ভরতকাঠি গ্রামের ছোট্ট ছেলে হাবিব। বাড়ির সকলের কাছে ও তেমনি প্রিয় যেমন ওর নামের অর্থ। সাতসকালে টুকটুক করে মাদরাসায় যাবে আর ছুটি শেষে সোজা বাড়ি চলে আসবে। মাদরাসার ব্যাপারে হাবিব খুব সিরিয়াস; মিস দেয় না কখনো। কিন্তু ছুটি একটু পেলেই হলো! দিনমান এদিক-সেদিক বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে কাদামাটিমাখা শরীরে সন্ধ্যাকালেই তবে ঘরে ফিরবে। পুকুরপাড়ে বসে ছোট্ট হাত দু’টি একসাথে করে মাছের ছানাপোনা ধরাও ছিল ওর একটা বেজায় শখ। কখনো-সখনো ধরতেও পারে দু’একটা। তবে মিছেমিছি রান্নার ছলে পোনাগুলোকে ও মারে না। হয়তো পানির বোতলে অথবা উঠোনের এককোণে চৌবাচ্চা বানিয়ে সেখানে রেখে পানি পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে অনেকদিন পর্যন্ত।
বর্ষাকাল। পুকুর, খাল-বিল, ডোবা-নালা পানিতে থৈথৈ করছে। মা মাছেরা তাদের ছানাপোনা নিয়ে ছোটাছুটি করছে সারা পুকুর। আজ আর অন্য কোথাও নয়। মাদরাসা ছুটি হওয়ার পর বাড়িতে এসে ব্যাগটা বিছানায় ছুঁড়েই দৌড়ে চলে গেল সোজা পুকুরপাড়ে। রেহানা বারকয়েক ডাক দিলেনÑ ‘ভাতটা খেয়ে যা বাবা।’ কিন্তু কাজে ছিলেন বলে আর ছেলেকে আটকাতে পারলেন না তিনি। এই একটাই সম্বল রেহানার। স্বামীটা কোনো এক দুরারোগ্যে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল যখন, হাবিব দুধের শিশু। এই একমাত্র ছেলেই এখন তাঁর স্বপ্ন। বেঁচে থাকার সম্বল।
হাবিব ঘাটের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মাছরাঙার মতো তাকিয়ে আছে পুকুরের মধ্যে। হঠাৎ ওর চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে একঝাঁক শৌলপোনা দেখে। পোনাগুলো ওর অনেকটা কাছাকাছিই ঘুরঘুর করছে। ও ঘাপটি মেরে রইল। যেই না দু’হাত বাড়িয়ে ধরতে যাবে অমনি পোনাগুলো দিলো ছুট!
আর হাবিবও আরেকটু সামনে ঝুঁকে গেল শেষ চেষ্টাটা করার জন্য। কিন্তু নাহ! পোনাগুলো একেবারে বাঁদর টাইপের। মিস হলো এবার।
দুই.
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল।
রেহানা ভাত নিয়ে বসে আছেন ছেলের জন্য। তার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। দুষ্টু ছেলেটার কোনো খবরই নেই!
মাগরিবের নামাজের পর রেহানার অস্থিরতা বাড়ছে। এমন দেরি ও কখনোই করেনি। ভেতরটা ধুকধুক করছে তাঁর। কিছুক্ষণ পর এ বাড়ি ও বাড়ি ছাপিয়ে পুরো গ্রামে রটে গেলÑ হাবিবকে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক রাত পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি হলো, কোথাও নেই হাবিব। দুঃখিনী এই মায়ের কান্নাকাটি আর ঘুমহীন অবস্থাতেই পার হলো দীর্ঘ রাত। আর ওদিকে হাবিব! ওর এখন পোনা ধরতে কষ্ট করে হাত বাড়াতে হয় না।হয়তো পোনাগুলোই এখন ওর হাতে বুকে মুখে ঘোরাঘুরি করছে।
আঁধার কেটে আলো ফুটতে শুরু করেছে।
গাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষজন ঘর থেকে বের হতে শুরু করেছে দু’একজন করে। বাড়ির তরুণ ছেলে মাহফুজ মাছের টুকরি নিয়ে হাঁটা দিয়েছে বিলের দিকে। পুকুরের পাশ কেটে যেতেই আৎকে উঠল সে। পুকুরের মাঝখানটায় ফুলে ফেঁপে ওঠা হাবিবের নিথর দেহ দেখে চিৎকার দিয়ে পুকুরে লাফ দিল মাহফুজ।
চিৎকারের আওয়াজ রেহানার কানে পৌঁছতে দেরি হয়নি মোটেও। বুকটা ধড়ফড় করছে। প্রাণটা উড়ে যেতে চাইছে যেন। ভয়মিশ্রিত ফ্যাকাসে মুখটা নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বিড়বিড় করে বললেনÑ ‘আমার হাবিবের কিছু হয় নাই তো!’
আলুথালু হয়ে ছুটলেন তিনি। পুকুরপাড়ের জটলা ঠেলে ছেলের নিথর দেহ দেখে বুকফাটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। একমাত্র ছেলে হারানোর কান্না ঘরে থাকতে দেয়নি কাউকেই। কারো চোখে জল টলমল করছে। কেউ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়াবি মুখটার দিকে। শোকে কাতর হয়ে পড়েছে পুড়ো বাড়ির লোকজন।
মাহফুজ বাজপড়া মানুষের মতো অপলক তাকিয়ে আছে পুকুরের পাড়টায়। আর ঠিক সেখানেই মাথা উঁচিয়ে লেজ নাড়ছে একঝাঁক সোনারঙের শৌলপোনা।
নবধ্বনি, মার্চ ২০১৮