ভেজা মাটিতে হেঁটে হেঁটে আসি প্রতিদিন সবুজ ঘাসবনে। একাকী কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকি ঝিলের নির্জন পাড়ে। ওদিকে আঙ্গিনাজুড়ে মানুষের উচ্ছাস; আনন্দের উল্লাস। যেন বাতাসে উড়ে বেড়ায় সুখী মানুষদের হাসির রিনিঝিনি সুর। চোখের তারায় আনন্দের চাঁদ এঁকে কত দুরন্ত কিশোর ছুটে যায় মাঠ পেরিয়ে হলদে পাতার বনে। আমি শুধু দিঘির মাঝে আড়াইশো বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা অশ্বত্থ গাছের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকি।
মানুষ আসে-যায়। উড়ে যায় কত বিষাদের রোদ্দুর। ঘুড়ির রঙিন সুতায় নিজেকে অজান্তেই জড়িয়ে ফেলে মেঘচিল। টুপ করে দিগন্তে নামে গোধূলিবেলা। এখনও ফেরেনি কেউ আনন্দ-মিছিল থেকে। প্রিয় মানুষের সাথে যে আজ হাঁটছে রোদমাখা বিকেলের পথ, সে কি এত শীঘ্রই ফিরবে আমার এই মনখারাপের দিনে? কথায় কথায় তো পথ গুটায়, সময়েরও আয়ু ফুরায়! কিন্তু অসহ্য অপেক্ষার ক্ষণকাল কি কাটে একনিমেষে? বরং অপেক্ষারা আরও যন্ত্রণার শিকড় ছড়িয়ে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে ব্যথাতুর হৃদয়। শত কষ্টে বুকের মাঝে রক্ত জমে জমে যে পাথর জন্মেছে, অতিশয় কষ্টে সে পাথর গলে একসময় ঝরঝর করে অশ্রু নামে দুগাল বেয়ে। দূরে বাতাসের ঝাপটা আর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে শূন্যতার এক বেদনাভরা সুর বেজে ওঠে। হাওয়ার পথ ধরে কার যেন কণ্ঠ ভেসে আসে। কে যেন দূরে বসে আনমনে ছন্দ কাটে—কোলাহলে খুঁজে নিস তোর প্রিয় মুখ, যে তোর হৃদয়ে ছড়িয়ে দিতে পারবে হাসনাহেনার সুখ!
শত মানুষের ভিড়ে খুঁজে নিস তোর প্রিয় মানুষ, যাকে দেখলে তোর হৃদয়াকাশে ওড়ে খুশির ফানুস!
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই মানুষের কোলাহলে। খুঁজে ফিরি প্রিয় মানুষটাকে। কত মানুষ হেঁটে যায়, দলবেঁধে কতজন দৌড়ে যায় ঘাসফড়িংয়ের মত হাসি-আনন্দ-উচ্ছলতায়। কিন্তু যে বা যার অপেক্ষায় কিংবা যাকে আপন ভেবে বসে থাকি আশায়, সে তো আর আসে না!
বিষাদের বিকেল মাড়িয়ে গোধূলির ধূলিপথে উড়ে যায় গাঙচিল। নিজেকে আরো শূন্যে ভাসাবার তরে ডানা ছড়িয়ে দেয় আকাশছোঁয়া বাজ। আনন্দমুখর মানুষের সমাগমে আপনকে খুঁজে খুঁজে বেদনায় আমি নত হয়ে বালুতে এলোমেলো পদরেখা আঁকি।
দলে দলে মানুষ ফিরছে ঝিঁঝিডাকা সন্ধ্যায়। আমি আবারও আশার পেখম মেলে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে থাকি মানবমিছিল পানে। না, কেউ আমার দিকে ফিরে তাকায়নি। কারো মনে পড়েনি একটিবারও আমার কথা। সবাই প্রিয় বন্ধুদের সাথে মেতে আছে হাসি-খেলা-খুনসুটিতে। শুধু আমি বিষণ্নতা মেখে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি সন্ধ্যার আঁধার বুকে। মনে হয়না, আজ আর কেউ আসবে। কার এতো সময় আছে আমাকে সামান্য সময় দিবে?
বেদনার অসহ যাতনায় আমার আঁধার নামা বুকে আরো কালো কালো মেঘ জমে। আমি তখন মেঘের আড়ালে সান্ত্বনার রোদছায়া খুঁজি এই ভেবে—হয়তো আমার জীবনে কোনদিন কোন প্রিয় মানুষ হবে না। আমায় কেউ আপন ভাববে না। ভাবলেও হয়তো কোনদিন মুখ ফুটে বলবে না। আমাকে সারাজীবন একাকিত্বের বোঝা বহন করেই যেতে হবে। এটাই হয়তো আমার ভাগ্যের লিখন, খণ্ডাতে পারবে আছে সে কোনজন?
প্রিয়জনকে হারাবার বেদনা যে কাউকেই পোড়ায়। কতজন তো বুকে হাত রেখে শপথ করেছে—একাকী থাকব, কারণ মানুষ শুধু কষ্ট দেয়।
শুধু আমি পারি না এ প্রতিজ্ঞায় নিজেকে আবদ্ধ করতে। তাই তো এখনও ভাবি—বেদনাগুলো তো ভুলে যেতে চাই, কিন্তু কে ভুলিয়ে দেবে আমার বেদনাগাথা? কে আমায় আপন করে নেবে আপন ভেবে—জানি না।
শুধু আশার পানসিতে দোল খেতে খেতে এতটুকুই বলতে পারি—
যে পারো সব ভুলিয়ে দাও,
আমায় তব প্রিয় করে নাও!
নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা
ফেব্রুয়ারি ২০২২