এরদোগান মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কথাটি এমনভাবে বলা হয় যেন মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার মতো অপরাধ আর নেই। তাঁকে সুলতান বলা হয়। যেন ‘সুলতান’ শব্দটি কোনো ভয়ংকর অপরাধীর নাম। এরদোগানের আরো কিছু অপরাধ আছে। তিনি একজন জনপ্রিয় নেতা। তুরস্কের ইতিহাসে পরপর চারবার নির্বাচিত দলের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। সুতরাং তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে চান! তাঁর হাত ধরে কামালবাদের রেখে যাওয়া আর্বজনা যেভাবে পরিষ্কার হচ্ছে আর জনগণ তাতে সমর্থন দিচ্ছে, তা মেনে নেয়া যায় না। অতএব তিনি একজন অপরাধী সুলতান বৈ নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বিশেষ করে সিরিয়া ও ইরাক সমস্যায় তুরস্ক যে মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকায় অবর্তীণ, তাতে এরদোগান একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতায় পরিণত হয়েছেন। ভাগ্যিস মিসরের গণতন্ত্র স্থিতিশীল হয়নি। অন্যথায় ইসরাইল-বিরোধী একটি শক্তিশালী অক্ষ গড়ে উঠতে পারত মধ্যপ্রাচ্যে। সুতরাং নতুন করে কোথাও রাজনৈতিক ইসলামের সম্ভাবনা দেখা দেয়ার পূর্বেই এরদোগানের অবসান হওয়া উচিত।
এরদোগানের সমস্যা ঘরে-বাইরে। ক্ষয়িষ্ণু কামালবাদের জেগে ওঠার আশংকা, কুর্দি বিদ্রোহ ও নিরাপত্তা ইস্যু এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তুরস্কের এক হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কবরস্থ করে জেগে ওঠে কামালবাদ। বহু শতাব্দী ধরে চলতে থাকা জাতীয় সংস্কৃতি ও পরিচয়কে তখন অপরাধ-প্রবণতার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। মাত্র কিছু দিন পূর্বেও যেখানে আজান দেয়া কিংবা আরবি শব্দের উচ্চারণ করা পর্যন্ত অপরাধ ছিল, তা এখন বৈধ। এটাকেই এরদোগানের সুলতান হওয়ার কাহিনি হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।
ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বিচারে তুরস্ক বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এশিয়া ও ইউরোপের কৌশলগত স্থানে এর অবস্থান। আন্তঃমহাদেশীয় তিনটি অন্যতম বাণিজ্যপথ তুরস্কের এশীয় ও ইউরোপীয় অংশকে পৃথক করেছে। মারমারা সাগর, বসফরাস প্রণালী ও দার্দানেল প্রণালী এই তিনটি জলপথ একত্রে কৃষ্ণ সাগর থেকে এশীয় সাগরে যাবার পথ তৈরি করেছে। তুরস্কের বৃহত্তম ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুল, যা দুই মহাদেশে অবস্থিত। হাজার বছরের অটোম্যান শাসনের সময় এটি ছিল তিন মহাদেশের রাজধানী। ইউরোপের বেলগ্রেড কিংবা আফ্রিকান দেশ সমূহ থেকে কত শত বার্তাবাহক আর সৈন্যের ঘোড়ার ক্ষুরের ধুলি এই শহরের বাতাসে উষ্ণতা ছড়িয়েছে, হিসেব নেই। গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাস জোড়েই তুরস্ক এশিয়া ও ইউরোপের সেতু হিসেবে কাজ করেছে। ফলে এশীয়, আফ্রিকান ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ে সেখানে একটি মিশ্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ১১ শতকের দিকে জাতিগত তুর্কিরা দেশটি দখল করে নেয়। তারা সেখানে সেলজুক রাজবংশের পত্তন করে। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের আক্রামণে সেলজুকদের পতন হলে এক পর্যায়ে উসমানীয় সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় এর সীমানা আনাতোলিয়া ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃতি লাভ করে। বর্তমান হাঙ্গেরির পশ্চিম অংশ এবং মধ্য ইউরোপীয় অঞ্চল ছাড়া গোটা ইউরোপ তখন অটোম্যান সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পৃথিবীতে তখন সা¤্রাজ্য বলতে একটিই ছিল, তুরস্ক। ক্রুসেডারদের আতংকের অপর নাম ছিল অটোম্যান। ইউরোপ সেই ইতিহাস ভুলেনি। তাই সুলতান নামটিকে তারা আতংকের প্রতিশব্দ হিসেবে উল্লেখ করে।
বর্তমান তুরস্ক হচ্ছে সেক্যুলারিজম থেকে ফিরে আসা একমাত্র মুসলিম রাষ্ট্র। রাজনৈতিক ইসলামের কৌশল এখানে অত্যন্ত সূ²। জটিল সেক্যুলার নিয়ন্ত্রণ থেকে একে একটি সাম্যাবস্থায় নিয়ে এসেছেন এরদোগান। না উগ্রবাদের বিকাশ হতে দিচ্ছেন তিনি আর না আরোপ করছেন ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ। ফলে কামালপন্থীদের মতে, তুরস্ক সেক্যুলার সত্তা হারিয়েছে। ইসলামপন্থী একটি অংশের মতে এরদোগান সেক্যুলারদের প্রতি সহনশীল। প্রকৃতপক্ষে তুরস্ককে খুব কৌশলে ইসলামিকরণের পথে হাঁটতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে শিক্ষা, সংস্কৃতি , সাহিত্য ও শিল্পে ইসলামি চেতনায় প্রত্যাবর্তন দেখা যাচ্ছে। দেশটি এখন মুসলিম ছাত্রদের স্বপ্নের জায়গা। বিশ্ব পর্যায়ে থিংথ্যাংক তৈরির লক্ষে দেশটি প্রতি বছর বহু মুসলিম ছাত্রকে স্কলারশিপ দিচ্ছে। সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থান প্রতিরোধে ছাত্ররা যে ভুমিকা রেখেছে তাতেই প্রমাণ হয় দেশটি ইতোমধ্যে একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
এরদোগানের অন্যতম শক্তির জায়গা হচ্ছে তাঁর পররাষ্ট্রনীতি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকাতুষ্ট নীতি থেকে তিনি বের হয়ে আসতে পেরেছেন বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে রাশিয়াকে বাণিজ্যিক সুবিধার আওতায় এনে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সংহত করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইসরাইল চাচ্ছে কুর্দি সমস্যা দিয়ে এরদোগানকে ঘায়েল করতে। সৌদি আরব কোনোভাবেই মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি গণতান্ত্রিক ইসলামি ভাবধারার রাষ্ট্রকে মেনে নিতে চায় না। বিশেষ করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে যখন মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো দল রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে কাজ করছে তখন রাজনৈতিক ইসলাম ও ইসলামি ভাবধারার মিডিয়া কেন্দ্র কাতারের পাশে তুরস্ককে কোনো অবস্থায়ই মেনে নিতে চায় না সৌদি। এরদোগানকে সেই অবস্থা জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে অত্যন্ত কৌশলে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষি, শিক্ষা ও সেবা খাতকে ঢেলে সাজিয়েছেন তিনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পর্যটন খাত আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিশ্বমানের । বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পর বেকারত্বের হার নিচে নেমে এসেছে। মানবাধিকার রক্ষায় তুরস্কের সোচ্চার কন্ঠ এরদোগানকে বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। সিরিয়ার শরনার্থীদের আশ্রয় দান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলা এবং সন্ত্রাসবাদের পশ্চিমা সংজ্ঞার সমালোচনা এরদোগানকে সর্বদা আলোচনায় রেখেছে। ইসলামোফোবিয়া পশ্চিমাদের বলছে, তুরস্কের স্থিতিশীলতা অন্যান্য রাষ্ট্রে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি বিপ্লবকে তরান্বিত করবে। এর ফলে ওআইসির কার্যকারিতা বাড়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক নতুন নতুন জোটের জন্ম হতে পারে, যা ইসরাইল ও পশ্চিমাদের নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ধারণাকে বাধাগ্রস্থ করবে।
তবে এরদোগান যদি তাঁর সম্মোহনী শক্তির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে পারেন, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের শর্তসমুহ মেনে চলেন এবং মানবাধিকার ইস্যুতে সোচ্চার থাকেন তবে অতীতের মতো আবারো তুর্কি জাতি বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম অনুঘটক হিসেবে আর্বিভূত হবে বলা যায়।
লেখক : তরুণ প্রভাষক, মৌলভীবাজার
নবধ্বনি, জানুয়ারি ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত