সৈয়দ মুজতবা আলী’র ‘পঞ্চতন্ত্র’ বইটি রসে টইটম্বুর। সেখান থেকেই কয়েকটি মজার ঘটনা উদ্ধৃত
করার লোভ সামলানো গেলো না–
বর্ষা নামক নিবন্ধটি থেকে জানা যায়, মিসরের কায়রোতে বৃষ্টি খুব কম হয়। লেখকের ভাষ্যে
‘কাইরোতে বছরে ক’ইঞ্চি বৃষ্টি পড়ে এতদিন বাদে সে কথা আমার স্মরণ নেই। আধা হতে পারে
সিকিও হতে পারে।’ এটুকু পাঠ করেই বোঝা যাচ্ছে কায়রোতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কেমন। তো,
কায়রোতে লেখকের চোখের সামনেই একদিন বৃষ্টি এল। এই বৃষ্টি নিয়েই সুদানের এক ছেলে একটি
গল্প বলল। গল্পটি এরকম–
সুদানের একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হ’ল। সে বললে, তার দেশে নাকি ষাট বছরের পর একদিন হঠাৎ
কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি নেবেছিল। মেয়েরা কাচ্চা-বাচ্চারা, এমন কি গোটা কয়েক জোয়ান মদ্দরা পর্যন্ত
হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়েছিল, ‘আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে আমাদের ঘাড়ে ভেঙ্গে পড়লো গো।
আমরা যাব কোথায়? কিয়ামতের (মহাপ্রলয়ের) দিন এসে গেছে। সব পাপের তওবা (ক্ষমা-ভিক্ষা)
মাঙবার সময় পেলুম না, সবাইকে যেতে হবে নরকে।’ গাঁও-বুড়োরা নাকি তখনো সান্তনা দিয়ে
বলেছিলেন, ‘এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আকাশটুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে না। এ যা নাবছে সে
জিনিস জল। এর নাম মর্ৎ (অর্থাৎ বৃষ্টি)।’ সুদানী ছেলেটি আমায় বুঝিয়ে বললে, ‘আরবী ভাষায় মর্ৎ
(বৃষ্টি) শব্দ আছে; কারণ আরব দেশে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়, কিন্তু সুদানে যে আরবী ভাষা প্রচলিত
সে-ভাষায় মর্ৎ শব্দ কখনো ব্যবহৃত হয়নি বলে সে শব্দটি সুদানী মেয়েছেলেদের স¤পূর্ণ অজানা।
বেদে নামক নিবন্ধে লেখক প্রথমেই একটু ভূমিকা টেনেছেন। সেখানে ‘রাসল পাশা’র একটি বইয়ের
কথা বলেছেন। এই বইয়ে রাসল পাশা মন্তব্য করেছেন, পৃথিবীর সকল বেদের (জিপসী) ভাষা আদতে
ভারতীয়। মুজতবা আলী এটা বিশ্বাস করতে চাননি। সন্দেহ পোষণ করেছেন এভাবে–
পণ্ডিত নই, তাই চট করে বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না। ইউরোপীয় বেদেরা ফর্সায় প্রায় ইংরেজের
সামিল, সিংহলের বেদে ঘনশ্যাম। আচার-ব্যবহারেও বিস্তর পার্থক্য, বৃহৎ ফারাক। আরবিস্থানের
বেদেরা কথায় কথায় ছোরা বের করে, জর্মনীর বেদেরা ঘুষি ওঁচায় বটে, কিন্তু শেষটায় বখেড়ার
ফৈসালা হয় বিয়ারের বোতল টেনে। চীন দেশের বেদেরা নাকি রূপালি ঝরণাতলায় সোনালি চাঁদের
দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চুকুস চুকুস করে সবুজ চা চাখে।
কিন্তু নিজের জীবনের একটি ঘটনার শেষে তিনি বিশ্বাস না করে পারলেন না। তখন তিনি জার্মানীর
রাজধানীতে। বয়স ২৫/২৬। একদিন কলেজের পাশের কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিলেন। তখন এক
বেদেনী তাকে ‘যবনিকা’ ভাষায় কি জানি বলতে লাগল। “সে ভাষা আমার চেনা-অচেনা কোন ভাষারই
চৌহদ্দি মাড়ায় না, কিন্তু শোনালো – তারই মুখের মত-মিষ্টি।” পরে কাফে মালিক মুজতবা আলীর
অনুরোধের প্রেক্ষিতে যখন বললেন যে তিনি ভারতীয়, তখন মেয়েটা হুঙ্কার দিয়ে কাফেওয়ালাকে
বলল, “সেই কথাইতো হচ্ছে। আমরা বেদে, ভারতবর্ষ আমাদের আদিম ভূমি। এও ভারতীয়। আমার
জাতভাই। ভদ্রলোক সেজেছে, তাই আমার সঙ্গে কথা কইতে চায় না।” পরে মুজতবা আলীর সাথে
আলাপচারিতায় জানা গেল। এরা বেদে, কিন্তু পড়াশোনা করে না। তারা ভাবতেও পারে না, কোন বেদে
কখনও পড়াশোনার চৌহদ্দি মাড়িয়েছে।
“বুঝতে পেরেছি বাপু, বুঝতে পেরেছি; বাপ তোমার দু’পয়সা রেখে গিয়েছে- হঠাৎ নবাব হয়েছ। এখন
আর বেদে পরিচয় দিতে চাও না! হাতে আবার খাতাপত্র- কলেজ যাও বুঝি? ভদ্রলোক সাজার শখ
চেপেছে, না?” আমি বললুম, ‘ফ্রালাইন, তুমি ভুল বুঝেছ। আমার সাতপুরুষ লেখাপড়া করেছে।
আমিও তাই করছি। ভদ্রলোক সাজা না সাজার কোনো কথাই উঠছে না।’
মেয়েটি এমনভাবে তাকালো যার সোজা অর্থ ‘গাঁজা গুল’। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ভারতীয় নও?
‘আমি বললুম, ‘আলবৎ’!
আনন্দের হাসি হেসে বলল, ‘ভারতীয়েরা সব বেদে।’
আমি বললুম, ‘সুন্দরী, তোমরা ভারতবর্ষ ছেড়েছ, দু-হাজার বছর কিংবা তারও পূর্বে। বাদবাকী
ভারতীয়রা এখন গেরস্থালী করে।’
মুজতবা আলীর বক্তব্য মেয়েটা কিছুতেই বিশ্বাস করে নি। পরে জানাল শহরের বাইরে রাখা তাদের
সার্কাসের গাড়ি রাখা আছে। তার বাবা-মার সাথে তর্ক করার আমন্ত্রণ জানাল। বলল, “বাবা সব
জানে। কাচের গোলার দিকে তাকিয়ে সব বাৎলে দেবে।”
ভাষাতত্ত্ব নিবন্ধের একটি রসিকতা–
‘ফরাসী ভাষাটা সব সময় ঠিক বুঝতে পারি কি না বলা একটু কঠিন। এই মনে করুন, কোনো সুন্দরী
যখন প্রেমের আভাস দিয়ে কিছু বলেন, তখন ঠিক বুঝতে পারি আবার যখন ল্যান্ডলেডি ভাড়ার জন্য
তাগাদা দেন তখন হঠাৎ আমার তাবৎ ফরাসী ভাষাজ্ঞান বিলকুল লোপ পায়।’
দা¤পত্য জীবন নামক নিবন্ধে তিনটি সংস্কৃতির দা¤পত্য জীবন নিয়ে কাহিনী আছে। মুজতবা আলীর
একজন চীনা বন্ধু ছিল। তারা দুজনে অফিস ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই ক্লাবে এসে আড্ডা দিতেন। ক্লাবের
এক কোনে নিমগাছের তলায় বসে তারা গল্পগুজবে মজে যেতেন। সাথে একজন ইংরেজ ছিলেন।
কথায় কথায় তাদের মধ্যে একটি বিবাহিত জীবন নিয়ে আলোচনা শুরু হল। প্রথমে ইংরেজের গল্প।
তাঁর গল্পটি এরকম। লন্ডনে একবার স্বামীদের বিরাট প্রতিবাদ সভা হচ্ছিল। মিছিল মিটিং চলছে।
প্রসেশনের মাথায় ছিল এক পাঁচ ফুট টিঙটিঙে হাড্ডি-সার ছোকরা। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই
ছ’ফুট লম্বা ইয়া লাশ এক ঔরৎ দুমদুম করে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা
টান দিয়ে বললে, ‘তুমি এখানে কেন, তুমি তো আমাকে ডরাও না। চলো বাড়ি।’ সুড়সুড় করে ছোকরা
চলে গেল সেই খাণ্ডার বউয়ের পিছনে পিছনে।’
বধৎশর
এবার চীনা বন্ধুর গল্প। চীনা গুণী আচার্য সূ রচিত শাস্ত্রে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। একবার পেপিং
শহরে অত্যাচার-জর্জরিত স্বামীরা এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল। কিভাবে স্বামীদেরকে
খান্ডার গৃহিনীদের হাত থেকে উদ্ধার করা যায় সেই বিষয়ের আলোচনা সভার প্রধান উদ্দেশ্য।
সভাপতি ছিলেন ষাট বছর ধরে দজ্জাল গিন্নীর হাতে নিপীড়িত এক দাড়িওয়ালা অধ্যাপক। সভায়
বক্তারা নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বলে গেলেন, “স্ত্রীলোকের অত্যাচারে দেশ গেল, ঐতিহ্য গেল, ধর্ম গেল,
সব গেল, চীন দেশ হটেনটটের মুল্লুকে পরিণত হতে চলল, এর একটা প্রতিকার করতেই হবে।
ধন-প্রাণ, সর্ব দিয়ে এ অত্যাচার ঠেকাতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন সময় দারোয়ান হন্তদন্ত হয়ে
ছুটে এসে জানালো এ সভার খবর পেয়ে গিন্নীরা ‘ঝাঁটা, ছেড়া জুতো, ভাঙা ছাতা’ ইত্যাদি নিয়ে তেড়ে
আসছে। এ কথা শুনে তো সবাই পড়িমড়ি করে পালিয়ে গেল। শুধুমাত্র সভাপতি তার আসনে শান্ত
গম্ভীর মুখ নিয়ে বসে আছেন। দারোয়ান কাছে গিয়ে বলল-
হুজুর যে সাহস দেখাচ্ছেন তাঁর সামনে চেঙ্গিস খান তসলীম ঠুকতেন, কিন্তু এ তো সাহস নয়, এ
হচ্ছে আÍহত্যার শামিল। গৃহিনীদের প্রসেশনে সক্কলের পয়লা রয়েছেন আপনারই স্ত্রী। এখনো সময়
আছে। আমি আপনাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।। সভাপতি তবু চুপ। তখন দারোয়ান তাঁকে তুলে
ধরতে গিয়ে দেখে তাঁর সর্বাঙ্গ ঠাণ্ডা। হার্টফেল করে মারা গিয়েছেন।
এবার মুজতবা আলীর পালা। গল্পটি অবশ্য পরিচিত। রাজা নিজ বৌয়ের (রাণীর) অত্যাচারে মন
খারাপ করে বসে আছেন। মন্ত্রী কারণ জানতে চাইলে বললেন, “ঐ রাণীটা- ওঃ কি দজ্জাল, কি
খাণ্ডার। বাপরে বাপ! দেখলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।”
মন্ত্রী বললেন এ আর কি ব্যাপার, বউকে তো সবাই ডরায়। এজন্য মন খারাপ করে বসে থাকতে হবে
নাকি? রাজা বিশ্বাস না করলে মন্ত্রী জনসমাবেশের ব্যবস্থা করলেন। সেখানে বলা হলো, যারা বউকে
ভয় পায়না তারা একদিকে আর যারা ভয় পায় তারা পাহাড়ের দিকে যেন যায়। মুহূর্তের মধ্যে
পাহাড়ের দিকটা ভর্তি হয়ে গেল। একজন শুধু ফাকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তখন মন্ত্রী তাকে ডেকে
বললেন, “তুমি যে বড় ওদিকে দাঁড়িয়ে? বউকে ডরাও না বুঝি?”
