আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছিলেন নিকট-অতীতের বাংলাদেশে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, অবিতর্কিত, সর্বজনমান্য বিস্ময়কর এক মনীষী আলেম। দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার প্রাত্র। দেশের হকপন্থী উলামায়ে কেরাম তো বটেই, সরকার এবং বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছেও ছিলেন পরম সম্মানীয় মুরব্বি। অবশ্যি ইন্তেকালের আগের কিছুদিন বার্ধক্যজনিত কারণে তাঁকে একটি চক্র নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু অভিযোগকারীরা তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা এবং সম্মান বজায় রেখেছেন। এই লেখায় আমরা আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কিছু মূল্যায়ন ও মতামত তুলে ধরব।
বাংলাদেশের মনীষী আলেমদের জীবনী-বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘জীবন্তিকা’ আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহমতুল্লাহি আলায়হি’র জীবনীর ওপর তাঁর জীবদ্দশায়ই কাজ শুরু করেছে। হজরতকে নিয়ে ইতিমধ্যেই দেশের নানা প্রান্তের বিশিষ্টজনদের মতামত ও মূল্যায়ন তারা সংগ্রহ করেছে। হজরত সম্পর্কে এখানে যেসব মতামত ও মূল্যায়ন বিবৃত হবে, তা জীবন্তিকার সেই সংগ্রহ থেকেই চয়ন করা।
আল্লামা আবদুল হালিম বুখারি
আল্লামা আবদুল হালিম বুখারি চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় দ্বীনি বিদ্যাপীঠ পটিয়া মাদরাসার মহাপরিচালক। আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহমতুল্লাহি আলায়হি সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কবে হয়েছিল, দিন-তারিখ ঠিক মনে নেই। আমি হাটহাজারীর মাহফিলে যেতাম, তিনি পটিয়ার মাহফিলে আসতেন। এইভাবেই একসময় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়। তাঁর প্রতি সবসময়ই আমার মনে শ্রদ্ধাপূর্ণ একটা মনোভাব জাগরুক থাকত। হেফাজতে ইসলাম যে মজলিসে গঠিত হয়, আমি সে মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। আন্দোলন গঠিত হয়েছিল দাওয়াতি আন্দোলন হিসেবে। কিন্তু আন্দোলনের দায়িত্বে, বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত থাকার কারণে দাওয়াতি আন্দোলনটা রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। লংমার্চ, অবরোধ—এগুলো তো রাজনৈতিক কর্মসূচি। তবুও হেফাজতের আন্দোলনকে একদম ব্যর্থ বলা যায় না। যাই হোক, সেটা ভিন্ন বিষয়। হজরতের নেতৃত্বে কওমি সনদ অর্জিত হয়েছে, এটা আমি মনে করি অনেক বড় অর্জন। হজরতের পুরো জীবনটাই ছিল হাদিসের খেদমতে কুরবান৷ তাঁর হাতে তৈরি হয়েছেন হাজার হাজার আলেম। যাঁরা দেশে-বিদেশে আলো ছড়াচ্ছেন। আমি মনে করি তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি সৌভাগ্য।’
অ্যাডভোকেট শেখ মো. আব্দুল্লাহ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ। করোনা সংক্রমণে এই তো মাস কয়েক হলো তিনি ইন্তেকাল করেছেন। উলামায়ে কেরামের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কতটা প্রগাঢ় ছিল, তা সর্বজনবিদিতি। তিনি আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফীকে নিয়ে কথা বলাটা সহজ, আবার কঠিনও। তিনি হলেন বাংলাদেশের আলেমদের হৃদয়ের মুকুট। যে সম্মান ও অভিধায় তিনি ভূষিত, ইখলাস ও খুলুসিয়্যাত না থাকলে কারও ভাগ্যে এই অভিধা জোটে না। আমাদের যেসমস্ত আকাবির, শামছুল হক ফরিদপুরী, মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি, শাইখুল হাদিস আজিজুল হক প্রমুখ তারকা আলেমদের যে স্বর্ণশৃঙ্খল, তাঁদেরই একজন গর্বিত উত্তরসূরি আল্লামা আহমদ শফী।’
কওমি মাদরাসা শিক্ষাসনদের স্বীকৃতি বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, কওমি মাদরাসার সনদের প্রসঙ্গ যখন উঠে, আমার মাধ্যমেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বললেন, “অবশ্যই সনদ দিতে রাজি। কিন্তু সবকিছুরই একটা নিয়ম থাকে। আপনারা একটা কমিশন তৈরি করুন। সেই কমিশনের অধীনে আমরা আমাদের সনদের কার্যক্রম শুরু করব।”
‘কিন্তু আলেমদের মধ্যে তখন প্রচুর বিভেদ। কোনোভাবেই তাঁদেরকে এক করা যাচ্ছে না। আল্লাহর ফজল—আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে সবাই এক পতাকাতলে এসে হাজির হন। আল্লামা আহমদ শফী সাহেব হুজুর না থাকলে সেই ঐক্য হতো কিনা সন্দেহ। এরপর আল্লামা আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে সনদের জন্য কমিশন তৈরি করা হয়। সেই কমিশনের সঙ্গে আলাপ করে সনদের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের তখন শেষদিক। মন্ত্রীসভায় বিল পাশের পর তিনি দেখলেন আইনি জটিলতা আছে এখানে। এদিকে সংসদ অধিবেশনও সমাপ্তির পথে। তড়িঘড়ি করে প্রধানমন্ত্রী একদিনেই বিলটি সংসদে পাশ করিয়ে নিলেন। এবং কমিশনের দেয়া যাবতীয় শর্তসহ।
‘আল্লামা আহমদ শফী ছায়াদার, ফলদার ফলবৃক্ষ এক। আমলে যেমন এগিয়ে, তেমনি ইলমেও। অনেকে ইলমে এগিয়ে আছেন, কিন্তু আমলে অনেক পিছিয়ে। আমল ছাড়া তো ইলমের কোনো মূল্য নেই। ইলম ও আমল—এ দুটোর জ্যোতির্ময় সম্মিলনে ঝলমল করে উঠেছেন আল্লামা আহমদ শফী। তার ছায়ায় বসে আমরাও স্বস্তি পাই, প্রশান্তি অনুভব করি।’
আল্লামা মুহাম্মদ ইদরীস
চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় দ্বীনি বিদ্যাপীঠ নাজিরহাট বড় মাদরাসার সদ্যপ্রয়াত মুহতামিম ও শায়খুল হাদিস আল্লামা মুহাম্মদ ইদরীস। মাস কয়েক হলো ইন্তেকাল করেছেন। আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তখন হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলি থানভি রহ.-এর খলিফা হজরত মাওলানা আবদুল ওয়াহহাব রহ.। একদিন আমার এক উসতাদ আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন পরিচয় করাতে। মুহতামিম সাহেব রহ. আমাকে বললেন, “বড়দের কাছাকাছি থাকবে সবসময়। বড়দের দুআ নিতে চেষ্টা করবে। বড়দের দুআয় মানুষ বড় হয়।” এই কথা বলে তিনি আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের একটি ঘটনা শুনান আমাকে। তিনি বলেন, “আহমদ শফী তখন ছোট, হেদায়াতুন্নাহু কিংবা কাফিয়া পড়ে। রবিপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক বাড়িতে লজিং থাকত। একদিন হঠাৎ আমার কাছে এসে কান্না শুরু করল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁদছ কোন? সে বলল, যে বাড়িতে লজিং থাকি, বাড়ির মহিলারা আমার সামনে চলে আসে। বলে, তুমি আমার ছেলের মতোই, এখনো ছোট। আমাদের সঙ্গে পাকঘরে বসে খাবার খাও। আমি বলেছি, আমি পর্দা করি, পারব না আপনাদের সঙ্গে বসে খেতে। কিন্তু তারা আমার বাধা মানে না, সামনে চলে আসে বারবার।”
