আমার আম্মার হাতে পীতলের প্রদীপ। ঘরে ফেরার জন্য বারান্দার বাইরে এসে গলা হেঁড়ে ডাকাডাকি; সেই হচ্ছে সন্ধ্যা কিংবা গোধূলির শেষ-লগন। তখনই আকাশে অরুণিম দেয়ালী। তখনই থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলা, ঝিঁঝিঁদের ঐকতানিক মুখরিত কোরাস। তখনই সন্ধ্যার উপাসনার আহŸান; পুকুরঘাটে, কলতলায় অজুর জলের ঝর্ঝর মুখর ধ্বনি, হাত-মুখ ধোবার শব্দ। তখনই সব পাখি নীড়ে ফেরে, করে নিদ্রার আয়োজন। মেঝেতে আমার মা যখন প্রার্থনার মাদুর পাতেন, ‘ওয়াল লাইলি ইযা আসআসা’র সুর ধরেন আমার নানাজী, তখনই পৃথিবী ছেয়ে আসে সন্ধ্যার অন্ধকার কালিমায়। শুক্লপক্ষের সন্ধ্যায় দাওয়ায় হাওয়া খেতে বসা, গল্প বলা, শোলক শোনা,গো-পাল নিয়ে জল-কাঁদা-ক্লিন্ন-ক্লিশিত দেহে হাশিম চাচাদের বাড়ি ফেরা, খলাতলায় ধাননিড়ানি, আকুল করা মৌ মৌ ঘ্রাণ, গরুর খুরের আঘাতে-পিষ্ট খড়ের খর্খর মৃদুধ্বনিময়তাÑআমার সেই সন্ধ্যা আজ কোথায় হারাল!
তথাপি, কিছু চিত্র চিরায়ত রূপে এখনো থেকে গেছে, থাকবে। এই আমাদের সন্ধ্যার চিরকেলে রূপÑমাদুর পেতে হারিকেন নিয়ে সেই পড়তে বসা, বইয়ের পাতার ছবিগুলো নিয়ে পাতার পর পাতা উল্টিয়ে পড়ার ভান করা। ভান করতে করতে ঢুলুনির মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে এক সময় নেতিয়ে পড়া। চুলাঘর থেকে ‘পড়ার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না কেনরে তোদের?’ এই হুঙ্কার এলে সলতে খাটো করে তেল ফুরোনোর অজুহাতে আবার নেতিয়ে পড়া।
সন্ধ্যায় নিশিগন্ধা, রজনীগন্ধার মন উন্মন করা গন্ধ, রূপকথার গল্পÑসেই সব সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। মায়ের করুণ মুখের মতো সন্ধ্যা; মুতরাপাতার পাখার শীতল বাতাসে দুই চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে; ঘুমোতে ঘুমোতে, ঢুলতে ঢুলতে, না খেয়ে ঘুমোনোর অপরাধে ঠোকর খেতে খেতে মায়ের হাতে খাওয়া সেই স্বপ্নের মতো সন্ধ্যাগুলি কোথায়, কোথায় গেল সেই ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ’ ওঠা, ‘থোকায় থোকায় জোনাক-জ্বলা’ সন্ধ্যাগুলি, সেই সন্ধ্যাদীপ, প্রদীপ হাতে ডাকাডাকি, ছুটোছুটি, সেই আকুল করা রজনীগন্ধা ফুল!
সেপ্টেম্বর ২০১৮