লোকটা কাঁপতে কাঁপতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, ‘অত শত বুঝি নে, হুজুর। এখানে আসবার সময়
বউ আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, “যেদিকে ভিড় সেখানে যেয়ো না।” তাই আমি ওদিকে যাই নি।’
ঝিগাতলার মোড়
তামীম আদনান
ঘন্টা দেড়েক হল মায়ের পেছনে ঘুরঘুর করছে রিমি। কোন কিছু আবদার জানানোর পূর্ব লক্ষণ এটা।
স্বাভাবিক ভাবে কোন কিছু পাওয়ার জন্য রিমিকে আবদার জানাতে হয়না। সব কিছু চাওয়ার আগেই
রিমির সামনে উপস্থিত করার চেষ্টা করে তার বাবা মা। কিন্তু রিমির যখন বিশেষ কিছুর প্রয়োজন হয়
তখনই সে মায়ের পেছন পেছন ঘুরঘুর করতে থাকে। কিন্তু জিজ্ঞেস করার আগে কখনোই নিজে
থেকে আবদারের কথা জানায় না রিমি। রিমির আজকের আবদারের বিষয় স¤পর্কে তার মা পূর্ব
থেকেই অবগত রয়েছে। আবদারটা তিনি মেনে নিতে চাইছেন না। তাই মেয়ের দিকে কোন রকম
ভ্রুক্ষেপও করছেননা। এদিকে রিমি অপেক্ষায় আছে কখন তার মা জানতে চাইবে, “কিরে ঘুরঘুর
করছিস কেন?” কিন্তু দেড় ঘন্টায় এই প্রশ্ন একবারো শুনতে না পেরে সে যারপরনাই অবাক হচ্ছে।
রিমি আর ধৈর্য ধরতে পারলনা! আগের নিয়ম ভেঙ্গে সে নিজেই মাকে ডাকল, আম্মু…..!
– হুমম…বল।
– আম্মু, আমি আন্দোলনে যেতে চাইছি!
– কিসের আন্দোলন?” কন্ঠে কিছুটা বিরোক্ত প্রকাশ করতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না! কারণ সে
নিজেও উত্তরটা জানে।
– কিসের আন্দোলন আবার! নিরাপদ সড়ক আন্দোলন।
– না! তুমি যেতে পারবেনা।
– আম্মু…. আমার সব বান্ধবীরা গেছে, আমাদের জুনিয়র সব ক্লাসের মেয়েরা গেছে, শুধু আমিই
তোমার পেছনে ঘুরঘুর করছি।
– তোর আব্বু কি বলে গেছে শুনিসনি।
– তার মানে কি আম্মু! তুমিও বাবার মত চাও এই আন্দোলন ছাত্র ছাত্রীরা না করুক?” প্রায় চেঁচিয়ে
প্রশ্নটা ছুড়ল রিমি।
– দেখ! আমি তোর সাথে তর্ক করতে চাইনা, তুই যদি যেতে চাস, তোর বাবার কাছে ফোন দিয়ে
পারমিশন নিয়ে যা! আমার সাথে চিল্লাচিল্লি করবিনা।
রিমি রাগ করে বারান্দায় এসে দাড়াল। ও জানে এখন আর আম্মুকে বলে কোন লাভ হবেনা। মনটা
খারাপ হয়ে গেছে ওর।
রিমির মন খারাপ থাকলে বারান্দায় দাড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশের বাড়ির
পায়রাগুলো যখন দল বেধে মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ায়, তখন মুগ্ধ হয়ে ওদের দিকে চেয়ে থাকে।
রিমি এখন সেই পায়রাগুলোর অপেক্ষা করছে।
রিমির বাবা আলতাফ হোসেন সাহেব। এলাকার সবাই তাকে “আলতাফ ভাই” বলে ডাকে। রিমির
বাবার আরো একটা পরিচয় আছে, তিনি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী একজন নেতা। এমপি মন্ত্রীদের
সাথে প্রায়ই তার ওঠাবসা হয়। তিনি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নামা স্কুল ছাত্র ছাত্রীদের ঘোর
বিরোধী। তার যুক্তি হল, ছাত্র ছাত্রীরা একদিন রাস্তায় দাড়িয়ে দাবি জানিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু
প্রতিদিন রাস্তায় নামার তো কোন প্রয়োজন নাই। দেশে সরকার আছে, এমপি মন্ত্রীরা আছে, তারা
অবশ্যই সড়ককে নিরাপদ করতে ব্যাবস্থা গ্রহন করবে। ছাত্র ছাত্রীদের ক্লাস ছেড়ে, পড়াশুনা ছেড়ে
রাস্তায় নামাটা “উগ্র খেয়ালিপনা” ছাড়া কিছুই না।
রিমি অবশ্য তার বাবার এই যুক্তির পাল্টা জবাবও দিয়েছে। এনিয়ে দুপুরে খাবারের টেবিলের উপর
দিয়ে ছোটখাটো একটা সাইক্লোনও বয়ে গেছে। কিন্তু কেউ কারো অবস্থান থেকে চুল পরিমানও
নরেনি।
জরুরী একটা মিটিংয়ে ডাক পরায় আলতাফ সাহেব খাওয়া দাওয়া করেই বাসা থেকে বের হয়েছেন।
বের হওয়ার আগে রিমিকে শক্ত কন্ঠে বলে গেছেন, “তোমার স্কুলের সবাই যদি তোমায় চিৎকার করে
ডাকতেও থাকে তবুও তুমি বাসার বাহিরে এক পা’ও রাখবেনা”।
আস্তে আস্তে সূর্য্যের আলো নিভে যাচ্ছে । পাখিরা যে যার নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য্য গলে
লাল হয়ে যাওয়া আকাশটার দিকে তাকিয়ে আছে রিমি। মা এসে তার পাশে দাড়াল! কাঁধে আলত
করে হাত রেখে বলল, “এই নে স্কুল ড্রেস, বেশি রাত করবিনা, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবি, আমি
তোর বান্ধবীদের সাথে কথা বলেছি ওরা রাত আটটার বেশি দেরি করবেনা”।
মায়ের কথা শুনে খুশিতে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে রিমি। মাকে একবার জড়িয়ে ধরে স্কুলড্রেস নিয়ে দ্রুত
রেডি হতে গেল সে! পাশেই কোন এক মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরীবের আযানের সুমধুর
ধ্বনি। মাথায় কাপড় দিয়ে রিমির মা মেয়ের কাছে জানতে চাইল, কোথায় দাড়িয়েছে তোদের স্কুলের
স্টুডেন্টরা?
রিমি উচ্ছাসিত কন্ঠে জবাব দিল, এই তো আম্মু সামনেই, ঝিগাতলার মোড়ে।
*****
আলতাফ সাহেব তার পছন্দের কিছু ছেলেদের নিয়ে জরুরী মিটিংয়ে বসেছেন। একটু আগে অবশ্য
এমপির সাথে একটা মিটিং শেষ করে এসেছেন। সেখানে কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেই
সিদ্ধান্তগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার লক্ষেই এই মিটিংটা করছেন আলতাফ সাহেব।
– ভাই বলেন কি করতে হইব!
ছেলেদের মধ্যে যেই ছেলেটা লিডার সে আলতাফ সাহেবকে খুব আÍবিশ্বাসের সাথে কথাটা বলল।
কথার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে এখন যদি ছেলেটাকে আগুনে ঝাপ দিতে বলা হয় সে তাই করবে এবং
তার দলের সবাইকে নিয়েই মরবে।
– কয় বছর আগে যেই কামটা করছিলি রাতের বেলা সেটা আজকে সন্ধ্যায় করতে হইব।
গম্ভীর গলায় বলল আলতাফ সাহেব। লিডার ছেলেটা বুদ্ধিমান খুলে বলার প্রয়োজন নেই তাকে।
– কিন্তু ভাই….. এখন তো সবার হাতে হাতে মোবাইল
– ওইটা নিয়া তোরে ভাবতে হইব না, উপর থেকে সব সেট করা থাকব।
– জ্বি ভাই! ভাই আরেকটা কথা….!
– কি টাকা!
– না ভাই… কিযে বলেন ওইটা নিয়া আপনারে কিছু কওয়ার নাই ওইটা তো আপনি বোঝেনই..!
– তাহলে কি, কয়া ফেলা!
বিরক্তি ঝড়ে পরল আলতাফ সাহেবের কন্ঠে।
– ভাই আমাগো ঝিগাতলার মোড়ে তো অনেক মাইয়া, এটিরে কেমনে কি……?
– “হুমমমম”! কথার গুরুত্বটা ধরতে পেরেছেন আলতাফ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, দুই চারজনরে
এমন ভয়ঙ্কর কিছু করবি যাতে বাকিটিও সোজা হয়ে যায়।
– ভাই! তাইলে কি ধ………।
পুরোটা কথা শেষ করতে পারলনা লিডার ছেলেটা। হাত উচিয়ে আলতাফ সাহেব থামিয়ে দিলেন ওকে
– হো আর কইতে হইবনা, যা বুঝছস তাই। আর শোন! বেশি কইরা পোলাপাইন নিছ!
– আচ্ছা!
– ওই জায়গায় কিছু স্কুল ড্রেস আছে নিয়া বাইর হয়া যা। আর কাম শেষ করার আগে পরে আমারে
আর কল দিবি না। একবারে কাম শেষ কইরা এহেনে আবি, যাহ…!
– আসসালামু আলাইকুম ভাই!
সালাম দিয়ে ছেলেরা বের হয়ে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে একটু আগে মাগরিবের আযান শুনেছিল
আলতাফ সাহেব। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল সে। জোরে
একটা টান দিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিল সিগারেটের কালো ধোঁয়া। ওদিকে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই
সিগারেট টানা চলতে থাকবে আলতাফ সাহেবের। অনেক কাজ করিয়েছেন ওদের দিয়ে। তিনি নিজেও
ছাত্র বয়স থেকে অনেক বড় বড় কাজ করেছেন। যার জন্যই এমপি মন্ত্রীদের কাছে তার কদর
বেড়েছে। কিন্তু এবারের কাজটা একেবারে আলাদা। ধরতে গেলে ছোট ছেলে পেলেদের নিয়ে কাজ।
আগে কখনো এমন কাজ করতে হয়নি। এই কাজটায় আলতাফ সাহেবের নিজেরও তেমন একটা
মত নেই, কিন্তু উপরের নির্দেশে করতে হচ্ছে। প্রথম সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে
দাড়াল সে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে কিছু নৃশংস দৃশ্য। হঠাত করেই তার একমাত্র মেয়ে
রিমির কথা মনে পড়ল। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা নিয়ে কল দিল বাসায়। কয়েকবার রিং
হতেই রিসিভ করল আলতাফ সাহেবের স্ত্রী। আলতাফ সাহেব নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, রিমি
কোথায়?
– ও তো বান্ধবীদের সাথে আন্দোলনে বেরিয়েছে।
একটু ইতস্তত করে বলল রিমির মা।
– কি বললে তুমি? প্রশ্নটা আর্তনাদের মত শোনা গেল আলতাফ সাহেবের কন্ঠ থেকে। তিনি বুঝতে
পারছেন এবার তার জন্য কিছু অশুভ সংবাদ অপেক্ষা করছে।
আমার লেখা
বিভূতিভূষণ
আমি কেমন করে লেখক হলাম, এ আমার জীবনের, আমার নিজের কাছেই, অদ্ভুত ঘটনা। অবশ্য
হয়তো একথা ঠিক,নিজের জীবনের অতি তুচচ্ছতম অভিজ্ঞতাও নিজের কাছে অতি অপূর্ব। তা যদি
না হত, লেখক জাতটাই সৃষ্টি হত না। নিজের অভিজ্ঞতাতে এরা মুগ্ধ হয়ে যায়। আকাশ প্রতিদিনের
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে কত কল্পনাকে রচনা করছে যুগে যুগে- তারই তারই তলে কত শত শতাব্দী ধরে
মানুষ নানা তুচ্ছ ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজের দিন কাটিয়ে চলেছে; মানুষের জন্ম- মৃত্যু আশা – নৈরাশ্য
হর্ষ-বিবাদ ঋতুর পরিবর্তন, বনপু®েপর আবির্ভাব ও তিরোভাব – কত ছোট বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে
পৃথিবীতে – কে এসব দেখে,এসব দেখে মুগ্ধ হয়?
এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাদের চোখে কল্পনা সব সময়েই মোহঅঞ্জন মাখিয়ে দিয়ে রেখেছে। অতি
সাধারণ পাখীর অতি সুরও তাদের মনে আনন্দের ঢেউ তোলে, অস্তদিগন্তের রক্তমেঘস্তুপ স্বপ্ন জাগায়,
আবার হয়ত তারা অতি দুঃখে ভেঙে পড়ে।এরাই হয় লেখক,কবি,সাহিত্যিক। এরা জীবনের
সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক। এক যুগের দুঃখবেদনা আশা আনন্দ অন্য যুগে পৌঁছে দিয়ে যায়।
আমার জীবনের সেই অভিজ্ঞতা তাই চিরদিনই আমার কাছে অভিনব,অমূল্য,দূর্লভ হয়ে রইল। যে
ঘটনা আমার জীবনের স্রোতকে স¤পূর্ণ অন্য দিকে বাঁক ফিরিয়ে দিয়েছে- আমার জীবনে তার মূল্য
অনেকখানি।
১৯২২ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধী নিয়ে ডায়মন্ডহারবার লাইনে একটা পল্লী গ্রামের হাইস্কুলে
মাস্টারি চাকুরি নিয়ে গেলুম আষাঢ় মাসে। বর্ষাকাল,নতুন জায়গায় গিয়েছি। অপরিচিতের মহলে
নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বোধ করছি। বৈঠকখানা ঘরের সামনে ছোট্ট একটু ঢাকা বারান্দাতে একলা
বসে সামনে সদর রাস্তার দিকে চেয়ে আছি,এমন একটি সময় ষোল-সতের বছর বয়সের ছেলেকে
একখানা বই হাতে যেতে দেখে তাকে ডাকলাম কাছে। আমার উদ্দেশ্য, তার হাতে কি বই দেখব এবং
যদি সম্ভব হয় পড়বার জন্যে চেয়ে নিব একদিনের জন্য। বইখানা দেখেছিলাম, একখানা উপন্যাস।
তার কাছে চাইতে সে বললে,এ লাইব্রেরির বই, আজ ফেরত দেওয়ার দিন। আপনাকে তো দিতে
পারছি নে,তবে লাইব্রেরি থেকে বই বদলে এনে দেব এখন।
– লাইব্রেরি আছে এখানে?
– বেশ ভাল লাইব্রেরি,অনেক বই। দু আনা চাঁদা।
– আচ্ছা চাঁদা দেব,আমায় বই এনে দিও।
ছোকরা চলে গেল এবং ফেরবার পথে আমাকে একখানা বই দিয়েও গেল। আমি তাকে বললম-
তোমার নামটি কি হে?
সে বললে- আমার নাম পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী, কিন্তু এ গ্রামে আমাকে সবাই বালক কবি বলে জানে।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম- বালক কবি বলে কেন? কবিতা টবিতা লেখ না কি?
ছেলেটির উৎসাহের সঙ্গে বললে- লিখি বই কি। না লিখলে কি আমাকে বালক কবি নাম দিয়েছে?
আচ্ছা কাল এনে দেখাব আপনাকে।
পরদিন সে সকাল বেলাতেই এসে হাজির হল। সঙ্গে একখানা ছাপানো গ্রাম্য মাসিক পত্রিকা গোছের।
আমাকে দেখিয়ে বললে- এই দেখুন, এই কাগজখানা আমাদের গাঁ থেকে বেরোয়। এর নাম ‘ বিশ্ব’।
এই দেখুন প্রথমেই ‘ মানুষ’ বলে কবিতাটি আমার। এই আমার নাম ছাপার অক্ষরে লেখা আছে
কবিতার উপরে- বলেই ছোকরা সগর্বে কাগজখানা আমার নাকের কাছে ধরে নিজের নামটি আঙুল
দিয়ে দেখিয়ে দিলে। হ্যাঁ সত্যিই লেখা আছে বটে, কবি পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী। তাহলে তো নিতান্ত
মিথ্যা বলেনি দেখছি। কবিতাটি সেই আমাকে পড়ে শোনালে। বিশ্বের মধ্যে মানুষের স্থান খুব বড়,
ইত্যাদি কথা নানা ছাঁদে তার মধ্যে বলা হয়েছে।
অবশ্য কাগজখানা দেখে আমার খুব ভক্তি হল না। স্টেশনের কাছে একটা ছোট প্রেস আছে এখানে,
সেই প্রেসেই ছাপানো অতি পাতলা জিল-জিলে কাগজ। পত্রিকাখানিকে ‘ মাসিক’ পাক্ষিক’ ইত্যাদি না
বলে ‘ ঐকিক’ বললেই এর স্বরূপ ঠিক বোঝানো হয়। অর্থাৎ যে শ্রেণীর পত্রিকা গ্রামের উৎসাহী লেখা
বাতিকগ্রস্ত ছেলে – ছোকরার দল চাঁদা তুলে একটি বার মাত্র বের করে, কিন্তু পরের বারে উৎসাহ
মন্দীভূত হওয়ার দরুন আশানুরূপ চাঁদা না ওঠাতে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়, এ সেই শ্রেণীর পত্রিকা।
তবুও আমার ঈর্ষা না হয় পারল না।আমি লিখি না বা লেখার কথা কখনও চিন্তাও করি না। অথচ
এতটুকু ছেলে – এর নাম দিব্যি ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে গেল। এর উপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হল, মনে
ভাবলাম, বেশ ছোকরা তে! অক্ষর মিলিয়ে মিলিয়ে কেমন কবিতা লিখেছে। সাহিত্যের সমঝদারি
তার মধ্যে ছিল তা আমি জানি। তখনকার আমলের একজন বিশেষ লেখকের বই না থাকলে
পল্লীগ্রামের কোন লাইব্রেরি চলত না। সেই লেখকের এক একখানা বই- এর তিন চার কপি পর্যন্ত
রাখতে হত কোন কোন বড় লাইব্রেরিতে।
ছেলেটি বলত- ওসব ট্রাশ- ট্রাশ! দেখবেন ওসব ঠিকবে না।
এক একদিন পাঁচুগোপাল আমাকে নিয়ে গ্রামের মাঠে বেড়াতে যেত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চোখও তার
বেশ ছিল। মাঝে মাঝে মুখে মুখে কবিতা তৈরি করে আমাকে শোনাত। অনেকগুলো কবিতা হলে পর
একটা কবিতার বই ছাপাবে এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করত। সেই সময় কলকাতার কোনও ‘ পাবলিশিং
হাউস’ ছয় আনা গ্রন্থাবলী প্রকাশ শুরু করে দিল। তার প্রথম বই লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের
বইখানি স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে পাঁচুগোপাল আমায় এনে দিয়ে বললে- এ বই নিতে ভিড় নেই। নতুন
এসেছে, এক- আধজন নিয়েছিল, কাল ফেরত দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু দেখুন গে যান অমুকের বই- এর
জন্য কি যে মারামারি। ডিটেকটিভ উপন্যাস না রাখলে লাইব্রেরি উঠে যাবে। কেউ চাঁদা দিবে না।
পরের মাসে আর একখানি বই বেরুল। সেখানা আমার কাছে নিয়ে এসে সে বললে- “আমি একটা
কথা ভাবছি, আসুন আপনাতে আমাতে এই রকম উপন্যাস সিরিজ বের করা যাক। খুব বিক্রি হবে,
আর একটা নামও থেকে যাবে। আপনি যদি ভরসা দেন,আমি উঠে পড়ে লাগি” আমি বিস্ময়ের সুরে
বললাম- “তুমি আর আমি মিলে বই – এর কারবার করব, এ কখনও সম্ভব? এ ব্যবসার আমরা
কিই বা জানি? তা ছাড়া বই লিখবেই বা কে? এতে লেখকদের পারিশ্রমিক দিতে হবে,সে পয়সায় বা
দেবে কে?”
সে হেসে বললে- বাঃ তা কেন, বই লিখবেন আপনি,আমিও দু একখানা লিখব। পরকে টাকা দিতে
যাব কেন?”
বাংলাসাহিত্যকে ভালোবাসতাম বটে,কিন্তু নিজে কলম ধরে বই লিখব এ ছিল স¤পূর্ণ দুরাশা আমার
কাছে।অবিশ্যি পাঠ্যবস্থায় অন্য অনেক ছাত্রের মত কলেজ ম্যাগাজিনে দু-একটা প্রবন্ধ, এক- আধটা
কবিতা না লিখেছি তা নয়, প্রতিবেশীর অনুরোধে বিবাহের প্রীতি উপহারে কবিতা য়ে দু- পাঁচটা না
লিখেছিলাম তাও নয়- কিন্তু সে কে না লিখে থাকে?
সুতরাং আমি তাকে বললাম- “লেখা কি ছেলেখেলা হে যে, কলম নিয়ে বসলেই হল?ওসব খামখেয়ালি
ছাড়। আমি কখনও লিখিনি,লিখতে পারবও না। তুমি হয়ত পারবে- আমার দ্বারা ওসব হবে না।”
সে বললে- “খুব হবে। আপনি যখন বি-এ পাস, তখন আপনার কাছে এমন কিছু কঠিন হবে না।
একটু চেষ্টা করুন তাহলেই হয়ে যাবে।” তখন বয়স অল্প,বুদ্ধি সুদ্ধি পাকে নি,তবুও আমার মনে হল,
বি-এ পাস তো অনেকেই করে,তাদের মধ্যে সকলেই লেখক হয় না কেন? অথচ বি-এ পাস করা
লোকদের ওপর পাঁচুগোপালের এই অহেতুক শ্রদ্ধা ভেঙে দিতেও মন চাইল না। এ নিয়ে কোন তর্কও
আমি আর তার সঙ্গে করি নি।কিন্তু করলেই ভাল হত, কারণ এর ফল হয়ে দাঁড়াল বিপরীত। দিন
দশেক পরে একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি সেখানে নোটিশ বোর্ডে, দেওয়ালের গায়ে, নারকেল গাছের
গুড়িতে সর্বত্র ছাপানো কাগজ টাঙানো- তাতে লেখা আছে,- বাহির হইল। বাহির হইল!! বাহির
হইল!! বাহির হইল!!! এক টাকা মূল্যের গ্রন্থমালা প্রথম উপন্যাস। লেখকের নামের স্থানে আমার
নাম দেখলাম।
আমার তো চক্ষুস্থির। এ নিশ্চয় সেই পাঁচুগোপালের কীর্তি। এমন ছেলেমানুষি সে বসে বসবে জানলে
কি তার সঙ্গে মিশি! বিপদের উপর বিপদ, স্কুলে ঢুকতেই শিক্ষক ছাত্রবৃন্দ সবাই জিজ্ঞেস
করে-“আপনি লেখক তা তো এতদিন জানতাম না মশাই? বেশ বেশ! তা বইখানা কি বেরিয়েছে না
কি? আমাদের একবার দেখিয়ে যাবেন।” হেডমাস্টার ডেকে বললেন,তাঁর স্কুল লাইব্রেরিতে একখানা
বই দিতে হবে। সকলের নানারূপ সকৌতূহলে প্রশ্ন এড়িয়ে চলি সারাদিন-কবে থেকে আমি লিখছি,
আর আর কি বই আছে, ইত্যাদি। স্কুলের ছুটির পরে বাইরে এসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। এমন বিপদেও
মানুষ পড়ে!
তাকে খুঁজে বের করলাম বাসায় এসে। দস্তুরমত তিরস্কার করলাম তাকে, এ তার কি কাণ্ড! কথার
কথা একবার একটা হয়েছিল বলে একেবারে নাম ছাপিয়ে এরকমভাবে বার করে, লোকে কি ভাবে!
সে নির্বাক হয়ে দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বললে-” তাতে কি হয়েছে? আপনি তো একবরকম
রাজিই হয়েছেন লিখতে। লিখুন না কেন!” আমি বললাম-“বেশ ছেলে বটে তুমি! কোথায় কি তার
ঠিক নেই,তুমি নাম ছাপিয়ে দিলে কি বলে আর দিলি দিলে একেবারে স্কুলের দেওয়ালে,নোটিশ বোর্ডে
সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছ, এ কেমন কাণ্ড? নামই বা পেলে কোথায়? কে তোমাকে বলেছিল ও নামে আমি
কিছু লিখেছি বা লিখব?”
যাক – পাঁচুগোপাল তো চলে গেল হাসতে হাসতে। এদিকে প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে সকলের প্রশ্নে অতিষ্ঠ
হয়ে উঠতে হল- বই বেরুচ্ছে কবে? কত দেরি আছে আর বই বেরুবার? মহামুশকিলে পড়ে গেলাম।
সে যা ছেলেমানুষি করে ফেলেছে তার আর চারা নেই। আমি এখন নিজের মান বজায় রাখি কেমন
করে? লোকের অত্যাচার চোটে তো অস্থির হয়ে পড়তে হয়েছে।
সাতপাঁচ ভেবে একদিন স্থির করলাম – এক কাজ করা যাক। সে এক টাকা সিরিজের বই কোনদিনই
বের করতে পারবে না। ওর টাকা কোথায় যে বই ছাপাবে? বরং আমি একখানা খাতায় যা কিছু লিখে
রাখি- লেকে যদি চায় খাতাখানা দেখিয়ে বলা যাবে, আমার তো লেখাই রয়েছে, ছাপা না হলে আমি
কি করব। কিন্তু লিখি কি? জীবনে কখনও গল্প লিখি নি, কি করে লিখতে হয় তাও জানা নেই। কি
ভাবে প্লট যোগাড় করে, কি কৌশলে তা থেকে গল্প ফাঁদে- কে বলে দেবে? লটই পাই কোথায়?
আকাশ-পাতাল ভাবি প্রতিদিন, কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি নে। গল্প লেখার চেষ্টা কোনদিন করি
নি। পাঠ্যবস্থায় সুরেন বাঁড়–জ্যে ও বিপিন পালের বক্তৃতা শুনে সাধ হত, লেখক হতে পারি আর না
পারি, একজন বড় বক্তা হতে হবেই।
কিন্তু লেখক হবার কোন আগ্রই কোনদিন ছিল না, সে চেষ্টাও করি নি। কাজেই প্রথমে মুশকিলে পড়ে
গেলাম। সাতপাঁচ ভেবে প্লট সংগ্রহ আর করতে পারি না কিছুতেই। মন তখন বিশ্লেষমুখী অভিব্যক্তির
পথ খুঁজে পায় নি। সব কিছুতেই সন্দেহ, সব কিছুতেই ভয়।
অবশেষে একদিন এক ঘটনা থেকে মনে একটা ছোট গল্পের উপাদান দানা বাঁধল। সে পল্লীগ্রামের
একটি ছায়াবহুল নিভৃত পথ দিয়ে শরতের পরিপূর্ণ আলো ও অজস্র বিহঙ্গকাকলীর মধ্যে প্রতিদিন
স্কুলে যাই, আর একটি গ্রাম্য বধূকে দেখি পথিপার্শ্বের একটি পুকুর থেকে জল নিয়ে কলসি কক্ষে
প্রতিদিন øান করে ফেরেন। প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়- কিন্তু দেখা ওই পর্যন্ত। তাঁর পরিচয়
আমার অজ্ঞাত এবং বোধ হয় অজ্ঞাত বলেই একটি রহস্যময়ী মূর্তিতে তিনি আমার মানসপটে একটা
সাময়িক রেখা অঙ্কিত করেছিলেন। মনে মনে ভাবলাম এই প্রতিদিনের দেখা অথচ স¤পূর্ণ অপরিচিত
বধূটিকে কেন্দ্র করে একটি গল্প আরম্ভ করা যাক তো, কি হয় দেখি! গল্প শেষ করে সেই গ্রামের
দু-এক জনকে পড়ে শোনালাম-পাঁচুকেও। কেউ বলে ভাল হয়েছে, কেউ বললে মন্দ হয় নি। আমার
এক বন্ধুকে কলকাতা থেকে নিমন্ত্রণ করে গল্পটি শুনিয়ে দিলাম। সেও বললে ভাল হয়েছে। আমি
তখন একেবারে কাঁচা লেখক; নিজের ক্ষমতার ওপর কোন বিশ্বাস আদৌ জন্মায় নি। যে আÍপ্রত্যয়
লেখকের একটি বড় পুঁজি, আমি তখন তা থেকে বহু দূরে, সুতরাং অপরের মতামতের ওপর
নির্ভরশীল না হয়ে উপায় কি। আমার কলকাতার বন্ধুটির সমঝদারিত্বের ওপড় আমার শ্রদ্ধা ছিল-
তার মত শুনে খুশি হলাম।
পাড়াগাঁয়ে স্কুলমাস্টারি করি কলকাতার কোন সাহিত্যিক বা পত্রিকা -স¤পাদককেই চিনি না- সুতরাং
লেখা ছাপানো সম্বন্ধে আমার একপ্রকার হতাশ হতে হল। এইভাবে পূজোর অবকাশ এসে গেল,
