মানুষকে চেনার জন্য প্রথম পরিচয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি মনে থাকে সারাজীবন। অনেক ক্ষেত্রে তো প্রথম পরিচয়ের ওপরই ভবিষ্যত সম্পর্ক নির্ভর করে। প্রথম পরিচয়পর্ব যদি ভালো হয় তাহলে বেশিরভাগ সময় সম্পর্ক ভালো দিকে গড়ায়। ভালো না হলে সেই ব্যাক্তির প্রতি আর আগ্রহ থাকে না। অনীহা এসে যায়।
একজন লেখকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে লেখার মাধ্যমে। লেখা পাঠকের কাছে লেখককে তুলে ধরে। কোনো লেখকের ভালো কোনো লেখা প্রথমে পড়া হলে তাঁর নাম গেঁথে যায় আমাদের মনে। তাঁর অন্য লেখা আমরা তখন খুঁজে খুঁজে পড়ি। একজন পাঠকের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো একজন লেখকের লেখা যদি আপনি আগে পড়ে না থাকেন তাহলে তাঁর কোন লেখা দিয়ে পড়া শুরু করবেন এটা অবশ্যই ভাবার বিষয়। শুনতে একটু কেমন লাগলেও এ কথা সত্য যে, একজন লেখকের সব লেখা কখনোই ভালো হয় না। লেখকেরা কোনো কোনো লেখা প্রকাশকদের চাপে পড়ে লেখেন। তখন লেখার মান ভালো নাও হতে পারে। স্বয়ং লেখকরাও এ কথা স্বীকার করেন যে, তাঁদের সব লেখা ভালো হয় না। তাই বড় বড় লেখকদের দেখা যায় নির্বাচিত কবিতা, নির্বাচিত উপন্যাস বা প্রবন্ধের বই প্রকাশ করতে।
বাজারে বইয়ের অভাব নেই। লেখকেরও অভাব নেই। একজন পাঠককে তাই অনুসন্ধিৎসু হতে হয়। সারাজীবনে একজন মানুষ আর কয়টি বই পড়তে পারে? তাই কোনো লেখকের সবচেয়ে ভালো বই হাতে আসাটা পাঠকের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়।
আমার এই সৌভাগ্য হয়েছিল যখন আমি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ পড়ি। এর আগে যে আমি মুজতবা আলীকে চিনতাম না, তা নয়। এমন বড় একজন লেখককে চাইলেও না চিনে থাকা যায় না। তবে স্বীকার করি, আমি তাঁর ভক্ত পাঠক ছিলাম না। তাঁর কিছু কিছু লেখা অগোছালোভাবে পড়েছিলাম। সেগুলো ভালো লাগলেও মনে দাগ কাটেনি। তাছাড়া ওই বয়সে তাঁর লিখনশৈলীর সঙ্গে পরিচিতও ছিলাম না। তাই তাঁর অন্য বই আর খোঁজা হয়নি।
একদিন ফেসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাস দেখে আগ্রহ জাগে ‘শবনম’ পড়ার। বইটি উৎসাহ নিয়ে পড়তে শুরু করি। একরকম ঘোর লাগা তৈরি হয় পড়তে পড়তে। তাছাড়া আমি তখন সদ্য বাইশ বছরে পা দেওয়া তরুণ। বুকের ভেতর তীব্র রোমান্স। শবনমের মতো উপন্যাস আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়।
মাত্র একশত ষাট পৃষ্ঠার উপন্যাসটি আমি হয়তো দু’দিনেই পড়ে ফেলতে পারতাম। কিন্তু উপন্যাসের মধ্যে ডুবে থেকে যে আনন্দ লাগছিল, চেয়েছিলাম তা আরও দীর্ঘায়িত হোক। তাই অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পড়ি।
উপন্যাসটি পড়ার সময় এবং তার পর অনেকদিন আমি যে নিজেকে এই উপন্যাসের নায়ক ভেবে শিহরিত হইনি তা অস্বীকার করছি না। বরং বলে রাখি, এই একটি মাত্র উপন্যাসেই আমি নিজেকে এর নায়ক কল্পনা করেছিলাম এবং খুব সত্যি সত্যি কামনা করেছিলাম আমি যদি সেই নায়ক হতাম আর শবনমের মতো কেউ হতো আমার…।
যাক, নিজের গল্প বেশি বলে ফেলছি। পাঠকরা অপরাধ নেবেন না। শবনমের গল্প তো সৈয়দ মুজতবা আলী বলেই গেছেন। আমি সেই গল্পের প্রতি আমার ভালো লাগার গল্প বলছি আপনাদের।
গল্পটা শুরু তাঁর চিরায়ত অন্য গল্পের মতো। একটু রস মাখানো আকস্মিকতা। বাদশা আমানুল্লাহর মাথা নিশ্চয়ই খারাপ। নইলে আফগানিস্তানের মতো বিদঘুটে গোড়া দেশে বল ডান্সের আয়োজন করতে যাবেন কেন? শুরুতেই বল ডান্সের অনুষ্ঠানের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ। কিন্তু এই বল ডান্স উপলক্ষেই শবনমের দেখা পেয়েছিলেন তিনি।
