(গত ৪ এপ্রিল ২০১৮ আফগানিস্তানের কুন্দুজে একটি মাদরাসার পাগড়ি প্রদান অনুষ্ঠানে বর্বর মার্কিনিদের ড্রোন হামলায় শাহাদতবরণকারী শত শিশু হাফেজের একজনের জীবন অবলম্বনে লিখিত নওফল রব্বানির এ গল্পটি নবধ্বনি’র পাঠকদের জন্য বাংলায় সাজিয়েছেন হামমাদ রাগিব।)
আবদুল্লাহ জানের আনন্দ আর ধরে না। খবরটা মাকে দিতে পারলে কী খুশিই না হবেন তিনি। উসতাদের ফোনটা ক’দিন ধরে পাওয়াই যাচ্ছে না। আবদুল্লাহ জান যখনই যায় মায়ের কাছে কল দিতে, দেখে, সহপাঠীদের কেউ না কেউ কথা বলছে ফোনে। খুশির সংবাদটা বাবা-মাকে শোনাচ্ছে। তার পেছনে আরও ক’জনের সিরিয়াল। একজনের পর আরেক জন কথা বলবে। আবদুল্লাহ জান সিরিয়ালে দাঁড়ায়। কিন্তু তার সিরিয়াল আসার আগেই বিরতির সময়টুকু ফুরিয়ে যায়। বিরস মুখে সে আবার ফিরে আসে ক্লাসে।
রেহাল-কুরআন নিয়ে সহপাঠীদের সাথে সারি বেঁধে ক্লাসে বসে আবদুল্লাহ। দুলে দুলে সবক শেখায় মগ্ন হবার চেষ্টা করে, কিন্তু কুরআনের পাতায় কিছুতেই সে মন বসাতে পারে না। কল্পনার ডানায় ভর করে ক’দিন সামনে চলে যায়। কল্পচোখে দেখে সহপাঠীদের সাথে সে বসে আছে মনোরম করে সাজানো মঞ্চের সামনে। এক এক করে নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। আবদুল্লাহ অপেক্ষা করছে কখন তার নাম ঘোষিত হয়। মঞ্চ থেকে তার নাম ঘোষণা হলেই সে মঞ্চে উঠবে। তাজা ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেওয়া হবে তাকে। উফ, কী ভালোই না লাগবে তখন।
আবদুল্লাহর মন আনচান করে–কবে যে মাকে এই খুশির খবরটা শোনাবে সে! ক্লাস ছুটি হয়। বিরতি আসে। আবদুল্লাহ আবার গিয়ে দাঁড়ায় ফোনের সিরিয়ালে। সিরিয়াল আসতে আসতে আবারও বিরতির সময় ফুরিয়ে যায়।
অবশেষে অনুষ্ঠানের দিন ভোরবেলা ফোনের সিরিয়াল পেল আবদুল্লাহ। কিন্তু হায়, মায়ের ফোনে যে কলই ঢুকাতে পারছে না! বার কয়েক চেষ্টা করল, উঁহু, কল যায়ই না। পেছনে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছে অনেকেই। ওরা তাড়া দেয় আবদুল্লাহকে। ‘কী রে? এতক্ষণেও তোর শেষ হয় না?’ আবদুল্লাহ অসহায় চোখে তাকায় সহপাঠীদের দিকে। অনুনয় ঝরে পড়ে তার কণ্ঠ থেকে। ‘আরেকটু দোস্ত! আম্মার ফোনে কেন যেন কল যাচ্ছে না। আমাদের এলাকার নেটওয়ার্কের যা অবস্থা!’ খানিকটা বিরক্তিও শোনা যায় আবদুল্লাহর কণ্ঠে।
বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর অবশেষে কল ঢুকল মায়ের ফোনে। আবদুল্লাহর চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল। বার কয়েক রিং হবার পর ওপাশ থেকে ফোন ওঠানো হলো। আবদুল্লাহর কণ্ঠে তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ¡াস। ‘মোরে, মোরে, জেমা দস্তারবন্দি দাহ!’Ñআফগানি ভাষায় অনেকটা চিল্লিয়ে উঠল সেÑ‘আম্মা, আম্মা, আজ না আমাকে পাগড়ি দেওয়া হবে!’
‘সত্যি বলছ, বাবা! আজ তোমাকে পাগড়ি দেওয়া হবে?’
‘হ্যাঁ, আম্মা। আমার হিফজ পুরোপুরি কমপ্লিট হয়ে গেছে।’
‘তা হলে এই রমজানে তুমি তারাবিহ পড়াতে পারবে?’
‘কেন নয়! অবশ্যই মা, ইনশাআল্লাহ, এই রমজান থেকে আমি তারাবিহ পড়াব।’
আনন্দে, তৃপ্তিতে আফগানি গ্রামীণ রমণী বাখমিনার কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে আসে। তিনি আর কিছু বলতে পারেন না। অস্ফুট সুরে কেবল ‘আলহামদুলিল্লাহ, তা হলে এখন রাখি, বাবা’ বলে ফোনের লাইন কেটে দেন। আনন্দ, শোকরানা আর তৃপ্তির জল ফোটা ফোটা অশ্রু হয়ে তাঁর কপোল বেয়ে ঝরে পড়ে। এ কান্না সুখের, রবের দরবারে কৃতজ্ঞতার; খানিকটা শোকেরও। আবদুল্লাহর বাবার আমরণ স্বপ্ন বাখমিনা আজ বাস্তবতায় রূপান্তর করতে পেরেছেন। তাঁদের ছেলে আবদুল্লাহ আজ কুরআনের একজন মুহাফিজ। তিরিশ পারা কুরআন আজ তার সিনায়। এই দিনটির জন্য বাখমিনা কত অপেক্ষাই-না করেছেন। কত জল ঝরিয়েছেন জায়নামাজে, আল্লাহর দরবারে দোয়া করে করে।
বাখমিনা তখন অন্তঃস্বত্বা। স্বামী দিনমান কাজ করেন কৃষিক্ষেতে। আফগানের কুন্দুজ পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট একটি বসতিতে তাঁদের বসবাস। দিনশেষে বাড়ি ফিরে স্বামী রোজই বলতেন, ‘আমাদের সন্তানকে আমরা হাফেজ বানাব। কেমন?’ বাখমিনা লাজুক হেসে সম্মতি জানাতেন। বলতেন, ‘ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ কবুল করুন।’
আবদুল্লাহর জন্ম হলো। কী ফুটফুটে চেহারা! আদর সোহাগ আর ভালবাসার অন্ত নেই মা-বাবার। কত স্বপ্ন এই ছেলেটিকে নিয়ে। কত কল্পনা। বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘দেখো বাখমিনা, আমাদের আবদুল্লাহ যেদিন হাফেজ হবে, সারা গাঁয়ের লোককে আমি দাওয়াত করব। তুমি নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াতে হবে কিন্তু সবাইকে।’ ছেলেকে নিয়ে কী উচ্ছ¡াস, কী আবেগ আর কী স্বপ্নই না ছিল লোকটার!
এই স্বপ্ন বুকে লালন করে করেই একদিন হঠাৎ তিনি চলে গেলেন পরপারে। যাওয়ার কথা ছিল না, তবু যেতে হলো। গেলেন শাহাদতের অমীয় সুধা পান করে।
আবদুল্লাহ জান আধো আধো বুলিতে তখন সবে কথা বলা শিখছে। আবদুল্লাহর বাবা সেদিন মাঠে কাজ করছিলেন যথানিয়মে। হঠাৎ মার্কিন বাহিনীর বোমারু বিমান আঘাত হানল কুন্দুজের শষ্যক্ষেতে। কোনো বাছ-বিচার নেই, দেদারসে বোমা ফেলতে লাগল কুন্দুজের সবুজ-শ্যামল পাহাড়ি উপত্যকায়। একটা বোমা এসে নিক্ষিপ্ত হলো আবদুল্লাহর বাবার শষ্যক্ষেতে। বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তাঁর দেহ। ছেলেকে হাফেজ বানানোর স্বপ্নবোনা-বুক টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল চারিদিকে।
বাখমিনার আজ খুব মনে পড়ছে স্বামীকে। তাঁর ছেলে আজ হাফেজ হয়েছে, আলেম-উলামাগণ ছেলের মাথায় আজ ধবধবে সাদা নবির সুন্নত পাগড়ি বেঁধে দেবেন। হায়, স্বামী যদি বেঁচে থাকতেন এতক্ষণে নিশ্চয় ছুটে যেতেন ছেলের মাদরাসায়। গর্বভরে উপভোগ করতেন ছেলের পাগড়ি প্রদান অনুষ্ঠান। চোখকে আজ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বাখমিনা। সুখ এবং শোকÑএকই সাথে বিপরীতমুখী দুই অনুভূতি গলে গলে পড়তে লাগল তাঁর চোখ বেয়ে।
বাখমিনা দৌড়ে গেলেন স্বামীর সয্যাপাশেÑযেখানে তিনি চিরদিনের জন্য সমাহিত হয়েছেন। সাথে নিয়ে গেলেন একগোছা ফুলের মালা। মালাটি কবরের ওপর রেখে বলতে লাগলেন, ‘আমি আফগানি নারী, বিয়ের সময় কথা ছিল আপনার মাথায় মুকুট পরিয়ে দেব, পারিনি। কিন্তু আমার ছেলে আজ এমন এক মুকুট নিয়ে আসছে, যার ঔজ্জ্বল্য সূর্যের আলোর চেয়েও বেশি দীপ্তিমান। আপনি না স্বপ্ন দেখতেন আপনার ছেলে কুরআনের হাফেজ হবে? দেখুন না, আপনার স্বপ্ন আজ অক্ষরে অক্ষরে পূরণ হয়েছে। আপনার ছেলে পাক কুরআন হিফজ করেছে। আজ তাকে পাগড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে। আপনি কেন এভাবে আমাকে একা ফেলে চলে গেলেন। ছেলের এত বড় খুশির দিন, অথচ তার পাশে আপনি আমি কেউ নেই। আপনি থাকলে তো আজ সেখানে যেতে পারতেন। দেখতে পারতেন আমাদের ছেলের মাথায় কিভাবে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে সম্মানের স্মারক। বাড়ি ফিরলে শুনতাম আপনার কাছ থেকে সেই কাহিনি। কেন এভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন…।’ বলতে বলতে বাখমিনা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্বামীর কবর থেকে ফিরে ঘরদোর গোছানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বাখমিনা। আবদুল্লাহর বাবার স্বপ্ন ছিল গাঁয়ের সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াবেন, বাখমিনার সে তওফিক নেই, তারপরও আশপাশের কয়েক পরিবারকে তিনি দাওয়াত করেছেন। তাঁরা আসবেন। ছেলেকে দোয়া দিয়ে যাবেন।
বাখমিনার ফোন বেজে ওঠে হঠাৎ। স্ক্রিনে আবদুল্লাহর মামার নম্বর। ছেলের পাগড়ি প্রদান অনুষ্ঠানে কিছুক্ষণ আগে ভাইকে পাঠিয়েছিলেন বাখমিনা। আবদুল্লাহ ফোন রাখার পর দৌড়ে গিয়ে তিনি প্রথমে ট্রাঙ্ক খুলেছিলেন। অল্প অল্প করে অনেকদিন ধরে কিছু টাকা জমিয়েছিলেন তিনি। জমিয়েছিলেন এই দিনটির জন্যই। ছেলে হিফজ শেষ করলে তাকে ভালো এক সেট জামা আর এক গোছা দামি হার কিনে দেবেন। আজ সেই কাক্সিক্ষত দিন। ভাইকে ডেকে এনে তাঁর হাতে টাকাগুলো গুঁজে দিয়ে বাখমিনা বলেছিলেন, ‘ভালো দেখে এক সেট পোশাক কিনবে আবদুল্লাহর জন্য, সাথে এক গোছা হার। তারপর মাদরাসায় গিয়ে তাকে সেগুলো পরিয়ে দেবে। আর আজ মাদরাসা ছুটি হবে। অনুষ্ঠান শেষে তাকে নিয়ে এসো বাড়িতে।’ ভাইয়ের ফোন দেখে বাখমিনা আশ্চর্য হলেন খানিকটা। এত তাড়াতাড়ি অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল! নাহ, এত জলদি তো শেষ হবার কথা না! তবে এই অসময়ে ফোন কেন? দ্বিধাদ্ব›দ্ব নিয়ে ফোন রিসিভ করলেন তিনি, ‘অনুষ্ঠান কি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল? আবদুল্লাহ পাগড়ি পেয়েছে?’
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসছে না। কেবল কান্না, চেচামেচি আর চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা আর অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠল বাখমিনার মাতৃহৃদয়। ‘হ্যালো, ভাই, শুনতে পাচ্ছ আমাকে? কী হয়েছে ওখানে? আমার আবদুল্লাহ ঠিক আছে তো? আমার আবদুল্লাহর কিছু হয়নি তো?…’ বাখমিনা সবকিছু ভুলে দিশেহারার মতো চিৎকার করতে থাকেন। ওপাশ থেকে খানিকপর ভাইয়ের গলা শোনা গেল। বড় ঠাণ্ডা এবং শক্ত তাঁর কণ্ঠ। ‘মার্কিনিরা বোমা হামলা করেছে, বাখমিনা। আবদুল্লাহসহ তার অসংখ্য সহপাঠী শাহাদত বরণ করেছে।’
হাত থেকে ঠাস করে মাটিতে পড়ে গেল মোবাইলটা। সেই সাথে বাখমিনাও লুটিয়ে পড়লেন। এতক্ষণে প্রতিবেশী মহিলারা এসে জড়ো হয়ে গেছেন সেখানে। তাঁরা ধরাধরি করে বাখমিনাকে খাটে ওঠালেন। এ কী, বাখমিনার চোখে অশ্রæ কোথায়? দুচোখে এ কিসের লেলিহান শিখা? লাল হয়ে আছে চোখজোড়া। প্রতিশোধের আগুন যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে সেখানে।
বাখমিনা শক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার আবদুল্লাহ মরেনি, শাহাদাত বরণ করেছে মাত্র। শাহাদাতের মাধ্যমে সে জান্নাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। আবদুল্লাহর পাগড়ি প্রদান আমার আল্লাহ দুনিয়াতে সম্পন্ন করেননি। তাকে জান্নাতে পাগড়ি পরানো হবে। পাগড়ি পরাবেন মোল্লা মুহাম্মদ উমর! আমার সৌভাগ্য, আমি একদিকে যেমন একজন শহিদের স্ত্রী, অপরদিকে একজন শহিদের মা। এমন সৌভাগ্যের জন্য আমার আল্লাহর দরবারে আমি লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করছি। কেউ মনখারাপ কোরো না। আমার স্বামী এবং সন্তানের রক্তপিচ্ছিল পথ মাড়িয়েই একদিন আফগানের আকাশে পতপত করে উড়বে কালেমা তাইয়েবার পবিত্র নিশান। আমি এখন থেকে সে দিনের ইনতেজারে রইলাম।’
তারপর বাখমিনা চুপ হয়ে শুয়ে থাকেন খাটে। বাইরে নিজেকে যতই শক্ত রাখছেন তিনি, ভেতরের মাতৃহৃদয়টা ততই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তাঁর হৃদয়ের কানে বারবার অনুরণিত হচ্ছে শহিদ ছেলের শেষ উচ্ছ্বাস–মোরে, মোরে, জেমা দস্তারবন্দি দাহ!
মে ২০১৮