ছুটিতে দেশে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে এলাম। পুনরায় ফিরে এসে কাগজপত্রের মধ্যে থেকে আমার সেই
লেখাটি একদিন বার করে ভাবলাম, আজ এটি কলকাতা নিয়ে গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখা যাক।
ঘুরতে ঘুরতে একটা পত্রিকা আপিসের সামনে এসে পঠা গেল। আমার মত অজ্ঞাত অখ্যাত নতুন
লেখকের রচনা তারা ছাপাবে এ দুরাশা আমার ছিল না, তবুও সাহস করে গিয়ে ঢুকে পড়লাম। দেখা
যাক না কি হয়, কেউ খেয়ে তো ফেলবে না, না হয় লেখা না-ই ছাপবে। ঘরে ঢুকেই একটি ছোট
টেবিলের সামনে যাঁকে কর্মরত দেখলাম, তাঁকে নমস্কার করে ভয়ে ভয়ে বলি-“একটা লেখা
এনেছিলাম-“; ভদ্রলোক মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,”আর কোথাও আপনার লেখা বেরিয়েছি? আচ্ছা
রেখে যান, মনোনীত না হলে ফেরত যাবে। ঠিকানাটা রেখে যাবেন।
লেখা দিয়ে এসে স্কুলের সহকর্মী ও গ্রামের আলাপী বন্ধুদের বলি- “লেখাটা নিয়ে বলেছে শীগগির
ছাপবে” চুপি চুপি ডাকঘরে গিয়ে বলে এলাম, আমার নামে যদি বুকপোস্ট গোছের কিছু আসে, তবে
আমাকে স্কুলে বিলি যেন না করা হয়। কারণ লেখা ফেরত এসেছে এটা তাহলে জানাজানি হয়ে যাবে
সহকর্মী ও ছাত্রদের মধ্যে। দিন গুনি, একদিন সত্যিই ডাকপিওন স্কুলে আমায় বললে- আপনার নামে
একটা বুকপোস্ট এসেছে, কিন্তু গিয়ে নিয়ে আসবেন। আমার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। নবজাত রচনার
প্রতি অপরিসীম দরদ যাঁরা অনুভব করেছেন তাঁরা বুঝবেন আমার দুঃখ। এতদিনের আকাশকুসুম
চয়ন তবে ব্যর্থ হল, লেখা ফেরত দিয়েছে।
কিন্তু পরদিন ডাকঘর থেকে বুকপোস্ট নিয়ে দেখি যে, আমার রচনা বটে, কিন্তু তার সঙ্গে সহকারী
স¤পাদকের একটি চিঠি। তাতে লেখা আছে, রচনাটি তাঁরা মনোনীত করেছেন, তবে সামান্য একটু –
আধটু অদল-বদলের জন্য ফেরত পাঠানো হল,সেটুকু করে আমি যেন লেখাটি তাঁদের ফেরত পাঠাই,
সামনের মাসে ওটা ছাপা হবে।
অপূর্ব আনন্দ আর দিগ¦জয়ীর গর্ব নিয়ে ডাকঘর থেকে ফিরি। সগর্বে নিয়ে গিয়ে চিঠিখানা দেখাতেই
সবাই বললেন-“কার সঙ্গে আপনার আলাপ আছে বুঝি ওখানে? আজকাল আলাপ না থাকলে কিছু
হবার জো-টি নেই। সব খোশামোদ, জানেনই তো।” তাঁদের আমি কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না,
যাঁর হাতে লেখা দিয়ে এসেছিলাম, তাঁর নাম পর্যন্ত আমার জানা নেই! তার পর সে গ্রামের এমন
কোনও লোক রইল না, যে আমার চিঠিখানা একবার দেখলে। কারও সঙ্গে দেখা হলে পথে তাকে
আটকাই এবং স¤পূর্ণ অকারণে চিঠিখানা আমার পকেট থেকে বেরিয়ে আসে এবং বিপন্ন মুখে তাকে
বলি- তাই তো,ওরা আবার একখানা চিঠি দিয়েছে, একটা লেখা চায়- সময়ই বা তেমন কই! হায়!
সে সব লেখকজীবনের প্রথম দিনগুলি। সে আনন্দ, সে উৎসাহ, ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার
বিস্ময় আজও স্মরণে আছে, ভুলি নি। নিজেকে প্রকাশ করার মধ্যে যে গৌরব এবং আÍপ্রসাদ
নিহিত,লেখকজীবনের বড় পুরস্কার সবচেয়ে তাই-ই। স্বচ্ছ সরল ভাবানুভূতির যে বাণীরূপ কবি ও
কথাশিল্পী তাঁর রচনার মধ্যে দিয়ে যান -তা সার্থক হয় তখনই,যখন পাঠক সেই ভাব নিজের মধ্যে
অনুভব করেন। এইজন্য লেখক ও পাঠকের সহানুভূতি ভিন্ন কখনও কোন রচনাই সার্থকতা লাভ
করতে পারে না।
বালক কবির নিকট আমি কৃতজ্ঞ। সে-ই একরকম জোর করে আমাকে সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে
নামিয়েছিল। পাঁচুগোপালের সঙ্গে মাঝে দেখা হয়েছিল। সে এখন চব্বিশ পরগণার কাছি কিএকটা
গ্রামের উচ্চ প্রাথমিক পাঠশালায় হেডমাস্টার। একনও সে কবিতা লেখে।
জুন ১৯৪৪- বেতারে পঠিত
বিভূতিভূষণ গল্পসমগ্র ১ম খন্ড থেকে সংগৃহীত
বি:দ্র: লেখকের বানানরীতি ও ভাষারীতি বহাল রাখা হয়েছে।