পুরো নাম সাদ্দাম হোসাইন আবদুল মজিদ আল-তিকরিতি। জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ এপ্রিল ইরাকের তিকরিত থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে আল-আওজা শহরের একটি মেষপালক পরিবারে। জন্মের ছয় মাস পর বাবা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কর্মক্ষম পুরুষহীন পরিবারে অভাব-অনটন আর দরিদ্রতার ভেতর শৈশব কাটান সাদ্দাম। দশ বছর বয়সে বাগদাদে মামার কাছে চলে যান। বাগদাদ শহরের একটি স্কুলে ভর্তি হন এগারো বছর বয়সে। স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই মামার কল্যাণে বাথ পার্টির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ক্রমান্বয়ে বাথিজম মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করেন। বাথিজম হচ্ছে আরব জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের সংমিশ্রণে তৈরি একটি মতবাদ। যার মূল লক্ষ্য ছিল বিপ্লবী সরকারের অধীনে অখণ্ড আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সাদ্দাম হোসাইন ১৯৫৭ সালে বাথ পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯৫৮ সালে ইরাক স্বাধীন একটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাথিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাথ আন্দোলনের অনুসারীরা ইরাক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী কাসেমকে হত্যা করার জন্য একটি গোপন অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করে। অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় নওজোয়ান সাদ্দাম হোসাইনকে। কিন্তু অপারেশনে তিনি সফল হতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তাঁকে পালিয়ে যেতে হয় সিরিয়ায়।
১৯৬৩ সালে ইরাকের গুপ্তঘাতক সংগঠন ফ্রি অফিসার-এর হাতে নিহত হন প্রধানমন্ত্রী কাসেম। ক্ষমতায় বসেন ফ্রি অফিসার-এর আবদুস সালাম আরিফ। ক্ষমতার বদল হওয়ায় বাথ পার্টির অন্যান্য নির্বাসিত ও পলাতক নেতাদের সঙ্গে সাদ্দাম হোসাইন সিরিয়া থেকে ফিরে আসেন ইরাকে। কিন্তু নতুন সরকার বাথ পার্টির নেতা-কর্মীকে গুম-গ্রেফতার করতে শুরু করে। সাদ্দাম হোসাইন গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায়ই তিনি বাথ পার্টির আঞ্চলিক উপ-সচিব নির্বাচিত হন। ১৯৬৭-তে কারাগার থেকে পলায়ন করতে সক্ষম হন। মুক্ত হয়ে পার্টিকে পুনর্গঠন করেন এবং ইরাকে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। ১৯৬৮ সালে এক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে ফ্রি অফিসারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং বাথ পার্টিকে ক্ষমতায় বসান। বাথ পার্টি ক্ষমতায় এলে হাসান আল-বকর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সাদ্দাম হোসাইন হন ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৯ সালে হাসান আল-বকর পদত্যাগ করলে তিনি প্রেসিডেন্টের আসনে সমাসীন হন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সাদ্দাম হোসাইন ইরাকের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনে মনোযোগ দেন। তাঁর হাত ধরে গড়ে ওঠে আধুনিক ইরাক। আরবের জ্বালানি সংকটের আগেই তিনি তাঁর দূরদর্শিতার মাধ্যমে ইরাকের তেল শিল্পের জাতীয়করণ করে নেন। দেশের এ রকম নানাবিধ উন্নয়নের কারণে জনগণের কাছে আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু এর বাইরে শিয়া ও কুর্দি জনগোষ্ঠী সাদ্দামের ঘোর বিরোধিতা করতে থাকে। সাদ্দাম-সরকারের বিরুদ্ধে নানা রকমের কূট-কৌশল ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তারা। সাদ্দাম হোসাইন এদের কঠোর হস্তে দমন করেন।
ইরান আক্রমণ
সাদ্দাম হোসাইনের শাসক-জীবনের অন্যতম একটা দিক ইরাক-ইরান যুদ্ধ। ১৯৭৯ সালে ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে শিয়াদের ধর্মীয় বিপ্লব সাধিত হয় এবং শিয়াদের ধর্মীয় গ্রæপ ক্ষমতায় আরোহন করে। নতুন সরকার ইরাকের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়। তা ছাড়া ইরাকে শিয়াদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নানাভাবে মদদ দিয়ে সাদ্দামের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়। এসব কারণে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সাদ্দাম হোসাইন ইরান আক্রমণ করেন। লেগে যায় তুমুল যুদ্ধ। দীর্ঘ প্রায় আট বছর একাধারে চলে এ লড়াই। উভয় পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। অবশেষে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালের আগস্টে যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ এ লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে।
কুয়েত আক্রমণ
ইরান আক্রমণের মতো কুয়েত দখলও সাদ্দাম হোসাইনের জীবনের বহুল আলোচিত একটি অধ্যায়। তেলের দাম বাড়ানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরাকের প্রভাবশীলতার কারণে কুয়েতের জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নিদারুণ অবনতি ঘটায়। সাদ্দাম ছিলেন রাগচটা শাসক। তাঁর দেশের ওপর কুয়েতের এমন নিষেধাজ্ঞা তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত করে। ইতিহাসের রেফারেন্স টেনে তিনি দাবি করেন, ‘কুয়েত ইরাকেরই অংশ। এত বাড়াবাড়ি যখন তারা করছে, তবে তাদেরকে আমরাই শাসন করব।’ ১৯৯০ সালের দোসরা আগস্ট সেনাবাহিনী পাঠিয়ে মাত্র ১৩ ঘণ্টার ভেতর তিনি কুয়েত দখল করে নেন।
নিজের স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে আমেরিকার চোখের বালি হয়ে ছিলেন সাদ্দাম। কুয়েত আক্রমণের সুযোগকে তারা পুরোদমে কাজে লাগায়। কুয়েতের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে সাদ্দাম হোসাইনের বিরুদ্ধে উস্কে দেয় মুসলিম বিশেষত আরব রাষ্ট্রগুলোকে। ফলশ্রুতিতে সবাই সাদ্দামের বিরোধিতা করতে শুরু করে। এমনকি তাঁকে রোখার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে তারা একজোট হতে থাকে। আমেরিকা ৯০-এর আগস্টেই জাতিসংঘ থেকে এই মর্মে একটি বিল পাস করিয়ে নেয় যে, কুয়েতকে ইরাকের দখল থেকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজনে বল প্রয়োগের আশ্রয় নেওয়া হবে।
১৯৯১-এর ১৭ জানুয়ারি আমেরিকার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক জোট ইরাক ও কুয়েতে ৯০০টি জঙ্গি বিমান নিয়ে উপর্যুপুরি হামলা শুরু করে। ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র সাতদিনে ইরাকি লক্ষ্যবস্তুগুলোতে আঘাত হানতে ১২ হাজার বার আকাশে ওড়ে এইসব জঙ্গি বিমান!
কিন্তু প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন এত সহজে বশে আসার পাত্র ছিলেন না। তিনি যথা সম্ভব মুকাবেলা করে পাল্টা আক্রমণও চালিয়েছেন নিজের শক্তি মাফিক। টানা ৩৮ দিন ধরে এভাবে বিমান হামলা করে যখন সাদ্দাম হোসাইনকে টলাতে পারলেন না, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবিøউ বুশ স্থল অভিযানের নির্দেশ দেন। ২৪ ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক জোট স্থল আক্রমণ শুরু করে। বিশ্বের সব শক্তিশালী দেশ একদিকে, আর একা এক সাদ্দাম হোসাইন একদিকে, আর কত টিকে থাকবেন তিনি? স্থল আক্রমণের চতুর্থ দিন তিনি জাতিসংঘের দেওয়া প্রস্তাব মেনে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন এবং নিজের বাহিনীকে ফিরিয়ে এনে কুয়েতকে মুক্ত করে দেন।
ক্ষমতা হারানো
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে হামলার পর আমেরিকা অভিযোগ করে সাদ্দাম হোসাইন ও আল-কায়েদা যৌথভাবে এ আক্রমণে মদদ জোগিয়েছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বুশ প্রশাসন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম করে নিজেরাই লিপ্ত হয় সন্ত্রাসীতে। ২০০৩ সালে মার্কিন সৈন্যরা ইরাকে আক্রমণ করে। টুইন টাওয়ারের অভিযোগ ছাড়াও জর্জ ডাব্লিউ বুশ যে কারণ দেখিয়েছিলেন এ আক্রমণ জায়েজ করার জন্য, তা হলো : সাদ্দাম হোসাইন ১৯৯১ সালের চুক্তি ভঙ্গ করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছেন এবং এ ধরনের অস্ত্রের মজুদও তাঁর কাছে আছে। কিন্তু আক্রমণের পর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তারা এ ধরনের কোনো অস্ত্রের মজুদ পায়নি ইরাকের কোথাও। তাছাড়া সাদ্দাম হোসাইন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করেছেন বলে যে অভিযোগ করেছিল তারা, এরও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি বিশ্বকে।
২০০৩-এর ২৩ শে মার্চ চতুর্মুখী আক্রমণের মাধ্যমে সাদ্দাম হোসাইনকে ক্ষমতাচ্যুত করে মার্কিন সৈন্যরা এবং তাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ জারি করে। গ্রেফতার এড়াতে তিনি মাস কয়েক পালিয়ে বেড়ান এখানে-ওখানে। অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিনিদের এক গোপন অভিযানে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বছর তিনেক বিচারের নামে নানা নাটকীয়তা ও প্রহসনের পর ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঈদুল আজহার দিন মার্কিন সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।
ইন্টারনেট অবলম্বনে লিখেছেন হামমাদ রাগিব
ডিসেম্বর, ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত