মিষ্টিমাখা ভেজা স্বাদ মেশানো সকাল। হালকা হালকা তেজহীন রোদ ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ বা শহরÑকেউই ব্যস্ত হয়ে ওঠার সময় হয়নি এখনো। মা রুমে ঢুকতে ঢুকতে কিছুটা ব্যস্ত গলায় ডাক দিলেন। পরপর কয়েকটা ডাকের পর ঘুমের ঘোরে চোখ বন্ধ রেখেই আমি হু বলে জবাব দিই। এগোতে এগোতে তিনি মাথার কাছে এসে বললেন, ‘উঠরে, তাড়াতাড়ি উঠে পড়।’
আমি মনে মনে তাঁর চলে যাবার অপেক্ষা করি। এই সাত সকালে ঘুমের চেয়ে মজা কিছুই নেই। একটা দম নিয়ে চোখ মেলি, দেখি, রুমে আর কারো শব্দ নেই। কাঁথাটা আরেকটু টেনে চুপচাপ নিজের মতো ঘুমিয়ে পড়ি। খানিক পর, কতক্ষণ পর ঠিক বলতে পারি না, কানের কাছে ধমকের স্বরে মাকে বলতে শুনলাম, ‘এ্যাঁ, এখনো উঠলি না? কই, কবে তোকে ডেকে গেলাম!’
মুখের ওপর থেকে কাঁথাটা সরিয়ে আমি মায়ের দিকে তাকাই। দেখি রাগি চেহারায় বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মিন মিন করে খানিকটা বিরক্তি মিশিয়ে বললাম, ‘শুক্রবার তো আজ, ক্লাস নেই। একটু বেলা হলে কী হবে?’
কিছুটা শান্ত কণ্ঠে এবার মা উত্তর দেন, ‘এখন উঠে পড়, বিকালে ঘুমোস নে। তোর রুমটা গোছাতে হবে তো। বরপক্ষ আজ রুমাকে দেখতে আসবে।’
এই সাত সকালে ঘুম ভাঙাবার কারণে যতটা বিরক্ত লগছে, তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি বিরক্ত লাগছে আপুর বিয়ের কথা শুনে। মায়ের আরো দু’তিনটা ধমকে বিছানা ছেড়ে রুম ত্যাগে বাধ্য হলাম। এখন তিনি নতুন সংসার গুছানোর মতো রুমটা সাজাবেন। দরোজা-জানালার পর্দা পাল্টাবেন। খাটে নতুন চাদর বিছাবেন।
তন্দ্রা চোখ নিয়ে রুম থেকে পুরোপুরি বের হতে পারিনি, আবারও আওয়াজ শুনলাম, ‘কইরে রাফি, এদিকে আয়, শুনে যা।’ চোখ কচলাতে কচলাতে আবার সামনে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াই। ‘তোর চাচার বাসায় যা তো, তোর চাচা-চাচীকে আমাদের বাসায় নিয়ে আয়। রুমাকে বরপক্ষ দুপুরে দেখতে আসবে।’
এই নির্মল সকালে বাসায় এমন হুলুস্থুল আমার একদম ভালো লাগে না। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। এ পর্যন্ত আপু কতবার সাজুগুজু করে চেনা পুরুষের সামনে পাত্রী সেজে বসল। কই, এখনো তো বিয়েটা হবে হবে করে আর হয়নি। এসব বিয়ে না হবার পেছনে সবচেয়ে গোলমাল করছে আপু নিজে। অনেকবার সরাসরি বলে ফেলল, আমি অমন ছেলেকে বিয়ে করব না।’ পাত্রী দেখানো, পাত্রী দেখানো করে, এ পর্যন্ত আব্বা যা টাকা বিসর্জন দিলেন, এ টাকা দিয়ে দু’একবার রমরমা করে তাকে বিয়ে দেওয়া যেত নির্ঘাত।
ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর চাচীদের আমি বাসায় নিয়ে আসি। বাসাটা কেমন জীবিত হয়ে উঠে। এটা করো, ওটা করো বলতে বলতে ব্যস্ততা শুরু হয়। ঘর-দরজায় কেমন সাজ সাজ রব ফুটে ওঠে। নানা রকম খাবারের ঘ্রাণ লাগে নাকে। জুমার নামাজের কিছু আগে বরপক্ষ পিনপিনে সাদা একটি কারে করে আসলেন। তখন আমরা নামাজের জন্য বেরিয়ছি। আব্বা তাঁদের সাদরে বাসায় নিয়ে আসেন। আমিও আবার পিছুপিছু অনুগত ভৃত্যের মতো অনুগামী হই। জুমার পর বাসাটা একেবারে গমগম হয়ে উঠল। আগত মেহমানদের সাথে ঘরের সবার মতো ওঠার চেষ্টা, এ প্রসঙ্গ ও প্রসঙ্গ টেনে গল্প, কে কী করে থেকে শুরু করে কার কার ক’টি ব্যবসা ইত্যাদি আলোচনায় তুলে আনা হচ্ছে। ওদের আলাপসালাপের ফাঁকে, সারাদিন ব্যয় করে, শিশির বিন্দুর মতো ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরিয়ে, মা-চাচীর প্রস্ততকৃত খাদ্য, ওয়েটারের মতো আমরা তাঁদের সামনে হাসিমুখে পেশ করি। ওদের কথাবার্তায় বুঝা যায়, প্রৌঢ় বয়সের কোট-টাই পরা ভদ্রলোকটি বরের বাবা। সাথে পরিপাটি দুই যুবকের একজন বর। ছোটটা তার ভাই। তাদের সাথের শাড়ি পরা মহিলাটি বরের মা। সাজগুজ করা মেয়েটি তার বোন। খাবার পর্ব শেষ হতেই প্রৌঢ় লোকটা বলে উঠলেন, আমাদের মেয়েকে তো দেখছি না। ও কই?’
চাচা বললেন, ‘ও পাশের রুমেই আছে।’
‘কই গো রুমা মা’ বলে চাচা উঠে আপুকে আনতে পাশের রুমে পা বাড়ান। এরপরই আপু পাশের রুম থেকে অনেক দিনের পরিচিত বেশে সেজেগুজে ছোট ছোট পায়ে বাঁকাবাঁকা ভাব নিয়ে পায়ের মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে রুমে ঢোকে। আশ্চর্য! আপুর চোখেমুখে কোন লজ্জার রেখা নেই। বরং বিরক্তিবোধ জমাট বেঁধে আছে। অথচ প্রথম প্রথম এই অবস্থায় আপু লজ্জায় মরি মরি হয়ে যেত। আস্তে করে সালাম দিয়ে সামনে পড়ে থাকা চেয়ারে চুপচুাপ বসে পড়ল। অন্য আরো দশটা বরপক্ষের মতো আপুকে ওরা চাকরির ইন্টারভিউয়ের ন্যায় প্রশ্ন করতে লাগল। আপুও মুখস্থ থাকা উত্তরের মতো পটাপট জবাব দিতে থাকে। ওরা নিজেদের মধ্যে আপুর প্রশংসা ছড়ায়। প্রৌঢ় ভদ্রলোকটা এবার আবার মুখের দিকে তাকায়। মুখে হাসি টেনে বলে, ‘মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে, এবার লেনাদেনা কী কী আলাচনা করে নিই। আমরা চাচ্ছি সপ্তাহদিনের ভেতর ঘরে তুলে নিতে।’
ভদ্রলোকর এ কথায় আমি বড় একটা ধাক্কা খেলাম। নির্লজ্জভাবে প্রথমেই তিনি নেওয়া-দেওয়ার হিসেব কষলেন! বেশি ভয় হলো আপুকে নিয়ে, চাচীরা কত বার আপুকে বুঝিয়েছেন, তুই বাপের একমাত্র মেয়ে। তোর বাপের তো মাশাল্লা দেবার মতো সামর্থ আছে। তবুও তুই বিয়েগুলো এলোমেলো করিস ক্যান?
ভয় যা ছিল তাই ঘটল। মূর্তির মতো নিথর হয়ে বসে থাকা আপুটা নীরবতা ভেঙে বড় বড় পায়ে হন হন করে রুম থেকে বের হয়ে গল। ভদ্রলোক শহরের রিকশাঅলার কাছে বেজ্জত হবার মতা অপমানবোধ করলেন। মনে হয় তার ভদ্রতায় বেশ লেগেছে। খানিকটা নিজেকে সামলে নিয় বললেন, ‘তো আপনারা আমাদের বাসায় কবে মেহমানদারি করছেন?’
পাশের রুম থেকে আপুর হুঙ্কার শুনলাম, ‘যৌতুক দিয়ে বিয়ে বসব না, প্রয়োজনে বিয়ে ছাড়া জীবন পার করব।’
চাকরিরপ্রার্থীকে ফিরিয়ে দেওয়া অফিসারের মতো কৃত্রিম হাসি টেনে আব্বাকে বলতে শুনলাম, ‘সরি, আসলে মেয়ের অমতে তাকে আমি বিয়ে দিতে পারব না।
সেপ্টেম্বর ২০১৮