‘ভাই, শফী সাহেব নাকি মারা গেছেন?’
আওয়াজটা শুনতেই আকাশ যেন ভেঙে পড়ল আমার উপর। কিছু না বলে, নীরব চেহারায় তাকানোটা উত্তর খুঁজছিল। এদিক সেদিক দৌড়াতে লাগলাম সঠিক উত্তরের জন্য। অবশেষে মনটাকে কাঁদিয়ে উত্তরটা হাজির হয়েই গেল। আল্লামা আহমদ শফী ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ‘দামাত বারাকাতুহু’-এর কাতার থেকে ‘রহমতুল্লাহি আলাইহি’-এর কাতারে শামিল হলেন।
আব্বার অফিসে গিয়ে বসলে, আব্বা জানতে চাইলেন, ‘খবর কতটুকুন সত্য?’
‘একদম সত্য।’
‘নজরুল সাহেবকে জানিয়েছ?’
‘তিনিই আমাকে ফোনে জানিয়েছেন।’
‘তাহলে জানাজায় যাবা না ‘
‘বড় আলেমদের প্রায় সকলেরই জানাজায় গিয়েছি। তাঁর জানাজায় যাব না তা কি হয়! অবশ্যই যাব।’
আব্বার চেহারা ও শরীর একেবারে শুকিয়ে এল। নীরবতার ছায়া নেমে এল চেহারায়। যেন কোন হীরার মানিক হারিয়েছেন; যাকে এতদিন কলিজায় গেঁথে রেখে ছিলেন। হুজুরের ইন্তেকাল আব্বাকে শোকে মূহ্যমান করে ফেলেছে।
যাইহোক, আব্বা প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানাজায় যাবার। পেছন থেকে বলে উঠলাম, ‘তুমি গেলে আমিও যাব কিন্তু।’ আব্বা বললেন, ‘যাবেনে, তাতে সমস্যা কী!’
‘আচ্ছা, জানাজা কোথায় কখন হবে জানা গেছে?’
‘না তো।’
এশার নামাজ চলাকালে নজরুল সাহেব লাগাতার ফোন দিতে লাগলেন। আব্বা নামাজে ছিলেন বলে ফোনটা আমিই রিসিভ করলাম। বাদ-সালাম নজরুল সাহেব বললেন, ‘তোমার আব্বাকে বলে দিয়ো—জানাজা কাল দুপুর দুইটায় হাটহাজারী মাদরাসায় হবে। সবশেষে আমরা ১০ জন মিলে একটা গাড়ি ভাড়া করে ১২টার দিকে রওনা হই হুজুরের জানাজার উদ্দেশ্যে। মূল সড়কে যাওয়ার পর দেখি সব গাড়ি এক দিকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ড্রাইভার সাহেব বলে উঠলেন, ‘হুজুর! আমার জানা মতে আমাদের ইউনিয়ন থেকেই প্রায় তিরিশটা গাড়ি যাবে।’
২.
আজ আকাশে কোন মেঘ নেই। সব মেঘেরা হাজির হয়েছে সবার মুখে। গাড়ির আওয়াজ থেকেও যেন কান্নার সুর ভেসে আসছে। ফুটফুটে চেহারাগুলো শোকে মলিন হয়ে আছে। সবার মুখে একই কথা, একজন আহমদ শফী হারালাম মানে একজন শায়খুল হাদীস হারালাম। একজন দ্বীনী মুরব্বি হারালাম। আমাদের চলার পথে একজন মুকুটহীন বাদশাহ-কে হারালাম। আমরা আমিরের ছায়া থেকে বঞ্চিত হলাম।
৩.
যেদিকে তাকাই, শোকের ছায়া। শুধু শোকের ছায়া। রাস্তার দুপাশের গাছগুলোও যেন আজ হাহাকার করছে আমির হারানোর বেদনায়। সবুজের বুকে জল আজ শিশির-ফোঁটা নয়, বেদনার অশ্রু। পাহাড়গুলোও যেন দাঁড়িয়ে থাকতে চাচ্ছে না নিজ ভূমির সোনার মানুষটাকে হারিয়ে।
ততক্ষণে গাড়ি গিয়ে পৌঁছুল মাদরাসা-এলাকায়। সীমাহীন মানুষ হওয়ার কারণে গাড়ি দূরে রেখে হেঁটে মাদরাসায় যেতে হয়েছে। মাদরাসায় প্রবেশের পর মনটা আরও কেঁদে উঠল হুজুরের হাতে-গড়া বিশাল প্রতিষ্ঠান দেখে। অসংখ্য ভক্তের কান্নায় প্রতিষ্ঠানের ইটগুলোও যেন মিলিত হলো কান্নার সুরে। অনেকে আবার হুজুরের মসনদ আলতো করে ছুঁয়ে সান্ত্বনা নিচ্ছেন।
অবশেষে লাখো ভক্তের ভিড়ে জানাজা শেষ করে ফিরে এলাম।
কিন্তু যখনই মোবাইলে হুজুরের ছবি বা ভিডিও ওয়াজ শুনি, মনে হয় না যে হুজুরকে আমরা হারিয়েছি। কী-বা করার আছে। কুদরতের হুকুমে সবাইকে একদিন তো যেতেই হবে। দু’দিন আগ-পিছ, এই যা।
হে আল্লাহ, তুমি তোমার বন্ধুকে নিয়ে গেলে হাজারো ভক্তকে কাঁদিয়ে। সেই ভক্তদের দুআকে কবুল করে হুজুরকে জান্নাতে আরও উচ্চ মাকাম দান করো। আমিন।
অক্টোবর ২০২০