শীতের শুরুতেই, বরং হেমন্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় মাহফিলের পালা-যজ্ঞ। নদীর ধারে বিলের পরে পল্লিগ্রামের মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে মাইকের আওয়াজ। শহর নগর আর মফস্বলগুলোও এ উৎসবমুখরতা থেকে মুক্তি পায় না। আষাঢ়ের ঝরঝর অবিরাম বাদলের সঘন ধারাপাত শুরু হবার আগ পর্যন্ত একটানা ৩-৪ মাস চলতে থাকে মাহফিলের গোলমেলে হট্টগোল। আগে যেসব ছেলে-ছোকরা চাঁদা তুলে গানের আসর করতো, যাত্রা মঞ্চস্থ করতোÑতারাই বিড়ি মুখে টুপি মাথায় রসিদ বইসহ দোকানপাট, হাটবাজার চষে বেড়াচ্ছে ধর্মীয় বয়ান-আয়োজনে চাঁদা উশুল করতে। খুব উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়েই তারা ঝাপিয়ে পড়ে কাজে। অমুক চৌধুরী ৫ হাজার দিয়েছেন, তালুকদার দিয়েছেন ১০ হাজার, সরদার সাহেব অবশ্যই ১৫ হাজার দেবেন। এমন আব্দার তাদের বিভিন্ন টাকাওয়ালার কাছে করতেই হয়। একটা মাহফিলে অন্তত দেড়-দুই লাখ টাকা খরচ। প্যান্ডেল, স্টেজ, মাইক, বক্তাদের হাদিয়া, গাড়িভাড়া, পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার, মাইকিং আর মাহফিল শেষে অতিথিদের বিরাট ভোজন। সাধারণ শ্রোতাদের জন্য কলাপাতার খিচুড়ি, ফিরনি, সিন্নি এইসব মিলিয়ে ব্যয়ভার নিতান্ত কম না। তবু বছরে তো একবারই হয়। ধর্মের জন্য পাড়ার মোড়ল-মাদবর-চেয়ারম্যান-মেম্বর-হাজি সাহেবরা এতটুকু করতে কোনো চাপ মনে করেন না। ছেলেপুলেরাও খেয়ে না খেয়ে ১৫/২০ দিন খেটে-খুটে অন্যরকম এক আনন্দ অনুভব করে। চাঁদা ভালো উঠলে মাহফিল শেষে ভাগ বাটোয়ারায় কিছু অংশ যা আসে তাতেও একটা ফুর্তির ব্যাপার আছে। সাধারণ মানুষ যারা বাইরে থেকে এসব উৎসব-আয়োজন দেখে তারাও ভাবে, যাক এতে করে তো অসামাজিক কাজ না হয়ে ধর্মের কথাই হচ্ছে। কিছু তো ফায়দা আছেই; কাজেই চলুক। আল্লাহ-রাসুলের কথাই তো বলা হয়। মানুষের আটপৌরে জীবনে কোনো পরিবর্তন আসুক কি না আসুক ভালো ভালো কিছু কথা তো শুনতে পায় গঞ্জের লোক। মাহফিল শেষে জবুথবু বৃদ্ধ, এমনকি দুরন্ত দুষ্ট বালকের চোখেও ফুটে ওঠে স্বর্গীয় আভা। সারা রাত ওয়াজ শুনে ফজর-জোহর কাজা হলেও বুকের ভেতর জান্নাতের স্বপ্নে জেগে ওঠে বিভোরতা। বহু তরুণ বক্তা মাহফিল বাণিজ্য করে অল্প দিনেই গাড়ি-বাড়ির মালিক হবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আলেম-উলামা চুক্তি বা চুক্তি ছাড়া যা কিছু হাদিয়া-তুহফা পান তাতে নিশ্চিন্ত মনে দীনের খেদমতে মনোযোগ দিতে পারেন। আয় উপার্জনের দুশ্চিন্তা সহজে দূর হতে পারে। এভাবে পুরো দেশে ধর্মীয় বিচিত্র এক আবহ সৃষ্টি হয়।
দুই
