‘আমার শিক্ষক।’ দু’টি শব্দ দিয়ে নির্মিত এ যে এক প্রেমের কবিতা, তা বলতে এখন আর দ্বিধা নেই। এর মাঝে গেঁথে আছে শত শত অনুরাগ আর প্রীতির অমোঘ সম্মিলন। সুললিত সুরে রোজ সকাল-বিকাল সে বিলাতে থাকে রিনিঝিনি অভিনবে এক সুশ্রাব্য ছন্দ। নেমে আসে তন্দ্রা। নীরব পদক্ষেপে সে তন্দ্রা আবারও কেটে যায়। কেটে যায় কেবল তারই হাত ধরে। পৃথিবীর সূচনা থেকেই তো সে অতুলনীয়। অনুপম।
ওই যে নবি মুহাম্মদ, সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, কোলাহলহীন হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন যখন তিনি, এলেন রবপ্রেরিত জিবরিল, বললেন, ‘ইকরা’। পড়–ন। বুকে চাপড়ে ধরে আবারÑ‘পড়–ন আপনি, হে মুহাম্মদ!’ ঠিক এখানেও তো শিক্ষার এক নিরুপম চিত্র দেখে ফেলি ¯পষ্টত। রাজসিক এক অবয়ব নিয়েই তো বলেছিলেন একজন শিক্ষক, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে’। যেখান থেকে সূচনা ইসলামের। সূচনা চির শান্তির।
মহামহিম এ শিক্ষক নিশ্চয় প্রতিটি প্রাণের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন। জড়িয়ে থাকতে হবেই। তদুপরি জীবনের এ বহুরঞ্জিত পথে আমার সঙ্গেও মিশে আছেন এ শিক্ষক। ওইযে দু’হাজার ছয়ের কোনো এক সন্ধ্যায় আব্বুর হাত ধরে যখন আমি ঢুকে গেলাম পবিত্র এক আঙিনায়, তখন থেকেই আমার অস্তিত্বে এ শিক্ষকের অনুভব। তখন তো ছোট। আম্মুর মায়া আর বাসা ছেড়ে এ পরিবেশ আমার জন্যে কিছুটা ভয়ঙ্করই ছিলো হয়তো। কিন্তু শিক্ষকের প্রীতির কাছে একটা সময় আমি সব ভুলে গেলাম মনে হয়। সন্ধ্যার পর সূর্য যখন নি®প্রভ, তখন আমাকে নেওয়া হলো এ মহলের একদম চ‚ড়ান্তে। সবাই পড়ছে। অধীর মনোযোগে। সবার হাতে চক-শ্লেট। ‘আলিফ মিম তোয়া জোয়া’র ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। আমাকেও দেওয়া হলো শ্লেট। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা বø্যাকবোর্ডের সম্মুখে একজন শিক্ষক। তিনি লেখাচ্ছেন। শেখাচ্ছেন। চৌদ্দশত বছর আগের যে শিক্ষা ‘ইকরা’, এরই চর্চা করছেন। আমার ছোট্টমন তখন ভীতসন্ত্রস্ত। কাঁপছে ঠোঁট। আমাকে লিখতে দেওয়া ‘হা’ আমি লিখতে গেলাম যখনই, আমার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। নবি মুহাম্মদের মতোই বলে ফেললাম চিন্তাহীন স্বরে, ‘আমি পারব না’। কিন্তু সে শিক্ষক দৌড়ে এসে আমাকে আদরের ভঙ্গিতে কোলে তুলে নিলেন। জড়িয়ে ধরলেন। আমার চোখেমুখে মেখে থাকা ভীতিবিহŸলতাÑসব ক্রমশ কেটে যেতে থাকল। শিক্ষকের হাত ধরে আমাকে চিনতে শেখাল শুদ্ধ-সুন্দর জীবনের বিমূর্ত সব পথঘাট।
এরপর কেটে গেছে বারটি বছর। বারটি বসন্ত। কত কত শিক্ষকের সামনে জড়সড়ভাবে বসে শিখতে হয়েছে নিরুপম এ শিক্ষা। কত কত মহান অস্তিত্বের কাছে নিজেকে বিলীন করে দিতে হয়েছে, সে তো বেহিসাব। কিন্তু তবুও কিছু কিছু স্মৃতি হঠাৎ হঠাৎ এসে জেঁকে বসে। কতক স্মৃতি হতাশার এক সুতীব্র ঢেউয়ের ভেতর ভাসিয়ে দেয় আমাকে। আবার কিছু প্রেরণায় ভরপুর করে দেয় মম অন্তর। তারই মধ্যে কিছু তো বলাই যায় দ্বিধাহীন। তাহলে বলেই ফেলি!
