ঘুণপোকা খেয়ে ফেলা আধো ভাঙা একটি টেবিলের ওপর হলুদ রঙের একটি খাতা দেখা যাচ্ছে। এর পাশে অযতেœ পড়ে আছে আরও কিছু বইপত্তর। কিছুটা অন্যমনস্কতা নিয়ে কৌত‚হলহীন খাতাটা কাছে টেনে আনলাম। ওল্টানোর ভঙ্গিতে যখনই হাত বাড়ালাম এর দিকে; আহসান জাইফ কিছুটা বারণের ত্রস্ততা নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসলেনÑ‘না না, এটা তো ধরা যাবে না।’ নিয়ে গেলেন জাইফ। কিন্তু ‘আল ইনসানু হারিসুন ফি-মা মুনিয়া’র পদভারে আমিও তো পিষ্ট। আমার লোভ বেড়ে গেল। তৈরি হলো আকর্ষণ। কী আছে এতে, হ্যাঁ?
কিছুদিন পরই যখন নানা কৌশলে খাতাটি আমার হস্তগত হলো তখন আত্মমুগ্ধতায় আমার ফেটে পড়বার উপক্রম। খাতার উপরাংশে লেখা ‘ত্রৈমাসিক ধানসিঁড়ি’। স¤পাদক প্যানেলে জাইফদের সঙ্গে আমার নামও দেখা যাচ্ছে। খাতাতে এ কাগজ বিষয়ক অনেক প্রস্তাবনার খসড়া করা হয়েছে। নানামুখী পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আমি এখনও কিছু জানি না। একটু বিস্মিত হলাম যদিও, কিন্তু সব বিস্ময় কেটে গেছে কিছুদিন পরই। জাইফ, তন্ময় আর আমি, কয়েকজন মিলে ত্রৈমাসিক ধানসিঁড়ির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করলাম। ইসলামি সাহিত্যকে আরও সজীব করবার প্রত্যয় নিয়ে শুরু করলাম পথচলা।
মাদরাসাতুল কাউসারের প্রথম বর্ষে তখন পড়ছি। বয়স চৌদ্দ পেরিয়ে পনেরোতে। নিতান্তই অপরিণত চিন্তার ধারক ছিলাম। বয়সের সঙ্গে এমন পরিকল্পনাকে দুঃসাহসী বলা যায়। কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টির এক দুধর্ষ চিন্তা আমাদের ক্রমাগত উদ্দীপিত করে তুলছিল। পাশাপাশি আরও সাহস পেতাম আমাদের যাঁরা বড় ছিলেন, তাঁদের কাজকর্ম দেখে। আল কাউসারে তো তখন একই সঙ্গে চারটি পত্রিকার কাজ চলছে। বর্ষে বর্ষে লিটলম্যাগের মহোৎসব। প্রতিযোগিতা দিয়ে কাজ হতো। শৈবাল, উন্মেষ, দুঃসাহস আর ধানসিঁড়ি। মনে হতো সাহিত্যের এক মহাকাল এখন। বিপুল আনন্দে ভাসমান আমরা আলাপ করতামÑসাহিত্যের এ চেতনা কওমি চিন্তা ধারায় চলমান প্রতিটি কওমি ছাত্রের ভেতরে যদি জেগে ওঠে, তবে তো বিজয় অনিবার্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অথবা কিছুটা লজ্জা নিয়েই বলা যায়, ইসলামি ধারার এ ম্যাগাজিনগুলোর কোনোটিই মূলধারায় স্থান করে নিতে পারেনি। কেউ ছিটকে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে কাজ। অর্থের অভাবে অথবা সাংগঠনিকভাবে প্রীতির বখিলতায় হারিয়ে গেছে অনেক অনেক কাগজ। সাপ্তাহিক লিখনী অথবা লিখনী তারুণ্যকেও বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছি স্বচক্ষে। মাসিক রহমত, আনতারা আর পরাগÑসবগুলোই অনিয়মিত হয়ে যাওয়ার দৃশ্যও দেখতে হয়েছে। মাদরাসাভিত্তিক ছোটো ছোট কাগজগুলোও হারিয়ে গেছে৷ নানামুখী সংকটে বিধ্বস্ত হয়ে আমি নিজেও তো আর দাঁড়াতে পারিনি ত্রৈমাসিক ধানসিঁড়ি নিয়ে। কিন্তু অভিজ্ঞতা কিংবা যোগ্যতা অর্জনের সত্যতা কি অস্বীকারযোগ্য? মোটেও না৷