‘আব্দুল ওয়াহহাব সাহেব বলেন, “এই ছেলের কথা শুনে আমি হতবাক। এত কম বয়সে এত তাকওয়া তার! তাকে দেখে আমার দৃষ্টি জুড়িয়ে গেল। ভেতর থেকে আমি দুআ করে উঠলাম আর ভাবলাম এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে, নিশ্চয়ই। তখম বোর্ডিং-জিম্মাদার ছিলেন মাওলানা আবদুল হামেদ সাহেব রহ.। আমি মৌলভি আহমদ শফিকে বললাম, আজ থেকে তুমি বোর্ডিংয়ে খাবে। লজিং বাড়ি যেতে হবে না। আমি মাওলানা হামেদ সাহেবকে বলে দেব। এর কিছুদিন পর সে দেওবন্দ চলে যায়। একদিন দেওবন্দ থেকে আহমদ শফির চিঠি আসে। খুলে দেখি সে লিখেছে, হুসাইন আহমদ মাদানি তাকে খেলাফত দিয়েছেন। চিঠি পড়ে চোখে জল এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুহাত তুলে পরম করুণাময়কে বললাম, আমি সুদৃষ্টিতে যা কামনা করেছিলাম, তুমি তা-ই পূর্ণ করে দিলে মালিক। লাজ রাখলে তোমার বান্দার শুভদৃষ্টির।”
‘আল্লামা আহমদ শফী সাহেব পরিচালনায় হাটহাজারী মাদরাসার অনেক উন্নতি হয়েছে। চারপাশে বিল্ডিং, ছাত্রাবাস, মনোরম পরিবেশ তাঁর চিন্তায় ও প্রচেষ্টায় তৈরি হয়েছে। তাঁর দায়িত্ব পালনকালে হাটহাজারী মাদরাসার যে উন্নতি হয়েছে, আর কারও সময়ে এত হয়নি। আল্লাহ তাঁকে বড় করেছেন, বড় বড় কাজ নিয়েছেন। শুধু হাটহাজারী মাদরাসাই নয়, বরং বাংলাদেশের মুসলিম উম্মাহর জন্যও বড় বড় কাজ করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন, অর্জিত হয়েছে কওমি মাদরাসার সনদ।’
প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভী
চট্টগ্রাম-১৫ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভী। আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে স্মৃতি থেকে কিছু গল্প বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আরবের মুখলেস এক দানবীর ব্যক্তিত্ব ছিলেন শেখ বসির। আরবের বাসিন্দা হলেও চিন্তা-চেতনায়, আবেগে-উচ্ছ্বাসে আপাদমস্তক দেওবন্দি ছিলেন। দেওবন্দের যাবতীয় ছাপ ছিল তাঁর মধ্যে। রুহানিয়্যাত, রব্বানিয়্যাত এবং তরিকত—সবকিছুতে সমান বিচরণ ছিল তাঁর।
‘তিনি ছিলেন হাজি ইউনুস সাহেবের মুরিদ। আরব রাষ্ট্রগুলো থেকে তাঁর মাধ্যমে হাজি সাহেব সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়েছেন। এরপর আল্লামা আহমদ শফী রহমতুল্লাহি আলায়হিও তাঁর মাধ্যমেই হাটহাজারী মাদরাসার জন্য সবচেয়ে বেশি অনুদান পেয়েছেন।
‘খানকার মতো একটা হলরুম ছিল শেখ বসিরের বাড়িতে। আরবের বিভিন্ন আলেম আসতেন সেখানে। ছোট হলেও আমিও যেতাম, যেতেন আল্লামা আহমদ শফীও। হলরুমের একপাশে বসতেন মিসরি এবং সিরীয় আলেমগণ। সেই মজলিসে আল্লামা আহমদ শফী কথা বলতেন। কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতির সঙ্গে আওড়াতেন গুলিস্তাঁ, বুস্তা, মসনবি থেকে ফার্সি কবিতা। যেই কবিতাগুলোতে থাকত রুহানিয়্যাত ও রব্বানিয়্যাতের ঝলক। বড় বড় আউলিয়ায়ে কেরামের দীপ্তিময় বাণী। সঙ্গে সঙ্গে ফার্সি কবিতাগুলোর অনুবাদ করে দিতেন। অনেকগুলোর অনুবাদ করে দিতাম আমি। বয়সে ছোট হলেও, মজলিসে আমিও কথা বলতাম। মন্তব্য পেশ করতাম। চেষ্টা করতাম কথাগুলো গুছিয়ে বলার। তাই সবাই আমার কথাগুলো পছন্দ করত।
‘এভাবেই আল্লামা শাহ আহমদ শফী’র সঙ্গে আমার পরিচয়। নুরানি এক সফরের শুরু।
‘হাটহাজারী মাদরাসা যেন হজরতের স্পর্শেই পূর্ণতা পেয়েছে। হাজি ইউনুস সাহেব হজরতকে মাদরাসার মুহতামিম বানানোর পর সবকিছুতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। মাদরাসার শিক্ষা, মাদরাসার কাঠামোগত উন্নতি, মাদরাসা পরিচালনা—সবকিছুতে এক নবজোয়ার এসেছে। সবকিছু নবউদ্দীপনা পেয়েছে। এত উন্নতি, তরতর করে উপরে উঠে যাওয়ার একমাত্র কারণ—হজরতের ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত। ইখলাসের শক্তি ও উদ্যম নিয়েই তিনি মাদরাসার জন্য দৌড়ে বেড়িয়েছেন দেশ-দেশান্তর। দুবাই, সৌদি আরব, কাতার। শেখ বসিরের মজলিসেও মাদরাসা নিয়ে কথা হতো।
