এক.
ভাবতে ভাবতে স্কুলের ভেতর ঢুকে পড়ি। গেটের ওপাশে পা রাখতেই আবারো নড়ে উঠে বিষণœ মায়ের চেহারা। নাহ, আজ স্কুল করব না। শক্তমনে বাড়ি ফিরলাম। আম্মুকে জিজ্ঞেস করবোÑ কেন তাঁর সাথে এমন হচ্ছে। উঠোনে পা রাখতেই দেখি আম্মু লাকড়ি করছেন। বড় এ পরিবারের ঘরোয়া সব কাজ তিনি একাই করেন। নারী হয়ে কঠিন পুরুষের কাজÑ লাকড়ি করছেন তিনি। মুন্নির ভাইয়া ডাক শুনে আম্মু সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে এমন ভঙ্গি করলেন যেন এতসব লাকড়ি তিনি করেননি। মজদুর করে গেছে আর তিনি শুধু নেড়েচেড়ে দেখছেন ঠিকমতো কাজ করেছে কি-না। যদিও আম্মুর অনিচ্ছায় শরীর থেকে মাটিতে ঝরঝরে গড়িয়ে পড়া ঘামের ফোঁটাগুলো মূল রহস্যটা প্রকাশ করে দিচ্ছে খুব ভালো করেই। তবুও আম্মু আমার থেকে ওসব লুকোবার চেষ্টা করছেন। ভাবলাম আমি তো আর ইয়া বড় না যে, চাচা-চাচীর সাথে ঝগড়ায় জড়াব। কঠিন এ প্রশ্নের সাথে আবেগতরঙ্গ উতলে উঠছে হৃদপিÐে, তবুও কেন আম্মু আমার থেকে ওসব লুকোচ্ছেন? ‘কিরে স্কুলে যাসনি?’ ‘না, আজ ভাল্লাগছে না। মাথায় কেমন চিনচিন ব্যথা করছে।’ আম্মুর উত্তর দিতে দিতে ঘরে ঢুকে পড়ি। স্কুলব্যাগটা খাটের কোণে রেখে গা এলিয়ে দিই বিছানার ওপর। দাদু তাঁর রুমে জালিসের সাথে গল্প করছেন। জালিস আমার চাচাতো ভাই। চাচা-চাচী দু’জন এখনো বেহেশতি ঘুমে বিভোর। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। গরমের মৌসুম হলেও আজ হালকা ঠাÐা পড়েছে। চাচাদের রুমে ফ্যান চলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অপচয়ের কথা ভেবে ফ্যানটা বন্ধ করতে তাদের রুমে যাই। কিন্তু দুজনের গায়ে কমল মোড়ানো দেখে বন্ধ করার সাহস পেলাম না। চুপে চুপে চলে এলাম।
দুই.
ঘড়ির কাটা চারটার কোঠায়। আম্মু গোসল করতে কাপড় হাতে নিচ্ছেন। ‘কি গো মাহবুবের বউ? প্রাতস্নান করাও কি তোমার ধর্মকাজ? রান্নাবান্না করেই না হয় তা করো।’ দাদুর কথা শুনে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। খাট থেকে উঠে দাঁড়াইÑ দাদুকে আজ ভালো করে…। কিন্তু দাদুর প্রতি আম্মুর স্বাভাবিক উত্তরÑ ‘না আম্মা, নামাজের ওয়াক্ত চলে যাবে। গোসল সেরে আগে নামাজটা পড়ে নিই। তারপর রান্না বসাব।’ আম্মুর কথা শেষ হতে না হতেই পাশের রুম থেকে চাচী বলে ওঠেন, ‘হায়! ধর্মের কথা বলে কর্মে ফাঁকিবাজি। মানুষ কত যে নাটক জানে!’ আমি আবারো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। ব্যাঘ্র হয়ে উঠলাম চাচীর প্রতি। কিছু বলতে যাব অমনি স্মরণ হলো, দশ তারিখ আব্বু দেশে ফিরছেন। আব্বুর কথা মনে পড়তেই ভেতরটা অন্যরকম হয়ে যায়। ঠাÐা মাথায় খাটের ওপর বসে পড়লাম। মনে মনে ভাবলামÑ আব্বু দেশে ফিরলে…। পরক্ষণেই মনে হলো, ওসব পাশবিকতার সাক্ষী হবে কে? দাদু আর চাচীরা তো সকাল-বিকাল আব্বুর কাছে আম্মুকে কালনাগিণী হিসেবেই উপস্থাপন করছেন!