এরপর আছে ভৃত্য আবদুর রহমানের সরস বর্ণনা। একটু দূর গিয়ে দেখা শবনমের সঙ্গে। শবনম মুজতবা আলীকে হোটেলের চাকর ভেবেছিলেন। কিন্তু ভুল বুঝতে পেরে প্রথমে ফরাসিতে ও পরে ফার্সিতে মাফ চেয়ে নেন। তিনি ভেবেছিলেন, লোকটি কতটুকুন আর শিক্ষিত হবে। ফরাসি নিশ্চয় বুঝবে না। এখানে মুজতবা আলী তাঁর পাÐিত্য দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করেননি। তিনি ফরাসিতেই তাকে উত্তর দেন। শুরু হয় তাঁর প্রতি শবনমের মুগ্ধতা।
লেখক কিন্তু শবনমকে দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। সে মুগ্ধতার বর্ণনা লেখক কীভাবে দিয়েছেন তা আমি বললে পাঠকরা সেই স্বাদ পাবেন না। বইয়ের পাতায় তা পড়ার অনুরোধ রইল।
এরপর গল্প এগোতে থাকবে। সেই গল্প আপনাকে কখনো হাসিয়ে মারবে। কখনো তাঁর সাহিত্যরসে মুগ্ধ করবে। এর মাঝে মাঝে খুব সচেতনভাবে আপনাকে রোমান্টিকতার স্বাদ দেবে। সেই রোমান্স একেবারে নির্মোহ। কোনো শক্তিশালী বীর পুরুষের রোমান্স নয়, একজন বাঙালি শিক্ষকের ভেতর থাকা সুপ্ত রোমান্স, বিদেশের মাটিতে যিনি চরম নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন। সেই সময় শবনম যেন ঠিক শবনম (শিশির) হয়ে এসেছিল তাঁর জীবনে।
সৈয়দ মুজতবা আলী এখানে শবনমকে একদম তাঁর নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছেন। রক্ষণশীল আফগানিস্তানের এক সরদারের কন্যা, যে বড় হয়েছিল সুদূর ফ্রান্সে। শিক্ষা-দীক্ষায় বহুগুণ এগিয়ে ছিল আফগানিস্তানের অন্য মেয়েদের থেকে। যে সাহিত্য বুঝত, কবিতা বুঝত। বরং কখনো কখনো কবিতাজ্ঞানে তাঁকেও ছাড়িয়ে যেত। মুজতবা আলীর মতো প্রতিভাবান সাহিত্যপুরুষকে সে চিনতে একটুও ভুল করেনি।
পৃথিবীর সব প্রেমের গল্পে প্রথম ভালোবাসার প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রথম কবে বলা হলো ‘ভালোবাসি’, এ কথা আমরা খুব মনোযোগ দিয়ে জানতে চাই। শবনম উপন্যাসে সেই ঘটনা লেখক রস এবং রোমান্স দুয়ের মিশেলে চমৎকারভাবে বলেছেন।
কয়েক দিন শবনমের দেখা নেই। পাগমানে তাদের দেখা হয়েছিল। সেখান থেকে সরদার তাঁর পরিবার নিয়ে চলে এসেছেন কাবুল। শবনম ভালো ফারসি জানে। লেখক এর মধ্যে ফারসি ভাষার বই জোগাড় করে সে ভাষা শিখতে শুরু করে দিয়েছেন। একদিন ছাত্রদের অনুরোধে সাঁতার কাটতে নেমে গেলেন কাবুল নদীতে।
সাঁতার কাটার মত জল নেই সেই নদীতে। ছাত্রদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদী থেকে উঠে একটি ঝোপের আড়ালে গিয়ে বসেছেনÑএমন সময় শবনমের আগমন। সাঁতারের কস্টিউম পড়া লেখক ঝুপ করে আবার লাফ দিলেন নদীতে। শবনম জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো? ওঠুন।’ লেখক নিরুত্তর। ‘ও, উঠবেন না?’ এ কথা বলে শবনম ব্যাগের ভেতর থেকে পিস্তল বের করতে গেল। লেখক ভয়ে অস্থির।
কী ভয়ংকর গল্প, ভাবা যায়? নদী থেকে কস্টিউম পরা লেখক উঠছেন না বলে প্রেমিকা পিস্তল দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। তারপর কী হলো, পাঠকরা কি ভাবতে পারেন? প্রেমিকা লেখকের লজ্জার কথা বুঝতে পেরে উদার হস্তে নিজের ওড়নাখানি দিয়ে দিল।
এরপর? কিছুটা অভিমান। নদীর কাছেই শবনম বানুদের বাগানবাড়ি। লেখক এত কাছে এসে পড়ায় তিনি বিস্মিত। আপনি কি জানতেন আমার বাড়ি এখানে?
‘না।’ লেখক জবাব দেন। এবারে শবনম বানু তার মেয়েলি অভিমান লুকোতে পারে না। কেঁদে দিয়ে বলে, ‘ও, আমার টানে নয়, সাঁতার কাটতে আর ফূর্তি করতে এসেছিলেন বুঝি!’
লেখক তখন নিজেকে চেপে রাখতে পারেন না। মুখ ফসকে বলে ফেলেন, ‘দেখুন, আমি বিদেশি, বিদেশে অনেক মনোবেদনা। তার ওপর মানুষ যখন ভালোবাসে…’
সহজ স্বীকারোক্তি। কিন্তু কী দারুণ উপস্থাপন। শবনমও সেদিন তাঁকে এর জবাব দিয়েছিল। কীভাবে, তা বই পড়ে পাঠক জেনে নিলে ভালো। এতে উপন্যাসের স্বাদ অক্ষুণœ থাকবে।
উপন্যাসটি শায়েরিতে ভরপুর। লেখ বা তার প্রেমিকা কেউই এতে কম যান না। একদিন শবনম হেরে গেলে আরেকদিন লেখক হেরে যান। এর মধ্যে আছে উচ্চাঙ্গ রোমান্স, যা পড়ে আবেগ উছলে ওঠে। সঙ্গে হাসিও।
এই বই পড়ার আগে-পরে আরও কত পড়েছি। এই বই মনে যতটা দাগ কেটেছিল তা ভোলার মতো না। প্রথমে ভেবেছিলাম স¤পূর্ণ সত্য ঘটনা। মুজতবা আলীর জীবনী ঘেটে এর সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি। তিনি একজন বাঙালি নারীকে বিয়ে করেছিলেন।
উপন্যাসের শেষে এসে পাঠক দুঃখ পেতে বাধ্য। কারণ, শবনমকে শেষ পর্যন্ত তিনি হারিয়েছিলেন। আমিও দুঃখ পেয়েছিলাম খুব। সেই দুঃখ ভুলতে অনেকদিন লেগেছিল।
তবে এই উপন্যাস আমাকে চিনিয়েছে মুজতবা আলী নামের শক্তিধর সাহিত্যিককে। একে একে তাঁর রচনাবলি আমি সংগ্রহ করি। বাংলা সাহিত্যে এক অতুলনীয় ভাÐার রেখে গেছেন তিনি।
অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকই শবনম উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন। তাঁর দেশে-বিদেশে, চাচাকাহিনী বা পঞ্চতন্ত্রের মতো বই খুব বিখ্যাত হলেও শবনমকে সবার ওপর রাখতে হবে। এ বইয়ে তিনি সুনিপুণ হাতে সাহিত্যের সকল উপাদানের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। তাঁর অন্য রচনার ক্ষেত্রে হয়তো এমন বলা যাবে না।
তিরিশের দশকের বাংলা সাহিত্যে তিনি যে অবদান রেখেছেন তাতে তাঁর সমকক্ষ আর কাউকে দেখা যায় না। সেসময়ে তাঁর মতো এমন সুশিক্ষিত সাহিত্যিক আর কাউকে আমরা দেখি না। বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। সেই অভিজ্ঞতা তিনি রস মাখিয়ে সংরক্ষণ করেছেন বইয়ের পাতায়।
তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছাত্র। শান্তিনিকেতন থেকে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিদেশ যান। সেই সময়ে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের যে রেশ ছিল তা থেকে তিনি ছিলেন ঊর্ধ্বে। তাঁর লেখায় তিনি সা¤প্রদায়িকতা থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থেকেছেন। সেজন্যও তাঁকে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিতে হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ তারিখ এই মহান ব্যাক্তির ১১৪ তম জন্মদিন অতিবাহিত হলো। নবধ্বনির পক্ষ থেকে তাঁর জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা।
অক্টোবর ২০১৮