‘১৯৯৩ সালে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে হাটহাজারি মাদরাসায় গিয়েছিলাম। এরপর গিয়েছিলাম কুয়েতের একদল অতিথি নিয়ে। হজরত আমাকে দারুণ আপ্যায়ন করেছেন। মেহমানখানায় হজরত নিজ হাতে তুলে আমাকে খাইয়ে দিয়েছেন। মাদানি দস্তরখানা যে কত উদার, তা সেদিন টের পেয়েছিলাম।
‘হজরতের ছেলে আনাস যখন হাটহাজারি মদরাসার কালেকশনের জন্য কুয়েত যায়, আমি একটি ‘রিকমেন্ডেশন লেটার’ লিখে দিয়েছিলাম। এই চিঠির ভরসায় শেখ আবদুল আলি আল মুতাউওয়া’ মাদরাসার জন্য বড় অংকের বার্ষিক একটা অনুদান চালু করে দেন। এজন্য হজরত আমার ওপর অনেক বেশি সন্তুষ্ট ছিলেন।
‘ইসলামি আকিদার জন্য, দেওবন্দি সিলসিলার জন্য, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের জন্য, সহিহ তাবলিগের জন্য, কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য—হজরত সবসময় তৎপর ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে এসেও চৌকান্না হয়ে কাজ করেছেন। আমাদের জন্য আলোর পথ তৈরি করেছেন। বিস্ময়কর সর্বশেষ যে কাজটি তিনি করে গেলেন, তা হলো কওমি সনদ। সব আলেমকে একমঞ্চে এনে, এক কাতারে দাঁড় করিয়ে সরকার থেকে আাদায় করলেন দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়া সনদ।
‘হজরতের মতো এত উদার, এত উন্নত ও মার্জিত মানসিকতার মানুষ খুব দুর্লভ। হাটহাজারি মাদরাসায় গেলেই টের পাওয়া যায় হজরতের উন্নত মানসিকতার চমক। মাদরাসার ক্লাসরুম, গবেষণাগার, মেহমানখানা, লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব—সবখানে। একদিকে হজরত ইখলাস ও জিকরে ইলাহিতে ভরপুর, অন্যদিকে দুনিয়াবি আসবাব ও আধুনিকতার দিকেও মনযোগী। দুটোর সম্মিলনে হজরত আমাদের জন্য জীবন্ত এক মহীরুহ হয়ে উঠেছিলেন। ছায়ায় মায়ায় আমাদের আগলে রেখেছিলেন।
‘শেখ বসিরের মজলিস থেকে হযরতের সঙ্গে যে নুরানি সফরের শুরু, তা আমার ছোট্ট জীবনকে ধন্য করেছে। এ সফরে হঠাৎ করেই এভাবে ছেদ পড়বে, বুঝতে পারিনি। হজরত চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আল্লাহ তাঁর মর্যাদাকে আখেরাতে আরও বুলন্দ করে দিন। আমিন।’
আলহাজ্ব মিছবাহুর রহমান চৌধুরী
আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছেন বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর আলহাজ্ব মিছবাহুর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘হজরতের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৮ সালে। যখন আমি লন্ডন থেকে ফিরি, বাংলাদেশে তখন কয়েকটি ইসলামি দলের সমন্বয়ে ইসলামিক একটি বড় প্লাটফর্ম তৈরি প্রয়াস চলছিল। মাওলানা মশিউর রহমান সাদী সাহেবের নেতৃত্বাধীন জমিয়াতুল আনসার, জমিয়াতুল উলামায়ে ইসলাম, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের জামাতা মাওলানা খলিলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন নিখিল বাংলাদেশ মুসলিম লীগ—জামায়াতে ইসলাম ছাড়া এইসব আরও অনেক দল নিয়ে এক-দুবছর পর একটি প্লাটফর্ম দাঁড়ায়। সম্মিলিত এই প্লাটফর্মের নাম ইসলামি আন্দোলন। আমি ছিলাম এর জেনারেল সেক্রেটারি।