তিন.
‘এই রাফি, নাও কথা বলো!’ চাচীর কণ্ঠে মাতৃসুলভ ডাক। আব্বু কল করলে তিনি ওভাবেই ডাকেন আমাকে। গলার স্বরটা তখন ¯েœহকাতর হয়ে যায়। যেন আমি তাঁর একমাত্র পুত্রধন। আব্বুর সাথে কথা বলার আমার একটা রোডম্যাপ আছে। সীমানার বাইরে কোনো শব্দ হলে চাচীদের থেকে আম্মুকে শুনতে হয় অকথ্য ভাষায় কল্পনাতীত বাজে কথা। তাই খুব মেপে মেপে কথা বলি। আব্বু আমাকে কোনোদিন বলেন নিÑ রাফি, তোমার খাওয়া-দাওয়া আর পোশাক-আশাক সব ঠিক আছে তো? বলার কারণ আছে বলেও আমি মনে করি না। কারণ, চাচীদের তরফ হতে আব্বুর কাছে প্রতিদিনই আমার নায়করূপ জীবনকাহিনি বর্ণনা করা হচ্ছে। সালামের উত্তর দিয়েই আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার জন্যে কী আনব রাফি?’ সহসা এমন প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। প্রয়োজনের সবকিছুই ম্যাপের বাইরে। যদি বলি ‘একটা স্কুলব্যাগ এনো আব্বু!’ তাহলে মহা গÐগোল বেঁধে যাবে নিশ্চয়। কারণ, আব্বু জানেন, আমার তিনটে স্কুলব্যাগ আছে। তা ছাড়া চাচীও আমার সামনে বসা। ‘না আব্বু, কিছু লাগবে না।’ হাসিমুখেই আব্বুর কথার উত্তর দিলাম। এবার দাদুর পালা। দাদু সবার শেষে কথা বলেন। নিয়মটা দাদুরই বেঁধে দেয়া। জানি না কেন এই অদ্ভুত নিয়ম। তবে যেটুকু বুঝিÑ সবার কথার কাটছাঁট আর বানানো গল্পের ম্যানশন করতেই হয়ত এ নিয়ম। মা হয়েও তিনি সবার শেষে কথা বলতে খুব স্বস্তিবোধ করেন। রাজ্যজয়ের আনন্দ পান। দাদুর ইদানীংয়ের গল্পগুলোর থিম খুবই চমৎকার। আব্বুর দেশে ফেরা ঠেকাতে চাচা-চাচীর সাথে তিনিও মরিয়া হয়ে উঠেছেন। মায়ের অসুখ। তার শরীরটাও খুব খারাপ। দিনে তিন-চার বার বমি হয়। দাদু কাঁদো কাঁদো স্বরে আব্বুর কাছে নিজেকে মরণকোলের রোগী হিসেবে পেশ করছেন। আমি নীরবে সব শুনে যাচ্ছি। সবচে হাস্যকর যে থিম সেটা হচ্ছে—Ñ চাচাতো বোন রুমানার বিয়ে। রুমানা নাকি খুব বড় হয়ে গেছে। দু’এক বছরের ভেতর তাকে বিয়ে না দিলে পরে কেউ তাকে…। রুমানা তখন ঘুমোচ্ছিল। আমি হাসতে হাসতে তাকে জাগিয়ে তুললাম। ততক্ষণে দাদুর গল্প বলা শেষ। ও আমার কথা বিশ্বাস করছে না। মৃদু শাসনের সাথে শরম পেয়ে ঝাল দেখিয়ে চলে যায়। বারো বছরের রুমানাকে দাদু আস্ত একটা ডাঙ্গর মাইয়া সাজালেন। সেদিন আমি হাসতে হাসতে খুব কেঁদেছি। এখনো মনে হলে খুব হাসি।
সেদিন ক্লাসে সহসা কথাগুলা কানে ভাসতেই নিজের অজান্তে খুব জোরে জোরে হাসতে শুরু করি। রুমানা আমার পাশের সিটেই বসে। ও আমাকে ধাক্কা মেরে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দেয়। আমি শেষ চেষ্টা করেও হাসি থামাতে পারিনি। স্যার আমাকে কাছে ডাকেন। লজ্জায় সত্য কথাটা বলিনি। হুটহাট চমকপ্রদ একটা থিম মাথায় আসে। দৈবক্রমে মাথায় চলে আসা ওই থিমটা শুনিয়ে সেদিনের মতো স্যারের থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম।
চার.
অবশেষে খোদায়ি ফায়সালায় আব্বু দেশে ফিরলেন। হার্টে সমস্যা থাকায় নিজের অনিচ্ছাতেই আব্বুকে বাড়ি ফিরতে হয়। জন্মের পর এই প্রথম আব্বুকে কাছ থেকে দেখা। দেশে ফিরে ঘর-বাড়ি আর আম্মুর মরা সুপারিগাছ মার্কা দেহ দেখে আব্বু হতচকিত হয়ে যান। কথায় আছে নাÑ ‘রাগব বোয়াল বড়শিতে লাগে না আর মুখবাজ কোথাও আটকে না।’ মিথ্যে বলে বলে আব্বুর ঘামঝরানো টাকার ক্যালকোলেটারিং হিসাব দিয়ে যাচ্ছেন চাচা। সমর্থনে পাশে আছেন দাদু আর চাচীও। সরলমনা আব্বু কৌতূহলী হয়ে সব শুনে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে সমবেদনা প্রকাশেও কার্পণ্য করছেন না। আমি মুসল্লিয়ানা নীরবতা পলন করে শুনে যাচ্ছি। জগতে সরল বলে যদি কেউ থাকেন তা হলে তিনি হবেন আমার আব্বু। কিন্তু অসম আর অন্যায় কিছু ধরতে পারলে দুনিয়ার গরল হয়ে যান। মিথ্যে গল্পের একপর্যায়ে চলে আসে আম্মুর প্রসঙ্গ। দাদুর প্রথম কথাতেই আমি প্রতিবাদী হয়ে ওঠি। কান্নামেশানো সুরে আব্বুকে সব পরিষ্কার করে বলতে লাগলাম। আম্মু তখন হু হু করে কেঁদে চলে যান তাঁর রুমে। চাচা আমাকে ধমকাচ্ছেন। সহসা পৃথিবীকে অবাক করে দিলেন চাচী। আমাকে উপরি (জিন) ধরা বলে আবিষ্কার করে ফেললেন মুহূর্তেই। সাথে সায় দিলেন দাদু আর চাচা। আব্বু বিশ্বাস করে বলে উঠলেন, ‘ওরে এতদিন কবিরাজ দেখাওনি কেন?!’ দাদু দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কত জায়গায় নিয়ে গেছি রে বাবা! কোনো কাজ হয়নি। দুদিন ভালো থাকে তো আবার এসে ভর করে।’ তখন পৃথিবী অবাক হলেও আমি মোটেও অবাক হইনি। কারণ, আমি তাঁদের সুখাসলত জানি। আম্মুর স্টিল থেকে খালাতো বোন শাকিলার দেয়া রেকর্ডারটি বের করে আনলাম। প্রায় মাসখানেক ধরে ওটা চাচাদের খাটের নিচে খুব গোপনে সেট করা ছিল। চাচাদের লোভনীয় সব ভাবনা, স্বপ্ন আর কল্পনা এবং আম্মুকে মৌখিক পেষণের বাক-বাচন সবই বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো রেকর্ডার ধারণ করেছে। রেকর্ডারটি অন করতেই চাচা-চাচীর খোশগল্প শুরু করে সেÑ ‘ধুর পাগলী! না আসে দেশে। এখন আলাদা হলেও সমস্যা নাই। শহরের ফ্ল্যাটটা তো জালিসের নামেই। তা ছাড়া…।
প্রথম রেকর্ডটা শুনেই আব্বু মাটিতে ঢলে পড়েন।
নবধ্বনি, মার্চ ২০১৮