বহুদিন তো হলো শৈশবকে ফেলে এসেছি পথের মোড়ে। চলতে চলতে পেরিয়ে এসেছি বহু পথ। এখন, শত শূন্যতা আর হাহাকারভরা এই সময়ে, সেই দিকে ফিরে তাকালেই যেন চোখে-মুখে ঝাপটা দিয়ে যায় মিষ্টি কোমল বাতাস। কী এক বিস্ময়কর মুগ্ধতার সময় ছিল! হাসি-খুশি আর আনন্দ-উচ্ছ¡াসে ছিল একেবারে টইটুম্বুর।
তবে হ্যাঁ, সেই সুখের বরষায়ও শূন্যতা ছিল। যেন কোথাও সুর কেটে গিয়েছিল গানের। কিন্তু সেই শূন্যস্থানের বৃষ্টিফোঁটা কী? কী সেই কেটে যাওয়া গানের সুরÑএ আমার বোধে ছিল না। একদিন হঠাৎ বেজে উঠল সেই সুর। পূরণ হলো শূন্যস্থান। রিমঝিম বৃষ্টির সুরে আমার কানে বাজতে লাগলÑ‘মাহফিল’!
চারজনের পুচকে একটা দল আমরা। সন্ধ্যের আগে আগে বেরুলাম। সূর্য তখন ডুবিডুবি করছে। বাড়ির পাশ ধরে মেঠোপথ। এরপর পাকা সড়ক। কিছুদূর বাদে নেমে পড়লাম এবড়ো-থেবড়ো মাটির ধানি জমিতে। ধান অবশ্যি নেই। শুধু পড়ে আছে বহুদূর তক মাটির বিছানা। মাটির বুক মাড়িয়ে, শীতের মরা খাল পেরিয়ে, মাফলার আর কোটের ভেতরেও শীত জড়িয়ে যখন আমরা ‘আলো-নগরে’ এসে পৌঁছুলাম, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। অন্ধকার জমতে শুরু করেছে বাতাসের গায়।
আলো-নগর বললাম, কারণ, মাহমুদ আমাদের তিন চাচাতো ভাইকে যেখানে নিয়ে এসেছে, এখানে চারদিকে শুধু আলো আর আলো। কুপির আলো। হারিকেনের আলো। মোম আর মশালের আলো। আছে হ্যাজাকের আলোও। এতো এতো আলোর সমাবেশ! দেখেই চমকে গেলাম। যেন থৈহারা এক রঙের মেলায় এসে পড়েছি। দোকান আর দোকান। নানা জাতের। নানা রঙের। কত শত জিনিসে ঠাসা।
অদূরেই মাঠ। বিশাল প্যান্ডেল। সেদিকে এগুলাম। ওইখানে অপেক্ষা করছিল আরও বড় বিস্ময়। এত্ত মানুষ! চারদিকে কেবল মানুষ আর মানুষ! ঈদের জামাতে ছাড়া আর দেখিনি এমন। এক কোণে জুতা রেখে সবার মতো আমরাও বসে পড়লাম খড়ের বিছানায়। যিনি বয়ান করছেনÑদূরে স্টেজে বসা। শাদা শ্মশ্রæমÐিত মুখ। গায়ে শাদা জুব্বা। শাদা রুমাল। যেন আপাদশির শুভ্রতার আলোমাখা এক মানুষ। তিনি কথা বলছেন খুব স্থির, শান্ত, সুন্দর উচ্চারণে। সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর কথা শুনছে। আমরাও শুনছি মুগ্ধতার ঘোরে।
এক সময় বয়ান শেষ হলো। আমরা উঠে পড়লাম। বাইরে এসে আচার, জিলাপি আর চানাচুর খেলাম। তারপর পকেটভর্তি বাদাম আর মুরালি নিয়ে রওনা করলাম বাড়ির দিকে। শীতের কুয়াশা-ভেজা অন্ধকার ভেদ করছে আমাদের টর্চ। ভয়-বুক নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছি কাছাকাছি বয়েসের চার শিশু। একেবারে চুপচাপ। কেউ কোনও কথা বলছি না। আমার ভেতরে শুধু অনুরণিত হচ্ছে সেই আলেমের একটি কথাÑ‘জীবনটা তো বাবা, খুবই ছোট। বেশিরচে’ বেশি দু’-তিন ঘণ্টার একটা মোমের মতো। এরপরেই তো গলে নিঃশেষ। এই এতটুকুন জীবনে, মানুষের কষ্টের আগুন না হয়ে, উপকারী আলো হওয়াই কি ভালো নয়!’ আমি টর্চের আলোয় হাঁটছি আর ভাবছি। ভাবছিÑ আমিও হব সবার আলো…
এইসব কথা বহু আগের। এখন আর তেমন যাই না মাহফিলে। অবশ্যি এর কারণও আছে। সেকথা এখন তোলা থাক অন্য সময়ের জন্যে। তবে প্রথমবার খুব ফূর্তিতে না ডুবলেও, সেবারের পর ‘মাহফিল’ আমাদের জন্যে হয়ে উঠেছিল যেন মোহনগন্ধ বাতাস। কিবা তীব্র আকর্ষণের অন্য রকম মৌচাক।
আসলে ‘শুদ্ধ’ এবং ‘সাচ্চা মাহফিল’ হলোÑ সত্য-সুবাসিত এক মোম। যার আলোয় দীপ্তিমান হয় বিশ্বাসীদের হৃদয়। কিবা ‘মাহফিল’ হলোÑ জল-ছলছল এক নদী। যার পূণ্য¯œানে শুদ্ধ হয় আঁধারাচ্ছন্ন আর অবিশ্বাসীর আত্মা। মাহফিলের সুগন্ধ তাই ছড়িয়ে পড়–ক ঝিরঝির বাতাসে, আলোর কণায় আর নদীর জলে। মাহফিল হোক মানুষ ও মানবতার আবেহায়াত।
এপ্রিল ২০১৮