ইতিহাসের পথিক
মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। চাঁদটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে ক্রমশ। আকাশে তারার হাট বসেছে যেন। মিটমিট করে জ্বলছে। চাঁদের হালকা আলোতে চারপাশ অস্পষ্ট ঠাহর করা যাচ্ছে। একদম পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না। দু-একটা নিশাচর পশু-পাখি দূরে কোথাও চিৎকার করছে। পূবাকাশ জুড়ে একটা সাদা আলো রেখা ছড়িয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এটা সুবহে কাজিবের আলো। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পরপর চাঁদটা মেঘের আড়ালে লুকোচ্ছে, আবার বেরিয়ে আসছে। আলো-আঁধারির এক অদ্ভুত খেলায় মেতেছে যেন পৃথিবী।
‘মুঈনুদ্দিন…!’
দশজনের একটা কাফেলা মেঘনা নদীর পাড়ে এসে থেমে গেল। সম্ভবত সুবহে সাদিক শুরু হয়ে গেছে। পূবাকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। পাখিদের কিচির-মিচির শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাড়ি-ফেরত দু-চারজন নৈশ-প্রহরী ছাড়া রাস্তায় মানুষের দেখা নেই। অবশ্য দু-একটা মালবাহী গাড়ি গড়গড় করে আসা-যাওয়া করছে খানিক পরপর। কাফেলার বড়রা জেগে উঠেছে। ফজরের নামাজ হবে।
‘মুঈনুদ্দিন…!’
গম্ভীর গলায় কাফেলার আমির আবার ডাকলেন মুঈনুদ্দিনকে। মুঈনুদ্দিন আমিরের ছোটভাই।
আমিরের বয়স পঞ্চাশের উপর হবে। গায়ে মোটা কাপড়ের অ্যারাবিয়ান জুব্বা। মাথায় পাগড়ি। পাগড়ির আঁচলে মুখের অনেকটা ঢাকা পড়ে আছে। চেহারায় তাঁর অসম্ভব দীপ্তি। সাদা চুল-দাড়ির মাঝখানে অব্যক্ত সুন্দর মুখ।
‘জি হজরত!’ মুঈনুদ্দিন জবাব দিল।
‘পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে?’
‘সূর্য উপরে ওঠার আগেই পৌঁছে যাব ইনশাআল্লাহ।’
কাফেলা আবার চলতে শুরু করল। মেঘনা নদী ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। সূর্যের আলোয় নদীর জল চমকাচ্ছে। রাজপথ থেকে এবার গেঁয়ো পথ ধরে এগিয়ে চলল কাফেলা। দীর্ঘ কয়েকদিন ভ্রমণের পর কাফেলা এ-ই বাঙ্গালা মুলুকে পৌঁছেছে। সবাই বেশ ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত।
কাফেলার আমির কিছুক্ষণের জন্য চোখ মুদলেন। শরীরে ক্লান্তি ঝেঁকে বসেছে। তাঁর চোখের সামনে অতীতের অনেকগুলো দূশ্য ভাসতে লাগল। একসময় তিনি হাওদার উপরেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
*******
৬৬৮ হিজরি।
দিনটি কী বার ছিল, তাঁর সঠিক মনে নেই। বণিকদের জাহাজে চড়ে তিনি হিন্দুস্তানে আসলেন। জীবনের বড় একটা অংশ মরুর আরবে থাকার কারণে কেমন যেন লাগছিল গাছপালা-শোভিত এই অঞ্চলকে। কিছুক্ষণ পরপরই নদী। কী নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ!