এই যে আজকের এ রাত্রিতে যখন আমি আমার জানালার খুব কাছে বসে বসে লিখছি আমার স্মৃতি, আমার অতীত, এবং টুক করে চোখ বের করে দেখে নিচ্ছি চাঁদ, তখনই আমার ভেতরে কিছু কিছু স্মৃতি এমন করে বেজে বেজে উঠছে ক্রমশ, যা আমাকে, আমার আগামীর পথকে করে দিচ্ছে সুগম। অবারিত।
কিছুদিন আগের কথাই বলি। তখনও চিন্তাজগত অনেকটা অপরিপক্ব। ‘মন যা চাহে তা’র ওপর চড়ে বসে চষে বেড়াচ্ছি সব। মনে চাইল একবার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যাব। বটতলায় বসে ভর্তাভাত খাব পেট পুড়ে। ছুটিছাটা না নিয়েই আমরা ক’জন বেরিয়ে পড়লাম। খেলাম আরাম করে। কিন্তু যখন ফিরে এলাম মাদরাসায়, দেখি সর্বত্র নি®প্রতিভ এক অবস্থার বিরাজ। কিছুক্ষণের ভেতরই অফিসে ডাক পড়ল। আরও কিছুক্ষণ পর কী হলো? আমার শিক্ষক, হয়তো-বা প্রেমের আবদার থেকেই, আমাকে শাস্তি দিলেন। প্রচÐ রকম। কিন্তু এরপরই মূলত জীবন থেকে ছিটকে পড়ার মতো ভুল আমি করে বসললাম। বেরিয়ে গেলাম মাদরাসা থেকে। অনেকটা পালিয়ে যাবার মতো কলঙ্ক নিজের গতরে মেখে দিলাম। তারপরই ভাবনার দুয়ারে উদয় হলো আমার শুভ চিন্তারাÑএ কী করলাম আমি! সেবার মাদরাসায় আসার পর অনেক কষ্টের পর মাফ পেয়েছিলাম। আমার শিক্ষক আমার প্রতি যে করুণা সেদিন করেছিলেন, তার জন্য আজীব্য আমি কৃতজ্ঞ থাকব। তাঁর জন্যেই হয়তো-বা আজকের এ রাতে আমি নিশ্চিন্তে চাঁদ দেখার মতো পরিবেশ পেয়ে গেছি। তাঁরই করুণার জন্যে হয়তো আমি লিখতে পারছি অচিন্তিত মনে। নিরুদ্বেগ এক আত্মাকে বয়ে। কেননা, ছোটবেলায় আমার প্রথম শিক্ষক আমার পরম অনুরাগী পিতা আমাকে এই শিক্ষাই দিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন শিক্ষকের মর্যাদা। তাঁর সম্মান।
আমার মনে আছে হিফজখানায় থাকাকালীন ছাদে ক্রিকেট খেলার আয়োজন হতো। এবং প্রতিদিনই বল মেরে আমরা ছাদ থেকে ফেলে দিতাম পাশের টিনের চালে। ভদ্রলোক রাগে গরগর করে ছুটে আসতেন মাদরাসার অফিসে। বেঁটেমতো বুড়ো লোকটির সে কী রাগ, দেখলেই গা জ্বলে যেত আমাদের। কিন্তু বিচার নিয়ে আসার পর কী হতো? আমাদের হুজুর নরম করে একটা বকা দিয়ে আমাদের পাঠিয়ে দিতেন। পরে আড়ালে গেলে শোনা যেত, হুজুর বলছেন, ‘এরা আমারই তো সন্তান, ওদের পিতা হয়ে একটু ক্ষমা চাচ্ছি। ক্ষমা কি করা যায় না?’
আমার শিক্ষক যাঁরা আছেন তাঁদের নিয়ে আমার অনেক গর্ব আছে। অনেক। অসামান্য। প্রেমের কথাও আছে। যখন আমি বসে থাকি হজরত ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভীর দরসে, তখন এসব গর্বেরা আরও জেগে উঠতে থাকে। প্রেমেরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কাসাসুন নাবিয়্যিনের দরস থেকে শুরু করে মাকামাত, অনেকটা সুগভীর এক অবলোকন এখানে আমার থাকে। কী অদ্ভুত মিষ্টতা নিয়ে হুজুর পড়াচ্ছেন। শব্দের তরজমা যেন আমাকে নিয়ে যেতে চায় আলি মিয়া নদভির কাছে। আমাকে টেনে নেয় আবু মুহাম্মদ আল কাসেমির দরসগাহে। এমনই এক স্বাদ এখানে। তাঁর এ পরিশ্রম, সাধনা, এসবের বিনিময় আমি কোত্থেকে দেব? ভেবে পাই না।
আমার শিক্ষককে আমি উপলব্ধি করার শুরু সময়েও দেখেছি, তাঁদের প্রীতি। আমার প্রতি। আমাদের
প্রতি। মাওলানা সাখাওয়াত হুসাইন দামাত বারাকাতুহ। আমরা ‘ঢাকার হুজুর’ বলে ডাকি। মাদরাসাতুল কাউসারের
অনেকটা সূচনা থেকেই হুজুর এখানে ছিলেন। ছোটবেলা তাকে দেখে খুব বিস্ময় বোধ হতো, যখন দেখতাম এত উঁচু মাপের একজন শিক্ষক নিজ হাতে ধুয়ে দিচ্ছেন ছোট ছোট বাচ্চাদের কাপড়চোপড়। কীভাবে সম্ভব? সত্যিই প্রেমের কাছে এসব নোংরা কাপড়গুলো পরাজিতই ছিল। কিন্তু দিনশেষে এটাই সত্যি, এর পূর্ণ কদর আমাদের পক্ষ থেকে হচ্ছে না। হতে দিচ্ছি না।
আর আমার বাবার কথা আর কী বলব! তিনিও তো আমার শিক্ষক। আবেগের বশে বলছি না। সত্যিই দরসে বসে থাকা একজন ছাত্রই আমি তাঁর। হজরত শায়খ জাকারিয়ায় আপবিতি যখন আমি পড়ি, তখন আমার পিতাকে আমি সবচাইতে বেশি উপলব্ধি করি। অনুভব করি আমার জন্য তাঁর এত বিসর্জন। এত প্রেমের সঞ্চার। পরিশ্রম।
২০১৩-তে যখন উত্তাল পুরোদেশ। নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন চলছে সর্বত্র। ঠিক তখনকার একটা গল্প আমার ভেতরে এখনও বেজে ওঠে। ৮ই মার্চ জুমাবার মিছিল বেরুল। সবার মুখে ইল্লাল্লাহর ধ্বনি। শুভ্র সফেদ ফেরেশতার দল চলছে সম্মুখে। তখনই দেখা গেল মিছিল আটকে দেওয়া হয়েছে। শ’খানেক ছাত্র আমরা। পুলিশের কাছে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতোই ছিল। আবেগের তাড়নায় আমরা যখন চিৎকার করছিলাম ব্যারিকেড সরিয়ে দেওয়ার জন্য ঠিক তখনই পুলিশের গুলি চলল আমাদের বুকে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও একটি ধ্রæবসত্য আজকের এ গল্পে না বললে বড় অপূর্ণ রয়ে যাবে। ‘আমার ছেলেদেরকে একটা গুলিও করবি না শয়তানের দল!’ চিৎকার শোনা গেল। দেখি অগ্রে দাঁড়িয়ে আছেন আমার শিক্ষক। আমরা তখন দৌড়াচ্ছি। দিগি¦দিক। পেছন ফিরে এ দৃশ্য দেখবার জন্যে হয়তো একটুও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার শিক্ষকের বুকে তাক করে রাখা আছে একটি রাইফেল। এখনই কি ট্রিগার চেপে দেওয়া হবে?
এরপরের গল্পটা আমি মনে রাখতে চাইনি আর। কিছু কিছু গল্প, কিছু কিছু স্মৃতি মুছে যাক। মুছে যাক চিরতরে। সত্যিই জীবনের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমি অনুভব করি আমাদের প্রতি শিক্ষকের প্রেম। এবং ¯পষ্টতই বলা যায় এমন অগুনতি ঘটনার চক্রে আমরা ঘুরছি ক্রমশ। আর এটাও বলা যায় ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের এ অতুলনীয় প্রেমের কথা, প্রেমের জিগির, কেবল এ শিক্ষার মধ্যেই সম্ভব; যে শিক্ষা আবৃত করে রেখেছে নুরে এলাহি। যে শিক্ষা আসমান থেকে নেমে আসা এক জ্যোতির মতোই। যে শিক্ষা স্বয়ং মাওলাপ্রদত্ত এক রশ্মির মতোই। এবং আরও পষ্ট করে বলি ‘আমার শিক্ষক’ এ শব্দ দু’টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছে একটি পৃথিবী। ব্যক্তিগত পৃথিবী কিংবা উত্থান পতনের এ সামগ্রিক পৃথিবী।
জুন ২০১৮