গল্পের কলম নেই। প্লট-পটভ‚মি কিছুই না। খুব আহামরি একরকম জয়জয়কার লেখনী সত্ত¡াও জন্মায়নি নাফিসের ভেতর। তাই ওসব গাল গল্পের ধাত নেই ওর। লিখতেও পারে না তেমন গোছিয়ে। তবে কিছু চরিত্র ব্যাপকভাবে কখনও সাড়া ফেলে তার ভেতর। নিজস্ব যে ভাবনার দুয়ার আছে সেটা ভেঙে যায় সময়ের কোনো নিদারুণ চিত্রে।
শীতের মাঝামাঝি সময় এখন। গরমকালে যেসময় ভর দুপুর। এখন এসময়ে সূর্যের চোখ খোলে। বড্ড বাতাস আসে পূবদিক থেকে। দাঁত খিঁচিয়ে দিয়ে যায় বাতাসের জোর। সারা সকাল একরকম লেপ মুড়ি দিয়েই কেটে যায়। শীতের চেয়ে বাতাসের প্রভাব বেশি যেন। হু হু করে বাতাস বইছে পূব দিক থেকে। গাছে সবুজ পাতায় বাতাসের দোলন।
দুপুর আড়াইটা বাজল প্রায়। আজ রবিবার। সপ্তাহের এ দিন থেকেই তার টিউশনি শুরু হয়। প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন। রবি থেকে বৃহস্পতি। আট দিন হতে চলল নাফিসের টিউশনির বয়স। নিয়ম করে দৈনিক ঠিক তিনটায় টিউশনির বাসায় উপস্থিতি জানান দিতে চায় সে। এ কয়দিনে বেশ কয়বার সময়ের হেরফের হয়েছে সত্য, কিন্তু এ বাসার মানুষগুলো অসম্ভব রকমের ভালো। সাধারণত টিউশনি বাসার মানুষেরা এত ভালো হয় না। কি এক বিচিত্র কারণে প্রাইভেট টিউটরের সাথে একরকম ধেই ধেই ব্যবহার করে অধিকাংশ স্টুডেন্টের বাবা-মা। ক্ষেত্র বিশেষ বাসার কাজের বুয়াও কেমন চোখ বাঁকা করে তাকায় দরজা খুলে একরকম কপাল খিঁচিয়ে। পানির গøাস রাখতে গেলেও ঠক করে একটা আওয়াজ করে যায়।
এ অভিজ্ঞতা নাফিসের বেশ পুরনো। পড়াশোনার খরচ চালাতে মোটামুটি কয়েক গেট মাড়াতে হয়েছে এ শহরে। সে তুলনায় তার নতুন এ টিউশনি বড্ড সুখকর। কি অমায়িক ব্যবহার। প্রথম দিনই এ বাসার মানুষগুলো তাকে আপন করে নিয়েছে।
বাসে যেতে-আসতে দৈনিক বিশ টাকা লাগে। কিন্ত বেশিরভাগ সময়ই তার কাছে টাকা থাকে না। তাই পকেট ফাঁকা থাকলেও ভাবনা নেই। দশ বিশ মিনিট লেট হয় অবশ্য, তবে বাসা থেকে কিছুই বলে না। একরকম হেঁটেই চলে যায় নাফিস। আট দিনের শেষ তিনদিন মালিবাগ থেকে শান্তিনগর পদব্রজে গিয়েছে সে।
পৌষের ঠাÐা দুপুর। রোদ জ্বেলে আছে ঠিক অথচ বাতাসের প্রকোপে এর উষ্ণতা ঢেকে আছে একদম। হোস্টেল ছেড়ে বেরুতে ঘড়ির কাঁটা এখন পৌনে তিনটায় এসে ঠেকে আছে। চটজলদি নীল পাঞ্জাবিটা কোনোরকমে গায়ে জড়িয়ে রাস্তায় নেমে আসে নাফিস। উদ্দেশ্য, শান্তিনগর আল-আমিন টাওয়ার। ফ্লাট নম্বর বি-থ্রি, তৃতীয় তলা।
মালিবাগে নতুন ফ্লাইওভার করা হয়েছে। আগে এখান থেকে শান্তিনগর যেতে সময় লাগত সাধারণত বিশ মিনিট। জ্যাম থাকলে সময়ও থেমে থাকত ঢাকার দুর্গন্ধ বাসগুলোর আয়নার ভেতর। এখন ফ্লাইওভার দিয়ে যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ চার মিনিট। দেশের এ উত্তোরত্তর উন্নতি বেশ আনন্দের। সরকারের ‘ভিশন ৩০’ অনেকটাই সফল হতে চলল মনে হয়। সন্ধ্যের পর ঢাকা শহরকে একরকম সিঙ্গাপুর মনে হয়। পুরো ঢাকা যেন ফ্লাইওভারে ঢেকে দেয়া হয়েছে। যত যাই হোক জনগণ এখন একটু কমকম সরকারের মুÐুপাত করে। অবসরে রাজনীতির বারোটা বাজানো বাঙালিদের পরমানন্দের কাজ। বিশ্ব রাজনীতি তখন বুড়ো আঙুলে ঘুরতে থাকে রমিজ উদ্দিন, কুদ্দুস আলির। গলা অষ্ট মাত্রায় টেনে এনে বলে এ সরকার তাও কাজ করে যাচ্ছে অনেকটা।
যদিও ঢাকার ট্রাফিকদের তিন টাকার বিনিময়ে ঘুষ খেয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়ার খবর হর-হামেশাই পাওয়া যাচ্ছে আজকাল। দেশের চরম উন্নতির সাথে জঘন্য রকমের নৈতিক বিপর্যয় এটা। শুরু থেকে শেষ সব হাতেই নাকি মুঠ গোঁজা হয়।
পয়সা নেই। হেঁটেই যেতে হবে শান্তিনগর। জোরসে পা চালাচ্ছে নাফিস। ফ্লাইওভারে উঠতে উঠতে স্বাধীন বাসটা একগাদা ধূলো দিয়ে গেল তার মুখে। সাধারণত রাস্তাঘাটে মুখ বন্ধ করে হাটা উচিত। ঢাকায় অধিকাংশ মানুষই ইদানীং মাস্ক পড়ে হাঁটে। কিন্তু নাফিসের অবস্থান বিপরীত মেরুতে। হা করে হাঁটাতে তার স্বাচ্ছন্দ্যবোধ। পরিচিত রাস্তার প্রায় প্রত্যেকটা খুঁটির বিজ্ঞাপন তার আদ্যোপান্ত মুখস্থ। সে ‘হা’ করে পড়ে। লেখা দেখলেই পড়ে। শহরের ফাউ বিজ্ঞাপনগুলোর নূন্যতম একজন পাঠকও আছে। এ সুখকর সংবাদটি বিজ্ঞাপনওয়ালাদের জানা উচিত। তাদের চরম পর্যায়ের অখাদ্য ভাষ্যলিপি সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনগুলো তাই একরকম স্বার্থক। নাফিস সবসময়ই মন দিয়ে পড়ে এগুলো।
আজকের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। জোরে হাঁটছে নাফিস। পরপর দুইদিন দেরি হয়ে গেছে। একজন শিক্ষকের এমন অনিয়ম উচিত নয়। মৌচাক ছেড়ে এসেছে। মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই শান্তিনগর মোড়। তারপর বায়ে মোচড় দিয়েই আল-আমিন টাওয়ারে টিউশনির বাসা। কিন্তু বিপত্তি ঘটেছে অন্য জায়গায়। ওখান থেকে আরেকটু এগিয়ে কাকরাইল যেতে হবে তাকে। এক শিক্ষক একটা তাবিজ পার্সেল করে ফরিদপুর পাঠাতে বলেছে। সময় কম। হাঁটার বেগ আরো বাড়িয়ে দেয় নাফিস। শান্তিনগর মোড় ছেড়ে একটু সামনে এগুতেই একটা মেয়েকে দেখল সে। মেয়েটার বয়স বড়জোর তের কি চৌদ্দ হবে। কোলে ঘুমিয়ে আছে সাত আট মাসের কালো কুচকুচে একটা শিশু। সম্ভবত বাচ্চাটা ওরই হবে। মেয়েটা সামনে পড়ে থাকা কিসের যেন একটা ঠোঙা ছুঁতে চাইছে খুব করে । কোমরটা একদম চিকন হয়ে আছে। এগুতে পারছে না সে। অথচ প্রানপনে চাইছে ওটা ধরতে। মনে হয় ওটার ভেতর কারো ফেলে দেয়া খাবার। হাতে সময় কম। টিউশনিতে আজও দেরি হয়ে গেল। নাফিসের একটু খারাপ লেগেছিল বটে। কিন্তু সামনে এস এস পরিবহন অফিস। ওখানে পার্সেলটা করে আবার পড়াতে যেতে হবে। নাফিস মেয়েটাকে দ্রæত পাশ কাটিয়ে চলে আসে। তবে ভাবনাটা ওর ভেতর গেঁথে থাকে ঠিকই।
নাফিস আরেকটু জোরে পা চালায়। সামনেই কুরিয়ার সার্ভিস। পেছনে টিউশনির তাড়া। ওর পকেটে পার্সেলের তাবিজ। মেয়েটা এখনো প্যাকেটটা ছুঁতে চাইছে।
দুই
ছোট্ট একটা ঝামেলা হলো অফিসে। মোটামুটি আধঘন্টা পর পার্সেলের কাজ শেষ হলো। পেছনের পথ ধরে নাফিস। টিউশনি বাসায় যেতে হবে। সময় কম। গাড়ির হুইসেলে কান বন্ধ হবার উপক্রম। বিকেল বাড়তেই কেমন মানুষের ভীড় বেড়ে গেছে এখন। ঠেলেঠুলে সামনে এগোয় সে। শান্তিনগর মোড় আরেকটু পথ। হঠাৎ তার চোখ থেমে যায় একটা দৃশ্যে। রেখে যাওয়া সে পুরনো দৃশ্যটা। ভেতরটা কেমন খচ করে উঠল এবার। নাফিস থেমে যায়। টিউশনির কথাটা ভুলে যায় একদম। পথ ছেড়ে একটা টং ঘেষে দাঁড়ায় ও। জল ছলছল চোখ। জগতে এমন দৃশ্যটা দেখার দরকার ছিল ওর! পৃথিবী কী নিষ্ঠুর! নাকি আমরা! আমাদের সমাজ। সেই কিশোরী মেয়েটা। একজন আনাড়ি মা। তার কোলে কয়েক মাসের একটা শিশু।
যে এখন থেকে আধ ঘন্টা আগেই একটা ঠোঙা নিতে উপুড় হয়েছিল। এখনও অমন চেষ্টাই করছে। পৃথিবীর মানুষগুলো তাদের পথ ধরে হাঁটছে। জীবন তাদের ব্যস্ত রেখেছে বড্ড। অথচ তাদের সামনেই দুটো জীবন্ত জীবন বেঁচে আছে অল্প একটু হয়ে। সামনে দু পা এগোতে যার সময় লেগে গেছে তিরিশ মিনিট। নাফিস যাওয়ার সময় তাদের এভাবেই দেখে গেছে। নাফিসের ভেতরটা ভেঙে যায়। টুকরো টুকরো হয়ে যায় তার অস্তিত্ব।
কিশোরী মায়ের পেছনে হল্লা করে এক দলের কর্মী তাদের নেতার পোষ্টার লাগিয়ে গেল। একটু পর পাশের দোকানে দামি বেনসন হেজেস ধরিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দিল আকাশের গায়। অর্ধেক কলা খেয়ে চেংড়া গোছের একটা ছেলে ওটা ছুড়ে মারে মেইন রোডে। কেউ চিৎকার করে বিরোধী পার্টিকে গালি দেয়।
দলনেতার মন জয় করার নাটক করে যাচ্ছে ওখানে। শেষমেষ প্রত্যেকের হাতে পাচশো টাকার একটা করে নোট গুঁজে দিল মাঝবয়সী দলনেতা। কিশোরী মায়ের সামনে থাকা সিলভারের পুরনো বাটিটায় ঝনঝন করে উঠল পাঁচ টাকার একটা সিঁকি পয়সা। নাফিস কাছে গিয়ে কিশোরীর মাথায় হাত দেয়। টুপ করে দু ফোঁটা পানি পড়ে তার সিলভারের থালায়
এরপর থেকে আজ ১১ দিন হতে চলল। দৈনিক ঠিক তিনটায় কিশোরী মায়ের কাছে হাজির হয় সে। বাস ভাড়ার বিশ টাকা তাকে দিয়ে আসে নাফিস। আসা-যাওয়ার পথটুকু হেঁটেই শেষ করে এখন। কথা হয়েছে অনেক। দু’জনের জানাশোনাও হয়েছে অনেকটা। নাম তুলি। আনন্দবাজার বস্তিতেই থাকে। বাবা নেই।
বিয়ে হয়েছিল এক নেশাখোরের সঙ্গে। সপ্তাহ খানেক পর কোথায় যে চলে গেল! আর হদিস নেই। কি অসুখ হয়েছে তুলির এটা তুলি নিজেই জানে না। তবে দিনদিন কোমরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। সোজা করার জোঁ নেই আর। হাঁটতে পারে না একদম। ঢাকা মেডিক্যালের সামনে পড়ে ছিল অনেকদিন। হসপিটালে ভর্তি করতে পারেনি তুলির মা। ওখানেই বাচ্চা হয়। তারপর দিন কয়েকবাদে ভিক্ষায় নেমে যায় তুলি। ওর মাও ভিক্ষা করে হাইকোর্ট মাজারের সামনে। সন্ধের একটুপর সেখান থেকে ফিরে তাকে নিয়ে যায় প্রত্যেকদিন। কথাগুলো বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তুলির। নাফিসের দম বন্ধ হয়ে আসছে একরকম। এ শহর, পৃথিবীর অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই। মানুষের প্রেম মরে গেছে অনেক আগেই। চারদিকে এত অন্ধকার কেন? এ মাসের বেতনটা এক সপ্তাহ আগেই দিতে বলেছে নাফিস। তুলিকে মেডিক্যালে ভর্তি করাতে হবে। অন্ধকার আরো গাঢ় হচ্ছে এবার। শহরের আরেকটা অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়ে নাফিস।
নবধ্বনি, মার্চ ২০১৮