বিস্ফোরণ, রক্তক্ষরণ, গগণবিদারী চিৎকার, কান্না, আহাজারি আর ধ্বংসস্তুপের দেশ সিরিয়া। দেশটির প্রতিটা জনপদ যেন একেকটা বধ্যভূমি। একাধারে সাত সাতটি বছর ধরে মানুষ ও মনুষ্যত্ব এখানে বলি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বলি হচ্ছে বড় করুণ আর হৃদয়বিদারকভাবে। সা¤্রাজ্যবাদী নানা দেশ, শক্তি, পরাশক্তি আর দল-উপদলের জিঘাংসা ও রক্তক্ষুধার শিকার হচ্ছে এখানকার নিরীহ সাধারণ অধিবাসী। ২০১১ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১০ লক্ষাধিক। আর প্রাণের মায়ায় সর্বস্ব ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হয়েছেন ৬০ লাখেরও বেশি। এদের অধিকাংশই নিরীহ জনগণ। এসব সংঘাত-সঙ্কট নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। শান্ত-নিরুপদ্রবে কেবল বেঁচে থাকতে পারাটাই ছিল তাঁদের আপাতত চাওয়া।
সাত বছর আগেও যে সিরিয়ার জনগণ খুব ভালোভাবে জীবনযাপন করছিলÑএমন না। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি (হিজ্ব আল-বাত আল-আরাবি আল-ইশতিরাকি-কুত্র সুরিয়া)-এর একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়েছে তারা। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ৬০% সুন্নি আরব মুসলমান, ৯% কুর্দি, ১২.৮% আলাওয়াইটস (নুসায়রি শিয়া) আরব, ১৩% খৃস্টান (৯% অর্থোডক্স ও ৪% আর্মেনিয়ান), ৩.২% ড্রুজ আরব এবং ইসমাইলি শিয়া ৩%। বাথ পার্টির নেতৃত্ব নুসায়রি শিয়াদের হাতে। ফলে মোট জনসংখ্যার ১২ ভাগ আলাওয়াইটস জনগোষ্ঠীই একচেটিয়াভাবে ভোগ করত সরকারি সুযোগ-সুবিধা চাকরি-বাকরিÑসবকিছু। অন্য মতাবলম্বী ও গোষ্ঠীগুলোকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বঞ্চিত রাখা হতো সরকারি কাজ-কর্মে। বিশেষত সুন্নি আরবদের। সংখ্যাগরিষ্ঠ এ জনগোষ্ঠী ছিল সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার। সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে তো বঞ্চিত রাখা হতোই, উপরন্তু পান থেকে চুন খসলেই তাদের ওপর নেমে আসত অকথ্য নির্যাতনের খড়গ।
নুসায়রি সম্প্রদায় ভয়ানক প্রকৃতির শিয়া। সুন্নি মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ তাদের রক্তের সাথে মেশানো। বাথ পার্টির প্রধান সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ এ গোত্রেরই লোক। সুন্নি নাগরিকদের নির্যাতনের বেলায় তাঁর প্রশাসন কোনো প্রকারের ছাড় দেয় না। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সুন্নি, তাই বাসার ও তাঁর প্রশাসনের প্রতি দীর্ঘদিনের একটা ক্ষোভ চাপা ছিল সিরিয়ার প্রতিটি জনপদে। সময় ও সুযোগের বৈরিতার দরুণ সে-ক্ষোভ বিস্ফোরিত হওয়ার সাহস পাচ্ছিল না।
চলমান গৃহযুদ্ধের সূচনা যেভাবে
২০১০-এর শেষ দিক। আরবের বিভিন্ন দেশে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছে। আরব বসন্ত নামের এ গণআন্দোলনে আরববিশ্বের শাসকদের অবস্থা তখন টলটলায়মান। সিরিয়া তখনও শান্ত ছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেছিলেন, আরব বসন্তের উত্তপ্ত এ হাওয়া বোধহয় সিরিয়াকে স্পর্শ করতে পারবে না। কারণ বাসার আল আসাদ চার দশক ধরে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করছিলেন পুরো সিরিয়াকে। সরকার-বিরোধী সামান্য কোনো আভাস কারো কাছে পেলেই তাকে জেলে পুরেছেন। চালিয়েছেন সীমাহীন জুলুম। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের এ ধারণা ভুল প্রমাণ করে অল্পদিনের ভেতর আরব বসন্তের লু হাওয়া সিরিয়ার পরিস্থিতিকেও উত্তপ্ত করে তোলে।
২০১১-এর মার্চের মাঝামাঝি সময়। সিরিয়ান পুলিশ দেওয়ালে দেওয়ালে সরকার-বিরোধী ¯েøাগান লেখার অপরাধে কয়েক কিশোরকে গ্রেপ্তার করে তাদের ওপর অত্যাচার চালায়। এর প্রতিবাদে আরও কিছু তরুণ রাজপথে নেমে আসে। শুরু করে বিক্ষোভ। তাদের সাথে যোগ দেয় আপামর জনতা। সরকারি বাহিনী শক্তহাতে তাদের দমন করার চেষ্টা চালায়। বিক্ষোভ চলাকালেই শুরু করে অবিরাম গুলিবর্ষণ। ঘটনাস্থলে মারা যায় বিক্ষোভকারীদের বেশ কয়েকজন। আহত হয় অনেকেই। ব্যাস। এখান থেকেই সূচনা। দাবানলের মতো এ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেশে।
এতদিনকার ভয়-ভীতি আর আতঙ্ককে ঝেড়ে ফেলে সিরিয়ার প্রতিটা শহরের রাজপথে নেমে আসে আপামর জনতা। তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাসারের নেতৃত্বাধীন বাথ পার্টির শাসনের বিরুদ্ধে। বিক্ষোভ চলতে থাকে শহরে শহরে, প্রতিটা জনপদে। বাসার আল-আসাদের সিংহাসনের ভীত নড়ে ওঠে এ বিক্ষোভে। ক্ষমতার মোহে অন্ধ বাসারের নৃশংসতার নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয় তখন। সাধারণ জনতার মুকাবিলায় তিনি সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে দেন। সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দেয় বাসারের অনুগত নুসায়রিদের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী গ্রæপগুলোও। বাসারের যৌথ এ বাহিনী ট্যাঙ্ক-কামান, আর্টিলারি ও হেলিকপ্টার গানশিপ নিয়ে পুরো দেশে একযোগে অপারেশন চালায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে। বিদ্রোহীরাও ততদিনে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। যদিও সরকারি বাহিনীর তুলনায় তা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল, তারপরও তারা এ দিয়েই মুকাবেলা করে। সরকারি বাহিনী নির্বিচারে আক্রমণ করতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। কোনো বাছবিচার ছাড়াই। ফলে বিদ্রোহীদের মৃত্যুর সারি ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে। মাত্র তিন মাসের মাথায়, ২০১১-এর জুলাই নাগাদ প্রায় ১৬ হাজার বিক্ষোভকারী প্রাণ হারায় আসাদ-বাহিনীর হাতে।
এত এত প্রাণহানির পরেও বিদ্রোহীরা দমে থাকে না। বরং নিহতদের রক্ত ছুঁয়ে শপথ করে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে তারা। এরই ভেতর আসাদ সরকারের অধীনে থাকা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনাসদস্য সরকারের অধীনতাকে অস্বীকার করে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। আন্দোলন আরও বেগবান হয়। সরকারি বাহিনীর নৃশংসতাও চলতে থাকে সমানতালে।
বিদ্রোহী সেনাসদস্যরা সরকারের কমান্ড থেকে বেরিয়ে এসে সমস্ত বিদ্রোহীদের নিয়ে ২০১১-এর জুলাই মাসেই একটি সশস্ত্র সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করায়। নাম দেয় ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। তাদের মূল লক্ষ্য বাসার-সরকারের পতন।
ফ্রি সিরিয়ান আর্মির আবির্ভাবের মধ্য দিয়েই সূচনা হয় চলমান দীর্ঘ এ গৃহযুদ্ধের। চলতে থাকে সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী ভয়ানক লড়াই।
যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ
সিরিয়ার চলমান এ সংঘাতে পক্ষ-বিপক্ষ নির্ণয় আপাতদৃষ্টিতে এক জটিল কাজ। কে লড়ছে কার পক্ষে, কে কার প্রতিপক্ষÑসমীকরণ করাটা মুশকিলই বটে। কারণ, গৃহযুদ্ধ লাগার সাথে সাথে রীতিমাফিক বহির্বিশ্ব এসে হাজির। রাশিয়া, চীন এবং ইরান তাদের দীর্ঘ দিনের মিত্র বাসার আল-আসাদের পক্ষে। লেবাননের শিয়াদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিজবুল্লাহও আছে তাদের সঙ্গে। ২০১৫ সালে বিদ্রোহীদের ওপর হামলার মাধ্যমে রাশিয়া প্রত্যক্ষভাবে অনুপ্রবেশ করে সিরিয়ার এ লড়াইয়ে।
আমেরিকা, ইসরায়েল, সৌদি আরব, কাতার ও ন্যাটোভূক্ত দেশগুলো সমর্থন দিয়েছে বিদ্রোহীদের। কিন্তু বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটর্ফম ফ্রি সিরিয়ান আর্মি হওয়া সত্তে¡ও তাদের মধ্যে আছে নানা মতপার্থক্য ও বিরোধ। এর সূত্র ধরে আছে অসংখ্য দল-উপদল। যার সংখ্যা শয়েরও অধিক। এরমধ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বাড়তি ফোঁড়া হয়ে আবির্ভাব ঘটে আইএস-এর। স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের জন্য সিরিয়ার কুর্দিরাও মাঠে নামে। আছে সুন্নি মুজাহিদিনদের সংগঠন জাবহা আন-নুসরাও। এরা সবাই বাসার সরকারের পতন চায়, কিন্তু আদর্শ ও উদ্দেশ্যগত পার্থক্যের কারণে একদল আরেক দলের ঘোর বিরোধী। বাসার সরকারের বিরুদ্ধে সবাই যেমন লড়ছে, তেমন এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধরছে।
আইএস
আমেরিকা সিরিয়ার এ লড়াইয়ে প্রত্যক্ষভাবে নিজেদের জড়ানোর কোনো অজুহাত খুঁজে পাচ্ছিল না। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অনুপ্রবেশের একটা ছুঁতো বের করার জন্য আমেরিকাই আইএস-এর জন্ম দিয়েছে।
আইএস-নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি হকপন্থী মুজাহিদিনদের কমান্ডিংয়েই প্রথমে কাজ করতেন ইরাকে। ২০১৩ সালে এসে দীর্ঘদিনের মনোমালিন্যের অজুহাতে তিনি পল্টি নেন। ছিন্ন করেন তাঁদের সাথে সব সম্পর্ক। এবং নিজেকে খলিফা ঘোষণা করে জিহাদের নামে ধ্বংসাত্মক সব কাণ্ডকারখানা শুরু করেন। কেউ তাঁর আনুগত্যকে অস্বীকার করলে তাঁকে মুরতাদ অভিহিত করে শিরোñেদের বন্দোবস্ত করেন। ইরাকে হকপন্থী অনেক মুজাহিদসহ সাধারণ মানুষ শিকার হতে থাকেন তাঁর এ নৃশংসতার। কিছুদিনের ভেতর এ নৃশংসতার ব্যাপৃতি ঘটান সিরিয়াতেও। সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধের ভেতর তিনি তাঁর ‘খেলাফত’কে বিস্তৃত করার প্রয়াস চালান। এখানে এসেও তিনি তাঁর ‘মুরতাদ’নীতিতে অটল থাকেন। আসাদ-সরকারের বিরুদ্ধে অসংখ্য লড়াকু যোদ্ধা–যারা তাঁর আনুগত্য অস্বীকার করেছেন, সবাইকে বিনা বিচারে শিরোñেদ করতে থাকেন। তাঁদের ঘর-বাড়ি পোড়িয়ে স্ত্রী-সন্তানদের গোলাম-বাঁদি বানিয়ে নিয়ে যায় তাঁর সৈন্যরা। এমনকি বেসামরিক নাগরিকদের ওপরওÑযারা আইএসের আনুগত্য করতে রাজি হয় না–সবার শিরোশ্ছেদ করা হতে থাকে একই কায়দায়। আবার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধেও তারা লড়তে থাকে সমানতালে।
এভাবে সিরিয়ার ভূমিতে আইএস সক্রিয় হতেই আমেরিকা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ করার যুৎসই একটা অজুহাত পেয়ে যায়। ন্যাটোভূক্ত দেশগুলো নিয়ে ২০১৪ সালে আইএস নির্মূলের নাম করে সে সিরিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। আইএস তাড়ানোর নামে সিরিয়ার বিভিন্ন জনপদে শুরু করে বিমান হামলা। যার নির্মম শিকার হয় জনপদগুলোর নীরিহ বাসিন্দারা।
বিদ্রোহীদের মধ্যে প্রধানত তিনটি গ্রæপ। একটি হলো সেক্যুলার ও সেক্যুলার ভাবাপন্ন। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি মূলত এদের নেতৃত্বেই। এদের উদ্দেশ্য বাসার সরকারের পতন এবং সিরিয়ায় পশ্চিমাদের অনুগত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। আমেরিকা, ইসরায়েল, সৌদি আরব ও ন্যাটোভূক্ত অন্যান্য দেশ মূলত এদেরকেই সাহায্য করছে। সরকারের পতন ঘটাতে পারলে তারা এদেরকেই ক্ষমতায় বসাবে।
কুর্দি বাহিনী
বিদ্রোহীদের আরেকটি গ্রæপ হলো কুর্দিদের। তারা লড়াই করছে সিরিয়ায় নিজেদের একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। আমেরিকা ও ন্যাটোভূক্ত অন্যান্য রাষ্ট্র সহায়তা করলেও তুরস্ক এদের ঘোর বিরোধী। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার সরাসরি বিমান হামলাও চালিয়েছে তারা কুর্দিদের ওপর। কারণ তুরস্কে দীর্ঘদিন যাবৎ সেখানকার কুর্দিরা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম করছে। সিরিয়ায় তারা স্বাধীন কোনো এলাকা পেয়ে গেলে তুরস্কে তাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম আরো বেগবান হবে। তাই তুরস্ক কোনো অবস্থাতেই চায় না, কুর্দিরা এখানে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করুক। ফ্রি সিরিয়ান আর্মিও কুর্দিদের বিরোধী। তুরস্কের সহায়তায় কুর্দি অধিকৃত এলাকাগুলোতে তারাও হামলা চালায়।
জাবহা আন-নুসরাহ
২০১১-এর আগস্ট মাসের ঘনঘনে এক দুপুর। ইরাক-সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দুইটি পিকআপ ভ্যান। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ভ্যানদুটোকে সাধারণ বেসামরিক গাড়ি মনে হলেও স্থানীয়রা জানে এগুলো কাদের এবং কী উদ্দেশ্যে এখানে চলাচল করে। এরা বিদ্রোহীদের একটি গ্রæপ। আর সব বিদ্রোহীদের থেকে এদের চাল-চলন ভিন্ন। আচার-ব্যবহার আলাদা। অমায়িক। মানুষের সাথে তারা সহজেই মিশে যায়। সাধারণ মানুষের যেকোনো সমস্যায় ত্রাতা হয়ে হাজির থাকে সবার আগে। মানুষের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বিষাদ ভাগাভাগি করে নিজেদের মধ্যেও। স্থানীয়রা তাই এদের দেখে আলাদা একটা ভক্তি ও ভালবাসার চোখে। গ্রæপটি সীমান্তের এই রুট দিয়েই ইরাক থেকে অস্ত্র কিনে নিয়ে আসে। বিভিন্ন পয়েন্টে সাধারণত এসব ভ্যান থাকে অস্ত্র-বোঝাই ট্রাককে নিরাপদে সিরিয়ার ভেতর নিয়ে আসার জন্য প্রহরী হিসেবে।
কিন্তু আজকের ব্যাপারটি ভিন্ন। স্থানীয়দের এ ব্যাপারে জানার কথা না। আজ তারা অস্ত্রের চালান রিসিভ করতে আসেনি। বিশ্ব জিহাদের অধীনে ইরাক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতাকে পাঠানো হয়েছে সিরিয়ার বিদ্রোহী এই গ্রæপটির নেতৃত্বের জন্য। তারা এসেছে তাঁকে রিসিভ করে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে। ঘণ্টাখানেক পর ছোট্ট একটি গাড়িবহর এসে থামল ইরাক সীমান্তে। গাড়ি থেকে নেমে এলেন কাক্সিক্ষত সেই নেতা। নাম তাঁর আবু মুহাম্মদ আল-জাওলানি। বিদ্রোহী গ্রæপটি তাদের নতুন এ নেতাকে রিসিভ করে নিয়ে গেল ক্যাম্পে।
আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহীদের মধ্যে তারা ছিল শক্তিশালী একটি গ্রæপ। সিরিয়ার এ লড়াইকে তারা ধর্মযুদ্ধ হিসেবেই গ্রহণ করেছিল। তাদের মূল শিকড় জিহাদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ই’লায়ে কালিমাতুল্লাহ যাদের মূল লক্ষ্য। এতদিন ধরে আসাদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে গেলেও তাদের গোছালো কোনো সাংগঠনিক রূপ ছিল না। জাওলানির আগমনের পাঁচ মাসের মাথায় নিজেদের সুসংগঠিত একটি কাঠামো দাঁড় করায় তারা। এর নামই জাবহা আন-নুসরাহ। মিডিয়া যাকে নুসরাহ ফ্রন্ট নামে চিহ্নিত করে।
নুসরাহ ফ্রন্ট অল্প দিনেই বিদ্রোহীদের শক্তিশালী একটি গ্রæপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। একদিকে আসাদ-বাহিনীর বিরুদ্ধে যেমন তারা লড়ে যাচ্ছিল বীরত্বের সাথে, তেমন নৃশংসতার শিকার হচ্ছিল আইএস-এর হাতে। তাদের অসংখ্য নেতাকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে আইএস ভয়ানক কায়দায় শিরোশ্ছেদ করে। আবার ইসরাইল ও আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটোভূক্ত দেশগুলোও ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র মুলো ঝুলিয়ে তাদের দখলকৃত এলাকায় বিমান হামলা চালাতে থাকে দেদারসে। সৌদি আরব, তুরস্কসহ অনেক মুসলিম দেশ এ হামলাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। রাশিয়া, ইরান, হিজবুল্লাহ আসাদের পক্ষ হয়ে তো আর আক্রমণ করছেই। চতুর্মুখী এ আক্রমণকে তারপরও নুসরাহ ফ্রন্টের বিদ্রোহীরা বীরত্বের সাথে মুকাবেলা করে যাচ্ছে।
হামলা, প্রতিরোধ আর যুদ্ধের পাশাপাশি নুসরাহ ফ্রন্ট সাধারণ জনগণের সুখ-দুঃখও দেখ-ভাল করে যথাসম্ভব। এজন্য তাদের আলাদা একটা ইউনিট আছে। সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা, আহতদের শুশ্রæষা, তাদের মধ্যে খাবার বিতরণ, পুনর্বাসন ইত্যাদি সেবামূলক কর্মকাণ্ডে এ ইউনিট ব্যস্ত থাকে সবসময়। এ কারণে স্থানীয় মানুষজনের কাছে নুসরাহ ফ্রন্টের আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে সেই শুরু থেকেই।
সিরিয়ার চলমান এ লড়াইকে ভয়ানক করে তোলার জন্য যেমন দায়ী রাশিয়া-ইরান, তেমন দায়ী আমেরিকা ও ন্যাটোভূক্ত দেশগুলোও। প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভৌগোলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে সিরিয়াকে সবাই চায় নিজেদের করায়ত্বে রাখতে। লড়াইয়ে অংশগ্রহণের পেছনে সকলেরই আছে ছোট-বড় নানা স্বার্থ। কার কী স্বার্থ এবার একটু দেখা যাক।
রাশিয়া
মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ইরান এবং সিরিয়ার বাসার-সরকার। সহজ করে বললে শিয়াদের সাথেই তাদের যত দহরম-মহরম। সিরিয়ায় যদি বাসার-সরকারের পতন ঘটে তবে দেশটি চলে যাবে আমেরিকা ও ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। তাই গৃহযুদ্ধের একদম সূচনা থেকেই রাশিয়া বাসারের পক্ষে আছে। যেমন যুদ্ধের ময়দানে তেমন জাতিসংঘেও। ২০১২ সালে বাসার বাহিনী যখন কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিল রাশিয়া তখন এগিয়ে না এলে আসাদ হয়তো এখন কারাগেরর অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিন গুজরান করতেন।
বাসার আল-আসাদ বর্তমানে তুলনা মূলক ভালো অবস্থানেই আছেন, আর এটা সম্ভব হয়েছে রাশিয়ার সহায়তার কারণেই।
ইরান
ইরানের স্বার্থ তো স্পষ্টই। ইরান শিয়া নিয়ন্ত্রিত একটি রাষ্ট্র। আর বাসার আল-আসাদ শিয়াদেরই একটি কবিলার লোক। তা ছাড়া ইসরাইলের সবচেয়ে বড় শত্রæ ইরান। আবার সৌদি আরবের সাথেও ইরানের ঐতিহাসিক বৈরিতা। আর বাসার আল-আসাদ এ দুটো রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী। এদিকে ইসরাইলকে হয়রান রাখতে লেবাননের শিয়া গেরিলা গোষ্ঠী হিজবুল্লাহকে ব্যবহার করে ইরান। হিজবুল্লাহকে অস্ত্র-শস্ত্র এবং রসদ পাঠাতে সিরিয়ার ভূমি তাদের ব্যবহার করতে হয়। এসব নানাবিধ কারণে ইরান তার সৈন্য ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সর্বাত্মক সহায়তা করে আসছে বাসার আল-আসাদকে। পাশাপাশি সহায়তা করছে ইরানের অনুগত গেরিলা সংগঠন হিজবুল্লাহও।
ইসরাইল ও আমেরিকা
সিরিয়ার বাথ পার্টির সঙ্গে ইসরাইলের শত্রæতা তার জন্ম থেকেই। আর ইসরাইলের শত্রæতা মানে আমেরিকারও শত্রæতা। বাসার আল-আসাদের পিতা সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদ ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আগ্রাসী তৎপরতার জবাবে বেকা উপত্যকায় ৩০ হাজার সিরিয়ান সৈন্য মোতায়েন করেছিলেন। বেশ কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছিল ইসরাইলের সঙ্গে এ বাহিনীর। প্রেসিডেন্ট হাফিজের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন বাসার আল-আসাদ। পিতার মতো তিনিও ইসরাইলের বিরুদ্ধে চরম শত্রæতা রাখেন। ফিলিস্তিনের হামাস ও লেবাননের হিজবুল্লাহকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে নানা সহযোগিতা করেন। বাসারকে তাই ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ইসরাইল ও আমেরিকা অন্তত তিনবার সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনোবারই পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে কথা বলেনি। ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের জন্য দুটো দেশ হুমকি হয়ে আছে। ইরান ও সিরিয়া। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের এই ফাঁকে আসাদকে সরিয়ে নিজেদের পছন্দমতো কাউকে বসিয়ে দিতে পারলে সিরিয়া নিয়ে তাদের আর মাথা ঘামাতে হবে না। মূলত এ কারণেই ইসরাইল ও আমেরিকা বাসারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করছে।
সৌদি আরব
এই দেশটি তো আর পশ্চিমাদের হাতের পুতুল। আমেরিকা যা শিখিয়ে দেবে তোতা পাখির মতো সে তা-ই বলবে। সিরিয়ার যুদ্ধে আমেরিকা-ইসরাইল বাসার-বিরোধী, ব্যাস, বাসারের বিরোধিতার জন্য এরচেয়ে বড় কারণের আর প্রয়োজন নেই তাদের। এখন তারা এই খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন পেট্টোডলার খরচ করতেও কোনো পরোয়া করবে না।
অবশ্যি এর বাইরে কারণ আরও আছে। বাসার শিয়া আর সৌদি সুন্নি মতাদর্শে বিশ্বাসী। আর শিয়া-সুন্নি দ্ব›দ্ব মধ্যেপ্রাচ্যে বহু পুরোনো।
কাতার
কাতারও শিয়া-সুন্নি দ্ব›েদ্বর জের ধরে বাসারের বিরুদ্ধে সহায়তা করছে বিদ্রোহীদের। এর বাইরে বাসারের পতনের জন্য তাদের এ প্রচেষ্টার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। কাতার পারস্য উপসাগর থেকে সিরিয়ার ভেতরদিয়ে তুরস্ক ও ইউরোপে গ্যাস-পাইপ-লাইন নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রাশিয়ার স্বার্থ চিন্তা করে বাসার আল-আসাদ তাদের এ চাওয়া পূর্ণ করছেন না। কারণ, এতে রাশিয়ার ওপর থেকে ইউরোপের গ্যাস-নির্ভরতা ¤øান হয়ে যাবে। বাসারের পতন ঘটাতে পারলে নতুন সরকার হয়তো কাতারকে গ্যাস-লাইন টানার অনুমতি দেবেÑএ আশা থেকে তারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে বিদ্রোহীদের সাহায্যের জন্য।
তুরস্ক
তুরস্ক আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের সাথে ন্যাটো জোটভূক্ত। শুরু থেকেই তারা আসাদ-বিরোধী বিদ্রোহী ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে এরদোগান প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হবার পর রাশিয়ার সাথে সম্পর্কোন্নয়নের সুবাদে আসাদ-বিরোধী মনোভাব কিছুটা পাল্টে যাচ্ছে তুরস্কের। বর্তমানে সিরিয়াযুদ্ধে তুরস্কের মূল লক্ষ্য স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের দমন করা। কারণ, কুর্দিরা এখানে স্বাধীনতা পেলে তুরস্কের সংগ্রামী কুর্দিদের শক্তি ও আশ্রয়ের কেন্দ্রবিন্দু হবে এটা। তুরস্ক কোনোভাবেই চায় না, এমনটা হোক।
কী অপেক্ষা করছে সিরিয়ার ভাগ্যে?
সিরিয়ার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে, এখনই বলা মুশকিল। কোনো পক্ষই কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। সরকারি বাহিনী কিংবা বিদ্রোহীÑদুপক্ষেরই অন্তত দুই লাখ করে সদস্য এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে। তাই, এক পক্ষ আরেক পক্ষের প্রতি নরম হওয়ার কোনো মানসিকতা নেই। সেই সাথে নানা দেশের নানা স্বার্থ তো আর আছেই। মধ্যস্থতা করার মতোও নেই কেউ। যারা মধ্যস্থতা করবে, স্বয়ং তারাই তো জড়িত এ লড়াইয়ে।
বর্তমানে বিদ্রোহীদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে আসাদ-বাহিনী। কিন্তু আসাদ-বাহিনীর বড় সমস্যা জনবল। পুরো সিরিয়া নিয়ন্ত্রণ করার মতো এত লোক আসাদ-বাহিনীর নেই। ফলে এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাশিয়া ও ইরানের ওপর ক্রমশ তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে নানা দল-উপদল থাকায় তাদের মাঝে ঐক্যের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। বলতে গেলে তাদের একক কোনো নেতাও নেই। নেতৃত্ব ও ঐক্যের অভাবে তারা এখন অনেকটা কোণঠাসা। আইএস-এর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। যুদ্ধে সবচেয়ে বড় পরাজয় ঘটেছে তাদের। তাদের অনেক এলাকা এখন কুর্দিদের দখলে। আমেরিকার সহায়তার কারণে কুর্দিদের অবস্থান বেশ শক্ত এখন।
আসাদ-বাহিনী যদি সিরিয়ার পুরো এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েও নেয়, দেশটিতে তবুও শান্তি আসবে বলে মনে হয় না। কারণ, পরাজয়ের পর বিদ্রোহীরা থেমে যাবে না। সম্মুখ যুদ্ধের পরিবর্তে তখন তারা চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নেবে। আবার কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তুরস্কের হামলাও অব্যাহত থাকবে। কারণ, তুরস্ক কুর্দিদের স্বাধীন কোনো অঞ্চল থাকুকÑএটা কোনোভাবেই মেনে নেবে না। আর বিশ্বমোড়লরাও চাইবে না, সিরিয়ার মানুষ শান্তিতে থাকুক। কারণ, এটা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ। মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ীভাবে অশান্তি বিরাজমান থাকুক, এটাই তো তাদের চাওয়া।
সুতরাং জটিল এ পরিস্থিতি থেকে সিরিয়া কবে বেরিয়ে আসবে, লাখো শরণার্থী কবে ফিরতে পারবে আপন-ভিটে মাটিতে, কবে দু’দণ্ড শান্তিতে ঘুমোতে পারবে সংখ্যগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত সিরিয়ার সাধারণ মানুষ, কবে স্বাভাবিক হবে তাদের যাপিত জীবনÑবিশ্ব নিয়ন্তা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এই জিজ্ঞাসার সম্ভাব্য জবাবটাও আর কেউ দিতে পারবে না।
নবধ্বনি, মে ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত