এক.
মাথায় অসহনীয় ব্যথা। রাতের প্রথম প্রহরে শুরু হয়েছিল। এখনও কমেনি। সূর্য উঁকিবুকি মারছে পুবাকাশে। সারারাত কেঁদে কেঁদেই পার করেছে রিতা। মনে মনে আল্লাহকে বলেছে, ‘আল্লাহ! আমি কী এমন মহাপাপ করলাম, তিনি বাঘের মতো আমার ওপর হামলে পড়লেন! চুল ধরে অমন মারপিট করলেন! আমি তো কেবল রাহিবের কথা বিচার দিয়েছিলাম ‘আন্টি, আপনার ছল আমাকে…।’’
দুই.
‘এই মেয়ে এদিকে আসো তো। ঘর মোছার পর এ কাপড়গুলো ধোবে। যাও চট কর চা বানিয়ে নিয়ে আসো; অফিসের সময় হয়ে গেছে।’ রসহীন ভাষায় দাঁড়ি-কমা ছাড়াই গড়গড়িয়ে কথাগুলো বললেন লাভলি চৌধুরী। রিতা চা নিয়ে আসে। ভয় আর তাড়াহুড়ায় চা পড়ে যায় তার হাতে। তীব্র গরম চা। সঙ্গে সঙ্গে হাত ফসকে ভেঙে যায় কাপ।
‘এই অলক্ষীর বাচ্চা, এটা কী করলি! তোর চৌদ্দগোষ্ঠীরে বিকি দিলেও কি এই কাপের দাম উঠবে?’
জবাবে কাঠ হয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে রিতা। ভয়ে পোড়া হাতটাও নাড়াচ্ছে না। কী জানি গতরাতের মতো আবারও হামলে পড়েন যদি!
‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি পরিস্কার কর। জানি না আজ সারাদিন কেমন কাটবে। সাতসকালেই কুলক্ষণ।’
সাপের মতো ফনা তুলে কথাগুলো বলতে বলতে বেরিয়ে যান চৌধুরী লাভলি। রিতা মনে মনে ভাগ্যর ওপর ক্রোধ ঝাড়ে। পৃথিবীক গালি দেয়, ‘টুইনটাওয়ারে ধ্বস দাও। টাইটানিক গিলে খাও। সুরমায় ভাসিয়ে নেও মানুষের পাপে মরা মানুষ। চোখে পড়ে না শুধু এই আমাকে?’
ব্যালকনিতে গড়িয়ে পড়া নিস্তেজ সূর্যের আলোয় দাঁড়িয়ে জীবনের ওপর তিক্ততার বিস্বাদ ঢালে সে। আশপাশের ছাদে সমবয়সী মেয়েদের লুটোপুটি আর সেল্ফিবাজি দেখে লাফ দিয়ে সেখানে চলে যাবার ইচ্ছে করে তার। দু’তলা থেকে পা বাড়ায় ছাদের দিকে। ছাদে উঠে এপাশ-ওপাশ গর্দনা ফেরায়। নিচে তাকাতেই দৃষ্টি বিঁধে কলোনির ছেলেগুলার ওপর। ওরা ক্রিকেট খলছে। চোখেমুখে লেপ্টে আছে সাকিবীয় স্বপ্ন। ওদের দেখে মনে পড়ে ফয়েজের কথা। ছোটভাই ফয়েজের ভালোবাসা রিতার আত্মহত্যার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তার চোখে ভেসে ওঠে ফুটবল কেনার জন্য ছোট্ট ফয়েজের কান্নামাখা সেই নি®পাপ করুণ চেহারা। বাড়ি বাড়ি মায়ের দিনরাত কাপড় কাচা আর মরিচ পেষার নির্মম চিত্র। কষ্টের বিনিময়ে সুন্দর একটা পৃথিবীর স্বপ্ন আঁকে রিতা। অঙ্কিত পৃথিবীতে ক্রিকেট-অলরাউন্ডার থাকে তার ভাই ফয়েজ। স্বপ্নপৃথিবীর কথা ভাবতে ভাবতে ছাদ থেকে নেমে আসে সে।
তিন.
‘কী রে, বিচার দিয়ে লাভ হলো তো? রিতার দিকে ব্যঙ্গাত্মক প্রশ্ন ছোঁড়ে রাহিব। আজ রাত আম্মু বাসায় আসবে না। অফিস থেক সোজা চল যাবে খালার বাসায়। থিউলিপের জন্মদিন আজ…। রাহিবের কথার সুরে ঘৃণ্য অশ্লীলতা। ঠোঁটের কোণে লালসার রেখা টেনে রিতাকে রাতলিপি বুঝিয় দিচ্ছে। রিতা স্টিল হয় সব শুনে যাচ্ছে। তার ভেতর ফুঁসে উঠছে ক্রোধের রাক্ষুসে সরীসৃপ। ইচ্ছে করছে রান্নাঘর থেকে দা এনে বদমাশটাক ওপারে পাঠিয়ে দিতে। আরেকটু বড় হলে রিতা অবশ্যই তাকে আসল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিত। কলেজপড়ুয়া গুÐা। তেরো বছরের রিতার পক্ষে ওর সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল। চোখ বুঁজে সব সয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।
সহসা রাহিবের ফোন বেজে ওঠে। ‘আচ্ছা যাই। রাতে কিন্তু…’ কথা অসমাপ্ত রেখেই সে ফোন কানে তুলে নেয়। কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে চলে যায় নিজের ঘরে।
চার.
‘আরে না। তোর মেয়ে তো আমার মেয়েই। আমার মেয়ে নেই বলেই তো ওকে আনলাম। আমি কি রিতাকে কাজের মেয়ে হিসেবে এনেছি নাকি যে, মানুষের মতো যেভাবে মনচায় খাটাব? তুই তো আমার সিঙ্গল পরিবার দেখেই গেছিস। কামকাজ বলতে কিছু নই। রান্নাবান্না তো সব আমিই করি। আর শোন, ও গ্রামের মেয়ে। শহরে প্রথম এসেছে তো, বাসাবাড়িতে তাই প্রথম প্রথম ওর মন বসবে না। কিছু দিন গেলে সব ঠিক হয় যাবে। ও বাড়ি যেতে বানিয়ে বানিয়ে তোর কাছে কিছু বলতে পারে। তুই ওসবে কান দিবি না।’
রিতার মায়ের সঙ্গে ফোন কথা বলছিলেন লাভলি চৌধুরী। পাশের রুমে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে রিতা। মাথায় ভেঙ্গে পড়ে খুঁটিহীন বিশাল আকাশ। সে ভেবেছিল সুযোগ পেলে মায়ের কাছে দূরাত্মীয়া খালা নামক এই কালনাগিনীর হিস্টোরিটা বয়ান করবে। এখন কি আর তার মা ওসব বিশ্বাস করবে? কঠিন এই প্রশ্নে রিতার দৃষ্টিসীমায় ঝেঁকে বসে ছিদ্রহীন অন্ধকার। সূর্যদীপ্ত পৃথিবীকে তার কাছে মনে হয় আন্দামানদ্বীপ।
আগস্ট ২০১৮