সাহিত্যের উৎকর্ষ অপকর্ষ বিচারমূলক সম্যক আলোচনাকে সাধারণভাবে সমালোচনা হিসেবে অভিহিত করা হয়। সাহিত্যের ভাব, বস্তু, রীতি-নীতি, অলংকার ও শিল্পীর বিশিষ্ট মানসদৃষ্টি প্রভৃতি সামগ্রিকভাবে এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। সহজ কথায়, কাব্য ও গদ্যের ভালো-মন্দ বিচার এবং সাহিত্যিক নীতিমালার আলোকে এর শিল্পমান বিশ্লেষণের নাম সমালোচনা এবং এ কাজে যিনি নিয়োজিত, তিনি হলেন সমালোচক।
হালের কারবার
কিন্তু আমরা দেখছি, সমালোচকরা এ-ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভুল এবং নীতিবিহির্ভূত কার্যকলাপের শিকার। কিছু সমালোচক লেখার কয়েকটি গুণের উপর ভিত্তি করে প্রশংসার এক দীর্ঘ সেতু তৈরি করেন, তো আবার কয়েকটি ত্রুটির কারণে ভুলের বাণ্ডিল খুলে দেন এবং অনেকটা গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়া ভুলের পসরা সাজান। অধিকাংশ সমালোচকের প্রবণতা হলো, তারা যেকোনো লেখার শুরুতে কিছু বহুলব্যবহৃত শব্দকথার প্রশংসামূলক অনুচ্ছেদ ভরে তোলেন এবং শেষের দিকে কিছু ত্রুটি বলে দেওয়াকে একাধারে ‘দায়িত্ব’ এবং ‘দায়মুক্তি’ বলে মনে করেন। এই উভয় প্রক্রিয়া চলে, এমনকি বিদ্যমান রচনায় ত্রুটির কোনো অবকাশ না থাকলেও কিংবা বেশিরভাগ রচনা নিম্নমানের হলেও। আরও দেখা যায়, লেখক নারী হলে সমালোচকের কথায় অস্বাভাবিক কোমলতা ও সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ থাকে, যা দেখার মতো! যেন সমালোচক লেখাটিকে ‘শৈল্পিক উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা’ হিসেবে হাজির করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন! বলা বাহুল্য, সমালোচনার এই তরিকাগুলো নেহায়েৎ দায়িত্বহীন এবং ভুল শুধু নয়, বরং জ্ঞানগত খেয়ানত ও অসততার পর্যায়ে পড়ে।
সমালোচকের দায় ও দায়িত্ব
সমালোচকের উচিত, সমালোচনাধীন লেখা, পুরুষ লেখকের হোক বা নারী লেখিকার, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে এর গুণাবলি এবং ত্রুটিগুলি নির্ণয় করা, এবং অতঃপর সামগ্রিকভাবে রচনাটির ‘মান’ বর্ণনা করা। শনাক্তকৃত ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়াতে লেখককে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া এবং নির্ণীত ত্রুটি সংশোধন করতে এর ‘বিশুদ্ধ বিকল্প’ কী হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করে দেওয়া।
সমালোচককে যেভাবে, সাহিত্যের সৃজনশীলতায় শৈল্পিক অথবা অন্য কোনো প্রকৃত ভুলকে নির্দেশ করা উচিত, ঠিক তেমনিভাবে অনুচিত জোর করে ভুল বের করার চেষ্টা করা। যেমন চাটুকারিতা বা তোষামোদি এক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত ও গর্হিত কাজ, তেমনি একজন সমালোচকের জন্য কেবল ভুল শিকারে ব্যপৃত হওয়া কোনভাবেই সঙ্গত অধিকার নয়। ‘ভুল ধরা না হলে, সমালোচনাকর্ম অসম্পূর্ণ হবে’—এমন ধারণা ভুল। কোনো লেখকের, বিশেষ করে নবীন লেখিয়েদের ক্ষেত্রে এমন হওয়াও বিচিত্র নয় যে, তার লেখার সিংহভাগই ভুল-ত্রুটিতে ভরা, এমতাবস্থায়, কর্তব্য হলো, হৃদয়কে আহত করে এমন শব্দ-মন্তব্য এড়িয়ে, সমালোচক ভদ্রভাষায় তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন, মার্জনাযোগ্য সমস্যাগুলো সহজভাবে দেখিয়ে দেবেন, যাতে করে লেখকের মন ও উদ্যম ভেঙে না পড়ে।
সত্যি বলতে, একজন সমালোচকের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, তার সমালোচনার কারণে কোনো লিখিয়ে হাত দমে যায়। হাতের কলমটা চিরতরে ড্রয়ারের ভেতর চাপা পড়ে যায়। সমালোচকের কেমন হওয়া উচিত—সে প্রসঙ্গে সৈয়দ আহমদ নদভির ‘তানকীদী নযরিয়্যাত কা মতালায়া’ নামক কিতাবের এই উদ্ধৃতি প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘সাহিত্যের সৃজনশীলতার প্রতি সমালোচকের আচরণ কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানীর জীবিত আত্মীয় স্বজনের প্রতি আচরণের ন্যায় হয়ে থাকে। সুতরাং সমালোচক ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে ও স্নেহের দৃষ্টিতে নিরীক্ষা করে। তার মধ্যে ঘৃণার দৃষ্টি থাকে না, কসাইয়ের অন্তর ও জল্লাদের হাতও থাকে না। সে কিছু অবদান রাখার জন্য সমালোচনা করে, কিছু নেওয়ার জন্য নয়।’
লেখকেরও আছে কর্তব্য
সমালোচকের দায়-দায়িত্বের পাশাপাশি রয়েছে লেখকেরও কর্তব্যবোধ। লেখক, কবি হোন বা গদ্য লেখক, পুরুষ কি নারী, সবার আগে তাঁর এই সত্য মনে রাখা উচিত যে, আমি একজন মানুষ, আমার লেখাজোখায় গলতি থাকতেই পারে। কাজেই সমালোচনা হতেই পারে এবং হওয়া উচিতও। কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো যে, লেখকেরা সাধারণত সমালোচনাকে সহ্যই করতে পারেন না। কোনরূপ ভুল ধরিয়ে দিলে তারা গোস্যা হয়ে ওঠে। মন খারাপ করে লেখাও বন্ধ করে দিতে চান কেউ কেউ। এমনকি এমনও ঘটে যে, সমালোচক লেখকের তরফ থেকে বিচিত্র কায়দায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অথচ, বাস্তবতা হলো, বড় বড় কবি ও লেখকরাও ভুল করেন, করতে পারেন, বরং বলা চলে, এই ভুল করা ও সমালোচনা সহ্য করার মধ্য দিয়ে তাঁরা আজকের অবস্থানে উন্নীত হতে পেরেছেন। এই তো স্বাভাবিক। কেন নয়, ভুল-শুদ্ধ মিলিয়েই তো মানুষ আর লিখতে লিখতেই তো লেখক, বড় লেখক, মহান লেখক। সমালোচনা হলে, দু-চারটা লেখা ভুল হলে, রাগান্বিত হওয়ার, কিংবা হতোদ্যম হয়ে কলমবিসর্জন দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। উত্তরোত্তর উৎকর্ষ ও সাফল্যের চুড়া স্পর্শ করার জন্য সমালোচনাকে সন্তুষ্টচিত্তে সয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। এ্যালবার্ট হার্বার্ড যেমন বলেছেন, ‘মহত্বের চূড়ান্ত প্রমাণটি বিরক্তি ছাড়াই সমালোচনা সহ্য করতে সক্ষম হওয়ার মধ্যে রয়েছে।’
এখানেও চাই উদারতা
বর্তমানে সমালোচনায় অসহিষ্ণু মনোভাব ও বিরূপ প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। যদি কোনো ‘বন্ধু’ লেখকের পোস্টের উপর ভুল ধরে, সমালোচনা করে তাহলে পোস্টদাতা বেজায় চটে যায়। এমনকি সমালোচনা যদি বস্তুনিষ্ঠও হয়, ভুল যদি বাস্তবও হয়। অথচ এক্ষেত্রেও উদারতায় পরিচয় দেওয়া দরকার বলে মনে হয়। যেন পোস্টের সকল পাঠক তা পড়ে জানতে পারে এবং তার বা অন্য কারো জ্ঞাত বিষয়ে ভুল-বিচ্যুতি থাকলে তা শুধরে নেওয়া যেতে পারে। বস্তুত, সামাজিক মাধ্যমে আপনার সঙ্গে ‘সহমত’, ‘একমত’—এ-জাতের বন্ধুদের চেয়ে আমাদের বরং ‘মতানৈক্যকারী’ বন্ধুদের প্রাধান্য দেওয়া দরকার। কারণ, যে একমত পোষণ করে, সে আমার বক্তব্য ও চিন্তার ক্ষেত্রে নতুন কিছু যোগ করে না। পক্ষান্তরে যখন কেউ দ্বিমত পোষণ করছে, তখন সে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নতুন দিক-দিশা দেয়, নতুন পয়েন্ট হাজির করে। আমার পরিবেশিত মতামত বা চিন্তাটি ভুল না হলেও, আলোচ্য বিষয়ে নতুন এবং অতিরিক্ত পয়েন্ট পাওয়া যায, যা আমাকে আরও সমৃদ্ধ করছে বৈকি!
মান ও রুচির আপেক্ষিকতা
আরেকটি বিষয় স্মরণীয়। দেখা যায় অনেক সময় কোনো একটি ভালো লেখাও প্রত্যাশিত মূল্যায়ন পাচ্ছে না। এই না পাওয়ার কারণ এই নয় যে, লেখাটি ভুল বা তাতে ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। অনেক সময় ব্যাপারটি পছন্দ-অপছন্দের কারণে ঘটে থাকে। এই হাকিকতটুকু আমাদের বিশেষভাবে স্মরণে রাখা জরুরি। একটি জিনিস পুরোপুরি সঠিক এবং সুন্দর, কিন্তু তবুও কারো কারো পছন্দ হয় না। এর কারণ মানুষের মান ও রুচিবোধের পার্থক্য। এটা খুবই সম্ভব যে, এই বিশেষ বিষয়ে সমালোচকের নিজস্ব ‘মান’ আছে, পাঠকের নিজস্ব রুচিবোধ আছে। তো, এটা মান ও রুচির আপেক্ষিকতার প্রশ্ন। লেখার ভুল-শুদ্ধ, ভালো-মন্দের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এই ধরনের সমালোচনাকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত। কারণ, লেখকর জন্য পাঠক-সমালোচকের এই মান ও রুচির যত্ন নেওয়া খুব একটা জরুরি নয়।
জানুয়ারি, ২০২২