‘তারা (সুখ-নিদ্রা থেকে) বিছানা ত্যাগ করে আশা ও ভয় নিয়ে তাদের রবকে ডাকে’(১)
ঘুমটা ভেঙে যাওয়ার পর দ্বিধায় ভুগছি খুব; উঠে পড়ব নাকি আবার ঘুমিয়ে পড়ব। মন চাচ্ছে আরও ঘুমোতে। এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কেই-বা উঠতে চায়! কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। আমি না উঠলেও শায়েখ যদি উঠে পড়েন, তাহলে তো লজ্জা পাব। তাহাজ্জুদের নামাজের প্রতি শায়েখের ভালোবাসা আশ্চর্যজনক। সেই বাল্যকালে তিনি তাহাজ্জুদের অভ্যাস গড়ে তুলেছিলেন। আর এখন এই শতবর্ষ বয়সে পৌঁছেও তাহাজ্জুদের ওপর আমল করে যাচ্ছেন। একসময় তিনি সামর্থ্যবান ছিলেন। নিজের সব কাজ নিজে করতে পারতেন। তাহাজ্জুদের জন্যেও নিজে নিজে উঠতে পারতেন। তবে এখন তিনি অধিক বৃদ্ধ—আগের সেই সামর্থ্য নেই। তাই প্রতিদিন তাঁকে আমি তাহাজ্জুদের জন্য জাগিয়ে দিয়ে অজু করিয়ে দিই।
কিন্তু আজ যে আমাকে অলসতা পেয়ে বসেছে। ঠাণ্ডা একদম কাবু করে ফেলেছে। মন বলল আজ আর উঠতে হবে না। আমি না উঠলে শায়েখও উঠবেন না। আর তিনি উঠলেও আমাকে না দেখে আবারও হয়তো ঘুমিয়ে পড়বেন। তিনি তো আর একা একা অজু করতে পারবেন না। এমনিতেই গত দুদিন ধরে খুব ঠাণ্ডা পড়েছে। দিন-দুপুরেও সূর্যের দেখা মেলেনি। কুয়াশার চাদর চারিদিক আবৃত করে রেখেছে। শীতের এই রাতে না উঠে একদিন ঘুমিয়ে পড়লে কী আর হবে!
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি হাদিস স্মরণ হওয়ায় আঁৎকে উঠলাম।
‘যখন কেউ ঘুমায় তখন শয়তান তার ঘাড়ের পেছনে তিনটি গিঁট লাগায়। প্রতিটি গিঁটে সে এ বলে ফুঁক দেয় যে—রাত খুব দীর্ঘ, তাই ঘুমাও। (ঘটনাক্রমে) যদি সে জাগ্রত হয়ে যায় এবং আল্লাহর জিকির করে, তখন একটি গিঁট খুলে যায়। যখন সে অজু করে তখন আরেকটি গিঁট খুলে যায়। আর যদি সে নামাজ পড়ে নেয় তাহলে তৃতীয় গিঁটটিও খুলে যায় এবং সে ভোরে উদ্যমী ও প্রাণবন্ত হয়ে জেগে ওঠে। অন্যথায় তার সকালটা শুরু হয় মানসিক অশান্তি ও আলস্যের মধ্য দিয়ে।’ (২)
শয়তান তাহলে আমাকে খুব ভালোভাবে পেয়ে বসেছে। গিঁট একটি খুললেও বাকিগুলো যাতে না খুলে, সেই চেষ্টা সে করে যাচ্ছে। বেচারাকে একদম হতাশ করে দিয়ে আমি উঠে শায়েখের কামরার দিকে রওনা হলাম। শায়েখের বাথরুমের সামনে যেতেই থমকে দাঁড়ালাম—শায়েখ অজু করে বাথরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছেন। আমি শায়খকে ধরে রুমে নিয়ে গেলে তিনি তাহাজ্জুদের নামাজ শুরু করলেন।
কী লজ্জা! হায়, কতো আফসোস আমার জন্য। আমার তারুণ্যে-ভরপুর শরীর দিয়ে কী লাভ! অসুস্থ ও দুর্বল শরীরের শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধ মানুষটি আমার চেয়ে হাজার কদম এগিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগে আমিই তো ভাবছিলাম, তিনি ঘুম থেকে উঠবেন না আর উঠলেও একা অজু করতে না পেরে আবারও ঘুমিয়ে পড়বেন। কোনো বাধাই তো তাঁকে আটকাতে পারেনি—না এই শীতের রাতের সুখনিদ্রা আর না দুর্বল শরীরে রুমের দেয়াল ধরে ধরে বাথরুমে গিয়ে অজু করা।
রবের আশিকগণ তাহাজ্জুদের সময় রবের সাথে একান্ত মুলাকাতের জন্য যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন, তা আমার মতো রবের নফরমানরা কী করে বুঝবে!
তাহাজ্জুদ বা সালাতুল লাইল—যে নামই বলুন, তা আমাদের কাছে কর্কশ মনে হলেও রবের আশিকদের কাছে নামটি খুবই মধুর। রবের আশিকরা জানেন এটা সে সময়, যে সময়ের নামাজ ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম। (৩)
তাঁরা জানেন এটা সে সময়, যে সময়ের ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি বলেছেন, ‘…এবং রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করো যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে নিশ্চিন্তে জান্নাতে যেতে পারবে।’ (৪)
তাঁরা জানেন এটা সে সময়, যে সময়ে তাঁরা রবের কাছে যা চাইবেন, তিনি তা তাঁদেরকে দেবেন। (৫)
তাঁরা তো এমন মানুষ, যাঁদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তারা কাঁদতে কাঁদতে (সিজদায়) লুটিয়ে পড়ে এবং এটা তাদের বিনয় বৃদ্ধি করে।’ (৬)
হায়, তাঁরা কোথায় আর আমরা কোথায়!
আমরা তো নাদান, গভীররাতের ঘুমে সুখশান্তি খুঁজি। আর রবের আশিকরা গভীররাতে শয্যাকে তুচ্ছ করে রবের প্রেমে প্রশান্তি খুঁজেন। এটা তো মহান রবের মহান নেয়ামত। রব এমন মহান নেয়ামত তাঁর মাহবুব বান্দাদেরকেই দান করেন। শেষরাতে শয্যা ত্যাগ করে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে যাওয়ার নেয়ামতটা শুধু রবের মাহবুবদের জন্য। যাঁদেরকে রব নিজেই বলেন, ‘কেউ কি আছো? আমাকে ডাকো, আমি সাড়া দেবো। আমার কাছে চাও, আমি তোমাদেরকে দেবো।’ (৭)
হায়, এমন মধুর আহ্বান আর কোথায় পাবেন? মুসিবত যখন আসে, তখন আমরা দিশেহারা হয়ে যাই। অশান্তি শুরু হলে শান্তির খোঁজে পাগলপারা হই। কিন্তু তখন কেন রবের এই মধুর আহ্বানে সাড়া দিই না?
কেন ভুলে যাই আমাদের রব অপেক্ষা করছেন—গভীররাতের সে সময়ে তাঁর কাছে চাওয়ামাত্র তিনি আমাদের প্রয়োজন পুরণ করবেন, যে সময়ের কথা আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গিয়েছেন : ‘রাতে দুআ কবুলের একটি সময় রয়েছে (তাহাজ্জুদের সময়)। যদি কোনো মুসলমান আল্লাহর কাছে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য কোনো দুআ করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তা কবুল করেন। আর এই সময়টি প্রতি রাতেই রয়েছে।’ (৮)
আমরা যা খুঁজি তা একমাত্র আমাদের রব দিতে পারেন। আমাদের চাওয়া-পাওয়া একমাত্র রবই পূরণ করতে পারেন। আমাদের দরকার শুধু সঠিক সময়ে তাঁর কাছে চাওয়া, তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়া।
হায় আফসোস! এখনো কি সময় হয়নি রবের আহ্বানে সাড়া দেয়ার? শেষরাতে শয্যা ত্যাগের অভ্যাস গড়ে তোলার?
এখনো কি সময় হয়নি রবের মাহবুব বান্দাদের কাতারে শামিল হওয়ার?
‘রহমানের প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।’ (৯)
নোট : ঘটনাটি ২০১৩ সালের শীত মৌসুমের; শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফি রাহিমাহুল্লাহ-এর খেদমতে থাকাকালীন সময়ের।
তথ্যসূত্র : ১. সুরা সাজদা: ১৬। ২. সহিহ বুখারি: ১১৪২। ৩. সহিহ মুসলিম: ১১৬৩। ৪. আততারগিব ওয়াত তারহিব: ২৮৯/১। ৫. সহিহ মুসলিম: ৭৫৭। ৬. সুরা বনি ইসরাইল: ১০৯। ৭. আদাবুল মুফরাদ: ৭৫৮। ৮. সহিহ মুসলিম: ৭৫৭। ৯. সুরা ফুরকান : ৬৪।
লেখক : খাদেম, আল্লামা শাহ আহমদ শফী
অক্টোবর ২০২০