে৷ মৌলিক সাহিত্যকর্ম এদিক থেকে অনুবাদ সাহিত্যকর্ম থেকে সহজতর৷ কারণ সেক্ষেত্রে দুই ভাষার দখল প্রয়োজন হয় না৷ আমাদের ইসলামি সাহিত্যে এ যাবত যাঁরা লেখালেখি করে আসছেন তাঁদের অনেকেরই এখনো মৌলিক সাহিত্যের ভিতটা ততটা মজবুত নয় যতটা মজবুত হলে তাঁরা অনুবাদচর্চায় মনোনিবেশ করতে পারেন৷ দুঃখের বিষয় হলো ইসলামি ঘরানার নবীন লেখকদের একটা অংশ তো লেখালেখি শুরুই করে অনুবাদ দিয়ে৷ আপনি লেখালেখি করুন বা সাহিত্যচর্চা করুন কিংবা এভাবেও বলা যায়, আপনি লেখক হোন বা সাহিত্যিক হোন আপনার ভাষা ও সাহিত্যের সঠিক উপলব্ধি এবং তার মৌল আবেদন বিষয়ে স্বচ্ছ ও নৈতিক ধারণা অবশ্যই থাকতে হবে৷ আমাদের কজন এ শিক্ষাটুকু নিয়ে তারপর নিজেকে লেখক বা অনুবাদক দাবি করছেন? সারা জীবন আমরা ফিকহী ইখতিলাফ ও কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যায় নানা জনের নানা মত-অভিমতের কথা শুনে এসেছি, পড়ে এসেছি৷ এর দ্বারা আমাদের কত শত ফায়দা হয়েছে৷ কত প্রকার মাহারাত অর্জিত হয়েছে৷ চার চারটি মাযহাবে সুচারু ও সুগঠিত আমলের পরিবেশ কায়েম হয়েছে৷ সাহিত্যেও কি নেই সেই পথ-পদ্ধতি, সেই মাহারাত-দক্ষতা অর্জনের সুযোগ, সেই ফায়দা হাসিলের উপায়? অবশ্যই আছে৷ কিন্তু আমাদের গবেষণা ও অনুসন্ধান অব্যাহত রাখার অভাব রয়েছে৷
কিছুক্ষণের জন্য আমরা সাহিত্যের সংজ্ঞা বিষয়ে দারুণ সব উক্তি জেনে আসি সাইয়েদ রাবে হাসানি নদভীর ‘গুবারে কারওঁয়া’ নামক বই থেকে৷
সাহিত্যের আরবি শব্দ হলো ‘আদব’৷
আরবি ‘আদব’ শব্দের অর্থে ফিরোজাবাদী কামূসে লিখেছেন, উপযুক্ত ও যথাযথ পন্থার অবলম্বন৷ ইবনে মনজুর লিসানুল আরবে লিখেছেন, আদব ঐ জিনিস যাকে লোকদের মধ্য হতে আদীব অর্থাৎ আদবধারী লোক গ্রহণ করে৷ তাকে আদব এই জন্য বলা হয় যে, তা লোকদেরকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে এবং খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে৷ তিনি আরো লিখেছেন যে, আদব শব্দের মূল অর্থ হলো দাওয়াত দেয়া৷ এর থেকেই ঐ দাওয়াত বা লোকদের ডাকা অর্থে ব্যবহৃত হয়৷ হযরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসের ভাষ্যে এই শব্দটি উদ্ধৃত হয়েছে৷ হাদিসের শব্দ হচ্ছে—এই কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে যমীনের ওপর দাওয়াত, সুতরাং এর দাওয়াত থেকে শেখো৷ সাহিত্যের সংজ্ঞা ইমাম আব্দুল কাহের জুরজানি এভাবে করেছেন যে, সাহিত্য ঐ বিষয় জানার নাম যার দ্বারা সকল প্রকার ভুল-ত্রুটি থেকে বাঁচা সহজ হয়৷ তা শাব্দিক হোক বা পারিভাষিক৷ ইবনে হুজাইল তাঁর কিতাব ‘আইনুল আদব’-এ লিখেন, সাহিত্য দুই প্রকার, প্রকৃতিগত সাহিত্য ও অর্জিত সাহিত্য৷ প্রকৃতিগত সাহিত্যে উত্তম চরিত্র ও প্রশংসনীয় গুণাবলী অন্তর্ভুক্ত৷ আর অর্জিত সাহিত্য হচ্ছে যা অধ্যয়ন, আত্মস্থ ও চিন্তার দ্বারা প্রাপ্ত৷ (গুবারে কারওঁয়া, [বাংলা] সাহিত্যের সাতকাহন, ৫০-৫১)
