ঢাকায় যাঁরা ইসলামি পত্রিকা নিয়মিত পড়েন, তাঁদের অধিকাংশই তাঁকে চেনেন ভালো করে। সাধারণ পাঠক থেকে নিয়ে নামজাদা লেখক-সম্পাদক পর্যন্তÑসবার সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। এক নাগাড়ে তেপ্পান্ন বছর ধরে তিনি বই ও ইসলামি পত্রিকা বিক্রি করছেন রাজধানীর বায়তুল মুকাররম এলাকায়। হাবিবিয়া বুক ডিপোর কর্ণধার কবির আহমদ। সফেদ দাঁড়িওয়ালা সাদামাটা এক ভদ্রলোক। নবধ্বনির পক্ষ থেকে এক সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন কবি ও কথাশিল্পী সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর। গ্রন্থনা করেছেন হামমাদ রাগিব।
কেমন আছেন?
এই তো আছি, ভালোই। আপনি কেমন আছেন? এখন তো দেখাই যায় না আপনাদের!
আছি, ভালোই আছি, আলহামদুলিল্লাহ। ব্যস্ততা বেড়ে গেছে, চাচা। তাই এদিকে আর আসা হয় না খুব একটা।
ও আচ্ছা। তো কী অবস্থা!
অবস্থা আর কী! এলাম আপনার একটু খোঁজ-খবর নিতে।
ভালো, ভালো। খুশি হলাম।
আচ্ছা, আপনার এই যে বইয়ের ব্যবসা, কত বছর হলো এ ব্যবসা করেছেন?
১৯৬৫ সালে শুরু করেছিলাম…।
৬৫ সালে! তারমানে পঞ্চাশ বছরের উপরে! বলেন কী?
হ্যাঁ, পঁয়ষট্টিতেই শুরু করি। বায়তুল মুকাররম মার্কেটে ওই যে আজিজিয়া লাইব্রেরি, আমার ভাইয়ের দোকান। ও আর আমি একসঙ্গে শুরু করি বই বিক্রি। তখন তো আর এসব মার্কেট-টার্কেট কিছু ছিল না, ফুটপাতে বসে দুই ভাই বই বিক্রি করতাম।
তখন আপনার বয়স কত ছিল?
কত আর, এই তো, ষোলো-সতেরো বছর!
পড়ালেখা করেননি?
করেছি। জিরি মাদরাসায় কাফিয়া পর্যন্ত পড়েছি।
আচ্ছা ভালো কথা, দেশের বাড়ি কোথায় আপনার?
চিটাগং, বাঁশখালি।
বাঁশখালি বাড়ি, জিরি মাদরাসায় পড়েছেন কাফিয়া পর্যন্ত, পড়ালেখা শেষ করেননি কেন? ভালো লাগত না ওসব?
পড়ালেখার জন্য তকদির লাগে, আমার সেই তকদির হয়তো ছিল না।
আচ্ছা, তকদির আলির তাহলে সব দোষ! যাক। তো জিরি মাদরাসায় তখন আপনার শিক্ষক ছিলেন কারা কারা?
আল্লামা নুরুল হক, মাওলানা ইসহাক সাহেব প্রমুখ। মুহতামিম ছিলেন মাওলানা আহমদ হাসান সাহেব রহমতুল্লাহি আলায়হি।
কাফিয়া পড়ে বাড়ি চলে এলেন। তারপর ঢাকা এলেন কীভাবে? আপনার ভাই কি আগে থেকেই ঢাকা ব্যবসা করতেন?
না, ভাই জিরি মাদরাসা থেকে ফারেগ হয়েছিলেন, ৬৪-তে। দুয়েক বছর পর তিনি ঢাকা আসেন। প্রথম আমি একাই এসেছি। ট্রেনে এসেছিলাম।
ঢাকা এসে প্রথমে কোথায় উঠেছিলেন?
