মহীশুরের নবাব হায়দায় আলী। তার প্রথম স্ত্রীর গর্ভে এক পুত্র সন্তান জন্ম হয়েচিলো। ছেলেটি আর দশজনের মত সুস্থ স্বাভাবিক ছিলো না । নবাবের ছেলে । সে তো হবে বীর যোদ্ধা । কিন্তু হায়দার আলীর এই ছেট বীর যোদ্ধা হওয়া তোদূরের কথা, ভালো করে চলাফেরাও করতে পারে না । এই নিয়ে দু:খের শেষ ছিলো না ।
নবাব ফকির দরশের দরবারে দোয়া চাইতেন, তার যেন, একটি পুত্র সন্তান হয় । একদিন এক দরবেশ তাকে দোয়া দিলেন । বললেন, বাঘের মত সাহসী এক ছেলে হগবে তোমার । তার নাম রেখো ফতেহ আলী টিপু। কানাড়ী ভাষায় টিপু মানে বাঘ । হায়দার আলীর অপর স্ত্রী ফাতেমা ফখরুন নিসার গর্ভে ফতেহ আলী টিপুর জন্ম হয় । এই ফতেহ আলী টিপু সত্যি সত্যিই একদিন বাঘ হয়ে উঠেছিলেন । বাঘের মত গর্জে উঠেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ।
১৭৪৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতাণ টিপুর জন্ম হয় । ছেলে বেলায় তিনি ধর্মীয় মিক্ষা-দিক্ষা লাভ করেন । রণকৌশলও রপ্ত করে ছিলেন । ছেলেবেলায় তিনি বাঘ শিকার করে ছিলেন । তখন থেকে তার ব্যাঘ্র-প্রীতি জন্মে যায় । তার পোশাকে , তরবারি সব কিছতেই বাঘের চামরার মত ডোরাকাটা রং ছিলো । বাঘের আকৃতি বিশিষ্ট একটি সিংহাসনও তিনি তৈরী করেছিলেন । তার মহলের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় বাঘের চিত্র আকাঁ ছিলো । এমনকি শোনা যায়, তার নাকি পোষা কয়েকটি বাঘও ছিলো । মহলের সামনে সেগুলোকে রাখা হতো । সুলতান টিপু ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ১৭৮২ সালে । পিতার মৃত্যুর পর তিনি তার সিংহাসনের অধিকারী হন । রাজ্য শাসনের দীক্ষা তিনি পিতার থেকে লাভ করেছিলেন। পিতার সাথে একাধিকবার যুদ্ধে অংশ গ্রহণও করেন।
যুদ্ধে একাধিকবার পরাজিত করেছেন ইংরেজদের । টিপু যে বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছিলেন, তা ছিলো সমগ্র ভারতবর্ষের অন্যতম উৎকৃষ্ট ভূখন্ড । এ জন্যেই এই সাম্রাজ্যের উপর ইংরেজদের লোভ ছিলো একটু বেশি।
টিপুর পিতা হায়দার আলীর আমলে ইংরেজরা একাধিকবার তার উপর আক্রমণ করেছিলো । কিন্তু হায়দার আলীর বীরত্ব ও রণকৌশলের সামনে তারা টিকতে পারেনি। সুলতান টিপুর সামনেও তারা মহীশুর দখলের ষড়যন্ত্র করে।
তৎকালীন লর্ড ঘোষনা করেছিলো, সমগ্র ভারতে ইংরেজদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে একমাত্র সুলতান টিপু হলো ইংরেজদের বাধা । সুলতান টিপুকে পরাজিত না করতে পারলে রাজত্ব কায়েম করা সম্ভব নয় । তাই ইংরেজরা উঠে পরে লেগেছিলো । টিপু সুলতানকে পরাস্ত করার জন্য তারা মালাবার দখল করে নেয় । টিপু পুনরায় মালাবার মুক্ত করেন । টিপুর শত্রু ছিলো মারাঠা এবং হায়দারাবাদের নিজাম । ইংরেজ টিপুর বিরুদ্ধে এদের লেলিয়ে দেয় । পরপর দুইবার যুদ্ধ করেও তারা টিপুকে কাবু করতে পারেনি । শেষ পর্যন্ত তারা একটি সন্ধির প্রস্তাব দেয় । স্বাধীনচেতা টিপু সেই সন্ধি মেনে নেন নি । ফলে টিপুর সাথে ইংরেজদের তৃতীয়দফা যুদ্ধ হয় । এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলো হেক্টর মুনোর । বীর টিপু এই যুদ্ধে গুলিদ্ধি হয়ে শাহাদাত বরণ করেন । তখন সময় ১৮৯৯ সালের মে মাস । এই পরাজয়ের ফলে মহীশুর ইংরেজদের দখলে চলে যায় ।
ব্যক্তিগতভাবে টিপু ছিলেন পরহেজগার এবং ধার্মিক । এ জন্যেই কেউ কেউ তাকে খোলাফায়ে রাশেদীনের একজনও বলে থাকেন । দেশের প্রতি তার গভীর ভালবাসা ছিলো । দেশের উন্নয়নের জন্য তিনি কৃষিখাত ও শিল্পখাতে বিরাট বরাদ্দ দিয়েছিলেন । শিল্পের উন্নয়নের জন্য ফরাসী কলাকুশলীদের তার দেশে এনেছিলেন । মহীশুরকে তিনি ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন । ইরান আফগানিস্তান ও তুরস্কের খলীফার নিকট দূত প্রেরণ করেন এবং খলীফার কাছ থেকে তার রাষ্ট্রের স্বীকৃতিও আদায় করেন । টিপুর প্রচেষ্টায় মহীশুর একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিলো।
টিপুর সিংহাসন ও ব্যবহূত জিনিসপত্র ইংরেজরা লুট করে নিয়ে যায় । এগুলো বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। টিপুর একটি ডায়রীও পাওয়া যায় । সেই ডায়রী ছিলো তার নিজ হাতে লেখা । তাতে হযরত মুহম্মদ সা: এর প্রতি অত্যন্ত ভালোবাসা এবং টিপুর কিছু কথার ব্যাখ্যা লেখা আছে ।
বীর সুলতান টিপুকে তার রাজধানী শ্রীমপটমে সমাহিত করা হয় । এখন সেখানে মাজার নির্মাণ করা হয়েছে । এখানেই ঘুমিয়ে আছেন ইতিহাসে “মহীশুরের বাঘ” খ্যাত এই বীর সুলতান ।