আধুনিক আরবি সাহিত্যের এই নবজোয়ারে সাহিত্যের যে সংজ্ঞাগুলো হই হই করে উঠেছে, সেগুলো থেকে চমৎকার কয়েকটি মাত্র এই—
সাহিত্য হচ্ছে বিরচিত প্রাঞ্জল বক্তব্য, সেটা কাব্য হোক অথবা গদ্য, যার লক্ষ্য হচ্ছে পাঠক ও শ্রোতাবৃন্দের আবেগকে প্রভাবিত করা। (তারীখুল আদাবিল আরাবি)
সুচয়িত শব্দাবলি, বলিষ্ঠ গঠনরীতি, সুষমামণ্ডিত রচনাশৈলী এবং হৃদয়গ্রাহী অর্থমালাই হচ্ছে সাহিত্য। (আল আদাবুল আরাবি ওয়া তারীখুহু)
সাহিত্য হচ্ছে এমন প্রতিটি কাব্য বা গদ্য, যা নান্দনিক প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে হৃদয়ে প্রভাব সৃষ্টি করে, চরিত্রকে পরিশীলিত
করে, শালীনতার প্রতি আহ্বান করে এবং অশালীনতা হতে দূরে রাখে। (আল আদাবুল আরাবি ওয়া তারীখুহু)
এখন বুঝুন, আদব বা সাহিত্যের যদি এতসব কৃতিত্বপূর্ণ সংজ্ঞা ও রোলস থাকে, তাহলে যিনি লেখক, অনুবাদক বা সাহিত্যনবিশ তার কি কোনো হেলাফেলা বা অবহেলার সুযোগ আছে? সাহিত্যের এই গুণবিশিষ্ট হয়েই তাকে কলমের দাগ বসাতে হবে খাতায়৷ আর অনুবাদ তো বিশেষ আমানত৷ আপনি একটি আরবি ইতিহাসের গ্রন্থ অনুবাদ করবেন, তাহলে সেই আরব লেখকের ধরণ-ধারণ, মন-মর্জি, দাবি-দাওয়া এবং তার সাহিত্যমান অক্ষুণ্ন রেখেই অনুবাদের কাজে হাত দিতে হবে৷ অন্যথায় আমি মনে করি আপনি আমানতের খেয়ানতকারী হবেন৷
অনুবাদ শুরু করার আগে অবশ্যই প্রয়োজন হবে—
এক. নিজের ভাষায় রচনার স্বাচ্ছন্দ্যশক্তি৷ নিজের মতো করে ভাব ব্যক্ত করার সরল সামর্থ অর্জনের পূর্বে অনুবাদে হাত দেয়া ঠিক নয়৷ আবার ফিরে আসতে হবে গোড়ায়৷
দুই. নিজের ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা হতে হবে স্বচ্ছ৷
তিন. যে ভাষার রচনা অনুবাদ করবেন সে ভাষা সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে৷
চার. যে শাস্ত্রের গ্রন্থ সে শাস্ত্র সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকতে হবে৷ নইলে মূল বিষয় ও বাণী ক্ষুণ্ন হবার আশংকা রয়েছে৷ (সাহিত্যের ক্লাস)
ইসলামি সাহিত্য অনুবাদে পাঠ্য কিতাবাদি যেভাবে অনূদিত হয়েছে এটাকে আক্ষরিক অনুবাদ বলে৷ এই ছাপটাই পরিলক্ষিত হয় অপাঠ্য কিতাবাদি অনুবাদ করার ক্ষেত্রেও৷ অথচ তাকে আদৌ গ্রহণীয় অনুবাদ বলা যাবে না৷ কারণ কোনো বইয়ের আক্ষরিক অনুবাদ কখনোও সাহিত্যিক মূল্য রাখে না৷ ভাবানুবাদ বা ছায়া অনুবাদ প্রাগ্রসর অনুবাদ সাহিত্যের মূল পুঁজি৷ এক্ষেত্রেও বইয়ের ধারা ও স্তর যাঁচাই করেই কোনটা ভাবানুবাদ হলে চলবে আর কোনটা ছায়া অনুবাদ হবে তা নির্ণয় করেই এগোতে হবে৷ এখানে প্রতিটি শব্দের আভিধানিক অর্থ এবং দ্যোতনিক বা গূঢ়ার্থিক চাওয়া কি তা মূল ভাষায় বিশেষজ্ঞ না হলে বিপত্তি ঘটবে পদে পদে৷ শব্দের অন্তর্গত দুর্বোদ্ধতা যেমন আছে তেমনি বাক্যের অন্তর্গত দুর্বোদ্ধতাও বিদ্যমান৷ নির্বোধ অনুবাদক কখনোও এসবের সফল সমাধানে সচেষ্ট হবে না৷ সে শুধু অভিধান খুলে বসে যাবে৷ একটি শব্দের চার-পাঁচটি অর্থ থেকে কোনো একটি মনে ধরলেই আগপিছ না ভেবে তাই বসিয়ে দেবে শখের অনুবাদে৷ এ জন্যই তো কেউ একজন বলেছিল—অনুবাদকের উচিৎ উৎসভাষার দেশে মূল লেখকের ভিটেমাটিতে কিছু দিন বেড়িয়ে আসা৷ যাতে করে গ্রন্থস্থিত জটিল-কঠিন-দুর্বোদ্ধ শব্দাবলী, বিশেষ বিশেষ বাক্যাবলী, ডায়ালগ বা বাগধারার স্থানিক অর্থ কী দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমিত হয়ে যায়৷ তা ছাড়া রূপান্তর আর অনুবাদ যে এক নয় তাও জানা থাকা আবশ্যক৷ রূপান্তর মানে মূল বইয়ের হুবহু অনুকৃতি বা প্রতিচ্ছবি৷ এখানে বাক্যের রূপবদল হয়েছে মাত্র৷ এই রূপান্তর বা অনুকৃতির আর কোনো প্রকারভেদ নেই যেমনটা আছে অনুবাদে৷ অনুবাদকের জন্য আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ৷ মূল লেখক সম্পর্কে পূর্ণ অবগতি লাভ করা৷ তিনি কোন টাইপের লেখক, কোন বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে লেখেন, তার আকিদা-বিশ্বাস কি এবং তার রচনার দাওয়াত বা উদ্দেশ্য কি৷ এসব জেনেবুঝেই তার বই বা কিতাব অনুবাদে ব্রতী হওয়া চাই৷
ইসলামি অনুবাদ সাহিত্যে যাঁরা নিরত তাঁদের অধিকাংশই আলেম লেখক৷ আরবি-উর্দূর অনুবাদই এরা করে থাকেন৷ ইলমি ও আমলি বইয়েই এদের নজর বা আগ্রহ বেশি৷ এর বাইরে যেমন—কবিতা, কথাসাহিত্য, স্থাপত্যকলা, ভ্রমণ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মীয় সমাজনীতি, নগর সভ্যতা, গ্রামীণ বৈচিত্র এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক আরবি-উর্দূ বই অনুবাদ করার ক্ষেত্রে তেমন আগ্রহী লোক পাওয়া যাচ্ছে না৷ এসব বিষয় ও এর বাইরে আরো যত সঙ্গত বিষয় আছে, এগুলোকে উপেক্ষা করে আমাদের অনুবাদকে ‘অনুবাদ সাহিত্য’ বলাটা বাতুলতা হবে৷ শুধু আরবি-উর্দূ থেকে অনুবাদ করলেই হবে না, বাংলা ভাষার আলেমদের নির্ভরযোগ্য বই-কিতাব আরবি-উর্দূ-ইংরেজিতে অনুবাদের উদযোগ গ্রহণ করতে হবে৷ মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন সাহেব বাংলাদেশি আলেমদের বই আরবি-উর্দূ-ইংরেজি-চায়নিজসহ বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষায় অনুবাদের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, আশা করি তা সময়ের বড় একটি দাবি পূরণ করতে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশি ওলামা ও তাঁদের রচনাবলি বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার এই সংগ্রামী প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই৷