তিনি মূলত মধ্য এশিয়ার বুখারার বাসিন্দা। সেখানেই কেটেছে শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের বড় একটা অংশ। পড়াশোনা শেষ করে এক সময় তাঁর মনে হলো—’আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌছে দাও’—রাসুলের এই হাদিসের কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারলাম। সেই জন্যই দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। শুরু করেন বিরামহীন পথচলা। হিন্দুস্তান এসে একটি মসজিদে আশ্রয় নিলেন প্রথমে। আল্লাহর ধর্মের দাওয়াত শুরু করলেন। সেখানেই যাদেরকে পেতেন এবং যারা চাইত, সবাইকে জ্ঞান দান করতেন। কয়েক বছরেই তাঁর পাঠদানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল রাজধানী দিল্লি ছাড়িয়েও এর আশপাশে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাঁকে ঘিরে মৌমাছির চাক রচনা করল। সপ্তাহে একদিন জনসাধারণকে ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি উপদেশ দিতেন। সেদিন সারা দিল্লি ভেঙে পড়ত তাঁর মহল্লায়। রাজা-রাজপুত্র থেকে নিয়ে ভিখিরি-সর্বহারা–সকলেই ধুলির আসনে সাম্যের জলসায় বসে যেত। রাজাদের ভুল ধরিয়ে দিতেন, করণীয় নির্দেশ করতেন। আমির-নবাবদের ইচ্ছাবিলাসের সমালোচনা করতেন, দেখাতেন সুপথ। কারও ভালোলাগা-মন্দলাগার পরোয়া করতেন না। অথচ তাঁর তখনো কোনো ঘর নেই, নেই বাসভবন। মসজিদেই এতেকাফ করেন বছরভর। বিত্তহীন এই ফকিরের প্রভাব যখন সর্বব্যাপী, এবং তিনি ভারতের শীর্ষ মনীষী হয়ে উঠেছেন, তখনই দিল্লির সালতানাত তাঁকে দিল্লি ত্যাগের আদেশ দিল। সম্ভবত দিল্লির সালতানাত তার জ্ঞানের প্রভাব ও প্রতাপকে ধারণ করতে পারেনি। ভয় পেয়ে যায় তাঁর জনপ্রিয়তাকে। তিনি যদি চান, জনগণকে উস্কে দিয়ে দিল্লির মসনদ উল্টে দিতে পারেন। এই ছিল সালতানাতের ভীতি ও আতংকের কারণ। অথচ দিল্লির স্থায়ী অধিবাসী ছিলেন না তিনি।
এতুটুকু স্মরণ হতেই আমির উদাসীন হয়ে উঠলেন। বিগত আট আটটি বছরের শ্বাস-নিঃশ্বাস মিশে আছে দিল্লির বাতাসে। যেন তাঁর চোখের সামনেই ঘটতে লাগল দিল্লি থেকে বাঙ্গালা মুলুকে ফেরার সময়কার ঘটনাগুলি।
গিয়াসুদ্দিন বলবনের আদেশ পেয়ে বিনা প্রতিবাদে, সন্তুষ্টচিত্তে তিনি বেরিয়ে এলেন। হাজারও জনতা রোদন করে করে আবু তাওয়ামার পেছনে যাত্রা করল। সম্রাট বলবনও ছদ্মবেশে কাফেলার সঙ্গ নিলেন। উত্তেজিত জনতা আবু তাওয়ামার চারপাশে বিদ্যমান, ছদ্মবেশী বলবন তাদের হয়ে কথা বলছেন—’আপনি হুকুম করুন, আজই আমরা বলবনের মসনদে আগুন লাগিয়ে দেব।’
তাঁর কথায় হাজারও জনতা প্রতিধ্বনি তুলল—এটাই হোক! আমরা আপনাকেই ক্ষমতায় বসাব, অথবা আপনি যাকে চান তাকে!’
আবু তাওয়ামা শান্ত, ধীরোদাত্ত। বললেন, ‘থামো! আমি আল্লাহর এক ইচ্ছা থেকে আরেক ইচ্ছার দিকে যাচ্ছি। আমি, আমরা এমন নই, যাদেরকে আঘাত করলে প্রতিশোধ নেয়। ব্যক্তিগত হারানো বলতে আমাদের কোনো হারানো নেই। আমাদের হারানো সেটাই, যেটা হারায় আমাদের জাতি। তোমরা বিদ্রোহ করতে চাও? হ্যাঁ, বিদ্রোহ করো সেই চরিত্রের বিরুদ্ধে, যে চরিত্রের কারণে তোমরা এক তাওয়ামার জন্য এক সাম্রাজ্যকে বিরান করতে চাও। আমার জন্য তোমরা উদ্বিগ্ন হয়ো না। উদ্বিগ্ন হও সেই ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে, যা তোমাদের ও তোমাদের শাসকদের দায়িত্বহীন করে রেখেছে। ক্ষমতা আমরা চাই না। যখন চাইতে থাকব, তখন আমরা আর আমরা থাকব না। ক্ষমতাকে সুপথে চালানোর চেষ্টা আমাদের। দিল্লিতে থাকতে এটা যেমন চলেছে, দূরে গেলেও চলবে। আমি চললাম। তোমরা ফিরে যাও। দিল্লি ও দিল্লির সুলতানের জন্য দুআ থাকবে আমার।’
সম্রাট বলবন ততক্ষণে লজ্জা ও অপরাধবোধে মাটি হয়ে যাচ্ছেন। সাধকের আসল অবয়ব দেখে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নুয়ে পড়লেন। ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করে নিবেদন করলেন, ‘আমিই বলবন, হে মহান! আমি অপরাধী। দিল্লি আপনার, আপনি দিল্লিতে আসুন।’
কিন্তু আবু তাওয়ামা ফিরলেন না। তিনি সম্রাট ও জনতাকে কল্যাণের উপদেশ দিয়ে বিদায় করে দিলেন। মরুভূমি মাড়িয়ে চলতে থাকলেন দূরের দিগন্তে। উদ্দেশ্য ঢাকার নিকটবর্তী সোনারগাঁ।
********
কাফেলা থেমে গেল। সবাই নামতে শুরু করেছে।
আমির আগে নামলেন। শহর থেকে অনেকটা পিছনে একটা চমৎকার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পরিচয় দিতেই দারোয়ান সসম্মানে গেইট খুলে দিয়েছে। সবাইকে খোশ আমদেদ জানাচ্ছে। বাড়ির গঠন-সৌষ্ঠব থেকে গৃহকর্তার রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। মোটামুটি বড় জায়গা নিয়েই বাড়িটা। গাছপালা ভরা। দুটি মাত্র ঘর। একটি বড় দালান। আরেকটি খুপড়ি। বাম পাশে আস্তাবল। আমিরের সবচেয়ে ভালো লাগল—বাড়ির পাশেই বইছে কুলকুল নদী।
‘শরফুদ্দিন!’
আমির কয়েকবার এই নামটি ধরে ডাকলেন। কিছুক্ষণ পরই বুদ্ধিদ্বীপ্ত চেহারার এক কিশোরকে আসতে দেখা গেল। সপরিবারে দিল্লি থেকে সোনারগাঁ আসার পথে বিহারের মানের নামক স্থানে রাত্রি যাপন করেছিলেন শরফুদ্দিন ইবনু ইয়াহইয়া মানেরিদের বাসায়। কিশোর শরফুদ্দিন মেহমানের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হলেন। মেহমানও কিশোরের মধ্যে দেখলেন ভুবন-জাগানো আলো। ভবিষ্যতের বিপুল ঐশ্বর্য। কিশোরের বাবা ইয়াহইয়া মানেরিও ছিলেন সমকালের দেশখ্যাত মনীষী আলেম।
কিশোর মহান মেহমানের সঙ্গী হতে চাইলেন। তাঁর মা-বাবাও রাজি হলেন। মহান মেহমান অসম্মত নন, এতে বরং খুশি। কারণ মেহমান এই কিশোরের মাঝে এক উজ্জ্বল প্রতিভা দেখতে পেয়েছিলেন।
এরপরের ঘটনা এক ইতিহাস। গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায় সৃষ্টি করলেন মধ্য এশিয়ার এই আলেম শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা বুখারি আদ-দেহলবি আল-হানাফি রহমতুল্লাহি আলায়হি।
শুধু শরফুদ্দিন ইবনু ইয়াহইয়া মানেরিকে দিয়ে শুরু হলো আবু তাওয়ামার বিশ্ববিদ্যালয়। উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো শুরু হলো রাসুলের হাদিসচর্চা। ধ্বনিত হলো ‘ক্বালা রাসুলুল্লাহ’র সুর।
সেখানে এক সময় এসে ভিড় করতে শুরু করল বিহার, দাক্ষিণাত্য, খোরাসান, কান্দাহার, বুখারা এমনকি সিরিয়া-ইয়েমেনের জ্ঞানপিপাসুরাও। ক্রমে ক্রমে ছাত্রসংখ্যা দশহাজারের কোটা ছাড়িয়ে গেল।
ক্রমশ সোনারগাঁয়ের বিশ্ববিদ্যালয় বিখ্যাত হয়ে উঠল হাদিস, তাসাউফ, লজিক ও নৌবিদ্যার জন্য। সোনারগাঁয়ের এ জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষাগতমান ও মর্যাদা তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের তথা ইরাকের বাগদাদ, মিশরের আল-আজহার, মরক্কোর ফেজ, মালির তিম্বুকতু এবং স্পেনের সেভিল, কর্ডোভা ও গ্রানাডা মাদরাসার সমপর্যায়ের হয়ে ওঠে।
মুসাফির! বেলা কম রাহা দূর
জানালার কাচে বাড়ি খেয়ে তন্দ্রা টুটে গেল। বাস আপন গতিতে চলছে। দুপাশে সরে যাচ্ছে গ্রামের সবুজ মাঠ আর ভেসে থাকা কুয়াশারা। জানালার কাচ গলে বিকেলের সূর্যটা বাসের ভেতর ঢুকতে চাচ্ছে। দিন ফুরিয়ে আসছে। পাখিরা নীড়ে ফিরছে দলবেঁধে।
ভাবতে ভাবতে কখন যে আবু তাওয়ামার যুগে চলে গিয়েছিলাম, টেরও পাইনি। আমরা যাচ্ছি বাংলাদেশের হাদিসের সর্বপ্রথম দরসগাহে। যেটা সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়ায় অবস্থিত। সাথে আছে মানব-সভ্যতার উন্নতির স্বর্ণযুগে বসবাসকারী তৃতীয় বিশ্বের তিনজন বাসিন্দা—দুজন ক্লাসমেট; আরেকজন অচেনা। সহপাঠি মাহদির বন্ধু। হাসিখুশি ছেলেটার নাম মাসুদ। ও স্থানীয়। রাত্রের থাকা-খাওয়া ওর বাড়িতেই হবে। সাথে গাইডও করবে আমাদের। মাহদি নামের বাচ্চা ছেলেটা নিয়ে আমার কথা কম। এক ধ্যানে বেচারা ফোনে ডুবে আছে। বাকি রইল আরেকজন—আমার পাশের সিটে বসা। এই ছেলের নাম অনেকগুলো। একটা ঠিক করি—নাসির মাহমুদ। আমরা এক জেলার লোক। কিশোরগঞ্জ। ছেলেটার গুণাগুণও বেশ। যদিও ডিস্টার্বমার্কা কিছু কাজ সেই প্রতিনিয়ত করে। তবে লোক ভালো।
মোটামুটি বুঝ হওয়ার পরে থেকেই এই জায়গার নামটা শুনে আসছিলাম। যাওয়ার একটা অন্তর্নিহিত ইচ্ছে ছিল। যাব যাব করে পরিকল্পনা পাকাচ্ছিলাম বছর দুয়েক আগে থেকেই, কিন্তু ভাগ্য আর সহায় হচ্ছিল না।
মোগরাপাড়াতে গিয়ে বাস থামল।
শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামাহ’র মাজারে যেতে অটো ঠিক করলাম। তাও অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে। একটা রিশকাচালকও জায়গাটা ঠিক মতো চেনে না। হায়, আমাদের ঐতিহ্য!
অটো চলতে লাগল শায়খ শরফুদ্দিনন আবু তাওয়ামা যে জায়গাটায় শিক্ষার আলো জ্বেলেছিলেন সে দিকে। কানে শীত লাগছে। ঢাকায় থেকে শীতের এত তীব্রতা বুঝতে পারিনি।
অনেকটা দ্রুত পৌঁছে গেলাম।
জায়গা বেশ জমিয়ে ফেলেছে তথাকথিত সাধুরা। লাল পতাকা টাঙানো আছে কয়েকটা। কয়েকজন জটচুলওয়ালা বসেছিলেন। আমাদের দেখে তেমন গা করলেন না। মাজারের সাথে লাগোয়া মসজিদ। দ্রুত ওজু সেরে আসরের নামাজ আদায় করলাম। বাইরে এসে একজনের সাথে কথা হলো। তিনি ইশারায় একটি কবরস্থান দেখিয়ে দিলেন। বেশ জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থা। পাশাপাশি ছয়টি কবর, পঞ্চম কবরটি সবুজ রঙের। কথিত খাদেম জানালেন, এটিই নাকি শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার কবর। ছোট ফলকে দেখলাম লেখাও আছে—‘শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামাহ।’ আরও কয়েকটি কবর দেখলাম পাশেই।
এ জায়গাতে যে ইতিহাস-বিখ্যাত সব ব্যাক্তি শুয়ে আছেন তা বলাই বাহুল্য। এ সব ইতিহাস আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রথী-মহারথীদের অজানা বা জানার আগ্রহ নাই। তাই তাদের চোখে শুধু পানাম নামটিই বড় হয়ে ধরা দেয়।
নাসির একটু প্রতিবাদী হয়ে উঠল জায়গাটার প্রতি এই অবহেলা দেখে।
কয়েকযুগ আগে তো এইগুলোর অস্তিত্বও ছিল না। বাবু বুদ্ধিজীবীদের কল্যাণে বাঙালি মুসলমানেরা আবু তাওয়ামার নাম ভুলে গেলেও মাত্র কয়েক বছর আগে ১৯৮০ সাল দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক (মরহুম) আখতার উল আলম বাগদাদের গ্রন্থাগারে শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামার লিখিত পাণ্ডলিপিটি দেখতে পান। সেটা তার বাগদাদ সফরের সময়।
শরফউদ্দিন আবু তাওয়ামা কর্তৃক সহিহ বুখারির হাদিসমালা গ্রন্থের ওপর রচিত ভাষ্য গ্রন্থখানির একটি পাণ্ডুলিপি বাগদাদের গ্রন্থাগারে এখনো সযত্নে রক্ষিত আছে।
দেশে ফিরে তিনি উতলা হয়ে উঠলেন। সাথে সাথে খোঁজ নিলেন। একদিন ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলায়হি কে সঙ্গে নিয়ে আখতার-উল-আলম সোনারগাঁয়ের এক অবহেলিত পল্লিতে লতাগুল্মের জঙ্গল সাফ করে শেখ আবু তাওয়ামার কবর জিয়ারত করেন। অনেক কষ্টে উদ্ধার করেন বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ১৯০৪ সালের সংরক্ষণ ফলক সম্বলিত সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ ও তাঁর কিংবদন্তী খ্যাত বিচারক কাজি সিরাজের সমাধি।
আমার সফরসাথিরা আমার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সম্ভবত তারা এসব কাহিনি বিশ্বাস করতে পারছে না।
এবার হাদিসের দরসগাহ খুঁজতে গিয়ে বেগ পেতে হলো। স্থানীয়রা এটাকে অন্য নামে চেনে। যাইহোক, একসময় পথ পেলাম। এবং যখন এক পথচারী বলল ‘আপনারা আন্দরকোঠা যাবেন?’ আমার ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। যেটি ছিল একসময় আলোর প্রকোষ্ঠ, তার নাম আমরা রেখেছি ‘আন্ধারকোঠা’!
আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি আন্ধারকোঠা নামক প্রায় বিধ্বস্ত এক ক্ষুদ্র দালানের কাছে। বিশ ফুট বাই দশ ফিটের মতো একটি কক্ষ। দেয়ালের চারধার জুড়েই রয়েছে তাক। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কক্ষটি ছিল শিক্ষার কমনরুম। তাকগুলোতে থাকত মূল্যবান কিতাবাদি। নিচের দিকে আরও একটি কক্ষ। সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। ভেতরে অন্ধকার। আমাদের দেখে একজন লোক আসলেন। তাঁর বাড়ি এখানেই, শুনলাম তিনিই এসব দেখাশোনা করেন। তিনি বললেন, প্রয়োজন না থাকলে নিচে না নামতে। ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে ঢুকলাম। বেচারা মাহদি ভয় পাচ্ছিল। যদি সাপ-টাপ থাকে। এই নির্জন কুঠুরিতেই নাকি আবু তাওয়ামা ইবাদত করতেন। আমার ভেতরটা তখন কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেল। বুক চিরে বেড়িয়ে এলো এক শীতল দীর্ঘশ্বাস।
আগাছায় ভরে গেছে দালানটি। দেয়ালের রং বদলে কালো হয়ে গেছে। দেয়ালের বিভিন্ন জায়গা ভেঙে পড়েছে। অনুমান হয় এটি দ্বিতল কোনো দালান, অযত্ন অবহেলায় এর এমন দশা। আফসোসের ব্যাপার হলো—প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে দর্শনার্থীদের জন্য কোনো দিকনির্দেশনা তো দূরে থাক, কোনো সাইনবোর্ডও নাই। এই স্মৃতিচিহ্নটি টিকিয়ে রাখার ব্যাপারেও তারা উদাসীন।
ধারণা করা হয়, এর আশপাশেই ছিল শায়খ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বহু দূরদেশ থেকে আসত শিক্ষানুরাগীরা। তাঁর সে বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো চিহ্ন আর অবশিষ্ট নাই মুগড়াপাড়ায়।
আমি মনে মনে ভাবলাম, হায়! আমাদের ঐতিহ্য আর কত লুণ্ঠিত হবে। আন্দালুসিয়ার পতন, বাগদাদের বিশাল লাইব্রেরির ধ্বংস, উসমানি খেলাফতের বিলুপ্তি! এসব পরাজয়ের ইতিহাস ছেড়াছেড়াভাবে আমার সামনে ভাসতে থাকে ।
আন্ধারকোঠার অল্প দূরত্বেই আরও কিছু স্মৃতিচিহ্ন। একটি ভাঙা ফটক দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। বুকের হাড়গুড় বেরিয়ে আছে। ইটের ফাঁকফোকড়ে গজিয়ে আছে নানা ধরনের আগাছা। নিকটেই বসা ছিলেন খাদেম পরিচয়ে একজন। এমন আরো সাতটি ফটক ছিল। জানালেন তিনি। কিন্তু এটি তথ্যের বাইরে। মূলত ফটক একটি ছিল। ‘রোমান্স অব এন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল’ নামক বইয়ে এ ফটকটির কথা উল্লেখ আছে। লেখক ফটকটির বিধ্বস্ত দশাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর বইটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯০৬ সালে। একশ বছরের বেশি সময় পরেও আমরা এটির ধ্বংসাবশেষে দেখতে পাচ্ছি। মুগড়াপাড়ার দমদমা নামক স্থানটিতেই নাকি সুলতানদের রাজপ্রাসাদসহ অন্যান্য স্থাপনা। সুলতান এবং রাজ-রাজড়াদের আনন্দ-উল্লাসে মুখরিত ছিল যে মুগড়াপাড়া এলাকা, এখন কান পাতলেই সে মাটি থেকে উঠে আসে ক্রন্দনধ্বনি।
সময় ফুরিয়ে আসে। সব পাখির নীড়ে ফেরা হয়ে যায়। গ্রামের শীত ক্রমশ জেঁকে বসতে শুরু করে। আমাদের ফিরতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর। একসময় ফিরতে হয়। চারিদিকে প্রায় আঁধার। আমরা অটোতে উঠে বসি। শো শো আওয়াজে চলতে থাকে। রাতের নৈঃশব্দ ভেঙে দেয় অটোর কর্কশ হর্ন। একসময় আমাদের গাড়ি মেঘনার পাশ দিয়ে চলতে শুরু করে। আমার মনে হয়, এই তো সোনারগাঁওয়ের পথ, সোনারগাঁওয়ের নদী, যেসব পথ আর নদীতে বীরদর্পে চলাচল করেছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা, শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা’র মতো জগদ্বিখ্যাত মনীষারা। আজ আমাদের সেই সৌর্য এবং প্রতাপ কোথায় হারিয়ে গেল! সে সময় চোখের পাতা ভিজে উঠলেও কারও দেখার সুযোগ নেই।
আমি মনে মনে মুন্সী মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহর কবিতার দুটো লাইন আবৃত্তি করি—
‘ভাবো মন দমে দম
রাহা দূর বেলা কম’
সূত্র : শতাব্দীর চিঠি, মুসা আল হাফিজ; ইতিহাসের অন্তরালে, ফারুক মাহমুদ; রোমান্স অব এন ইস্টার্ন ক্যাপিটাল, ব্রা ডলে বার্ড
শিক্ষার্থী, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, সাত মসজিদ, মুহাম্মদপুর, ঢাকা
নভেম্বর, ২০২০