বর্ষার জলে থৈ থৈ করে চারপাশ। টলমল পানিতে মাছেরা ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। ভোর সকালে দৃষ্টিজুড়ে শাপলার দিগন্ত বিস্তৃত মহড়া। পানকৌড়ির দল মাঝ-বিলে শরীর ডুবিয়ে নিশ্চিন্তে চলে যায় বহুদূর। পানির সরু আলোড়ন দেখেই বোঝা যায় কোথায় গিয়ে ভেসে উঠবে। আমার দৃষ্টি স্থির থাকে স্বচ্ছ পানির আরশিতে। সেখানে সবুজের নির্মল প্রতিবিম্ব। একটু দূরে তিরতির কাঁপে নীলাকাশ। দূর থেকে ছুটে আসে দখিনা বাতাস। দূরের দেশ থেকে উড়ে আসে মেঘের ভেলা। রোদ আড়ালে চলে গেলে পানিতে বিষণœতার ঢেউ ওঠে। ঝুপ করে শব্দ তুলে দৃষ্টি-সীমার আড়ালে চলে যায় একটি মাছরাঙা। দূরে কোথাও রঙিন ছায়া পড়ে। এসব দেখতে দেখতে কোন ফাঁকে চুলোয় জ্বলতে থাকা আগুনের মতো দুপুর গড়িয়ে যায়। ফুরিয়ে যায় রোদজ্বলা প্রহর। আমি শ্রান্ত পথিকের মতো বর্ষার জল দেখি। নৈঃশব্দ্যের ভাঁজে আটকে থাকা নিঃসঙ্গ দুপুরের গান শুনি।
সুন্দরের প্রতি সবসময় আমার তীব্র আকর্ষণ। আজন্ম বুকের ভেতর সুন্দরের তৃষ্ণা লালন করি। সেই তৃষ্ণা থেকেই ফুলের প্রতি দূর্বলতা, ফুলকে ভালোবাসা। ফুলের বাগান করার একটা ইচ্ছে শৈশব থেকে লালন করে আসছি। এটা আমার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। জানা-অজানা অজ¯্র ফুলের সমাহার হবে এখানে। প্রতিনিয়ত অগণিত ফুল ফুটবে। মুগ্ধ সুবাসে মাতিয়ে রাখবে চারপাশ। নানা কারণে সেটা এতদিন পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এখন একটু-একটু করে পূরণ করছি। এই কয়দিনে ছোটখাট একটা বাগান হয়েছে। তবে আমার স্বপ্ন আরও বড়, অনেক বড়! তাই যখনই নতুন কোনো ফুল গাছ দেখি, আর্থিক টানাপোড়েন থাকলেও কিনে ফেলি। তবে ঢাকা থেকে কখনো আনার সাহস হয়নি। এবার বাড়িতে আসার সময় আম্মু বলার কারণে প্রায় আধমরা হতে-হতে দুটো ফুল গাছ এনেছি। একটি রজনীগন্ধা, আরেকটির নাম জানা নেই। লম্বা-লম্বা পাতায় ছাওয়া হলুদ রঙের ফুল। রজনীগন্ধাটার অবস্থা একেবারে সঙ্গিন। যায় যায় আরকি। তবু হাল ছাড়ছি না। সকাল-সন্ধ্যা পানি দিয়ে গাছটাকে বাঁচিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। বুকের ভেতর আশার ক্ষীণ আলো, গাছটা বেঁচে উঠবে। আশার এই শেষ আলোক বিন্দুটুকুই আমাদের প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখায়, বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।
বিকেলে হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ চোখ পড়ল কদম গাছটার দিকে। একি! একটা কদমও নেই। মাটিতে কয়েকটা মরা পাপড়ি পড়ে আছে। গাছে কয়েকটা বিবর্ণ কদম। এই ভরা বর্ষায় কদম নেই, বাতাসে মনকাড়া সেই সৌরভ নেই। মনটাই খরাপ হয়ে গেল। সূর্যের রক্তিম প্রতিবিম্ব পানিতে এসে পড়ছে। মৃদু ঢেউয়ের আলোড়ন। দূরে একটি নৌকা দাঁড় করানো। পাশে কয়েকটা ছেলে জাল হাতে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে খুব সন্তর্পণে সামনে এগোয়। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে শাপলাগুলো মিশে আছে পানির সঙ্গে। চোখের পাতায় খেলা করে শৈশবের অসংখ্য স্মৃতি। মাছ ধরা, শাপলা-শালুক কুড়ানোর অদম্য নেশা ছিল। তবে এসবের জন্য খুব বেশি সময় পাইনি। খুব ছোট থাকতেই এসব ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয়েছিল বহুদূর।
হিফজের সময়টার কথা খুব মনে পড়ে। চাঁদনী রাতে কয়েকজন চুপিচুপি বেরিয়ে পড়তাম। চারিদিক ফকফকে জোছনা। বিশাল বড় চাঁদটা তখন পানিতে ডুব দিয়ে আলো বিলাচ্ছে। আমরা আপনমনে মাছ ধরতাম। আবার সেহরির আগেই ফিরে এসে কেটেকুটে রান্না করা। আহা, কী সোনাঝরা দিন ছিল! খুব মনে পড়ে, যাদের সঙ্গে মাছ ধরতাম তাদের কথা। সবাই যে কোথায় হারিয়ে গেল। যেন ভুল করে অন্য কোনো বগিতে উঠে পড়েছি আমি। কারো সঙ্গেই আর যোগাযোগ নেই। সবাই আমার পৃথিবী থেকে বহুদূর। ভাবতেই বুকের ভেতর উথলে ওঠে কান্না। ওরা কেমন আছে, কোথায় আছে―জানতে খুব ইচ্ছে করে। জীবনটাই এমন, হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য হাহকার ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তারপর আমার জীবনে কখনো এমন সুযোগ আসেনি। শহুরে জীবনে কখন বর্ষা আসে, যায়―বুঝতেই পারি না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। পাখিরা ঘরে ফেরে। আমার আর ঘরে ফেরা হয় না। মন পড়ে থাকে সুদূর অতীতের কোনো এক বর্ষারাতে।
মেঘের লুকোচুরির কারণে চাঁদের দেখা পাওয়া গেল না। তবে আজ চাঁদ উঠে গেছে। এই চাঁদ হয়তো তেমন ঘটা করে দেখা হয় না। উৎসবের আমেজ নেই। তবু চাঁদ উঠেছে মনে হতেই অজানা শিহরণ জাগে মনে। হৃদয়ের জানালায় দোলা দিয়ে যায় আনন্দ-বাতাস। সামনে দীর্ঘ অবকাশ। নিয়মতান্ত্রিক জীবন থেকে বেরিয়ে মুক্ত আকাশের সঙ্গে কাটবে কিছুদিন। প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখার এই সুযোগ আমার জীবনে খুব কম। তাই এই কয়টা দিনই আমার জন্য অনেক। হয়তো এই দিনগুলোও খুব দ্রæত ফুরিয়ে যাবে। আনন্দময় সময় কখনো দীর্ঘ হয় না, দ্রæতই নিঃশেষ হয়ে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে রাত দীর্ঘ হয়। আকাশে একটি তারাও নেই। আকাশজুড়ে মেঘের ইতস্তত উড়োউড়ি। রাতজাগা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ মিলিয়ে যায় দূরে কোথাও।
হাসিব ইমতিয়াজ শিক্ষার্থী, জামিয়া ফরিদাবাদ, ঢাকা
ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত