জীবনে এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্য আসে, যাঁদের উপস্থিতি জীবনের বাঁকে বাঁকে সুদূরপ্রসারী ছাপ ফেলে যায়। মাঝিবিহীন যেমন কোনো নৌকা নদীতে ঠিক পথে চলতে পারে না, তেমনি একজন নীতিবান আদর্শ শিক্ষক ছাড়া কোনো ছাত্র মানুষের মতো মানুষ হতে পারে না।
পাথরঘাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শ্রদ্ধেয় রঞ্জিত কুমার নাথ তেমনই এক মানুষ, যিনি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক। প্রাইমারি শেষ করে যখন হাই স্কুলে উঠি, তখন ঐ ছয়টি বছরে মনের মতো কোনো শিক্ষক পাইনি। কিন্তু স্কুল জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে পরিচয় হয় মেধাবী ও মহান আদর্শের অধিকারী শিক্ষক রঞ্জিত স্যারের সাথে। প্রথম ক্লাসে অল্প সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার সুস¤পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কের বাঁধনটা পরবর্তী সময়ে এতটাই পোক্ত হয়েছিল যে, আজও আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কল্পখাতায় তাঁর নাম লেখা আছে। একজন ভালো শিক্ষক হতে যতগুলো গুণ থাকা দরকার তার সবগুলোই ছিল রঞ্জিত স্যারের মধ্যে।
যখন আমি নবম শ্রেণীতে পড়ি, আমার মা মারা যান। মা বিয়োগের শোকে পড়াশোনা বেশ ঘাটতি দেখা দেয়। পরিণতিতে সে বছর রেজাল্ট মারাত্মক খারাপ হয়। মা মারা যাওয়ায় আমার বোন তখন অভিভাবক। রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় হেডস্যার আমার বোনকে খবর দিয়ে স্কুলে আনালেন। আমার রেজাল্টের অবস্থা তাঁকে দেখালেন। প্রচÐ মনখারাপ হলো আমার। খানিকটা অপমানবোধও করলাম। রঞ্জিত স্যার তখন এসে আমার মাথায় পিতৃ¯েœহের পরশ বুলিয়ে সান্ত¦না দিলেন। নরম গলায় বললেন, ‘মনখারাপ করিস না, পাগলী! পরিশ্রম করবি বেশি করে, পড়াশোনায় আর গাফলতি করবি না, আজ ব্যর্থ হয়েছিস, আগামীতে অবশ্যই তুই সফল হবি। ব্যর্থতার পরই তো সফলাতা!’ স্যারের আদরমাখা সেদিনের সে উপদেশ আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না সেদিনের মধুর সেই স্মৃতি। অন্তত এই একটা দিনের জন্য হলেও স্যার আমার হৃদয়কাননে অমর হয়ে থাকবেন আমার শেষ নিঃশ্বাস অবধি।
সেদিনের পর থেকে স্যার আমার কাছে অনন্য এক উচ্চতায় আসীন হয়ে যান। স্যারের ক্লাসগুলো আমার কাছে খুবই ভালো লাগত। স্যার এত অদ্ভুত সৌন্দর্যে কথা বলতেন যে, ক্লাসের গোমড়া মেয়েটার মুখেও মুক্তোর মতো হাসি
ঝরত। স্যার তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের খুব সহজভাবে বোঝাতে পারতেন, যা একজন আদর্শ শিক্ষকের অন্যতম গুণ। গণিত আর রসায়ন বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়গুলোওÑযা অনেকের কাছেই আতঙ্কেরÑএত সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন যে, বিষয়গুলোর প্রতি ভয় কাটার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাও বেড়ে যেত কয়েকগুণ। স্যার আমাদের এত উৎসাহ ও দক্ষতা নিয়ে পড়িয়েছেন যে, তাঁর সকল ছাত্র-ছাত্রীই তাঁর প্রতি চিরমুগ্ধ থাকবে।
সুদীর্ঘ সময় শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। আমার মনে আছে, তাঁর কাছে পড়ার সময় আমরা যেকোনো অঙ্কের সমাধান ক্যালকুলেটরে করার আগেই তিনি সমাধান দিয়ে দিতেন নিজে নিজেই! একবার আমার এক সহপাঠী তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, ‘স্যার, আপনি পুরো বইয়ের অঙ্ক মুখস্থ কিভাবে করলেন?’
জবাবে স্যার হেসে বলেছিলেন, ‘বাবা, আমি অংক মুখস্থ করি নাই। দীর্ঘ ২৫ বছর একই বই পড়াতে থাকলে কোন অঙ্কের সমাধান কী, তা এমনিতেই মনে থাকে!’
আমার মেট্রিক পরীক্ষার বছর। মেট্রিক পরীক্ষা জীবনের অন্যতম একটা টার্নিং পয়েন্ট। এ জন্য আমি নিজের পড়াশোনা নিয়ে ভাবার আগে স্যার আমাকে নিয়ে ভেবেছেন আমার চেয়েও বেশি। ডিসেম্বরের কনকনে শীতে জনজীবন যখন কুপোকাত, তীব্র সেই শীতের মধ্যেও সকালের পড়া বেশি স্থায়ী হয় বলে সেই স্থায়িত্বের
সময়কে যথাযথ ব্যবহার করতে আমার জন্য স্যারের ঘড়ির অ্যালার্ম আমার অ্যালার্মের আগেই বেজে উঠত। আমাদের তিনি শাসন করতেন বাবার চোখে। কোনো ক্লাসে নম্বর কম পেলে দুশ্চিন্তা করতেন মায়ের মতো। তিনিই আমাদের স্যার, প্রিয় রঞ্জিত স্যার। যাঁর কাছে শিক্ষার্থী হয়েও ‘আপনি’ সম্বোধন পেতাম। আবার প্রয়োজনে ‘তুই’, ‘তোরা’, ‘পাগলি’, ‘গাধি’ ডেকে যিনি আমাদের ¯েœহকাতর হৃদয়কে প্রফুল্লতা দিয়ে ভরিয়ে দিতেন। যাঁর কাছে শিখেছি ছোটদেরও সম্মানবোধ আছে, ¯েœহের মোড়কে তাদেরও সম্মান করতে হয়।
স্যার আমাদের শিখিয়েছেন বই পড়তে, বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে। তাঁকে দেখেছি, অনেক অভাবী মেধাবী ছাত্রছাত্রীর সাহায্যে তাদের পাশে দাঁড়াতে। তাঁর কথা আমি লেখায় ও মুখের ভাষায় বলে শেষ করতে পারব না। আমি স্যারের দীর্ঘায়ু কামনা করি।
কিছু মানুষ আছে যাদের কথা অজান্তেই খুব করে দাগ কাটে আমাদের মনে। রঞ্জিত স্যার অনন্য সেসব মানুষেরই একজন। শিক্ষাজীবনের অনেকটুকু অংশই তাঁর আদরে-শাসনে কাটিয়েছি আমরা। ক্লাসের ভেতর আমাদের রোজকার রুটিনে যেমন তাঁর উপস্থিতি থাকে, ঠিক তেমনি ক্লাসের বাইরে তাঁর কথাগুলো সারাজীবন আমাদের জীবনে কাজ করবে জাদুর মতো। এমন এক ব্যক্তিত্ব নিয়ে লেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য নবধ্বনিকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জুন ২০১৮