নিজ প্রাসাদে বন্দী অবস্থায় কাটানো জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাদ্দাম হোসাইনের সার্বক্ষণিক পাহারায় নিযুক্ত ছিলেন ১২ জন মার্কিন সৈন্য। মার্কিন ৫৫১ নম্বর মিলিটারি পুলিশ কোম্পানির ওই ১২ সেনাসদস্যকে ‘সুপার টুয়েলভ’ বলে ডাকা হতো। গ্রেফতার হওয়ার আগে তাঁরা যে সাদ্দামের ‘বন্ধু’ ছিলেন, সেটা মোটেই নয়। কিন্তু সাদ্দামের শেষ সময়ে তাঁদের সঙ্গে তাঁর দারুণ এক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহূর্ত অবধি কেবল তাঁরাই ছিলেন সাদ্দামের নিত্যসঙ্গী।
সুপার টুয়েলভের একজন, উইল বার্ডেনওয়ার্পার একটি বই লিখেছেন, ‘দ্য প্রিজনার ইন হিজ প্যালেস, হিজ অ্যামেরিকান গার্ডস অ্যান্ড হোয়াট হিস্ট্রি লেফট আনসেইড’ নামে। বাংলা করলে বইটির নাম হতে পারে ‘নিজের প্রাসাদেই এক বন্দী, তাঁর আমেরিকান প্রহরীÑইতিহাস যে কথা বলেনি’। সম্প্রতি অভিজাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নবপ্রকাশ ‘সাদ্দাম হোসাইন : জীবনের শেষ দিনগুলো’ নামে বইটির বাংলা অনুবাদ বের করেছে।
বইটি জুড়ে রয়েছে সাদ্দাম হোসাইনকে তাঁর শেষ সময় পর্যন্ত সুরক্ষা দেওয়ার অভিজ্ঞতা। বার্ডেনওয়ার্পার স্বীকার করেছেন, তাঁরা যখন সাদ্দাম হোসেনকে জল্লাদদের হাতে তুলে দিলেন ফাঁসির জন্য, তখন তাঁদের ১২ জনেরই চোখে পানি এসে গিয়েছিল।
বার্ডেনওয়ার্পার তাঁরই এক সেনা-সঙ্গী রজারসনকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘আমরা কখনও সাদ্দামকে মানসিক বিকারগ্রস্ত হত্যাকারী হিসেবে দেখিনি। তাঁর দিকে তাকালে নিজের দাদুর মতো লাগত অনেক সময়।’
বন্দী থাকাকালীন নিজের এক্সারসাইজ বাইকে চড়তে পছন্দ করতেন সাদ্দাম। বাইকটির নাম দিয়েছিলেন ‘পনি’। মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসতেন। মাঝেমধ্যেই মাফিন খেতে চাইতেন।
বার্ডেনওয়াার্পার লিখেছেন, নিজের জীবনের শেষ দিনগুলোতে সাদ্দাম তাঁদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতেন। ওই ব্যবহার দেখে বোঝাই যেত না, সাদ্দাম হোসাইন কোনো এক সময়ে একজন অত্যন্ত নিষ্ঠুর শাসক ছিলেন।
সাদ্দামের ‘কোহিবা’ সিগার খাওয়ার খুব নেশা ছিল। মনে করা হয় কিউবার সিগারের মধ্যে এই ‘কোহিবা’ সবার চেয়ে সেরা সিগারগুলোর অন্যতম। ভেজা ওয়াইপে জড়িয়ে একটা বাক্সের মধ্যে রাখা থাকত সিগারগুলো। সাদ্দাম নিজেই বলেছিলেন, বহু বছর আগে ফিদেল কাস্ত্রো তাঁকে সিগার খাওয়া শিখিয়েছিলেন।
সিগার ছাড়াও বাগান করা আরেকটা শখ ছিল সাদ্দাম হোসাইনের। জেলের ভেতরে অযতেœ ফুটে থাকা জংলী ঝোপঝাড়গুলোকেও তিনি একটা সুন্দর ফুলের মতো মনে করতেন।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন সাদ্দাম। সকালের নাস্তাটা তিনি কয়েকটা ভাগে খেতেনÑপ্রথমে অমলেট, তারপর মাফিন আর শেষে তাজা ফল। ভুল করেও যদি তাঁর অমলেটটা টুকরো হয়ে যেত, সেটা তিনি খেতে আপত্তি জানাতেন।
বার্ডেনওয়ার্পার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে লিখেছেন, একবার সাদ্দাম তাঁর ছেলে উদয় কতটা নিষ্ঠুর ছিল, সেটা বোঝাতে গিয়ে বীভৎস একটা ঘটনার কথা বলেছিলেন। ওই ব্যাপারটায় সাদ্দাম প্রচÐ রেগে গিয়েছিলেন। উদয় কোনো একটা পার্টিতে গিয়ে গুলি চালিয়ে দিয়েছিল। তাতে বেশ কয়েকজন মারা গিয়েছিলেন। গুলিতে আহত হয়েছিলেন আরও কয়েকজন। সাদ্দাম ব্যাপারটা জানতে পেরে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, উদয়ের সবক’টা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে। ওই ঘটনাটা বলতে গিয়ে সেনা প্রহরীদের সাদ্দাম ভীষণ রেগে গিয়ে শুনিয়েছিলেন যে, উদয়ের দামী রোলস রয়েস, ফেরারি, পোর্শা গাড়িগুলোতে তিনি আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
