শীতকাল এলেই মনে পড়ে যায় আমার দূরন্ত শৈশবের কথা। যে বয়সটা ছিল মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে উড়ে বেড়ানোর। কাকডাকা ভোরে মায়ের হাতের আলতো ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙত অধিকাংশ দিন। কখনো মা আদর করে কপালে চুমু এঁকে দিতেন। চোখ কচলে কচলে উঠে বসলাম। মায়ের সাথে কনকনে শীতভোরে বেখেয়ালি ওজু করে দাঁড়ানো হতো জায়নামাজে। সেই তখন থেকেই প্রস্তুতি চলত মক্তবে যাওয়ার। অথচ তখনও ভোরের আলোর প্রস্ফুটন হয়নি। চারদিক ঘন কুয়াশায় আবৃত। টিনের চাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কুয়াশাজল। খোলা মাঠ, বন-জঙ্গল, নদীর তীরে কুয়াশারা ভীষণভাবে ছাউনি ফেলে রেখেছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দশেষে পৃথিবী জেগে উঠছে ক্রমশ। এমন কুয়াশাজড়ানো ভোরেই আমাদের বাড়িতে পা রাখত আমার শৈশবের মকতববন্ধু রফিক। ‘ফুআদ! ফুআদ!’ বলে গলা ফাটিয়ে ফেলত রোজ। আর বলত—‘ কই গেলেন চাচি? ফুআদ কি আজ মকতবে যাইত না? তারে তাড়াতড়ি কন বেরোইতো। জলদি মকতবে যাইতে ওইব, নইলে উস্তাদজি কড়া মাইর মারব।’
রফিকের কথা শুনেই মা আমাকে মকতবে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে নিয়ে বের হতেন। কিন্তু মকতবের কথা শুনেই আমার মুখের হাসি সব উবে যেত। অশ্রুভেজা মুখ। ছলছল চোখে অশ্রুর ঝলকানি। শৈশবকালে আমি বড্ড দুষ্টু ছিলাম। খুব ছেলেমানুষি করতাম। মক্তবে যেতে মন চাইত না একটুও। কিন্তু মা আমার নিষ্পা ছোট্ট হৃদয়ে আকাশছোঁয়া দালানের মতো বিশাল বিশাল স্বপ্ন আঁকতে বলতেন। মন না চাইলেও ছোট-বড় হাজারো স্বপ্নের শহরে বিভোর থাকতে হতো। মা আঁচলের গুছ থেকে দুটাকার নোট বের করে পাঞ্জাবির বুকপকেটে পুরে দিতেন রংছাতী মোড় থেকে তিলের নাড়ু খেতে। আর রেহাল, কায়দা তুলে দিতেন রফিকের কাছে। বাড়ি থেকে বের হয়ে মোড়লবাড়ির সামন দিকের আঁকবাঁকা মেঠো পথ ধরে যাওয়া হতো মকতবের দিকে। ভোরের হিমশীতল বাতাসে কুঁকড়ে যাওয়ার উপক্রম হতাম। মক্তবে যেতে যেতে শীতের আমেজ লুফে নিতাম। শিশিরে ভেজা ঘাস। দূর্বাঘাসের কপোলে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশিরকণা। সারি সারি খেজুর-গাছে ঝুলন্ত রসের হাড়ির দৃশ্য। রাস্তার অদূরে হলদে সরিষাফুলের ঘ্রাণে কচির হৃদয়ে দোলা দিত এক অন্যরকম শিহরণ। কথা বলতে বলতে আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে দেখে পথ ধরতাম মোল্লাবাড়ির। মোল্লাবাড়ির পেছনে পেছনে ছিল বিশাল আকারের হিজলবন। তার সাথেই লাগোয়া বিশালদেহী কয়েকটি বড়ই গাছ। মকতবে আসা-যাওয়ার পথে ঢিল ছোঁড়া হত প্রতিদিন। কখনো বড়ই পেতাম কখনো মোল্লা দাদুর ধমক। তবুও পেতাম এক ধরনের তৃপ্তির ছোঁয়া। পথ চলতে চলতে ততক্ষণে বাঁশঝাড়ে উঁকি দিয়ে উঠত রক্তিম সূর্য। তখন আমরা পা রাখতাম মকতবের আঙিনায়। আমাদের বাড়ি থেকে মক্তব একটু দূরেই ছিল। আর রাস্তায় নানা ধরনের কাণ্ড ঘটিয়ে যেতে যেতে মকতবের নির্দিষ্ট সময় তরতর করে শেষ হয়ে যেত। আমাদেরকে দেখেই ওস্তাদজি রাগত স্বরে বিশুদ্ধ উচ্চারণে চোখ রাঙানিতে শাসন করতেন। ওস্তাদজি ছিলেন মরহুম গাজী সানাউল্লাহ রাহিমাহুল্লাহ। খুব প্রিয় ছিলেন তিনি। সমকালীন অনেক বড় বড় আল্লামাকে টপকিয়ে যেতেন ভালোবাসার গুণে। সর্বদা অকৃত্রিম হাসি লেগে থাকত ঠোঁটের কোণে। আমাদেরকে দু-চারটি ধমক দিতেন। কখনো আবার কাছে গিয়ে কান মলে দিতেন। কিন্তু তখন একটুও মন খারাপ হতো না। ভালোই লাগত। কিছুক্ষণ পর সবক দিতে গিয়ে আবার খেতে হতো ধমকানি অথবা বাঁশের কঞ্চির আঘাত। কখনো মুখটা লাল হয়ে যেত কখনো আবার হয়ে যেত কালো। তবুও পেতাম ছুটির সময় এক অন্য ধরনের তৃপ্তির ছোঁয়া। আমাদের মকতব ছুটি হতো যখন দাদারা বাজার থেকে ফিরছেন। মায়ের পাতিলের ভাত হয়ে যায় যায় সময়ে। বড্ড মিস করি শৈশবকে। ইট-পাথর, কংক্রিটের শহরে শীতসকালের আমেজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্মৃতি বারবার পিছু টানে। আবারও ফিরে যেতে ইচ্ছে করে শৈশবে। বড্ড ইচ্ছে করে লুফে নিতে শীতসকালের আমেজ। তা কি আদৌ সম্ভব?
শিক্ষার্থী, জামিয়াতু ইবরাহীম, সাইনবোর্ড, ঢাকা
জানুয়ারি ২০২২