‘ইসলামি আন্দোলনের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গুলিস্তানে, স্টেডিয়ামের পাশে। তখনই মাওলানা মশিউর রহমান আমাকেসহ আরও কয়েকজন আলেমকে নিয়ে হাটহাজারী যান। আল্লামা আহমদ শফীর সামনে সম্মিলিত প্লাটফর্মের এই ধারণাটি তুলে ধরেন। হজরত পূর্ণ সমর্থন জানান। কাজ চাালিয়ে যেতে বলেন এবং তিনি সঙ্গে থাকবেন বলেও আশ্বাস দেন। এভাবেই হজরতের সঙ্গে আমার পরিচয়।
‘একবার হাটহাজারী মাদরাসা নিয়ে আল্লামা আহমদ শফীর সাথে কমিটি কিংবা এলাকাবাসীর বিরোধ হয়। খতিব মাওলানা উবায়দুল হক রহ. এবং মুফতি ইযহার সাহেব বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করেন। তখন আমি খতিব সাহেবের সঙ্গে গিয়েছিলাম। হজরত খুব খুশি হয়েছেন। দুআ দিয়েছেন। ভালোবাসা দিয়েছেন।
‘২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৯ সালে ভোলার গ্রিন ক্রিসেন্ট মাদরাসায় অস্ত্র পাওয়া নিয়ে অধিকাংশ মিডিয়া কওমি মাদরাসাকে দোষারোপ করতে শুরু করল। তখন আমরা বাইতুল মোকাররমের উত্তর গেটে একটি বড় সমাবেশ করি। প্রধান অতিথি ছিলাম আমি, সভাপতিত্ব করেছিলেন মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ। আগেই অ্যাপয়েনমেন্ট নেওয়া ছিল। সমাবেশের পর ১০ সদস্যের একটি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করি। তাঁকে বলি, পুরো দেশের উলামায়ে কেরামের পক্ষ থেকে আমরা কয়েকজন এসেছি। কওমি মাদরাসার ওপর যে দোষারোপ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। খুব মনোযোগ দিয়ে তিনি কথাগুলো শুনলেন।
‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই বৈঠকেই কওমি সনদের প্রসঙ্গ উঠে আসে। আমি বললাম, “আল্লামা আহমদ শফীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।” প্রধানমন্ত্রী বললেন, “কিভাবে কী করা যায়?” আমি বললাম, “একটি সিলেবাস-কমিটি গঠন করা যায়। কারও হস্তক্ষেপ ছাড়া তারা একটি সিলেবাস প্রণয়ন করবে। সেই সিলেবাসের ওপর সনদ দেওয়া হবে।” আমার কথাটি মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ সাহেবও পছন্দ করলেন।
‘এরপর আল্লামা আহমদ শফী সাহেব যখন ঢাকা আসেন, ফরিদাবাদ মাদরাসায় বৈঠক হয়। বৈঠকে ছিলেন মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মালানা রুহুল আমিন খান, মাওলানা নুরুল ইসলাম, ইসলামি ঐক্যজোটের মনিরুজ্জামান চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন আলেম। তিনি বিষয়টি খুব ইতিবাচক হিসেবে নিয়ে বললেন, “অবশ্যই কমিটি করতে হবে এবং তা আজকেই।” হজরত বললেন, “তোমার নামও থাকবে কমিটিতে।” আমি বললাম, “আমি কওমি মাদরাসায় পড়িনি। কওমি মাদরাসা সম্পর্কে ভালো জানি না। আমি না থাকলে ভালো হয়।” তবুও হযরত জোর করে আমার নাম কমিটিতে দিয়ে দিলেন। হজরতের সাইন করা তালিকা আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিই।
‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে তালিকা দেবার পর প্রথম বৈঠকে আমি যাইনি। শাইখুল হাদিস আজিজুল হক ও আল্লামা আহমদ শফী গিয়েছিলেন। বৈঠক অরগানাইজ করেছিলেন শেখ মো. আব্দুল্লাহ। বৈঠকে শাইখুল হাদিস রহ.-এর লিখিত বক্তব্য পড়ছিল তাঁরই কোনো এক ছেলে। বক্তব্যের একস্থানে আমার নাম পড়তে গিয়ে বলল, তিনি কওমিতে পড়েননি। তখন শাইখুল হাদিস সাহেব প্রধানমন্ত্রীর সামনেই ধমকে উঠলেন, “তিনি কওমিতে পড়েননি কথাটা কি লেখায় আছে? এটা বললে কেন?”
‘এই ঘটনায় আল্লামা আহমদ শফী সাহেবও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
‘হজরত একটি পরশপাথর। আমার যাপিত জীবনের বর্ণমালা তাঁর ছোঁয়ায় আলাদা মর্ম পেয়েছে। আলাদা ব্যাঞ্জনা পেয়েছে। জীবন আলোকিত করার জন্য এইসব মনীষীর দুআ এবং ছোঁয়া দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।’
অধ্যাপক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী
বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাপরিচালক অধ্যাপক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী। আল্লামা শাহ আহমদ শফী’র সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ও তাঁর সম্পর্কে নিজের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি রহমতুল্লাহি আলায়হি’র সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল খুবই সাদামাটা এবং খোলামেলা। যখন যা ইচ্ছে, অন্যরা যা বলতে পারত না, আমি তা মুখ খুলে বলে ফেলতে পারতাম। তিনি কখনো আমার কোনো কথা ফেলে দেননি।
‘আমি তখন নতুন বেফাকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব আমাকে হজরতের কাছে নিয়ে গেলেন। সাক্ষাৎ-শেষে হযরত আমাকে বললেন, ‘কাজ করে যান। দুআ করি আপনাদের জন্য।’ আমি তখন বললাম, ‘শুধু দুআয় পোষাবে না, মাথায় একটু ফু দিয়ে দেন, যেন সঠিকভাবে কাজ করতে পারি।’ হজরত মুচকি হেসে আমার মাথায় ফু দিয়ে দিলেন। এরপর যখনই দেখা হয়েছে, হজরত আমার পুরো শরীরে হাত বুলিয়ে ফু দিয়ে দিতেন।
‘হেফাজত ট্রাজেডির দুবছর পর হজরত প্রথম যখন ঢাকায় এলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ফরিদাবাদ মাদরাসায় গেলাম। সঙ্গে মাওলানা মনিরুজ্জামান সাহেব। আমি মাওলানাকে বললাম, “হজরত বেফাকের চেয়ারম্যান। এতদিন পর ঢাকায় এলেন আর বেফাকে আসবেন না, তা হতে পারে না। আমি তাঁকে বেফাকে আসবার দাওয়াত করব।” মাওলানা আবদুল জব্বার সাহেব দেওবন্দ সফরে থাকায় আমি তখন বেফাকের ইনচার্জ মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলাম। ফরিদাবাদ যখন পৌঁছি, আসর হয় হয়। নামাজের পর রেস্টরুমে এসে দেখি হজরত সাদা গেঞ্জি পরে বসে নাস্তা করছেন। তাঁর সামনে বসে আছেন বড় বড় অনেক আলেম। কেউ হজরতের সঙ্গে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না।
‘নাস্তা শেষ হলে আমি এগিয়ে গিয়ে মুসাফাহা করে বললাম, “আমি অমুক, বেফাকের অমুক দায়িত্বে আছি। আপনি তো বেফাকের বাপ। ঢাকা এলেন আর বেফাকে আপনার সন্তানেরা কী কাজ করছে, না দেখেই চলে যাবেন? অন্তত পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও বেফাকে যেতে হবে।” আমার এমন কথা শুনে সবাই তো কেমন কেমন করছেন। না জানি হজরত কী বলেন। হজরত আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, আমি হজরতের দিকে। এরপর তিনি তাঁর খাদেম শফিকে ডেকে বললেন, “ডায়েরিতে লিখো আমি বেফাকে যাব।” সত্যিই হজরত বেফাকে এলেন, এক ঘণ্টা সময় কাটালেন।
‘আরেকবার হজরত ঢাকায় এলেন। ফরিদাবাদ মাদরাসায় গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। আসরের পর মাওলানা আবদুল কুদ্দুস সাহেবের (বেফাকের সদ্য-বিদায়ী মাহসচিব) রুমে তাঁর সামনে অনেকেই বসা। আমার ভগ্নিপতিও দেওবন্দ-ফারেগ এবং মাদানি রহ.-এর খলিফা। আমি হজরতকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি ভগ্নিপতির আগে না পরে ফারেগ হয়েছেন?” হজরত বললেন, “আগে।” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি আগে খেলাফত পেয়েছেন নাকি উনি?” আমার প্রশ্নের ধরন দেখে উপস্থিত সবাই উশখুশ করলেও হজরত উত্তর দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে আমার ভয়ের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
‘একবার বেফাকের একজন দায়িত্বশীল আমাকে দিয়ে হজরতের কাছে কিছু বলাতে চাচ্ছিলেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, তাই। আমি বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম। হজরতকে বললাম, “আগের তুলনায় বেফাক ভালো চলছে এখন। আবদুল জব্বার সাহেবের সময় বেফাক পিছিয়ে পড়েছিল।” এতটুকুই। হজরত কীভাবে যেন বুঝে ফেললেন কথাটা আমার না, পাশে বসে থাকা মাওলানার। হজরত তখন শুধু বললেন, “আবদুল জব্বার সাহেব যা করে গেছেন, তার প্রতিদান আল্লাহর নিকট পাবেন। আপনারা তাঁর শুকরিয়া আদায় করুন। গিবত করা জায়েজ নেই। আপনাদের কাজটুকু আপনারা করুন।”
‘হজরতের সঙ্গে অন্য কারও তুলনা চলে না। সাধারণ মানুষ থেকে প্রধানমন্ত্রী, সবার কাছেই তিনি বরণীয়। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল গণভবনে যখন আলেমদের আমন্ত্রিত করা হয়, সেখানে প্রধানমন্ত্রী এবং আল্লামা আহমদ শফীর চেয়ারে কোনো পার্থক্য ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর সামনে দুই মাইক, হজরতের সামনেও দুই মাইক। প্রধানমন্ত্রী হজরতকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন, পাতে খাবার তুলে দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একজন আলেমের এই সম্মান সেদিন সবাই প্রত্যক্ষ করেছিল।
হজরত কথা বলতেন খুব কম। কিন্তু কে কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কথা বলছে, তা ধরে ফেলতেন সহজেই। এমনকি বৃদ্ধ বয়সে এসেও। বিভিন্ন মিটিংয়ে দেখেছি মাথা নিচু করে বসে থাকতেন। আমরা মনে করতাম তিনি ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু সবার কথা শেষ হলে তিনি এমন একটা সিদ্ধান্ত দিতেন, আমরা মুগ্ধ এবং অবাক হয়ে যেতাম তাঁর বিচার-বিবেচনা দেখে। মনেই হতো না এত বয়স হয়েছে তাঁর। শেষ-বয়সে ক্লান্তি তাঁকে স্পর্শ করেছিল ঠিক, বার্ধক্যও এসেছিল, কিন্তু তা কেবলই দেহে, মনে নয়।
পরকালীন জীবনে হজরতের মর্যাদাকে আল্লাহ তাআলা আরও সমুন্নত করুন, এই দুআ করি।
মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী
দেশের খ্যাতিমান ওয়ায়েজ মাওলানা নুরুল ইসলাম ওলিপুরী। আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী রহমতুল্লাহি আলায়হি’র সঙ্গে প্রথম পরিচয় কবে কোথায় ঠিক মনে নেই, তবে স্মৃতির আবছা আলোয় এতটুকু মনে করতে পারি, হাটহাজারী মাদরাসার মাহফিলে গিয়েছিলাম। তখনই প্রথম দেখা, প্রথম পরিচয়। হজরতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার কোনো যোগ্যতা বা গুণ আমার ছিল না, এখনও নেই। হজরত নিজেই নিজের উদ্যোগে আমাকে তাঁর ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছিলেন।
‘বেশ কবছর আগে হজরত একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি হাটহাজারী মাদরাসায় ছুটে গিয়ে হজরতের সামনে উপস্থিত হলাম। হজরত বললেন, “হাটহাজারী মাদরাসার ভর্তি ফরম পুরা করো।” আমি পুরো করলাম। এরপর বললেন, “ভর্তি ফি আদায় করো।” আমি করলাম। দাওরায়ে হাদিসের সবকে বসতে পুরো বছরের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা মাদরাসায় জমা দিতে হয়। তা-ও দিলাম। তিনি বললেন, “আজ বুখারির সবকে বোসো।”
‘হজরত যখন বুখারির সবক পড়াতে এলেন, আমাকে বললেন, “একটি হাদিস পড়ো।” আমি হাদিস পড়ার পর তিনি ক্লাসের দেড় হাজার ছাত্রকে সাক্ষী রেখে বললেন, “তোমরা সাক্ষী থাকো। আমি তাকে সিহাহ সিত্তা পড়ানোর সনদ দিলাম। পাশাপাশি আমার খেলাফতও দিলাম।”
‘হজরতের দরসে তারপর আমি অনেকবার বসেছি, হাদিস পড়েছি। দেখেছি—তাঁর হাদিসের পাঠদান বেশ শানদার, জানদার। লন্ডনের এক সফরে সেখানে খতমে বুখারির এক অনুষ্ঠানে বুখারি শরিফের শেষ হাদিসের তাকরির করেছিলেন হজরত। এমন জ্ঞানগর্ভ তাকরির আমি কোথাও শুনিনি। সেদিন আমার আন্দাজ হয়েছে—হাদিস শাস্ত্রে তিনি কত পারঙ্গম, কত অভিজ্ঞ! আমার দৃষ্টিতে হাদিস শাস্ত্রের পাণ্ডিত্য এবং অভিজ্ঞতা তাঁর বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম।
‘আমার মনে হয়, দেশে বিদআতিদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বেশি কলম ধরেছেন তিনি। যখন তিনি বিদআতিদের বিরুদ্ধে দলিল-প্রমাণ পেশ করা শুরু করেন, উলামায়ে কেরামের মধ্যে তিনিই ছিলেন একমাত্র। তখন তিনিও লক্ষ করেছিলেন, আমিও বাতিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এটিই মনে হয় আমার প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের প্রধান কারণ।
‘ছোট্ট এই জীবনে এমন কিছু সৌভাগ্য আসে—যা জীবনের ছোট্ট এই ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে যেতে চায়। আল্লামা আহমদ শফী আমার সেই সৌভাগ্য, আসমান থেকে বর্ষণ করা ফুলচন্দন। হজরত আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, এতিম হয়ে পড়লাম আমরা। আল্লাহ তাআলা হজরতের কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিন, এই দুআ করি।’
মাওলানা জাফর আহমদ
রাজধানীর ঢালকানগরের পীর মাওলানা জাফর আহমদ। আল্লামা আহমদ শফী সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম পীর ও মুরশিদ যিনি তাঁর ইন্তেকালের পর ইস্তেখারা করে সংকল্প করলাম, আমি মাওলানা আবদুল হাফেজ মক্কি রহ.-এর হাতে বাইআত হব। মক্কী রহ.-এর ইন্তেকালের পর অনেক চিন্তা-ফিকির করে আমি আল্লামা আহমদ শফীর সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ি।
‘হজরত ফরিদাবাদ মাদরাসায় এসেছিলেন। এখানেই, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস সাহেব হুজুরের রুমে আমি হজরতের হাতে বাইআত হই। হজরত আমাকে আত্মশুদ্ধি বিষয়ে অনেক কথা বললেন৷ মুসাফাহার সময় আমার হাত অনেকক্ষণ ধরে রাখলেন। হজরতের একটি কথা সেদিন আমার মন আনন্দে ভরিয়ে তুলেছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, “আমি আপনাকে শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর সাথে জুড়ে দিলাম।”
‘আসলে হজরত আমাদের সকলের জন্যই বিরাট এক রহমত। আমাদের উচিত এমন বুজুর্গদের কাছে গিয়ে তাঁদের থেকে উপকৃত হওয়া। তাঁদের আলোয় নিজেদের আলোকিত করা। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।’
মাওলানা মুশতাক আহমদ
খুলনা’র ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ জামিয়া দারুল উলুম খুলনার প্রিন্সিপাল মাওলানা মুশতাক আহমদ। আল্লামা শাহ আহমদ শফী সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সালে আমি হাটহাজারী পড়তে আসি প্রথম। বাড়িতে না জানিয়েই। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়ে যাই কুদুরিতে। এ বছর কাফিয়া পড়েছি আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের কাছে।
‘হজরত তখন বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রামে যেতেন। এক জায়গায় প্রোগ্রামে গিয়ে পড়লেন বিপাকে। এক বিদআতি নিজের পরিচয় লুকিয়ে তাঁকে দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি মঞ্চে ওঠার পরই গণ্ডগোল বেঁধে যায়। মানুষ তাঁকে মারতে আসে। খবর পেয়ে মাদরাসার ছাত্ররা তখন গেট খুলে বেরিয়ে যেতে চায় প্রতিবাদে। কিন্তু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ আটকে দেয়। তবুও এই রাতে কয়েকজন ছাত্র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বেরিয়ে যায়।
‘হজরত তখন ভিড় ঠেলে কোনোমতে নিজেকে বাঁচিয়ে পেন্ডেল থেকে বেরিয়ে তাঁর এক ভক্তের বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। ছাত্ররা গিয়ে তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে এল। তিনি ফজরের পর সব ছাত্রের উদ্দেশ্যে বয়ান করলেন।
‘বড়দের খুব সম্মান করতেন হজরত। ঘটনাটা কুদুরির বছরই। মসজিদের বারান্দায় বসে ছিলেন আবদুল আজিজ সাহেব, আহমাদুল হক সাহেব-সহ আরও কয়েকজন। আজিজ সাহেব তখন দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। আমি মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ চোখ ফেরাতেই দেখি আবদুল আজিজ সাহেব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন মাত্র, আহমদ শফী সাহেব দোতলা থেকে উড়ন্ত ঝড়ের মতো নেমে এসে আজিজ সাহেব হুজুরকে ধরলেন। তিনি মাদরাসার উসতাদ হয়ে এগিয়ে এলেন, আর আমরা ছাত্ররা তাকিয়ে রইলাম। কী আজমত, কী মুহাব্বত, বড়দের প্রতি কী যত্ন!
‘কুদুরি বেশিদিন পড়তে পারিনি হাটহাজারী মাদরাসায়। কুরবানির বন্ধে বাড়ি গেলে মা বললেন, ‘হাটহাজারী যাবার দরকার নেই। গওহরডাঙ্গায় পড়ো।’ আমার আর আসা হলো না, গওহরডাঙ্গায় ভর্তি হয়ে গেলাম। এরপর ১৯৭৮ সালে হাটহাজারী দাওরায়ে হাদিস পড়তে যাই। দাওরাতে আল্লামা আহমদ শফী আমাদেরকে শামায়েলে তিরমিজি পড়িয়েছেন।
‘হজরতের যতটুকু সান্নিধ্য এবং ভালোবাসা পেয়েছি—এ জীবনে মনে করি সৌভাগ্যগুণেই পেয়েছি। আল্লাহর শুকরিয়া!’
অক্টোবর ২০২০