ইসলামি সাহিত্য কিংবা কওমি মাদরাসাভিত্তিক সাহিত্যের যে পুনর্জাগরণ ক্রমবর্ধমান ক্রমাগত, তা এখন চিরকাল বিদ্বেষ পোষণ করা মানুষদের মুখেও শোনা যাচ্ছে৷ বইমেলা কিংবা মূলধারার সাহিত্যকর্মেও আজকাল কওমি ছাত্ররা ঢুকে যেতে পারছে। আত্মপ্রকাশ করছে বিভিন্ন অঙ্গনে নানারকম পরিচয়ে৷ সোশ্যাল মিডিয়াতেও আজকাল দেখা যাচ্ছে সাহিত্যকেন্দ্রিক নানামুখী পদক্ষেপ। প্রশংসাযোগ্য এসব কর্মের পদো™ঘাত খুঁজে দেখলে দেখা যাবে এসব লিটলম্যাগের মাধ্যমেই হাতেখড়ি হয়েছিল সব বরেণ্য লেখকের। লিটলম্যাগ সাংগঠনিক শক্তির সন্ধানদাতা। যদিও সাহিত্যচর্চার জন্যে কোনো সংঘ কিংবা সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে আমার মনে হয়। সাহিত্যসৃষ্টি একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। সংঘবদ্ধ হয়ে পত্রিকা বের করা যায়, রাজনীতি করা যায়, সাহিত্যসৃষ্টি করা যায় না।
ইসলামী পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে না পারারও কিছু কারণ আছে আমার মনে হয়। অধিকমাত্রায় এসব কাগজের উত্থান পাঠকের মন থেকে জৌলুশ হারিয়ে ফেলছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। ইসলামিক আর অনৈসলামিকÑএ দু’য়ের মধ্যে রেখা টানলে এ সংকট অনুভব করা যায়।
বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের পশ্চিম পাশের লিটলম্যাগ চত্বরটিও ছিল লেখক-পাঠকদের আনাগোনায় মুখর। আজ সে ঐতিহ্য অতীত। ইসলামি ধারার সাহিত্য পত্রিকাগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। পাঠক আশাহত হচ্ছেন ম্যাগাজিনগুলো দেখে। চর্চার জন্যে প্রকাশিত ম্যাগগুলোও আকাশচুম্বী স্বপ্ন ধারণ করে বসে আছে। দু’য়ে মিলে মধ্যখানে এ সাহিত্য পত্রিকাগুলো মাঠে মারা পড়ছে। কিন্তু এতকিছুর পরও ইসলামি ধারার কিছু ম্যাগাজিন আপন স্বকীয়তা নিয়ে নির্ভার দাঁড়িয়ে আছে। যেগুলো আমাদের জন্যে গর্বের। নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। পাঠকও গিলে খাচ্ছে নির্ভয়ে।
অনলাইনমুখী গণমানুষের এ তীব্র চাহিদার মধ্যেও যে বা যারা এখনও কাগজে-কালমে লিখে যাচ্ছেন, তাঁদের প্রতি আমার বিন¤্র সালাম। নবধ্বনিকেও শুভেচ্ছা। খুঁটে খুঁজে যেসব ম্যাগাজিন এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে
দেখি দিনশেষে, তাদের মধ্যে নবধ্বনিই অন্যতম।
আসলে এসব লিটলম্যাগ যেরকম যোগ্যতার জানান দেয় তেমনি আনন্দের। এই যে দৌড়ঝাঁপ, লেখা সংগ্রহ, স¤পাদনার নামে লালকলমে কাঁটাছেড়াÑকী অভ‚তপূর্ব আনন্দ। এ আনন্দ আমি আধুনিকতার পরশ পেয়ে দিনকে দিন মোডারেট বনে যাওয়া ‘আমার’ ভেতর খুঁজে পাই না৷ ছোট্ট এ জীবনের ‘লিটলম্যাগ’কেন্দ্রিক স্মৃতিগুলো আমার ভেতরে অতুলনীয় এক ভালো লাগার সৃষ্টি করে।
সেপ্টেম্বর ২০১৮