সোনালী ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার আজ পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলো সিফত আলির। টাকাগুলো পরিশোধ কিংবা অন্তত সুদটা আদায় করার তাগদা দিয়ে বছরে বছরে ব্যাংক থেকে চিঠি আসে তাঁর কাছে। খেতের ধান বিক্রি করে সিফত আলি যা পান, ওখান থেকে মুদী দোকানের বাকি, কর্জ করা টাকা ও ব্যাংকের সুদ আদায় করেন। গেলবার
উপর্যুপরি তিনবার বন্যা এসে খেত তলিয়ে নিয়ে গেল। এবার সোনা সোনা ধানের মুখ দেখেনি উঠোন-প্রাঙ্গণ। সিফত আলির এ বছর পায়ের নিচে মাটি নেই। দশপাঁচ ভাবছেন তিনিÑএবার লোনের সুদ কিভাবে পরিশোধ করা যায়?
হতাশায় হিম হয়ে ভেবে-কষ্টে এক সন্ধ্যায় সিফত আলি গেলেন গাঁয়ের জহির মিয়ার কাছে। জহির মিয়া টাকাওয়ালা লোক। কালেভাদ্রে টাকা-পয়সা কর্জ দিয়ে একটা ইন্টারেস্ট পান তিনি। এই ইন্টারেস্টে একটা সুখ আছে। ঘরে বসে সংসার চলে। জহির মিয়া ড্রয়ার থেকে টাকার বাÐিল বের করে একঝলক নিরস মুচকি হাসেন। হেসে হেসে বলেন, ‘আজকাল টাকার বড়ই নিদান ভাইসাব, টাকা-পয়সা আইজকাইল কর্জ মিলে না। দায়দরকার রেখে কে কারে টেকা দেয়? টাকার আমারও দরকার ছিল। টাকাটা আমি ব্যবসায় খাটাতাম। কিন্তু তুমি আইছো টাকার জন্য আমি তো আর না করতে পারি না। এই পাঁচ হাজার টাকা নেও। মাস তিনেক পর পর আমারে হাতখরচের জন্য পাঁচশ কইরা দিয়ে যেও।’ জহির সাহেবের এই ভদ্রলোকি কথাবার্তা সিফত মিয়ার জানা আছে। সিফত আলি চাদর মুড়ানো মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলেন, ‘ঠিকাছে ভাই। বিপদের কালে আপনে পাশে দাঁড়াইছেন এইটাই বহুত বড় ঋণ।’
কৃষ্ণপক্ষের কুয়শাঘন রাতে একটা বিড়ি ধরিয়ে সিফত আলি ধীরে ধীরে হাঁটছেন। এক পা এগোন তো আধ পা পিছোন। ভাবলেশহীন চিন্তাসমেত হেঁটে হেঁটে কখন বিড়িটা শেষ হয়ে গেল সিফত আলি টেরও পাননি।
রাতে বউয়ের সঙ্গে বোঝাপাড়া করলেন, ‘এইবার না হয় টাকাটা দিয়া একটু খরচাপাতি আনি। বুরোখেত কইরা ব্যাংকের ট্যাকা দিয়া দিমুনে।’
পাঁচ মাস পর আবার ব্যাংক থেকে নোটিশ এল সুদ পরিশোধ করার জন্য। জহির সাহেবও তাগদা দিতে লাগলেন সুদের টাকা দিয়ে দিতে। কিন্তু এবার বুরোধান ভালো হয়নি। মেঘে-বাদলে ধান সব নিয়ে গেছে। সিফত আলি এখন নিতান্ত অসহায়। জহির মিয়াকে ওসব শোনালেও কাজ হয়নি। ইন্টারেস্ট না পেলে জহির মিয়া সব টাকা একসাথে ফেরত চায়। এই নিয়া বাঁধলো গÐগোল। হতাশার দোলাচলে একটা চিন্তা মাথায় এল সিফত আলিরÑখাসিবাচ্চাটা বিক্রি করে তিনি ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করবেন। ক’দিন পর জহির মিয়া তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন এই খবর পেয়ে। ব্যাংকের টাকা দিতে পারে আর আমারটা দিতে যত গড়িমসি-বাহানা! দস্তুরমতো একটা ঝগড়া লেগে গেল। একদিন দুপুর বেলা জহির মিয়া সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে সিফত আলির উপর হামলে পড়লেন। সিফতের ফুফাতো ভাই সাজিদ আলি মোটামুটি ধনী লোক। চরম আত্মসম্মানওলা। মামাতো ভাইয়ের সাথে জহিরের এমন কর্মকাÐ তিনি মেনে নিতে পারলেন না। লোকবল নিয়ে রীতিমতো একটা যুদ্ধ চলল জহিরে-সাজিদে। জহির-পক্ষের একজনের হাত ছিঁড়ে যাওয়াতে বিষয়টা তিল থেকে তাল হয়ে গেল। ঘরোয়াভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তির অনেক চেষ্টাসাধনা করেও কাজ হয়নি। উভয় পক্ষ মিলে এলাকায় সালিশ বসাল। মাহতাবউদ্দি এলাকার অন্যতম একজন বিচারী। তিনি বিচারকার্যের আগে কিছু ‘হাদিয়ার মাল’ না পেলে নড়েন না। যেই পক্ষ কিছু ‘মাল’ পকেটে পুরে দেয় তার তরফে বিচার আসে। জহির মিয়া মাহতাবউদ্দিকে কিছু হাদিয়া দিলে বিচার চলে এল জহিরের পক্ষে। মাহতাবউদ্দি পায়ের উপর পা রেখে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে মজলিসে বললেন, ‘কথা তো হাছা। বেচারার পাওনা টাকা দিতে এত গড়িমসি করে কেন দুইটেকার বেটা সিফত আলি?’ সাজিদ আলি এই একতরফা বিচারে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বলে উঠলেন, ‘আজকের মজলিসটা এক তরফা। আমরা এই বিচার মানি না। থানায় গিয়ে দেখব!’ কিন্তু পরদিন সকালে দেখা গেল উল্টো জহির মিয়াই থানায় গিয়ে একটা খুনের মামলা দায়ের করে বসেছে।
অনেক দেনদরবারের পর অবশেষে সাজিদ আলি আর সিফত আলি আপাতত ৩৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে জেলে যাওয়া থেকে বাঁচে।
দুই.
উপরের চিত্রটা এখানে রেখে এবার চলুন অন্য কথায়। মানুষ সামাজিক জীব। পরিবেশবান্ধব। সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করছে। সৃষ্টিগতভাবেই তারা পরিবেশবান্ধব। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল-খালকু ইয়ালুল্লাহÑসৃষ্টিকুল আল্লাহর পরিবার’। এই যে জহির, সিফত, মাহতাবউদ্দিÑএদের নিয়েই তো সমাজ এবং সংগঠন। এরা এই সমাজের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এদের ব্যাপারে আজ সমাজ কতটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে? সমাজের অন্যান্য ব্যক্তি থেকে নিয়ে সামাজিক সংগঠনগুলো পর্যন্তÑকেউ এদের দায় এড়াতে পারবেন?
আসুন, একটু পরখ করি হিলফুল ফুজুলকে। সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে অন্যায়-অবিচার, সুদ-ঘুষ, হত্যা-ধর্ষণ-রাহাজানি ইত্যকার অপরাধ যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল তখন সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে, ইনসাফের সমাজ গড়তে মক্কার একদল সম্ভ্রান্ত উদ্যমী তরুণের প্রত্যয়ে গড়ে উঠেছিল ‘হিলফুল ফুজুল’। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমাদের মহানবি হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। সংগঠনের সবাই অঙ্গীকার করেছিলেন, ‘মক্কায় সংগঠিত যেকোনো প্রকার জুলুম-অত্যাচারেরর প্রতিবাদ আমরা করব। কেউ অত্যাচারিত হলে প্রতিকার করে তাঁর অধিকার ফিরিয়ে দেব।’
উপরে চিত্রিত সিফত আলি টাকার তাড়নায় ঘুরে বেড়ানো, বৈধ উপায়ে কারো কাছে কর্জ না পাওয়া, বাধ্য হয়ে জহির মিয়ার কাছ থেকে সুদে টাকা আনা, অতঃপর এই টাকা পরিশোধ নিয়ে সমাজে ফিতনা সৃষ্টি হওয়া এবং এই সুযোগে মাহতাবউদ্দি ও থানাকে ঘুষ দেওয়াÑএগুলো কি স্পষ্ট জুলুম নয়? সমাজে অশান্তি-বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ নয়? অথচ আল্লাহ তায়ালা কর্জ দেওয়ার প্রতি আমাদের উদ্বুদ্ধ করে কুরআনে কারিমে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ তায়ালাকে উত্তম কর্জ দাও’। (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াতক্রম : ২০) অর্থাৎ যখন কোনো মানুষ ঋণ চাইবে তাকে বিনা শর্তে ঋণ দিতে হবে। যখন সে স্বেচ্ছায় তা আদায় করবে তখন তা গ্রহণ করবে। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ফিতনা হচ্ছে হত্যার চেয়েও জঘন্য’। (সুরা বাকারা, আয়াতক্রম : ১৯১) অপর আয়াতে সুদকে নিষেধ করে বলেন, ‘মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেও না’। (সুরা আলে ইমরান, আয়াতক্রম : ১৩০) অন্যত্র বলেন, ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত করেন’। (সুরা বাকারা, আয়াতক্রম : ২৭৬)
ঘুষের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে-শোনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকগণের নিকট পেশ কোরো না। (সুরা বাকারা, আয়াতক্রম : ১৮৮)
ঘুষের ভয়াবহতা দেখিয়ে হাদিসের কিতাবে এসেছে, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতার ওপর অভিসম্পাত করেছেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিসক্রম : ৩৫৮০; সুনানে তিরমিজি, হাদিসক্রম : ১৩৩৬)
অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতাÑউভয়ই জাহান্নামে যাবে।’ (তাবারানি-আদ-দুআ, হাদিসক্রম : ২০৯৪-২০৯৮; আল-মু’জামুল আওসাত তাবারানি, হাদিসক্রম : ২০২৬)
অতএব, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের দায়িত্বটা আমাদের সবারÑবিশেষ করে সামাজিক সংগঠনগুলোর। আমরা সঙ্গবদ্ধ হলে সুশৃঙ্খলভাবে সংগঠন গড়ে তুললে সামাজিক এসব অনিয়ম দূর করা সম্ভব। আমাদের সমাজে, আমাদের পরিবেশে যদি এই পাপগুলো হতে থাকে আর আমরা এর প্রতিকারের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ না করি তাহলে আমরা এর দায় আমরা কেউই এড়াতে পারব না। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নিজে বাঁচো এবং তোমাদের আহালদের বাঁচাও’। (সুরা তাহরিম, আয়াতক্রম : ৬)
এই সম্মিলিত বাঁচার পন্থা হতে পারে সামাজিক সংগঠনগুলো। সিফত আলিদের মতো মানুষদের সুদের অভিশাপ থেকে বাঁচাতে গড়ে উঠতে পারে সংগঠন ভিত্তিক ক্ষুদ্র ঋণব্যবস্থা প্রদান। মানুষদের আল্লাহমুখী করতে ভ্রাতৃত্বের পরম মমতা মেখে সংগঠনভিত্তিক কাজ করা যেতে পারে। ন্যায়বিচার প্রতষ্ঠা, সকল প্রকার অন্যায়-অশ্লীলতা-পাপাচার থেকে সমাজকে মুক্ত করতে সামাজিক সংগঠনগুলো রাখতে পারে বলিষ্ঠ ভূমিকা। হৃদয়ে ধারণ করতে পারে হিলফুল ফুজুলের চেতনা। একুশ শতকের এই সময়ে নির্মল সমাজ বিনির্মাণে হিলফুল ফুজুলের আবেদন ধরে রাখতে পারবে কি আমাদের সামাজ? নববি আদর্শে যদি পারে সেই আবেদন বাস্তবায়ন করতে, তবেই সামাজিক সংগঠনগুলোর স্বার্থকতা ফুটে উঠবে। আল্লাহ তওফিকদাতা।
মে ২০১৮