সাদ্দাম হোসাইনের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত আমেরিকান সেনারাই তাঁকে একদিন জানিয়েছিলেন যে, তাঁর ভাই মারা গেছেন। যে সেনাসদস্য খবরটা দিয়েছিলেন, সাদ্দাম তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে তুমিই আমার ভাই।’ আরেকজন প্রহরীকে বলেছিলেন, ‘যদি আমার সম্পত্তি ব্যবহার করার অনুমতি পাই, তাহলে তোমার ছেলের কলেজে পড়তে যা খরচ লাগবে, সব আমি দেব।’
এক রাতে বছর কুড়ি বয়সের সেনা প্রহরী ডসন বাজে মাপে কাটা একটা স্যুট পরে ঘুরছিল। জানা গেল যে, ডসনকে ওই স্যুটটা সাদ্দাম উপহার হিসাবে দিয়েছেন। বার্ডেনওযার্পারের কথায়, ‘বেশ কয়েকদিন আমরা সবাই ডসনকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম ওই স্যুটটার জন্য। ওটা পরে ও এমন ভাবে হাঁটাচলা করত, যেন মনে হতো কোনো ফ্যাশন শোয়ে ক্যাটওয়াক করছে ডসন।’
সাদ্দাম আর তাঁর প্রহরীদের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশ ঘন হয়ে উঠেছিল, যদিও তাদের ওপরে কড়া নির্দেশ ছিল যে, সাদ্দামের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টাও যেন কেউ না করে।
সাদ্দাম হোসাইনকে মামলা চলা চলার সময় দুটো জেলে রাখা হয়েছিল। এক জেল ছিল আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কয়েদখানা, আর অন্যটা উত্তর বাগদাদের সাদ্দামেরই একটা প্রাসাদ। ওই প্রাসাদটা ছিল একটা দ্বীপে। একটা সেতু পেরিয়ে সেখানে যেতে হতো।
বার্ডেনওয়ার্পার লিখেছেন, ‘আমরা অবশ্য সাদ্দামকে এমন কিছু দিইনি, যেটা তিনি পাওয়ার অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু ওঁর অহংবোধে কখনও আঘাত করতাম না আমরা।
একবার সাদ্দাম হোসাইনকে একটা চমক দেওয়ার ইচ্ছা হলো সুপার টুয়েলভের। পুরনো, ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র থেকে একটা ছোট টেবিল আর চামড়ার ঢাকনা দেওয়া একটা চেয়ার নিয়ে আসা হলো। টেবিলের ওপরে ইরাকের একটা ছোট পতাকাও রাখা হলো। বার্ডেনওয়ার্পারের ভাষায়, ‘আমরা চেষ্টা করেছিলাম জেলের ভেতরেই সাদ্দামের জন্য শাসনকাজ পরিচালনার মতো একটা অফিস তৈরি করতে। যখন সাদ্দাম ওই ঘরটায় প্রথমবার গিয়েছিলেন, একজন সেনা সদস্য হঠাৎই খেয়াল করল, টেবিলের ওপরে ধুলো জমে আছে। সে ধুলো ঝাড়তে শুরু করে।’
ওই আচরণটা সাদ্দামের নজর এড়ায়নি। চেয়ারে বসতে বসতে তিনি মুচকি হেসেছিলেন। তারপর থেকে তিনি রোজ ওই চেয়ারে এসে বসতেন। তাঁর নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত সেনাপ্রহরীরা সবাই সামনের চেয়ারগুলোতে বসতেন। যেন সাদ্দাম নিজের দরবারে বসেছেন।
নিরাপত্তা রক্ষীরা চেষ্টা করতেন সাদ্দামকে খুশি রাখতে। তার বদলে সাদ্দামও সকলের সঙ্গে হাসি-মস্করা করতেন। কয়েকজন রক্ষী পরে বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন যে, তাঁরা বিশ্বাস করতেন, ‘যদি তাদের কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়, তাহলে সাদ্দাম তাঁদের বাঁচানোর জন্য নিজের জীবনও বাজি রেখে দিতে পারেন।’