ঢাকা স্টেডিয়ামের সুইমিং পুলে। একটা ম্যাচে থাকতাম। পঁয়ষট্টির যখন যুদ্ধ চলে, তখনও আমি ওখানে থাকতাম। আর বইয়ের দোকানদারি করতাম বায়তুল মুকাররমের ফুটপাতে।
পঁয়ষট্টির যুদ্ধ বলতে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ…।
আচ্ছা, পঁয়ষট্টির যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে এর কী প্রভাব পড়েছিল, আপনি কী দেখেছেন?
কী আর দেখব, ছোট মানুষ ছিলাম, সারাদিন বায়তুল মুকাররমে বসে বই বিক্রি করতাম, যুদ্ধ-বিগ্রহের খবর রাখার ফুরসত পেতাম কোথায়?
না, বলতে চাইছি, বাংলাদেশে তো এর কোনো প্রভাব পড়েনি?
বলেন কী! প্রভাব পড়েছে অবশ্যই, বায়তুল মুকাররমের আশপাশেও গুলির টুকরা-টুৃকরি এসে পড়ত।
পঁয়ষট্টির যুদ্ধ তো আমরা জানি পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে হয়েছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ল কীভাবে?
দেশ তো এক ছিল! দেশের একপ্রান্তে যুদ্ধ চললে অন্যপ্রান্তে ছড়াবে না?
ও আচ্ছা। তাই? যাই হোক, তখন থেকেই এই মার্কেটে আপনি বইয়ের ব্যবসা করতেন? মার্কেটে তখন বইয়ের দোকান ছিল কয়টা?
আরে, মার্কেট! মার্কেট পাবেন কোথায়? ফুটপাতে বসতাম আমরা দুই-চারজন।
কীসে বসতেন? ছালা-বস্তা বিছিয়ে?
ভ্যানগাড়ি ছিল। ভ্যানগাড়িতে বই রাখতাম। তার আগে প্রথম প্রথম ট্রাংক নিয়ে বসতাম। ট্রাংকে করে বই এনে কোথাও বসে যেতাম ট্রাংক খুলে। কিছু দিন পর ভ্যান কিনে ফেলি।
কী ধরনের বই বিক্রি করতেন?
এই তো ইসলাম বিষয়ে নানা ধরনের বই। এমদাদিয়া, সোলেমানিয়া, মদীনা পাবলিকেশন্স ইত্যাদি প্রকাশনীর বই। তবে বেশির ভাগ বিক্রি হতো কুরআন শরিফ।
তখন তো আন্দোলনের সময় ছিল। শেখ সাহেব, ভাসানিরা দুর্বার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এদিক দিয়ে তো অনেক মিছিল-টিছিল হতো…।
হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক হতো। রোজ রোজই হতো। মতিঝিলে অনশন করেছিলেন ভাসানি। আরও কত কী!
আপনি তো তখন তরুণ। শরীরের রক্ত টগবগ করছে। এসব মিছিল-মিটিংয়ে আপনি যেতেন না?
নাহ, বই বিক্রি করেই কুল পেতাম না, আন্দোলনে যাব কোত্থেকে!
যাইহোক, পঁয়ষট্টি থেকে তাহলে আপনার বই ব্যবসার সূচনা…।
হ্যাঁ, পঁয়ষট্টিতে ব্যবসা শুরু করলাম, চুয়াত্তরে এসে মোটামুটি একটা দোকানের বন্দোবস্ত করলাম। কিন্তু অল্পদিন পর সরকার দোকানটি উচ্ছেদ করে ফেলে। আবার ভাসমানভাবে বই বিক্রি শুরু করি। তারপর পঁচাশিতে এসে এই এখানে স্থায়ী হই। আজও আল্লাহর রহমতে এই দোকান নিয়ে আছি।
হাবিবিয়া বুক ডিপো নাম কবে থেকে নিলেন?
চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের দিকে, ভাইয়ের থেকে ব্যবসা আলাদা করার পরে।
আচ্ছা, মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকার কী অবস্থা ছিল? ঢাকা তো পাকিস্তানের অধীন ছিল? আপনি কী দেখেছেন তখন?
কী আর দেখব? আমরা গরিব মানুষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ পরের কথা, আগে আমাদের পেটের চিন্তা করতে হয়েছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে সমস্যা হয়নি? বইপত্র কি বিক্রি করতে পারতেন?
আমরা ছোট ব্যবসায়ী, আমাদের আর কী সমস্যা হবে! তবে বিক্রি-বাট্টা কম ছিল। মানুষজন আতঙ্কের ভেতর সময় পার করত, বই কেনার খুব একটা ফুরসত পেত না। তাছাড়া এখনকার মতো এত লোকজনও ছিল না তখন। এলাকাটাও এত জমজমাট ছিল না। এই যে হাউজ বিল্ডিং, দালানের নাম-নিশানাও ছিল না, একটা ডোবা ছিল সেখানে।
এটা তো পুরানা পল্টনের অংশ। এখানে এখন যে বড় বড় দালান, এসব তো তাহলে কিছুই ছিল না। সব কিছ্ইু আপনার চোখের সামনে গড়ে উঠেছে…।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবই তো আমার চোখের সামনে। এই যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, এখানে লাল বিল্ডিং ছিল, ইসলামি অ্যাকাডেমির হেড অফিস, পরে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এটাকে সংস্কার করে আজকের এই রূপে দাঁড় করিয়েছে। গুলিস্তানের জাতীয় গ্রন্থাগারটাও আগে এইখানে ছিল।
আপনি অনেকদিন ধরে বইয়ের ব্যবসা করছেন, সেই চৌষট্টি-পঁয়ষট্টি সাল থেকে, অনেক লেখক-সম্পাদক আপনার এখানে এসেছেন, দেখেছেন, তাঁদের মধ্যে কার সঙ্গে আপনার হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল?
ছিল তো অনেকের সঙ্গেই। তাঁদের মধ্যে আখতার ফারূক সাহেব অন্যতম। তাঁর নতুন বই বাজারে এলেতিনি আমার এখানে আসতেন। বই বিক্রির ব্যাপারে এটা-ওটা পরামর্শ নিতেন, দিতাম। তাছাড়া মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবও আসতেন। খুব ¯েœহ করতেন। ছোট ভাইয়ের মতো দেখতেন। সে সুবাদে তাঁর ছেলেরাও আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে। দেখা হলে ‘মামা’ সম্বোধন ছাড়া কথা বলে না। এমনকি মদীনার স্টাফে যারা আছেÑসবাই আমাকে ‘মামা’ সম্বোধন করে। উবায়দুর রহমান খান নদভীও একসময় নিয়মিত আসতেন। খুব ভালোবাসেন আমাকে। আরও অনেকে ছিলেন এরকম। নাম ভুলে গেছি।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহমতুল্লাহি আলায়হির সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা আরেকটু বিশ্লেষণ করুন। তাঁর অফিস তো পল্টনেই ছিল। আপনার কাছাকাছি।
অফিস এখানে ছিল, কিন্তু তিনি তো এখানে খুব একটা বসতেন না। আমার দেখা হতো তাঁর সঙ্গে বাংলাবাজার, মদীনা ভবনে।
বিয়ে করলেন কবে?
বিয়ে তো করেছি বাহাত্তরের ডিসেম্বরে।
শ্বশুরবাড়ি কি চিটাগংয়েই?
হ্যাঁ, চিটাগং, দেশের বাড়ি।
তখনও তো ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা করছিলেন। আলাদা হয়েছেন চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের দিকে। আলাদা হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ আছে?
না, বিশেষ কোনো কারণ নেই। আলাদা তো একসময় হতেই হয়। নিজের পরিবার নিয়ে আলাদা চিন্তা তো সবারই আছে। থাকতে হয়।
আচ্ছা। তো হাবিবিয়া বুক ডিপো নামটা কোথা থেকে এল? হাবিব কার নাম?
আমার বড় মেয়ের নামা উম্মে হাবিবা। ওর নামের দিকে খেয়াল করেই দোকানের নাম রেখেছিলাম ‘হাবিবিয়া বুক ডিপো’।
আপনাকে তো সবাই চেনে হাবিবিয়া বুক ডিপোর মালিক বা হাবিবিয়া বুক ডিপো হিসেবে। আপনার নাম তো বোধহয় কেউই জানে না। আপনার নাম কী?
হা হা হা! আমার নাম কবির আহমদ।
আপনি কি বই-টই লেখেন?
না, বই লিখিনি। অন্য লেখকদের কয়েকটি ছেপেছিলাম আমার দোকানের নামে। মাওলানা আজাদের ‘সত্যের ডাক’, ‘আদাবুন নবি’, ‘ইসলাহুল মুসলিমিন’ ইত্যাদি চার-পাঁচটা বই ছেপেছি হাবিবিয়া বুক ডিপোর প্রকাশনায়।
কত সালের দিকে বই ছাপা শুরু করেছিলেন?
এসব অনেক আগে। আশি সালের দিকে।
বইগুলো কি চলেছিল বাজারে?
হ্যাঁ, এখনও চলে।
তাহলে নতুন বই ছাপেন না কেন?
একা মানুষ, অতো ঝামেলা নিতে পারি না। আগে ছেলেরা সময় দিতে পারত পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে, এখন তো সবাই চাকরিজীবী, ব্যবসাটা আমার একারই সামাল দিতে হয়, তাই আর ওসব ঝামেলায় যাই না।
ছেলেমেয়ে কয়জন?
এগারো জন। চার ছেলে, সাত মেয়ে।
সবার তো বিয়ে-শাদি শেষ?
হ্যাঁ, তবে এক ছেলে বাকি আছে।
ছেলেরা কী করে?
বড় ছেলে অ্যাকাউন্টস অফিসার। দ্বিতীয়টা হাফেজ-আলেম, মাদরাসায় শিক্ষকতা করে। তৃতীয়টা ডাক্তার, বক্ষ-ব্যাধি হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার। মেয়ে সবার বিয়ে হয়ে গেছে।
তাহলে তো দেখা যায়, পারিবারিক দিক থেকে আপনি বেশ স্বচ্ছল, তারপরও এই বয়েসে ছোট্ট একটা দোকান নিয়ে বসে আছেন কেন?
ব্যবসাটার প্রতি একটা মায়া জন্মে গেছে। ছাড়তে মন চায় না।
দুনিয়াদারি আর কত করবেন? এখন তো মসজিদে বসে বসে তসবিহ জপবেন, তাবলিগে গিয়ে চিল্লা লাগাবেন…।
হা হা হা! এটাই বড় তাবলিগ। ইসলামি বই বিক্রি করছি। এটা তো তাবলিগই, তাই না?
তা বটে। পরিবার কি ঢাকায়? নাকি দেশের বাড়িতে?
না, সবাই ঢাকায়। ছেলেমেয়েরা তো এখানেই পড়াশোনা করেছে, বড় হয়েছে, চাকরি-বাকরিও এখানে করছে।
জায়গা-জমি কিনেছেন ঢাকায়?
হ্যাঁ, সাইনবোর্ডের ওদিকে বাড়ি করেছি।
ছেলেরা আলাদা হয়ে গেছে?
নাহ, সবাই আমার সঙ্গেই আছে। এক পাকে সবার খাওয়া-দাওয়া।
তো ওই যে শুরু করলেন ১৯৬৫ সালে, আজ তিপ্পান্ন বছর, ইসলামি পত্র-পত্রিকা যারা পড়েন, ঢাকার মোটামুটি সবাই আপনাকে চেনেন, এই যে আপনার দীর্ঘ একটা জার্নি, বলা চলে একটা সংগ্রাম, এর পেছনে তো অনেক চেষ্টা-সাধনা, কষ্ট-ক্লেশ জড়িত…
হ্যাঁ, সে অনেক দীর্ঘ ফিরিস্তি। আমার সঙ্গে প্রথম প্রথম যাঁরা ছিলেন এই ব্যবসায়, তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। আমার ভাই, আজিজিয়া লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা, যাঁকে নিয়ে ব্যবসা শুরু করি, তিনিও চলে গেছেন পরপারে।
আপনার দীর্ঘ এই ব্যবসায়িক জীবনের সফলতা কী? আপনি কি মনে করেন?
সফলতা বলতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি, এই আর কি! আর কিছু না।
এটাই আপনার আত্মতৃপ্তি?
হ্যাঁ, এটাই।
আপনার কাছে কোন ধরনের পাঠক বেশি আসে?
সব ধরনের পাঠকই আসে। একেবারে সেনাবাহিনী থেকে নিয়ে পুলিশ অফিসার, সরকারি লোকজনÑএক কথায় সবাই আসে।
আপনি এই মার্কেটে, অর্থাৎ বায়তুল মুকাররম মার্কেটে সবচেয়ে বেশি ইসলামি পত্রিকা রাখেন, কোন কোন পত্রিকা বেশি চলে?
এখন তো পত্রিকার কাটতি কিংবা সংখ্যা কমে গেছে…।
পত্রিকার তাহলে সবচেয়ে ভালো সময় ছিল কোনটা? আজ থেকে কত বছর আগে?
এই তো ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত। এই সময়টাতে পাঠকের খুব একটা আগ্রহ ছিল ইসলামি পত্রিকার জন্য। ২০১০-এর পর থেকে ইসলামি পত্রিকা জগতে কেমন একটা স্থবিরতা চলে এসেছে। সবচেয়ে বেশি চলত যে পত্রিকা, আদর্শ নারী, সেটাতেও এখন ভাটা পড়ে গেছে। রহমত তো বন্ধই হয়ে গেল!
অনেক পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে আপনার ভালো খাতির ছিল, অনেকেই নিয়মিত যাতায়াত করতেন আপনার এখানে…।
হ্যাঁ, আসতেন অনেকেই আসতেন। আবদুর রহীম ইসলামাবাদী, মাওলানা রেজাউল করীম ইসলামাবাদীÑকত জনের নাম বলব? অনেকের নাম তো জানি না।
রহমতের মনযূর ভাই…।
আহারে, মনযূর ভাই তো নিয়মিত আসতেন, উবায়দুর রহমান খান নদভী সাহেব, যাইনুল আবিদীন সাহেব, শরীফ মুহাম্মদ সাহেব–সবাই একসময় নিয়মিত আসতেন। যাইনুল সাহেব আর শরীফ মুহাম্মদ সাহেব তো আমার বাসায়ও গিয়েছেন। আমার ছেলের মাদরাসায় একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তাঁরা, আমিও ছিলাম, বাসার কাছে মাদরাসা হওয়ায় তাঁদের দাওয়াত করি। ব্যাস। তাঁরাও খুব খুশি হয়ে রওনা হলেন আমার সঙ্গে।
মানে সবার সঙ্গেই আপনার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক কার সঙ্গে ছিল?
সবার সঙ্গেই তো খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, তবে মনযূর ভাই আর মুহিউদ্দীন ভাই ঘন ঘন আসতেন বিধায় সম্পর্কটা তাঁদের সঙ্গেই বেশি গাঢ় ছিল। মনযূর ভাই তো এখনও আসেন, তবে আগের মতো না। সবারই এখন ব্যস্ততা।
আপনার এখান থেকে সরকারি অফিস-আদালতের জন্য ইসলামি পত্রিকা নিয়ে যাওয়া হয়, গোয়েন্দা অফিস থেকেও লোকজন আসে, এদের সবাইকে আপনি চেনেন?
চিনি বলতে মুখ চিনি আর কি!
বিভিন্ন অ্যাম্বেসি থেকেও তো লোক আসে ইসলামি পত্রিকা কেনার জন্য…
অ্যাম্বেসি বলতে কেবল আমেরিকান অ্যাম্বেসি থেকে একজন লোক প্রতি মাসে নিয়মিত আসে, বাকিরা কেউ নিয়মিত না। কোনো মাসে আসে, কোনো মাসে আসে না। আবার অনেক সময় আসে কিন্তু কোনো পরিচয় দেয় না। আমেরিকান অ্যাম্বেসির লোকটাকে চিনি, সে এলে কিছু সময় গল্প করে যায়। আজও ফোন দিয়েছিল এ মাসের সব পত্রিকা এসেছে কি-না জানার জন্য।
এরা পত্রিকা সংগ্রহ করে গবেষণা করার জন্য, কে কী লেখে জানার জন্য, তাই তো?
হ্যাঁ।
আপনার দোকানে কোন ধরনের বই বেশি চলে?
আগে তো ইমাম গাজালি, হজরত থানভি–এঁদের বই বেশি চলত। এখন চলে আল্লামা তকি উসমানি, মাওলানা জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি–এঁদের বই।
আপনার দোকানে মীনা, সোলেমানিয়া ইত্যাদি প্রকাশনীর বইও দেখা যাচ্ছে…
এগুলো এক পাশে পড়ে থাকে। রাখি আর কি, দু-একজন এসে চায় বলে।
এগুলোর বাজার কি এখনও আছে? আগে তো এই সব প্রকাশনীর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল…
বাজার এখনও আছে, কিছু পাঠক এখনও আছে, ওসব পড়ে, তবে আগের তুলনায় অনেক কম।
আপনি তো অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বইয়ের ব্যবসা করছেন, বর্তমানকার ইসলামি বই বা ইসলামি প্রকাশনা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
ইসলামি বই বা প্রকাশনা এখন অনেক উন্নত। সবদিক দিয়েই। লেখকদের সংখ্যা এবং মানও অনেক ভালো। আগে একটা সময় ছিল, ইসলামি অঙ্গনে লেখক সঙ্কট ছিল প্রকট, এখন আর সে দিন নেই। ভালো মানের লেখকদের সংখ্য এখন এখানে অগুনতি।
এখন অনলাইনের যুগ। মানুষ এখন অনলাইনমুখী। পাঠের জন্য এখন আর কাগুজে বইয়ের দ্বারস্থ হতে হয় না খুব একটা। এর কী কোনো প্রভাব পড়েছে বইয়ের বাজারে?
কিছুটা তো পড়েছেই, তবে সেটা বইয়ে না, ম্যাগাজিনে। অনলাইনের কারণে ম্যাগাজিনের প্রতি মানুষের আর অতোটা আগ্রহ নেই।
এখন অনলাইন থেকেই মানুষ বই কেনে। অনলাইনে অর্ডার করে, ঘরে বসে বই পেয়ে যায়। এ জন্য দোকানে কিংবা মার্কেটে আসতে হয় না। এর কি কোনো প্রভাব পড়েনি আপনাদের বেচাকেনায়?
নাহ, এর কোনো প্রভাব পড়েনি। অনলাইনে যারা বই কেনে, আদতে তারা মার্কেটে আসতই না খুব একটা।
বহু দিন ধরে ব্যবসা করছেন, আপনার ব্যবসার মূলনীতি কী?
মানুষকে দীনের পথে রাখা, দীনের কথার প্রচার-প্রসার করা।
না, এটা তো আপনার লক্ষ্য-উদ্দ্যেশ্য। মূলনীতি মানে আপনি কী করেন ব্যবসার মধ্যে, সততার সঙ্গে ব্যবসা করেন, নাকি মানুষকে ঠকান?
না, ব্যবসার শুরু থেকেই আমি সততা বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি।
বইয়ের ব্যবসায় কিন্তু অনেক অসাধুতা আছে, বাংলাবাজারে যেটা দেদারসে চলে, এ জন্য জিজ্ঞাসা করলাম।
না, আমি সবসময় এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।
বইয়ের ব্যবসার এই দীর্ঘ সময়ে আপনার সবচেয়ে আনন্দের দিন কোনটি?
আমার প্রথম মেয়ের যেদিন জন্ম, সে দিনটা ছিল আমার জন্য খুব আনন্দদায়ক।
প্রথম মেয়ে বলতে উম্মে হাবিবা?
হ্যাঁ।
তাঁর জন্ম কত সালে হয়েছিল?
১৯৭৪ সালে। ওই বছরের রমজানে, শবে কদরের রাতে। তখন ভাড়া বাসায় থাকতাম। স্টেডিয়ামের ওদিকে।
সেদিনকার স্মৃতিটা একটু বিস্তারিত করে বলুন তো?
সেদিন দিনের বেলা গিয়েছিলাম একটু চকে (চকবাজার)। আসরের সময় দোকানে ফিরি। আমার বড়ভাই, আজিজিয়ার মালিক, বললেন, ‘বাসা থেকে তোর টেলিফোন এসেছিল। যাওয়ার জন্য বলেছে।
কে টেলিফোন করেছিল? তখন তো টেলিফোন খুব দুর্লভ ছিল।
বাসার কাছে একটা দোকান থেকে ফোন করেছিল এক প্রতিবেশী।
ও…। আচ্ছা বলুন তারপর।
বাসায় গেলাম। আমার স্ত্রীর অবস্থা তখন আশঙ্কাজনক। নিকটাত্মীয় বলতে বাসায় তো আর কেউ ছিল না। পাশের প্রতিবেশীরা ছুটে এসেছিল। প্রতিবেশী এক মহিলা আমাকে অভয় দিয়ে বললেন, নার্স আনতে তিনি ইতিমধ্যেই লোক পাঠিয়ে দিয়েছেন। চিন্তার কোনো কারণ নেই। দোকানে খুব ঝামেলা ছিল। মহিলার আশ্বাসে আমি আবার দোকানে ফিরে আসি। পরে রাতে দোকান বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার পর রাত একটার দিকে মেয়ের জন্ম হয়।
তখন আপনার মাসিক ইনকাম কত ছিল?
এসব কোনো হিসাব ছিল না। দোকানদারি করছি, বাসায় খরচপাতি নিচ্ছি, অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করছি, এভাবেই চলত। এখনও হিসাব করি না।
জীবনে আপনার অপ্রাপ্তি কী?
নাহ, অপ্রাপ্তি বলতে কিছু নেই আমার। আল্লাহ এই জীবনে যা দিয়েছেন, তাই অনেক কিছু। আল্লাহ আল্লাহ করে এখন কেবল বাকি জীবনটা কাটিয়েদিতে পারলেই বাঁচি।
কোনো চাওয়া-পাওয়া আছে জীবনে?
একটাই চাওয়া আছে। হজ করা। হজটা করে ফেলতে পারলে আর কিছু নেই এ জীবনে চাওয়ার মতো।
হাফেজ্জি হুজুর রহমতুল্লাহি আলায়হির সঙ্গে দেখা হয়েছে কখনও?
হ্যাঁ, হয়েছে। অনেক বারই দেখেছি তাঁকে। কামরাঙ্গীরচরে তাঁর মাদরাসায়একসময় প্রায়ই যেতাম।
ফরিদপুরিকে দেখেছেন?
একবার দেখেছি। কোন জায়গায় দেখেছি এখন আর স্মরণ নেই।
আপনার এখানে কত রাজনৈতিক দলের নেতা আসেন, চোখের সামনে কত মিছিল-মিটিং হয়, কখনও রাজনীতি করার ইচ্ছে বা শখ জাগেনি?
না, ওইরকমভাবে তেমন আগ্রহ পাইনি। ইসলামি রাজনীতিতেও আমি এককভাবেকারও সমর্থক নেই। সবাইকে সমানভাবে দেখার চেষ্টা করি। ওসব নিয়ে আলাপ-আলোচনাও খুব একটা করি না।
আপনার দোকান থেকে মাদরাসার অনেক তরুণ শিক্ষার্থী পত্রিকা কেনে, এদের দেখে আপনার কেমন লাগে?
ভালোই লাগে।
কোন ধরনের পাঠক আপনার এখানে এলে আপনি বেশি খুশি হন?
তরুণরা।
তেপ্পান্ন বছর ধরে এই যে আপনি মানুষকে বই পাঠ করাচ্ছেন, ব্যবসায়িক চিন্তা বাদ দিলে, এটা কি আপনার কাছে ভালো লাগে?
হ্যাঁ, খুব ভালো লাগে। মানুষ একটা বই নিল, পড়ল, জ্ঞানের জগতে বিচরণ করল, এটা আমাকে খুব আনন্দ দেয়। তরুণরা এলে আমি বলে দিই, ‘যে বইটা আপনি কিনলেন, নিজে পড়ার পর তা আলমারির ভেতর ঢুকিয়ে রাখবেন না, বন্ধু-বান্ধব বা আশপাশের লোকজনকেও পড়তে দেবেন।’ কোনো কোনো সময় এ-ও বলি, ‘বই যদি পড়ে ভালো না লাগে, তবে ফেরত দিয়ে অন্য একটি বই নিয়ে যেয়ো।’
জীবনে তো হাজার হাজার বই আপনি দেখেছেন, নাড়াচাড়া করেছেন, বিক্রি করেছেন–এগুলোর মধ্যে আনুমানিক কতটা বই আপনার পড়া হয়েছে? এবং কোন কোন বই আপনাকে নাড়া দিতে পেরেছে?
বই পড়ার তেমন একটা ফুরসত পাই না। তবে একসময় পড়েছি কমবেশি, কতটা, তাবলা মুশকিল। নাড়া তো অনেক বই-ই দিয়েছে, নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না।
এই যে আপনার দোকান থেকে মানুষজন বই কিনে নিয়ে যায়, পড়ার জন্যই তো নেয়, কী কারণে বই পড়া দরকার বা বই পড়ার ফজিলত কী বলে আপনি মনে করেন?
বই পড়লে মন প্রশান্ত থাকে, আত্মিক প্রশান্তির জন্য বই পড়া উচিৎ। তাছাড়া বই পড়লে চিন্তা শাণিত হয়, কুচিন্তা থেকে বেঁচে থাকা যায়।
বই বেচাকেনায় জীবন পার করে দিলেন, জীবনভর বইয়ের সংস্পর্শে থেকে আপনার মধ্যে কী পরিবর্তন এল?
জীবনটাই তো পরিবর্তন হয়ে গেল। ইসলামি বই বিক্রি করার কারণে সবসময় ইসলামি একটা আবহের ভেতর আমার সময় কেটেছে, নিজের মেজাজ-মর্জি ইসলামি ছাঁচে গড়ে উঠেছে, সেই প্রভাব গিয়ে পড়েছে নিজের পরিবারের ওপর, যার দরুণ পুরো পরিবারটাই আজ দীনের ওপর পরিচালিত হচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ।
বেশ অনেকক্ষণ আলাপ হলো আপনার সঙ্গে। অনেক কিছু জানলাম। নবধ্বনির পাঠক কিন্তু মাদরাসা-পড়–য়া উঠতি তরুণ ও নবীনরা…
হ্যাঁ, জানি তো! প্রতি মাসে এতগুলো নবধ্বনি বিক্রি, করি আমি জানব না?
হ্যাঁ, তা বটে। তো নবধ্বনির এই উঠতি তরুণ ও নবীনদের উদ্দেশে কিছু বলুন!
আল্লাহ তাআলা তাদের তওফিক দান করুন, তারা যেন ভালোভাবে লেখাপড়া করে দেশ ও জাতির সেবা করতে পারে। ভালো ভালো বইপত্র পড়তে পারে। ভবিষ্যতের কাণ্ডারি হতে পারে। এই দ্আুই করি তাদের জন্য।
ছাত্র অবস্থায় কি আপনি তাদের বেশি বেশি বইপত্র পড়তে বলেন?
হ্যাঁ, তবে ক্লাসের পড়া ঠিক রেখে। মূলটা না থাকলে তো এসব বইপত্র পড়ে কোনো কাজে আসবে না।
ঠিক আছে তাহলে! ভালো থাকুন। নবধ্বনিকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনারাও ভালো থাকুন। নবধ্বনিকেও ধন্যবাদ আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। আল্লাহ হাফেজ।