এতসব ফায়দা সত্তে¡ও তাই ইবনে সিরিন, গাজালি প্রমুখের উক্তি দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। ইবনে সিরিনকে তাঁর যুগের এমন মাহফিল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘এই বিদআতের সূচনা করেছে খারেজি সম্প্রদায়। তাদের পূর্বে এমন ধারার অস্তিত্ব ছিল না।’ ইমাম গাজালিও এহইয়াউ উলূমিদ্দিনে লিখেছেন, ‘এই ওয়াজ মাহফিলের ধারা সম্পূর্ণ অর্বাচীন, পূর্বসূরিগণ এসব মাহফিলে বসতে নিষেধ করেছেন; কারণ, এই ধারাটি নবিজির যুগে বা আবু বকর, ওমরের যুগেও ছিল না; বিশৃঙ্খলার সময়ে এসবের সূচনা হয়েছে।’ ইমাম গাজালি এসব ওয়ায়েজিনদের ওয়াজকে ওয়াজ বা তাজকির নামকরণেও সন্তুষ্ট নন। প্রচলিত ওয়াজকে ওয়াজ বলাটাও তাঁর দৃষ্টিতে চরম বিকৃতি। (এহইয়াউ উলূমিদ্দিন ১/৫২ দ্রষ্টব্য)। হাফেজ ইরাকি রহ. তাবারানির সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘বনি ইসরাইল সম্প্রদায় ধ্বংস হয় যখন তারা কিসসা বর্ণনা শুরু করলো।’ হাদিসে কুসসাসের উল্লেখ আছে; ইবনুল জাওজি বলেন, বক্তাদেরকে আগের যুগে ‘কুসসাস’ই বলা হতো। বিখ্যাত তাবেয়ি হজরত আবু কিলাবা রহ. বলেন, ‘মা আমাতাল ইলমা ইল্লাল কুসসাস―বক্তারা তাদের ওয়াজ দিয়েই ইলমের মৃত্যু ঘটিয়েছে। একটা লোক এক বছর কোনো বক্তার পিছু ঘুরেও কিছুই হাসিল করতে পারে না। অথচ একজন আলেমের কাছে একটি মজলিসেই সে কিছু না কিছু অর্জন করতে পারে।’ শুজা ইবনে মাখলাদ বলেন, ‘আমি মানসুর ইবনে আমের নামক এক বক্তার মাহফিলে যাচ্ছিলাম। বিশরে হাফি আমাকে দেখে বললেন, শুজা! অবশেষে তুমিও এসবের পেছনে পড়লে! ফিরে যাও! যদি এসব মাহফিল শোনায় কোন কল্যাণ থাকতো তাহলে সুফিয়ান সাওরি, ওয়াকি, ইমাম আহমাদ সর্বাগ্রে তাতে অংশ নিতেন।’ হজরত উমরের যুগে তামিমে দারি ওয়াজ করার বাসনা প্রকাশ করে বারংবার নিবেদন করেন; উমর তাঁর পীড়াপিড়িতে কিছু সীমা বেঁধে দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে ওয়াজের অনুমতি দেন। হাফিজ ইরাকি রহ. এ ঘটনা উল্লেখ করে মন্তব্য করেন, ‘সাহাবি তামিমে দারির ক্ষেত্রে হজরত উমরের যদি এমন সতর্কতা হয় তবে পরবর্তীদের বেলায় এক্ষেত্রে কত বেশি সাবধানতা প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না! (সুয়ুতি রচিত তাহজিরুল খাওয়াস-এর২২৩ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।)
ওয়াজ মাহফিলের বিরুদ্ধে ইবনুল জাওজি, ইরাকি এবং সুয়ুতির স্বতন্ত্র পুস্তক আছে। পূর্বসুরী বহু মনীষী আওয়াজ সর্বস্ব ওয়াজের তৎকালীন ধারা অপছন্দ করতেন। (জানি না বর্তমানে যে কোকিল কণ্ঠের কলেরা বা হেলিকপ্টারের হিড়িক তা দেখলে তাঁরা কি করতেন।) কিন্তু কেন এই বিরূপ মনোভাব? ইবনুল জাওজি এর কারণ দর্শাতে গিয়ে বলেন, ‘এসব মাহফিলের ওয়াজ-নসিহত জনসাধারণের অন্তর বিগড়ে দেয়। ধীরে ধীরে তারা অশুদ্ধতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। কাল্পনিক গল্পগাথার পেছনে পড়তে আরম্ভ করে। বক্তারা অতিরঞ্জিত করে না বললে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না; আর সব শ্রোতাকে ভক্ত না বানাতে পারলে বারবার নিমন্ত্রণও মেলে না। শরিয়তের বিকৃত উপস্থাপনা হতে হতে এক সময় পুরো সমাজে এর বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া বহুলোক বক্তাদের শ্রæতিমধুর ওয়াজ শোনায় এতই ব্যস্ত বা এ নিয়ে এতই মত্ত থাকে যে, কোরআন তেলাওয়াত বা ধর্মের গভীর জ্ঞানার্জনের চেষ্টাও করে না। (আজকাল ইউটিউব ফেসবুকের কল্যাণে মাহফিল প্রেমিক শ্রেণীর জন্য আরও সুবিধার হয়েছে।) আরেকটি কারণ―বক্তারা নিজেদের দিকেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন; সাধারণ মানুষকে আলেম-উলামা ও সত্যিকার ওলি-বুজুর্গদের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করে রাখে ।’
তিন
যা কিছু হোক, বাঙালিদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে শীতকালীন মাহফিল কেন্দ্রিক ডামাডোল। এক বক্তার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম তিনি বলতে চাচ্ছেন মাহফিলে যাবার আগে এই যে বক্তাদের চুক্তি করে নেওয়াÑতাও একটা মহত্তর ভাবনার দিক থেকে ঠিকই আছে। এটা বাঙালি সংস্কৃতির বিচারে দারুণ এক সৌন্দর্যের বিষয়। সংস্কৃতিরই অংশ। শরিয়তের দৃষ্টিতেও তা কাম্য। তাঁর মুখেই শুনুনÑ ‘আমাকে দাওয়াত দিতে এল উত্তরবঙ্গের নওগাঁ থেকে কয়েকজন লোক। তাঁদের এলাকার মাহফিলে যেতে হবে। আমি শুরুতেই জিজ্ঞেস করলাম, কত দিতে পারবেন? তাঁরা আমার প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল। এতবড় হুজুর (অন্তত ৫ পীরের খেলাফত যার ঝুলিতে আছে) তাঁর মুখে এ কেমন কথা! গ্রামীণ লোকগুলির বিস্ময় ভেঙে তাদের মূর্খতা দূর করে বললাম, দেখো ভাই, ইসলাম আমাদের স্বচ্ছতা শেখায়। দিন-তারিখ ঠিক করলাম, তারপর আমি আশা করলাম আপনারা ৩০ হাজার টাকা দেবেন আর আপনারা দিলেন ১৫ হাজার টাকা তাতে দু’পক্ষেরই মন কষাকষি হবে। এর চেয়ে ভালো―একটা ঠিক করে দিলেন, পরে আমার যদি পোষায় তাহলে গেলাম; না পোষালে বলে দিলাম। কি বলেন আপনারা? (আমাদের সম্বোধন করে বললেন)। আমি মৃদু হেসে অন্য দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ থেমে বললাম, দু’দিন আগেই তিরমিজি শরিফের ২৪০ নম্বর পৃষ্ঠায় একটি হাদিস পড়েছি। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম পাঠার প্রজনন কর্মের বিনিময় গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। মাদি ছাগলের মালিকরা পাঠা খাসির মালিকের কাছ থেকে প্রজনন প্রক্রিয়ার জন্য হৃষ্টপুষ্ট পাঠা ভাড়া আনতো। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এ পাঠার বিনিময় গ্রহণে নিরুৎসাহিত করেছেন। এ হাদীস উল্লেখের পর ইমাম তিরমিজি রহ. ফেকাহবিদদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবেÑ‘যদি প্রজনন কর্মের পর খুশি হয়ে ছাগলের মালিকরা কিছু দেয় তবে তা গ্রহণ বৈধ; কিন্তু পূর্বচুক্তি বৈধ নয়।’ কৌতুক রসেই তাঁকে এ কথা উল্লেখ করে বললাম, এক্ষেত্রে কী বলবেন হজরত? মুয়ামালা পরিস্কার করে নিতে তো পাঠার বিনিময়ও চুক্তিভিত্তিক প্রদান আবশ্যক হওয়া উচিত? তবে কি ইসলামি আইন বিশারদরা ভুল করলেন না?
একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা দিয়েই এই নিবন্ধের ইতি টানছি। মাওলানা আহমাদ আলি লাহোরি রহ.। পাকিস্তানের প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন। হজরত ইউসুফ বিন্নুরি আল-বালাগ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, একবার মাওলানা বিন্নুরি সীমান্ত প্রদেশের কোনো এক মাহফিলে যাচ্ছিলেন। রেলওয়ে স্টেশনে মানুষের ভিড় দেখে ভাবলেন তাঁকে (বিন্নুরিকেই) স্বাগত জানাতে এরা এসেছে। কিন্তু না তাঁর দিকে কারো নজর নেই। জীর্ণ পোষাক পরিহিত শীর্ণকায় এক অশীতিপর বৃদ্ধ। কাঁধে পুরনো চাদর। পায়ে কাঠের চটি। সাদা খদ্দরের লুঙ্গি। এরূপ লেবাসের অতি সাধারণ বেশের এক লোক। একজন ইশারা করে দেখালো ঐ মৌলভিকে নিতেই এত মানুষের সমাগম। বিন্নুরি ভাবলেন, না জানি কত বড় আলেম। খুব মনোযোগ সহকারে বয়ান শুনলেন। কোনো সুর নেই, পাÐিত্যের প্রকাশ নেই। সাদামাটা কথাবার্তা কিন্তু শ্রোতাদের কান্নার গমকে পুরো মাহফিল আচ্ছন্ন। ঠিক বুঝে এল না মানুষের এত ভক্তির কারণ। মাহফিল শেষে মরহুম লাহোরি তাঁর ছোট্ট বোচকা নিয়ে সোজা স্টেশনে চলে গেলেন। স্টেশন পর্যন্ত অসংখ্য ভক্তের ভীড়। বিস্ময়কর দৃশ্য। কারোও কোন হাদিয়াও গ্রহণ করলেন না। পায়ে হেঁটে স্টেশনে। গাঁটের টাকায় ফিরতি টিকিট আগে থেকেই করা ছিল। এলাকাবাসীর কারো বাড়িতে রাতের খাবারটাও খেলেন না। সঙ্গে করে লাহোর থেকে শুকনো রুটি এনেছিলেন তা-ই ছিল তাঁর রাতের খাবার। যে কোনো স্থানে ওয়াজ করতে গেলে এমনই ছিল তাঁর সবসময়ের নীতি। মাওলানা বিন্নুরি বলেন, বুঝলাম, এই বৃদ্ধের এমন মাকবুলিয়াতের অন্তর্নিহিত কারণ কি?
এ ধরনের বহু ঘটনা পড়েছি, শুনেছি, কিছু কিছু দেখেছিও। তাই আজকের যে পরিস্থিতি তার সঙ্গে সে সব অতীত দিনের ঘটনা খুব একটা মেলাতে পারি না। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আমরা আসলে কোন দিকে যাচ্ছি? আমাদের গন্তব্য কোথায়? আর আরবস্থানের যাত্রায় কোনো তুর্কিস্তানের পথে হাঁটছি আমরা? মনে হয় এই সমাজের লোকদের নতুন করে গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার এসব বিষয়ে।
এ ধর্মের পথে চলতে খুব দীর্ঘ বিস্তৃত বয়ান বা জাঁকজমকপূর্ণ ওয়াজ শোনার প্রয়োজন পড়ে না। প্রত্যেকের কর্তব্য শরিয়ত সঠিকভাবে জেনে সিরাতে মুস্তাকিমের পথে চলা। যারা বেশি জানেন এবং আমল করেন―প্রয়োজনীয় কর্মের পাশাপাশি বেশি থেকে বেশি এমন জ্ঞানী ও সৎ মানুষের সংস্পর্শে গিয়ে আমৃত্যু ভালো হবার নিরন্তর সাধনা করে যাওয়া প্রত্যেক সমঝদার মানুষের অবশ্য কর্তব্য। পরিশেষে বলব, যেখানে বাস্তব প্রয়োজন আছে যথাযথ সুন্দর মাহফিল আয়োজন হোক কিন্তু মাহফিল-বাণিজ্য এবং পরিবেশ দূষণ আজ থেকেই বন্ধ হোক।
এপ্রিল ২০১৮