যখনই সময়-সুযোগ পেতেন, তখনই সাদ্দাম হোসাইন পাহারার দায়িত্বে থাকা রক্ষীদের পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। বার্ডেনওয়ার্পারের বইটাতে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যে বিষয়টার উল্লেখ রয়েছে, সেটা হলো, সাদ্দামের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রহরীরা রীতিমতো শোক পালন করেছিলেন, যদিও তিনি আমেরিকার কট্টর শত্রæ ছিলেন। প্রহরীদেরই একজন, অ্যাডাম রজারসন উইল বার্ডেনওয়ার্পারকে বলেছিলেন, ‘সাদ্দামের ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পরে আমার মনে হচ্ছে আমরা ওঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। নিজেদেরই এখন তাঁর হত্যাকারী বলে মনে হচ্ছে। এমন একজনকে মেরে ফেললাম আমরা, তিনি যেন আমাদের খুব আপনজন ছিলেন।’
সাদ্দামের ফাঁসির পর যখন তাঁর মরদেহ বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন সেখানে জমা হওয়া লোকজন মৃতদেহের ওপর থুতু ছিটানো শুরু করে। দৃশ্যটা দেখে হতভম্ব হয়ে যান সুপার টুয়েলভ আমেরিকান সেনারা। বার্ডেনওয়ার্পার লিখেছেন, ‘ওই নোংরামি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা সবাই, বিশেষ করে যে ১২ জন তাঁর শেষ সময়ে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।’ তাঁদের মধ্যে একজন ওখানে জমা হওয়া লোকজনের কাছে হাতজোড় করে তাদের থামাতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দলের বাকিরা তাঁকে টেনে সরিয়ে নেয়।
ওই ১২ জনের অন্যতম, স্টিভ হাচিনসন সাদ্দামের ফাঁসির পরপরই আমেরিকার সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন। তিনি এখন জর্জিয়ায় বন্দুক চালনা আর টেকনিক্যাল ট্রেনিং দেওয়ার কাজ করেন। তাঁর মনে এখনও ক্ষোভ রয়েছে, কারণ সেদিন যেসব ইরাকি সাদ্দামের মৃতদেহকে অপমান করেছিল, তাদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে না পড়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের।
২০০৬ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ঈদুল আজহার দিনে সাদ্দাম হোসাইনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ৩০শে ডিসেম্বর রাত তিনটে নাগাদ তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়েছিল। জানানো হয়েছিল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এই কথাটা শোনার পর সাদ্দামের মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। তিনি শান্ত স্বাভাবিকভাবে চুপচাপ গোসল করে ফাঁসির জন্য তৈরি হয়ে নেন।
সেই সময়েও তাঁর একটা ভাবনা ছিল। জানতে চেয়েছিলেন, ‘সুপার টুয়েলভের সদস্যরাও কি ঘুমোচ্ছে?’
ফাঁসির কয়েক মিনিট আগে স্টিভ হাচিনসনকে কারাকক্ষের বাইরে ডেকে পাঠান সাদ্দাম হোসেন। লোহার শিকগুলোর মধ্য দিয়ে হাতটা বের করে নিজের রেমন্ড ওয়েইল হাতঘড়িটা দিয়ে দেন স্টিভকে। হাচিনসন আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু সাদ্দাম কিছুটা জোর করেই ঘড়িটা স্টিভের হাতে পরিয়ে দেন।
জর্জিয়ায় হাচিনসনের বাড়ির একটা সিন্দুকে রাখা ঘড়িটা এখনও টিক টিক করে চলেছে বিরামহীন। আর ঘড়ির মালিক সাদ্দাম হোসাইন ইরাকের মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন নিথর-নিরালায়।
প্রতিবেদন-কৃতজ্ঞতা বিবিসি
ডিসেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত