প্রিয়তম নগরী ‘মক্কা’র প্রেমকে মিশিয়ে দিয়ে মাটির সঙ্গে, তিনি চলেছেন মদিনার পথে। এর আগে পরিবার-পরিজন, তাঁরাও তো চলে গেছেন। দিন-দুপুরে কিংবা রাতের গভীরে, প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে কিংবা সকলের অগোচরে, দলে দলে কিংবা একাকী, পায়ে হেঁটে কিংবা সওয়ারির পিঠে চড়ে। সকলই চলেছেন হিজরতের মহান লক্ষ্যে। কিন্তু আদরের কন্যা জয়নব? তার কী হবে? এ মুহূর্তে তাকে সঙ্গে নেওয়াও যাচ্ছে না, আবার পৌত্তলিক স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদও করানো যাচ্ছে না। অন্যান্য অমুসলিম আত্মীয়দের সঙ্গে সেও যে রয়ে গেছে মক্কায়। এভাবে কন্যাকে রেখে চলে যাওয়া যায়?
কিন্তু জামাতা আবুল আস নিজেকে মুসলিম হিসেবে ঘোষণা না করলেও সে খুব ভদ্র। তার আচরণ সুন্দর কিন্তু রহস্যজনক। তার ভেতরে কারও সঙ্গে শত্রæতার জের নেই। আবু লাহাব, আবু জাহেলরা তার প্রতি রুষ্টও নয়। নবি মুহাম্মদের জামাতা হয়েই-বা কী হবে! সে তো কোরেশদের বিরোধিতা করবার মতো কোনো আবুল আসও নয়। মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম) ধর্ম সে এখনও মেনে নেয়নি। নিলেও তা মনে মনে। অপ্রকাশিত কোনো সংবাদের ওপর ভর করে। জয়নব মুসলমান হলে কী হবে! সে তো তার স্ত্রী। যার আঁজলায় তুলে শরাব, রোজ পান করে সে অনাগত কোনো মহাসংবাদের প্রতীক্ষায়।
আবুল আস চায়, মুসলমানদের সঙ্গে মিশে যাবে। এই এক্ষুণি, সে চিৎকার করে বলবে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।’ কিন্তু তার মন বলে কৌশলী হতে। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর নিজেকে বিলীন করবার কথাও বলে। সে অনুভব করে অন্যরকম ভালোবাসা। পবিত্রতম প্রেম। তার ধারণা বদ্ধম‚ল হয়, প্রকাশ্যে মুসলিম হলে তার কাছে লুকিয়ে থাকা আমানতের বড় খেয়ানত হবে। মক্কার মুশরিকেরা তার সহায়-সম্পদের ওপর চোখ তুলে তাকাবে। মদিনায় চলে যাওয়া মুসলিমদের যে গচ্ছিত আমানত তার বাক্সে, তা লুটেপুটে খাবে পিশাচসুলভ মানুষগুলো। তাকেও বিতাড়িত হতে হবে এই মক্কা থেকে। সে চুপ রয়। নীরবে হয়তো বলেও নেয় যখন চোখাচোখি হয় স্ত্রীর সঙ্গে, ‘আমি তোমাদেরই লোক, হে জয়নব।’
দুই
মক্কার চারদিকে রটিয়ে দেওয়া হয়েছে এক সংবাদ। মুসলিম গুপ্তচরেরা মক্কার ব্যবসায়ী কাফেলায় আক্রমণ করে সব সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। মুশরিকদের মনে প্রতিশোধ আর যুদ্ধের দাবানল জ্বলজ্বল করে উঠছে ক্রমশ। ঘরে ঘরে যুদ্ধের সাজসাজ রব। কোরেশদের প্রধান প্রধান নেতারা মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনাও সেরে ফেলেছে ইতিমধ্যে। কাফেলা প্রস্তুত। রণডঙ্কা বেজে উঠলে পথচলা শুরু হবে। এ কাফেলায় সবাই আছে। কোরেশ-নেতা আবু জাহেল, ওতবা, শায়বাÑসবাই। মক্কার সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে এ যুদ্ধে। কোনো অজুহাত চলবে না। যেতে হবে যুদ্ধে। কিন্তু আবুল আস? সে কি এ যাত্রায় বেঁচে যেতে পারবে? পরিত্রাণ পাবে কোনোভাবে? তাকেও কি ‘অমুসলিম’ পরিচয়ে তলোয়ার উঁচু করতে হবে নবি মুহাম্মদের বিরুদ্ধে? কী নিদারুণ নিঠুর চিত্র। আবুল আস মেনে নিতে চায় না। সে পারে না। হয়তো এখানেও সে কৌশল অবলম্বন করবে। যুদ্ধেও যাবে। রক্ষা করবে আমানতও।
বদর প্রান্তর। চারদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ আমেজ। একদিকে শোনা যায় ‘ইল্লাল্লাহ্র’ ধ্বনি অন্যদিকে হিংসা-ভরা চোখে কলরুদ্ধ চাহনি। এক পক্ষের সেনাপতি স্বয়ং রাসুলে আকবার নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, অন্য পক্ষে আবু জাহেল, ওতবা, শায়বারা। আবুল আস আকাশের দিকে তাকায়। ছিন্নভিন্ন এ অন্তরে সে অনুভব করে এক মহাপরীক্ষা। তার তো কোনো উপায় এখন আর নেই নিশ্চিত। পরম শ্রদ্ধেয়, পরম পবিত্রতম মানুষটির বিরুদ্ধে তাকে উঁচু করতে হবে তলোয়ার। কীভাবে এমনটা করবে আবুল আস? সে ভেবে পায় না। সে তো জানে নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব। মহামানব। বিস্ময়কর সত্য, অবাক বিস্ময়ের স্থপতি। সে জানে তিনিই হবেন আজকের বিজয়ী। কেননা তাঁর ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা সুন্দরের এই আলোকরশ্মি কখনও নির্বাপিত হবে না।
শ্বশুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিলেই-বা কী! অন্তর্যামী জানেন তার মনের অবস্থা। আবুল আস ভয় পায় না। হিং¯্র কোরেশরা যুদ্ধ করে সব ছিঁড়ে ফেললেও আজ তাদের পরাজয়ই অবশ্যম্ভাবী। কোনোরকম যুদ্ধের ময়দানে থাকলেই হলো। মুসলিমদের কাছে বন্দী হলেও তারা তার কোনো ক্ষতি করবে না, এ বিশ্বাস আবুল আসের আছে। তাছাড়া সে তো মুসলিমদের কোনো ক্ষতি করেনি। আবু জাহেলদের মতো কোনো অন্যায়ও করেনি। তাই হয়তো আজকের যাত্রায় সে ক্ষমা পেয়ে যাবে। পেয়ে যাবে নিশ্চিত।
তাই সে এসেছে। বদর প্রান্তরে কোরেশদের পক্ষে যুদ্ধে এসেছে। ঐ তো মুসলিম বাহিনী একে একে বিরোধী কোরেশদের পরাভ‚ত করছে। বাহ্যত দৃষ্টিতে মুখটুকু মলীন হয়ে গেলেও, আবুল আস অনুভব করছে এক মহাপুলকের স্বাদ। শেরে খোদা আলি কাররামাল্লাহ হত্যা করে ফেলেছেন ওয়ালিদকে। বীরকেশরী হামজা উড়িয়ে দিয়েছেন ওতবার গর্দান। পরাভ‚ত হয়েছে শায়বাও। ওদিকে আবু জাহেলের বিরুদ্ধে লড়ছেন দুই কিশোর ভ্রাতা মুআজ-মুআওয়েজ। মস্তক ছিন্ন করে ফেলেছেন তরবারির আক্রোশে আক্রোশে। যে আবু জাহেল নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল নবি মুহাম্মদের নবুওতের আলোক শিখা, ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল আশ্রিত সাহাবিদের মদিনাকে, নেভাতে চেয়েছিলো আল্লাহর নুরের ঔজ্জ্বল্যকে, তাকেই কিনা আজ নিঃশেষ হতে হলো এ দুই কিশোরের তরবারি-তলে। অভ‚তপ‚র্ব!
তিন
রাসুলের জামাতা বন্দী শিবিরে প্রহর গুণছেন। আবুল আসের হৃদয় লজ্জায় সংকুচিত হয়ে আসে। যদিও তার হৃদয়ের এক কোণে জ্বলছে আনন্দের ফল্গুধারা। মুসলমানেরা সত্যের ধারক হয়ে তুলে ধরতে পেরেছেন হকের পতাকা। বিজয়ী হয়ে সুর তুলতে পেরেছেন মহাসত্যের। অন্যদিকে লজ্জা আর বেদনাÑরাসুলের জামাতা হয়েও সে এসেছিল রাসুলের পক্ষে লড়তে, এখন বন্দী হয়েছে। সাহাবাদের সম্মুখে রাসুলের মুখটুকু লজ্জায় অবনত হয়ে যাবে না তো? হায় হায়! কী অন্যায়ই না করেছে আবুল আস। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবে তার ওপরে তো আছেন এক অন্তর্যামী। তিনি জানেন সবকিছু। জানেন অন্তরের ভেতরে, অতলে, যা কিছু ঘটছে, তার সবটুকু। আবুল আস এসব ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেয়। শান্ত করে তোলে।
কিন্তু মক্কায় পড়ে থাকা তার স্ত্রীর কী হবে? কী হবে নবি-কন্যা জয়নবের? সে রেহাই পাবে তো ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে ফিরে যাওয়া কোরেশদের কাছ থেকে? আহা! প্রিয়তমা স্ত্রী কী ভাবছে তা জানে না আবুল আস। এমন স্পর্শকাতর মুহ‚র্তে সে যদি ভাবে, তার স্বামী পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, এখন ক্ষণ গুণছে বন্দীশালায়! যদি সে চলে যায় তাকে ছেড়ে! রাসুলের অস্তিত্বের একটি অংশ যদি ছিঁড়ে খসে যায় তার ভাগ্য থেকে, কী হবে তার! আবুল আস চিন্তিত হয়ে পড়ে আবার। সে আরও ভাবে, জয়নব তো চাইলে পারত স্বামীকে ছেড়ে পিতার সঙ্গে মদিনায় চলে যেতে। সে তো তা করেনি।
মক্কার কোরেশরা অর্থের বিনিময়ে একে একে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে আত্মীয়দের, কিন্তু আবুল আস? তার ভাগ্যের আকাশে আজ কি কোনো চাঁদের দেখা মিলবে? প্রিয়তমা স্ত্রী কি তার জন্যে কিছু করবে? হয়তো। জয়নব তো তার খালাম্মা খাদিজারই কন্যা। খাদিজা যেমন করে স্বামীর পদতলে সমর্পণ করে দিয়েছিলেন সম্পদের মহাপ্রাচুর্য, তাঁরই কন্যার কাছে এমনটা আশা করা তো অসম্ভব কিছু নয়।
মক্কার লোকেরা একে একে ফিদয়া প্রদান করে মুক্ত করে নিচ্ছে আপনজনদের। জয়নব ভাবছেন, কী পাঠাবেন ফিদয়া হিসেবে তাঁর স্বামীর জন্যে! কী বিনিময় করবেন প্রিয়তম স্বামীর সঙ্গে। আজকের মদিনায় রাষ্ট্রনেতা তো তাঁরই পিতা। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। তিনি তো চাইলে নিজ কন্যার স্বামীকে এমনিতেই ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু এমনটা তিনি করবেন কেন? সবাই দেবে মুক্তিপণ আর রাসুলের জামাতা বলে সে এভাবেই মুক্তি পেয়ে যাবে, তা কী করে হয়! তিনি তো দয়ার অর্গল বুকে ধারণ করলেও ন্যায়বিচারের এক অনন্য ধারক। সবার মতোই হবে তার প্রিয়জনদের বিচার।
জয়নব ভাবেন তিনি ফিদয়া দেবেন। কিন্তু কী দেবেন? কী আছে তাঁর এমন? সবচাইতে শ্রেষ্ঠ ফিদয়াই তাঁকে দিতে হবে স্বামীর মুক্তিপণ হিসেবে। কেননা তাঁর স্বামী তো নবি-কন্যা জয়নবের স্বামী। যে কন্যার সঙ্গে মিশে আছে রাসুলের অবয়ব। তার জন্যে হতে হবে অবশ্যই সব থেকে শ্রেষ্ঠ কোনো কিছু। জয়নব ভাবেন না আর। স্বামীর মুক্তির জন্যে মদিনায় পাঠিয়ে দেন শ্রেষ্ঠতম এক মুক্তিপণ।
বন্দী আবুল আসের ফিদয়া হিসেবে যখনই রাসুলের সামনে তুলে ধরা হলো একটি চমৎকার লকলকে হার, নবিজি একটু চমকে ওঠেন। চোখ দুটো ভিজে যায় নবিজির। প্রিয়তম স্বামীর জন্যে স্ত্রী তাঁর মায়ের সর্বশেষ স্মৃতিটুকু পাঠিয়ে দিয়েছে। জয়নব, তিনি তো চেয়েছেন পিতার কোনো মানহানী না হোক। লজ্জায় না পড়ুক তাঁর পিতা। নবিজি আবেগের তাড়নায় দুলতে থাকেন। এ হার তো খাদিজার গলায় থাকা এক মূল্যবান হার। সহধর্মিণী, প্রথম মুসলিম, প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতি বিজড়িত হার। পৃথিবীর সব সম্পদ এর কাছে তুচ্ছ। এ তো অমূল্য রতন। কী করে এটি বায়তুল মালের সঙ্গে মিশে যাবে! কেবল জয়নবের গলায়ই এ হার মিশে থাকতে পারে। পৃথিবীর কোনো হাতের স্পর্শ কি এর সঙ্গে যায়?
রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘এ হার পাঠিয়েছে আমার কন্যা জয়নব। এ হারটি তার মায়ের। ইচ্ছে করলে হারটি তোমরা পাঠিয়ে দিতে পারো। মক্কা গিয়ে আবুল আস জয়নবকে মদিনায় পাঠিয়ে দেবে। এই তার ফিদয়া।’
কী অতুলনীয় সমাধান! মানুষের বিনিময়ে মানুষের মুক্তি। জয়নব তো মুসলমান। তিনি কেন অসহনীয় জাঁতাকলে কষ্ট করতে থাকবেন দারুল হরবে। তিনি ফিরে আসবেন শান্তির শামিয়ানায়, মদিনার আবাসে। পিতার রাষ্ট্রে। মা খাদিজার স্মৃতিচিহ্নটা গলায় নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে আসবেন পিতার আশ্রয়ে।
মহামূল্যবান এ হারের বিনিময়ে জয়নব ফিরে পেলেন স্বামী আর নবিজি পেলেন আদরের কন্যা জয়নবকে।
যিয়াদ বিন সাঈদ শিক্ষার্থী, মাদরাসাতুল কাউসার, ঢাকা
ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত